মুনির হাসানের লেখা গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং বইটা পড়া সমাপ্ত করলাম আজ। সেগুন বাগিচা বারডেম হাসপাতাল এবং উবার রাইড জার্নি, দুই জায়গায় অবস্থানের ব্যয়িত সময় যোগ করলে বইটা পড়তে মোট সময় ব্যয় হয়েছে ৭৪ মিনিট। ক্রমাগত লাইন বাই লাইন পড়া আমার অভ্যাস নয়, আমি পড়ি আর নিজের কল্পনায় সেটা রিপ্রোডিউস করি; ফলে প্রতিটি বই শেষ হবার সাথে সাথে সমগ্র বইটা আমি লিখেও ফেলি, যা মূল বইয়ের থেকে পুরো আলাদা।
আম্মুর চেক আপ করাতে পৌনে বারোটার দিকে গিয়েছিলাম সেগুন বাগিচা বারডেমে; গিয়ে শুনি আমার জানায় ভুল ছিল, ডাক্তার বসবে আড়াইটায়। এই বিপুল সময় খরচার খাতায় না দিতে রকমারি ডট কমে ফোন করে মুনির হাসানের বইটা চাই; দেড়টার দিকে বই চলে আসে হাসপাতাল গেটে; ফিরি উবারে চড়ে; উবার থেকে নামার পূর্বেই বই পড়া সমাপ্ত! এই যে ঘোরাঘুরি বা অন্য কোনো উপায়ে আড়াই ঘণ্টা খরচ না করে বই পড়ে সময় খরচ করার চিন্তা করলাম, এবং সফলভাবে চিন্তার এক্সিকিউশন হলো- একে নির্দ্বিধায় গ্রোথ হ্যাকিং বলতে পারেন, যদি আক্ষরিক সংজ্ঞা মুখস্থ না করে কনসেপ্টকে ইন্টারপ্রেট করায় আগ্রহ থাকে।
মুনির হাসানের পড়ো পড়ো পড়ো বইটা পড়ে রিভিউ লিখেছিলাম গত বছর; পরবর্তীতে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো ২ বার, সর্বমোট ৭টা ছোট ছোট বাক্য বিনিময় হয়েছে ২ সাক্ষাৎ মিলিয়ে। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, তিনি একজন চরম এবং বিরলমাত্রার একশন বেইসড মানুষ; সে তুলনায় থিংকিং ডমিনেন্স তার কম। এমনটাই হয়ে থাকে সাধারণত; থিংকিং বেইসড মানুষড একশনে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, একশন বেইসড মানুষ থিংকিংয়ে পারঙ্গম হয় কম। একই মানুষ একাধারে অসাধারণ লেখক এবং অসাধারণ বক্তা কিংবা সংগঠক, এই কম্বিনেশন পৃথিবীর ইতিহাসেই দুর্লভপ্রায়। কোনো একটাতে তাকে এভারেজ হতেই হয়। ২ বারের স্বল্প পর্যবেক্ষণ থেকে আমার ধারণা মুনির হাসানের পারসোনালিটি প্রোফাইল ESTP অথবা ENFJ ; ফলে আমি তার লেখা বই থেকে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প খোঁজার নিমিত্তে তার বই সংগ্রহ করি, কনটেন্ট মেরিটকে রাখি থার্ড বা ফোর্থ অপশন হিসেবে, ক্ষেত্রবিশেষে সেটা অপশনালেরও অপশনাল।
গণিত অলিম্পিয়াডের ইমপ্যাক্টকে আমি কীভাবে দেখি? উত্তর বলবো না, তবে গড়পড়তার চাইতে তুলনামূলক বেশি মেধার বাচ্চাদের মধ্যে যে নিজেদের লিমিট ভাঙ্গার সাহস তৈরি হচ্ছে, এজন্য এই উদ্যোগটাকে আমি ব্র্যাকেটের বাইরে রাখি। যে কোনো উদ্যোগকে নষ্ট করে, প্রশ্নবিদ্ধ করে এভারেজ এবং বিলো এভারেজ মেধার মানুষেরা; এরাই যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে উদ্যোগের সাথে গ্ল্যামার লাগে। গ্ল্যামার ছাড়া উল্লিখিত শ্রেণিতে কোনোকিছু টিকতে পারে না, এবং মজার বিষয় হলো, সেই গ্ল্যামারের সুফল ভোগ করা তাদের যোগ্যতায় কুলোয় কম, গ্ল্যামারের ফসল ঘরে তোলে অন্যরা। তবু কেবলমাত্র সংখ্যার জোরে তাদের কাছেই থাকে কোনো কিছুকে টিকিয়ে রাখবার কিংবা সম্প্রসারিত হওয়ার লাইসেন্স প্রদানের অধিকার।
বুয়েটে পড়াকালে একদিন প্রথম আলোতে আই-ক্যাচি এক শিরোনাম চোখে পড়ে- ‘চাকরি করবো না, চাকরি দেবো’। কাছেপিঠে সময়ে মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘এমএলএ ফাটাকেষ্ট’ সিনেমার বিভিন্ন সংলাপ নিয়ে খুব ট্রল চলছিলো। তার একটা ছিলো- ফাটাকেষ্ট খবর পড়ে না, খবর দেখে না, খবর তৈরি করে’। শিরোনামটা দেখার পর সর্বপ্রথম ওরকম কোরিলেশনই মাথায় এসেছিলো। কিন্তু আর্টিকেলটা পড়ার পর ভাবনায় পরিবর্তন আসে; বুঝ দিই- মেধাবী ছেলেপেলেও যদি চাকরি করে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে কারা। ম্যাথ অলিম্পিয়াড এবং চাকরি করবো না, চাকরি দেবো- বহু উদ্যোগের মধ্যে কেবলমাত্র এ দুটোর কারণে হলেও মুনির হাসানের উদ্যমপ্রিয়তাকে বুঝতে চাওয়াটা যথার্থ, এবং মজার বিষয় হলো- এদুটোকেও হেসেখেলে গ্রোথ হ্যাকিং বলতে পারেন আপনি।
আমার জীবিকার মাধ্যম কী? ধরাবাঁধা জীবিকা নেই; ২৫ বছর ধরে মানবগবেষণাতে সময় দিই, তার প্রেক্ষিতে পাওয়া পর্যবেক্ষণ, অনুসিদ্ধান্ত এবং নতুন এক্সপেরিমেন্ট চেষ্টা করা- এই প্রবণতাগুলো অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান (যাকে সবার মতো আমিও সোহাগ ভাই নামে সম্বোধন করি এবং বড় আপার পর আমার জীবনের সবচাইতে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মানুষ) খুবই এপ্রিশিয়েট করেন, সেগুলোর কিছু কিছু তার কোম্পানীতে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন, বিনিময়ে আমি আর্থিক নিশ্চয়তা পাই। সে হিসেবে আমাকে একজন ইনডিপেনডেন্ট ক্যারিয়ারিস্ট বলা যায় যে ট্যালেন্ট নারচারিং, প্রসেস ডিজাইন, ডাটা ড্রাইভেন এনালাইসিস, ইনসাইট, ফোরসাইট এবং আনঅর্থোডক্স বিজনেস এপ্রোচ নিয়ে কাজ করতে চায়। আমার কাজগুলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে একে খুবই আনইউজুয়াল গ্রোথ হ্যাকিং বলা যায়। ২০১৭ সালের পুরোটা সোহাগ ভাই যে কনসেপ্ট নিয়ে সবচাইতে অবসেসড ছিলেন তার নাম গ্রোথ হ্যাকিং। তার কোম্পানীর মার্কেটিং টিম নিয়ে বছরজুড়ে তিনি ওয়ার্কশপ চালিয়েছেন রীতিমতো। গ্রোথ হ্যাকিং শব্দটাও প্রথম তার মুখ থেকেই শোনা। বুকিশ কথা-বার্তা আমি কখনোই ফর গ্রান্টেড মানি না, সেটা যে-ই বলে থাকুক; আমি সবকিছুকে নিজের ভাবনায় ইন্টারপ্রেট করে নিই; যে কারণে কয়েকটা ওয়ার্কশপে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত হয়ে গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং ব্যাপারটাকে আমি ইন্টারপ্রেট করি এভাবে- যেখানে টাকার খরচ কম, কিন্তু বুদ্ধির খরচ অনেক বেশি, সকল কার্যক্রমের একটা কনভারসন টার্গেট থাকবে, এবং সবকিছুকে ডাটা হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। যার মর্মার্থ হলো- ইফিশিয়েন্সি বাড়াতে হবে, যার লিমিট আকাশপানে। ইফিশিয়েন্সি বাড়াতে হবে এটাই যদি মূল কথা হয়, তাহলে গ্রোথ হ্যাকিংয়ের শেষে মার্কেটিং শব্দটা জুড়ে দিয়ে এর ইফিশিয়েন্সি কমানো কেন? এবং কেবলমাত্র মানি মেকিং এক্টিভিটিতেই গ্রোথ হ্যাকিং সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? একজন লেখক দিনে ৫ পৃষ্ঠা লিখতে পারেন, কিন্তু সুনির্দষ্ট কিছু কৌশল অবলম্বন করে তিনি ৬ পৃষ্ঠাতে উঠলেন; একজন এইচআরকে জব ইন্টারভিউতে প্রতিনিয়ত কমন কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়; সে ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোয়েইশ্চনের একটা ডকুমেন্ট তৈরি করে ক্যান্ডিডেটদের আগেই সরবরাহ করলো; ইফিশিয়েন্সি বেড়ে গেলো। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই গ্রোথ হ্যাকিং পলিসি প্রয়োগ করা সম্ভব।
এই সরল ইন্টারপ্রেটেশনের পর গ্রোথ হ্যাকিংয়ের মতো ভারি শব্দকে আমি বাংলা একটি শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করি; শব্দটা – চিপাবুদ্ধি। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে চিপাবুদ্ধি শব্দটা নেগেটিভ ইনটোনেশন এটা যখন মাথায় আসে তৎক্ষণাও এমন প্রশ্নও চলে আসে- হ্যাকিং শব্দটা কি বাঙালি গণমানসে পজিটিভ? হ্যাকিং মানেই আমরা ধরে নিই হ্যাকার, যারা সাইবার ক্রিমিনাল, এবং পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। গ্রোথ হ্যাকিং শব্দটা কখনো শোনেনি এমন ৫ জন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করি, গ্রোথ হ্যাকিং শুনলে মাথায় কিসের ইমেজ আসে? প্রত্যেকেই বলেছে হ্যাকারদের কোনো এক্টিভিটি, মানে নেগেটিভ কিছু। ফলে সার্বিক চিন্তা শেষে আমি শব্দবন্ধটাকে রিডিফাইন করি- গ্রোথ থিংকিং হিসেবে।; একদম ষ্পষ্ট এবং শোনামাত্রই বোঝা যায় এর মধ্যে গ্রোথ সংক্রান্ত ব্যাপার-স্যাপার আছে; ফলে ব্যবসামনস্ক মানুষকে আকর্ষণ করা সহজ হতে পারে। এটা ভেবে মনে হয়, গ্রোথ হ্যাকিং টার্মটারই একটা হ্যাক বানিয়ে ফেলেছি।
যেহেতু গ্রোথ হ্যাকিং এনভায়রনমেন্টেই আছি সর্বশেষ ১৫ মাস যাবৎ, এবং নিজস্ব ইন্টারপ্রেটেশন তৈরি করে নিয়েছি,. মুনির হাসানের এই বই পড়ার বিশেষ কোনো কারণ থাকতে পারে না আমার। কিন্তু পড়তে চেয়েছি মূলত ২টা কারণে। প্রথমত, বইটার লেখকের নাম মুনির হাসান যিনি চাকরি করবো না, চাকরি দেবো শ্লোগানটাকে একটা থিমে রূপান্তর করতে অনেকখানি সমর্থ হয়েছেন। তাকে আমি দেখি একজন চেঞ্জমেকার, ট্রেন্ডসেটার কিংবা ইনিশিয়েটর হিসেবে। তার নেটওয়ার্কে যেহেতু প্রচুরসংখ্যক তরুণ উদ্যোক্তা যুক্ত, এই বইটির মাধ্যমে তিনি অন্তত মেসেটা দিতে পেরেছেন যে, গতানুগতিক চিন্তার ভাত নাই, বিজনেস করতে হলে ঘিলু খাটাতে হবে, নইলে শখ মিটে যাবে কয়েকদিন পরই। আম, ছালা তো যাবেই ঘটি, বাটিও চলে যেতে পারে। তিনি বলতে চেয়েছেন গতানুগতিকতা ছাড়ো, কীভাবে ছাড়তে পারো তার কিছু নমুনা দিলাম; এইবার নিজের ভার নিজেই বহন করো। অপরের কাঁধে চড়ে সমুদ্র জয় তো বহুদূর, একটা খালও পার হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং বিজনেস জগতকে জানতে হবে, এই বোধটুকু আমি তোমাকে দিলাম, আমার সময় থেকে কিছু সময় বাঁচিয়ে তোমার জন্য কিছু রসদেরও ঠিকানা দিলাম। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়, তোমাকে আরও শিখতে হবে। কেউ শিখে বই পড়ে, কেউ মানুষের মুখে গল্প শুনে, কেউবা ভিডিও দেখে; মাধ্যম যেটাই হোক, শেখার প্রবণতা ছাড়া তুমি একটা নিভে যাওয়া হারিকেন।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বিজনেস আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের একটা প্যারাডাইম শিফটিং প্রয়োজন। ট্যালেন্ট, লিডারশিপ, থিংকিং এবং ইমাজিনেশন প্রয়োগের সর্বোচ্চ সেক্টর হলো বিজনেস। কিন্তু আমাদের জনপদে বিজনেস একটি নেগেটিভ শব্দ। আমাদের সিনেমায় বিজনেসম্যান মানে স্মাগলার। কিংবা বাস্তবেও বড় বিজনেস বলতে আমরা যাদের কথা জানি বা শুনি, সেগুলো চলে ব্যাংক ঋণে, কিংবা প্রায়ই বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে খবরের শিরোনাম আসে। পেপার, টেলিভিশন চলে কর্পোরেট হাউজের মুখপাত্র হিসেবে। পেপারভর্তি বিজ্ঞাপন, টিভিতে বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড বিজ্ঞাপন, রিয়েলিটি শো- থলেভর্তি টাকা দিয়ে নায়ক-নায়িকা, ক্রিকেটারদের মডেল বানিয়ে সমুদ্রসম টাকা খরচ করার মধ্যে কৃতিত্ব কী? এবং তরুণ যারা উদ্যোক্তা হতে চাইবে তারা তো ধরেই নিবে মার্কেটিং মানে ওরকম কিছু, তার ওপর ট্রেডিশনাল মার্কেটিংয়ের যেসব বই আছে সেগুলোতে লেখা থিওরির চর্চা করলে সর্বনাশ আরো বাড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সর্বত্র ইফিশিয়েন্সিহীনতা। চাকরির ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে আমি ৬১ জনের বেশি প্রার্থীকে জিজ্ঞেস করেছি, এতো পড়াশোনা করে ১৫-২০ হাজার টাকার চাকরি করার কী দরকার; নিজেই কিছু শুরু করেন না কেন? প্রত্যেকেই উত্তর দিয়েছে- বিজনেস করার টাকা থাকলে কি চাকরি খুঁজতে আসি! তার মানে বিজনেস মানেই বিশাল অংকের পুঁজি লাগবেই। আমি যখন বলি, হ্যাঁ প্রারম্ভিক কিছু পাঁজি লাগে সত্যি, কিন্তু আজ যদি কেউ বলে আমাকে ১৫ লাখ টাকা দাও, সরকারি চাকরি নাও, আপনি হয়তো একসেপ্ট করবেন, এবং মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিগুলো কীভাবে কীভাবে যেন টাকাটা ম্যানেজও করে ফেলে। বিজনেস শুরু করতে তো এর চাইতে অনেক কম টাকা লাগবে; টাকার চাইতেও অনেক বেশি লাগবে বুদ্ধি, এটা টাকার অভাব পুষিয়ে দেবে। একজনও আমার কথায় কনভিন্সড হয়নি, বরং ১২ জন বলেছে, ‘চাকরি দেবেন না সোজাসুজি বললেই তো পারেন, এভাবে অপমান করার দরকার কী’! মানসিক এই জরাগ্রস্ততা তখনই বদলাবে যখন মেধাবী মানুষেরা বিজনেসের সাথে যুক্ত হতে শুরু করবে। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশে বর্তমান তরুণ উদ্যোক্তাদের সর্বোচ্চ ৭% গ্রোথ হ্যাকিং শব্দটার সাথে পরিচিত; সরাসরি প্র্যাকটিস করে এই পারসেন্টেজটা আরো কম হবে। মুনির হাসানের বইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে এই কনসেপ্টটা একটা প্রাথমিক ইমপ্রেসন তৈরি করুক; ক্রমাণ্বয়ে আরো অনেকে লেখার মাধ্যমে হয়তোবা কয়েক বছরের মধ্যে এটা প্রতিষ্ঠাও পেয়ে যাবে। কুস্তি লড়ে একজনকে হারানো যায়, বুদ্ধি দিয়ে হারানো যায় ১ বিলিয়নকে। সুতরাং ভাত ছিটিয়ে কাক ডাকার চাইতে কাক স্বপ্রণোদিত হয়ে আসবে এমন বুদ্ধি বের করাটাই অনেক বেশি মিনিংফুল। বাংলাদেশের বিজনেস কালচার আদতে ভাত ছিটিয়ে পাওয়া কাকের আদলে দুলছে; এখানে পরিবর্তন আবশ্যক। তাতে ভবিষ্যতে অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস পাবে, একটা আদর্শ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠবে। প্রচণ্ড যুক্তিবাদী আদতে নির্বোধের মতো অনেকে প্রশ্ন তুলতেই পারেন, সবাই উদ্যোক্তা হয়ে গেলে বিজনেস চালানোর মতো কর্মী কোথায় পাওয়া যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে দিই: মাত্র ১১ জন ব্যাটিং করার সুযোগ পায়; সেঞ্চুরি করে কতজন, ফিফটি করে কতজন? এমনকি সবার ব্যক্তিগত স্কোরও সমান হয় না। কেউ ১০, কেউ ২০, কেউ ৫০, এমনকি ২-১জন থাকে যারা কোনো রানই সংগ্রহ করতে পারে না। মাত্র ১১ জন মানুষই যদি একই হারে পারফরম করতে না পারে, সংখ্যাটা কোটিতে পৌঁছে গেলে তখন কি ‘সবাই’ শব্দটা উচ্চারণ করা বুদ্ধিমানের লক্ষণ আদৌ?
আগেই বলেছি মুনির হাসানের বইয়ের ক্ষেত্রে কনটেন্ট মেরিট আমার কাছে অপশনালেরও অপশনাল। তবু একটা খুবই ভাইটাল মেসেজ আছে এই বইয়ে; যারা উদ্যোক্তা হতে চায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই আইডিয়া নিয়ে প্রচুর সময় দেয়, যে কারণে অধিকাংশ সময়ই বিজনেস মুখ থুবড়ে পড়ে। বরং তার বিজনেসের মাধ্যমে সমাজের কোন প্রয়োজনটা পূরণ হবে এই পাজল সমাধান করতে পারলে বিজনেসের বাকি রহস্যের জটগুলো সহজ হয়ে আসে। উদ্যোক্তা হতে চাওয়া মানুষদের জন্য এই লারনিংটা জরুরী।
বিদেশী রেফারেন্স আমাদের কনফিডেন্স বাড়ায়, নিজেদের উদাহরণ আমরা খুব বেশি আমলে নিই না; সেক্ষেত্রে মুনির হাসানের বইয়ে উবার, ইনস্টাগ্রাম, হটমেইল প্রভৃতির উদাহরণ দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা আর আস্থা তৈরির প্রবণতা আছে, তুলনায় স্থানীয় উদাহরণ হিসেবে আছে কেবল ঝংকার মাহবুবের বই আর চট্টগ্রামের এক দোকানীর বিজনেসের কেস স্টাডি, তাও খুবই ছোট স্কেলে। আরেকটু বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় নিয়ে যেতে উদাহরণ দিয়েছেন ম্যাথ অলিম্পিয়াডের, এবং বইয়ের একদম শুরুতে ৭ই মার্চের ভাষণের। তবে ৩৫০০+ মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুবাদে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করেছি, অনেক বেশি দূরবর্তী উদাহরণ দিলে মানুষ তার সাথে নিজেকে কোরিলেট করতে অনাগ্রহ দেখায়, এবং সেটা তার কাজে লাগে কম। যে তরুণ মাত্র ২ টা কবিতা লিখেছে, তাকে পাবলো নেরুদা কবিতা লেখার সময় কী ভাবতেন সেই গল্প শোনালে সে নিজেকে কোথাও প্লেস করতে পারবে না; তাকে শোনাতে হবে বাংলাদেশেরই কোনো এক কবির গল্প যার ২-৩টা বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে পাবলো নেরুদাও থাকতে হবে অবশ্যই যাতে সে বুঝতে পারে ভালোর লিমিট আসলে লিমিটলেস। অনুরুপভাবে যে তরুণ মাত্র বিজনেসে নেমেছে, সে হটমেইল বা ফেসবুকের কেস স্টাডি উপেক্ষা করে যাবে, বলবে ‘আমেরিকা, ইংল্যান্ডের ইকোসিস্টেম উদ্যোক্তা তৈরির জন্য আদর্শ, বাংলাদেশে পদে পদে রক্তচোষা আর সামাজিক প্রতিবন্ধীর আনাগোনা, জুকারবার্গ বাংলাদেশে জন্মালে ২ বছর বেকার ঘুরে ৭ হাজার টাকায় গার্মেন্টসে চাকরি নিতো’! কিন্তু তাকে যদি বাংলাদেশী কেস স্টাডিগুলো পড়ানো হয়, সে ভাববে- ‘আরে, ওই ব্যাটা পারলে আমারো তো পারা উচিত’। উদাহরণ দেয়ার ক্ষেত্রে এই চরম প্রান্তিক মান আমাদের উদ্দেশ্য পূরণের পরিবর্তে অনেক সময় উদ্দেশ্য থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দেয়।
তবে গ্রোথ হ্যাকিংয়ে আরও খুব গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি লিখতে পারতেন তা হলো- সবার আগে প্রয়োজন সমচিন্তার ও সমআদর্শের এক সমণ্বিত টিম। কারণ বিজনেস চালায় মানুষ; চেয়ার, টেবিল, ল্যাপটপ বা স্যুট-টাই নয়। সুতরাং বিজনেসের অন্য নাম যে মানুষ, এই বোধ না জাগলে প্রফিট নেগেটিভে চলে যেতে যেতে দেউলিয়া হওয়া নিশ্চিত। বাংলাদেশে যৌথ উদোগগুলো এতো ভালনারেবল কেন, মনুষ্যনীতিতেই রয়েছে তার উত্তর।
বইয়ের টার্গেট রিডার আসলে যে কোনো মানুষ। কেবলমাত্র বিজনেসচিন্তার মানুষের এই বই পড়া উচিত, এটা কখনোই বলবো না। বরং গ্রোথ থিংকিং প্রবণতার যে কোনো মানুষই এটা পড়ে যদি ইন্টারপ্রেট করতে পারে নিজের মতো করে, তার জীবনভাবনা বদলাতে কাজে আসতে পারে। ইন্টারপ্রেট করার ক্ষেত্রে ছোট্ট একটা নীতি অনুসরণ করতে হয়- এই লাইনটা কেন লিখলো। আগের লাইনের লাইনের সাথে পরের লাইনের সম্পর্ক কী? লাইনগুলো একত্রিত করলে এর ভেতরে যে মেসেজটা পাওয়া যাবে সেটা আসলে কী? আমি কীভাবে নিশ্চিত হলাম সঠিক মেসেজ উদ্ধার করতে পেরেছি। এই ধারা থেকেই ইন্টারপ্রেটেশনের প্রাথমিক চর্চা তৈরি হয়ে যায়। বাকি পথটুকু নিজেকেই পাড়ি দিতে হবে।
গ্রোথ কি দরকার, কেন দরকার? না হলে সমস্যা কী? এই প্রশ্নের উত্তর প্রকৃতিতেই আছে; ৫ বছর বয়সী বাচ্চা একদিন ২৫ বছরের যুবক, তারপর ৮৫ বছরের বৃদ্ধ হয়। কেউ কি প্রশ্ন করেন, কেন হয়, না হলে সমস্যা কী? আপনি সাধু হন, চোর হন, বা উদ্যোক্তা হন, যদি জীবিত থাকেন, গ্রোথ লাগবেই। মানুষের কথা বাদ দিলাম, এমনকি গ্রোথনীতি মেনে চলে জলজ বিগহেড কার্প মাছও।
হ্যাকিং- ট্যাকিং নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না, গ্রোথের গ্ল্যামারে গ্রামার ভুলে যেতে চাই….