বাংলাদেশের ক্রিকেটে হাথুরুসিংহে একটি ব্যক্তি, নাকি সিস্টেমের নাম এ নিয়ে প্রায়ই ভাবি। মানুষ বিষয়েই আমার ব্যক্তিগত জীবনে গভীর ফ্যাসিনেশন এবং অবসেশন কাজ করে, তার প্রতিফলনেই সম্ভবত হাথুরুসিংহে ক্রিকেট কোচের চাইতে একজন ইন্টারেস্টিং মানুষ হয়ে উঠেন আমার কাছে, আমি তার একশন নয়, ইনটেনশন বোঝার চেষ্টা শুরু করি, অর্থাৎ কী করেছেন এর পরিবর্তে কেন করেছেন সেই সূত্রগুলো খোঁজার চেষ্টা করি, এবং কিছু হাইপোথেসিসে পৌঁছাই। হাইপোথেসিস কোনো প্রমাণিত সত্য নয়, এজাম্পশনমাত্র। এই পয়েন্টে পৌঁছানোর পূর্বে ইংরেজিতে ‘Hathurusinghe’ এবং বাংলায় ‘হাথুরুসিংহে’ লিখে গুগলে সার্চ দিই এবং ১১টি সাজেস্টেড পেজ পর্যন্ত গিয়ে যে সকল রিসোর্স পাই সবগুলোই পড়ে নিই, এর মধ্যে থেকে যেগুলো সরাসরি কাজে লেগেছে সেগুলোর লিংক কমেন্ট সেকশনে দিয়ে রাখছি। মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে হাথুরুসিংহে,আমার বিবেচনায়, খুবই গ্ল্যামারাস একটি স্যাম্পল।

হাথুরুর ব্যক্তি ম্যাপিং:
– হাথুরু সীমিত মেধার একজন ক্রিকেটার ছিলেন, শ্রীলংকার ক্রিকেট ইতিহাসে তার নামের সংযোজন বিয়োজনে এমন কিছুই আসবে যাবে না; বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘এহসানুল হক সেজান’ যে ক্যালিবার বহন করে, শ্রীলংকাতে হাথুরুও তা-ই। মূলত ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিলেন, তাও সেটা রোশান মাহানামার প্রক্সি হিসেবেই বেশি; জয়াসুরিয়া ওপেনার হয়ে গেলে তার জায়গা হয় মিডল অর্ডারে, সাথে কাজ চালানোর মতো বোলিং। এই ক্যালিবার নিয়ে তখনকার প্রমিজিং শ্রীলংকান দলে বেশিদিন টিকবার কারণ ছিলো না, সেও হারিয়ে গেছে।

– তবে হাথুরুর এক্সিলেন্স এখানেই যে সে বুঝতে পেরেছিলো মিডিওকর খেলোয়াড়ই মেধাবী কোচ হয় সাধারণত, কারণ তারা স্ট্রাগল আর ক্রাইসিসটা অনুধাবন করতে পারে, যেটা প্রতিভাবানদের এন্টেনার ওপর দিয়ে যায়; তারা মনে করে ‘এটা তো এমনি এমনি হয়ে যাওয়ার কথা’। হাথুরু কোচিংয়ে নেমে পড়ে; আরব আমিরাতের কোচ হয়, এখনকার অধিনায়ক আমজাদ জাভেদ তখন অফস্পিন করতো, হাথুরু তাকে পেস বোলার হওয়ার পরামর্শ দেয়, এবং সম্প্রতি যারা আরব আমিরাতের খেলা দেখেছেন তারা জানেন দলীয় অধিনায়ক আমজাদ জাভেদ একজন পুরোদস্তুর পেস বোলার। হাথুরুর মাঝে সম্ভাবনা দেখেছিলেন শ্রীলংকান বোর্ড, তাকে বানানো হয় শ্রীলংকার ‘শ্যাডো কোচ’ যে ভবিষ্যতে হেড কোচ এ উন্নীত হবে একদিন। থিলান সামারাবিরা, এঞ্জেলো ম্যাথিউস, কান্দাম্বি প্রত্যেকে তাদের ব্যটিং উন্নতির জন্য হাথুরুর প্রশংসা করেছে, এমনকি মুরালিধরনও নিজের বোলিংয়ে হাথুরুর কিছু অবদানের কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু ২০০৯ এ একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট থেকে মাঝপথে দেশে ফিরে আসে হাথুরু, লক্ষ্য ছিলো অস্ট্রেলিয়াতে লেভেল থ্রি কোচিং করবে। তৎকালীন বোর্ড ডিসিপ্লিনারি ইস্যুতে তাকে বরখাস্ত করে।

– হাথুরু অস্ট্রেলিয়াতে সেটেলড হয় স্ত্রী সন্তান নিয়ে এবং সেখানকার বিভিন্ন ক্লাবে কোচিং করাতে থাকে।
এই তথ্যগুলোকে পর্যালোচনা করে হাথুরুর যে ৩টি প্রধান বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়: এম্বিশন, পর্যবেক্ষণ, ইনটিউশন
কোচ হিসেবে হাথুরু কেন:
আমি ক্রিকেট অনুসরণ করি ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ থেকে, বাংলাদেশের খেলা সংক্রান্ত সিরিয়াসনেস আসে ৯৭ এর আইসিসি ট্রফি পরবর্তী জোয়ার থেকে। সেই সময়ে বাংলাদেশের কোচ ছিলেন গর্ডন গ্রীনিজ। তার আগে যারা কোচ ছিলেন চাইলে তাদের নামও উল্লেখ করা যায়, কিন্তু তখন যেহেতু খেলা দেখতাম না, ওই অংশটুকু ওভারলুক করলাম। গর্ডন গ্রীনিজ থেকে শুরু করে হাথুরুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোচ ছিলেন যারা তাদের একটা সামারি দাঁড় করানো যায় এমন:
-গর্ডন গ্রীনিজ: আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার কমিটমেন্ট করেন। পরবর্তীতে টেস্ট স্ট্যাটাস ইস্যুতে বোর্ডের সাথে মতানৈক্য হওয়ায় তার বিদায়টা সুখকর হয়নি।
-এডি বারলো: কোচ থাকাকালে স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের একমাত্র অনুরাগী বিদেশী কোচ বললে তাকেই বেছে নেব।
-ট্রেভর চ্যাপেল: মূলত চ্যাপেল ফ্যামিলির সদস্য পরিচয়টাই যোগ্যতা হিসেবে কাজ করেছে। খেলোয়াড়দের ফিটনেস বিষয়ে সিরিয়াস ছিলেন, যে কারণে আকরাম খানের মতো স্থূলকায় ক্রিকেটাদের প্রতি বিরূপ ছিলেন।
-মহসীন কামাল ও আলি জিয়া: পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরালো করার একটা এটেম্পট থেকে ক্রিকেটের দ্বারস্থ হওয়া। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের যুগ বলা যায় তাদের সময়টাকে।
– ডেভ হোয়াটমোর: অন্তত ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে একটি প্রমিজিংৱ দল বানানোর প্রজেক্ট নিয়েছিলেন। মাল্টি স্কিলড খেলোয়াড় তত্ত্ব চেষ্টা করেছিলেন, অলক কাপালিকে লেগ স্পিনার থেকে সলিড ব্যাটসম্যান বানিয়েছিলেন। টোটাল টিম হিসেবে নয় ইনডিভিজুয়াল পারফরমার দিয়েই যে বাংলাদেশকে আপসেট ঘটাতে হবে এটা অনুধাবন করেছিলেন, এবং তার প্রেক্ষিতে মাশরাফি, আশরাফুলদের আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতেন। বেটার অফার পেয়ে অন্যত্র চলে যান।
-জেমি সিডন্স: সীমিত মেধার ক্রিকেটারদের ( রকিবুল, জুনায়েদ, ইমরুল, নাঈম, মাহমুদুল্লাহ) লয়্যালটি বা আনুগত্যকে কাজে লাগিয়ে পারফরম্যান্সে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তামিম ইকবালকে ফ্রি লাইসেন্স দিয়েছিলেন, কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতিতে বিষয়টা পলিটিক্স বা গ্রুপিং হিসেবে পরিচিত হয়, কারণ আশরাফুলের পারফরমহীনতা যে টেকনিকাল নয়, মানসিক এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আশরাফুলের ব্যাটিং গ্রিপ, পজিশন নিয়ে নানারকম চেষ্টা করেছিলেন, এবং সেসময় সাকিব-তামিম-বিকেএসপি প্রভৃতি ইস্যুগুলো মিডিয়াতে বেশি আসতো। তার বিদায়টাও সুখকর হয়নি।
-স্টুয়ার্ট ল: যে ফুল অংকুরেই ঝরে গেল…
-জার্গেনসন: আনুষ্ঠানিকভাবে কোচ হিসেবে নিয়োগ পাননি, আপৎকালীন দায়িত্বের মেয়াদটাই বেড়েছিলো মাত্র। হোয়াটমোর আর সিডন্সের অসমাপ্ত প্রজেক্টের আউটপুট পেতে শুরু করেন।

উল্লিখিত কোচদের সামারিগুলো বিশ্লেষণ করার সাথে বাংলাদেশে কোচ পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা হাইপোথেসিস পাওয়া যায়। বোর্ড চাইতো শক্তিশালী দেশ বা বিখ্যাত খেলোয়াড়দের কাউকে কোচ বানাতে, কিন্তু ব্যাটে বলে মিলতো খুব কমই। এই সংকটের পেছনে ৫টি প্রধান কারণ অনুমান করা যায়:
-চ্যালেঞ্জের বিপরীতে মূল্যায়ন: বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের যে অবকাঠামো এবং খেলোয়াড়দের যে মাইন্ডসেট, সেই আন্ডার প্রিপারড দলকে ২০০০ সালের বিশ্বক্রিকেটে সাফল্য দেখানো বিরাট চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিলো, এবং এর বিপরীতে যে স্যালারি আর ফ্যাসিলিটিস কোচরা আশা করতো সেটা এফোর্ড করার মতো অবস্থায় বোর্ড ছিলো বলে মনে হয় না। কোচদের কাছে সব দেশের দর্শক বা বোর্ড কেবল সাফল্য চায়, অন্য কিছু নয়। ছুটির দিনে ঢাকার কিছু চিকিৎসক পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে (যেমন মানিকগঞ্জ, গাজিপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ) চেম্বার করেন, স্থানীয়রা ভাবে ঢাকা থেকে ডাক্তার এসেছে, অথচ বাস্তবতা হলো ঢাকার কম্পিটিটিভ মার্কেটে অবস্থান গড়তে অসফলরাই সাধারণত বাড়তি ইনকামের আশায় ( স্থানীয় ভাষায় বলে খ্যাপ) বিকল্প রাস্তায় হাঁটে। বাংলাদেশের কোচ পদটাও একসময় সেরকম ছিলো, শুনতে যেমনই লাগুক।
– ক্যারিয়ার গ্রোথ স্থবিরতা: কোচদের সিভি ভারি হয় দলের সাফল্য দেখাতে পারলে। বাংলাদেশে কোচিং করিয়ে সেই সুযোগটা ছিলো সীমিত, কারণ ইংল্যান্ডের কাউন্টি দলে কোচিং করিয়েছে এই তথ্য কাউকে বাংলাদেশের কোচ হওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্য বানালেও বাংলাদেশের কোচ ছিলাম একসময় এই তথ্য তাকে ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার কোনো ক্লাবের কোচ হওয়ার দৌড়ে একটুও এডভান্টেজ দিতো না।
– ক্রিকেটহীনতা: উপমহাদেশের ৪টি দেশেই ক্রিকেট বোর্ড কমবেশি রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত, এর মধ্যেও রাজনৈতিক দাপটের র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে থাকবে। বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের মাথায় ক্রিকেট ছাড়া আর সবই ঢুকতো। আপনি যদি এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন যার কর্তাব্যক্তিরা আপনি কী বলছেন সে সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা রাখে না, শুধু বলে প্রফিট বাড়াও প্রফিট বাড়াও, সেখানে কাজ করতে ইচ্ছা কাজ করবে না একদমই।
– ক্রিকেটারদের সেন্সহীনতা: সাম্প্রতিক কালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাদে যতগুলো শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ আছে, ক্রিকেট সেন্স চিন্তা করলে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা একদম তলানীতে থাকবে। এরা খেলার আগে বোঝে ভাব, এটিচুড; স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট থেকে কথা বললে, স্কিল ডেভেলপমেন্টের কথা বললে তাদের আগ্রহ কাজ করে বা করতো কম। এই বৈশিষ্ট্যের মানুষ নিয়ে কাজ করাটা যে কারো জন্যই কঠিন।
– সাংস্কৃতিক পার্থক্য: সামাজিক অনুশাসনের কারণে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের লাইফস্টাইলের অনেক কিছুই বাংলাদেশে ওপেনলি একসেপ্ট করে না। ফলে আমোদ-ফূর্তির যোগানে ঘাটতিও একটা বড় কারণ ছিলো।
এর মধ্য থেকে হাথুরুসিংহে কীভাবে সিলেক্টেড হলো, এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায় ক্রিকইনফো, যেখানে বলা হয়েছে হাথুরিসিংহে শ্রীলংকান অরিজিন হওয়ায় উপমহাদেশের কন্ডিশন সম্পর্কে ধারণা আছে, পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়াতে কাজ করার অভিজ্ঞতা- এই দুটো ফ্যাক্টরই মূলত তাকে এডভান্টেজ দিয়েছিলো। এগুলো গতানুগতিক কথা, যা প্রত্যেক কোচ নিয়োগের সময়ই ফরমায়েশিভাবে মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয়।
তাই দেখা যাচ্ছে, হাথুরুর নিয়োগটাও অন্য কোচদের মতোই ছিলো, হয়তবো হাথুরু নিজেও খুব বেশি কনফিডেন্ট ছিলো না। তার ওপর নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিনের মাথায়ই সাকিব আল হাসানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে যার ফলাফলস্বরূপ সাকিব বড় ধরনের শাস্তি পেয়েছিলো। দায়িত্ব নেয়ার পরই দলের সবচাইতে বড় তারকা ক্রিকেটারের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানোটা বাংলাদেশের অন্য কোচের ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। হাথুরুকে বোঝার ক্ষেত্রে ৩ বছর আগের সেই দ্বন্দ্বটার ইমপ্যাক্ট আছে প্রচ্চন্নভাবে, যা লেখার অন্য পয়েন্টে উঠে আসবে।
হাথুরুর জীবন বদলে দেয়া ২০১৫ সাল:
ভাগ্য, নাকি যোগ্যতা আর চেষ্টা, কোনটা মানুষকে সফল করে, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবারই যোগ্যতা আর চেষ্টা বিজয়ী হবে, কিন্তু এটাও অবধারিত একটি নির্দিষ্ট লেভেলের উপরে উঠতে ১% হলেও ভাগ্যের সহায়তা লাগে, ওই ১% কে বলা যায় গাড়ির চাবির মতো, যেটা ছাড়া গাড়ি স্টার্ট দেয়া কঠিন। হাথুরুর প্রথম এসাইনমেন্টটা মনে আছে? ভারতের ৩য় সারির দলের বিপক্ষে ১০৫ রান চেজ করতে গিয়ে ৫৮ রানে অলআউট হতে হয়েছিল। ২০১৫ বিশ্বকাপ নিয়েও জনমনে প্রত্যাশা ছিলো না বিশেষ, কারণ প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে পারফরম্যান্স আশানুরূপ ছিলো না; গ্রুপের সহজ দুই প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান আর স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জিতবে কিনা এটা নিয়েও কনফিউশন ছিলো (২০১৪ তে আফগানিস্তানের কাছে ওয়ানডেতে হারতে হয়েছিলো)। কনফিউশন দূর করে দুটো দলকেই হারানোর পাশাপাশি ইংল্যান্ডকেও হারিয়ে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল দল। ২০১১ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডের সাথে ৩য় যে দলটিকে হারিয়েছিলো সেটা ইংল্যান্ড, ২০০৭ এ ঝুলিতে ছিলো ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর প্রাপ্তি, কিন্তু ওই আসর দুটির মূল্যায়ন নেই বিশেষ কারণ টুর্নামেন্ট ফরম্যাটের ভিন্নতা, অন্যদিকে ১টা মাত্র বড় দলকে হারিয়ে ২০১৫ তে পৌঁছানো গিয়েছিলো কোয়ার্টার ফাইনালে, এবং এখানে ভাগ্য কতটা সহায়, অস্ট্রেলিয়ার সাথে ম্যাচটি পণ্ড তো হলোই, উপরন্তু বাংলাদেশ মুফতে পয়েন্ট পেলো, যেটি পার্থক্য গড়ে দিলো। ২০১৭ এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও একই ঘটনা, অস্ট্রেলিয়ার সাথে পুরো ম্যাচ খেলা হলে নিশ্চিত হার, সেটাও পণ্ড হলো, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ পৌঁছে গেল সেমিফাইনালে।
বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে রোহিত শর্মার নো-বল বিতর্কে আড়াল হয়ে গেলো বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা, যেন ওই নো-বলটি না দিলে বাংলাদেশ জিতে যেত।
২০১৫ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর পাকিস্তান ক্রিকেটে বড় ধরনের রদবদল হয়, ট্যুরের আগে সাকিব আল হাসান একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছিলো, বাংলাদেশ ৩-০ তে সিরিজ জিততে পারে, প্রত্যাশাতীতভাবে সেটাই হয়, এবং যেহেতু পাকিস্তানের সাথে পুরনো হিসাব-নিকাশ আছে, সঙ্গতকারণেই এর একটা উন্মাতাল প্রভাব পড়ে। ভারত সিরিজ হেসেছে মূলত একক মুস্তাফিজের কাছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে দুটো টি২০ আর প্রথম ওয়ানডেতে বাজেভাবে হারার পর বিসিবি সভাপতি সিরিজের মাঝপথে খেলোয়াড়দের নিয়ে জরুরী সভায় বসেন, যেটা নিয়ে পত্রিকা আর সোস্যাল মিডিয়াতে সভাপতির তুমুল সমালোচনা করা হয়। সিরিজের শেষ দুটি ওয়ানডেতে সাউথ আফ্রিকা তাদের রীতি অনুসারে কলাপস করে, এবং এই সিরিজ জয়ের প্রেক্ষিতে ১১ বছর পরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। হাথুরুর নিজে কি অনুমান করতে পেরেছিলো এমনটা হতে পারে?
২০১৫ এর ম্যাচগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফি, মাহমুদুল্লাহ, মুস্তাফিজ, সৌম্য এই ৭ জন খেলোয়াড়ই কী রোল প্লে করেছে। এদের মধ্যে প্রথম ৫ জন হাথুরু আসার অনেক আগে থেকেই দলের নিয়মিত পারফরমার; মুস্তাফিজ বয়সভিত্তিক দলের পারফরম্যান্সের কারণে ইতিমধ্যেই নির্বাচকদের স্পেশাল নোটে ছিলেন, সৌম্যও তাই। তবে হাথুরুর কৃতিত্ব এখানে, সে সৌম্যকে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে পেয়ে একজন এগ্রেসিভ ওপেনারে বদলাতে সমর্থ হয়েছে। এর চাইতেও বড় কৃতিত্ব আসলে মাহমুদুল্লাহর পুনর্জন্ম। ২০১৪ এর এপ্রিল পর্যন্ত ৭ বা ৮নম্বরে ব্যাটিং করে মাহমুদুল্লাহর গড় ছিলো ৩৩.৪২; ২০১৫ তে ৪ নম্বরে উঠে আসার পর ১৪টি ইনিংস খেলেছেন যেখানে গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮.৫৩ (যার মধ্যে আছে বিশ্বকাপের ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি)। একদা ভায়রা ভাই নামে ব্যাপক ট্রলের শিকার হওয়া মাহমুদুল্লাহ হয়েছে দলের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ।
২০১৬ এর ২৫ ফেব্রুয়ারি পল রেডলি নামের একজন লেখক একটি আর্টিকেল লেখেন সেখানে হাথুরুর ইমপ্যাক্ট বোঝানোর জন্য তিনি একটি শব্দ খরচ করেন। তিনি বলেন, হাথুরু বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে এম্বিশন তৈরি করতে পেরেছেন, যেটা ইতিপূর্বে কোনো কোচ সমর্থ হননি। আমি এই কথাটা আংশিক সমর্থন করি, কারণ হাথুরু একটি সংঘবদ্ধ দল হাতে পেয়েছিলো যেটা অনেক বছর ধরে একসাথে খেলছিলো। মাহমুদুল্লাহ ছাড়া আর কোনো খেলোয়াড় এখনো পাওয়া যায়নি যার পারফরম্যান্সে তার ক্যারিশমা কাজ করেছে। সে এখনো পর্যন্ত সবচাইতে বেশি ইনভেস্ট করেছে সৌম্য সরকার আর সাব্বির রহমানের পেছনে, তারা এখনো আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি, যদিও ক্যারিয়ারের বয়স ৩ বছর হয়ে গেছে। ব্যর্থ প্রজেক্ট ছিলো জুবায়ের লিখন, তানবীর হায়দার। তাই এম্বিশন ক্রিয়েট ব্যাপারটা যত গভীর ইমপ্যাক্ট নির্দেশ করে, হাথুরু সেপথে কতটা অবদান রেখেছে এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
২০১৫ এর সেই অতর্কিত সাফল্যের জন্য হাথুরু নিজেও কি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলো? ২০১৬ এর বছরটা ছিলো টি২০ এর, যে কারণে টেস্ট ম্যাচ বাতিল করে টি২০ খেলা হয়েছে পর্যন্ত। এই পয়েন্টে এসে বোঝা যায়, সিভি সমৃদ্ধ করার দিকে হাথুরুর মনোযোগ কত বেশি। সেবছর দুটো মাত্র ওয়ানডে সিরিজ হয়েছে, একটা আফগানিস্তান, অন্যটা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১৭ এর শুরুটা হয়েছে নিউজিল্যান্ডে হোয়াইটওয়াশ হয়ে, সেটা বড় হয়ে উঠতে পারেনি শ্রীলংকা সিরিজ ড্র হওয়ায়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনালে উঠায় (যদিও নিউজিল্যান্ডের সাথে জয়টি বাদে সমগ্র টুর্নামেন্টের দলের পারফরম্যান্স মোটেও সন্তোষজনক কিছু ছিলো না। এটা মনে থাকবে না, সেমিফাইনালে খেলাই বড় কথা হয়ে থাকবে)।
একবার নাম-যশ হয়ে গেলে সেটা ভাঙিয়ে যেমন বেশ কয়েক বছর খাওয়া-পরা যায়, হাথুরুর ব্যাপারটাও অনেকটা কাছাকাছি পর্যায়ের। এক ২০১৫ এর ৩টি সিরিজ আর ফরম্যাটের সুবিধায় খেলা কোয়ার্টার ফাইনাল দিয়ে একটি বাতাবরণ সে তৈরি করতে পেরেছে, যা বলছে বাংলাদেশ এখন দারুণ সমীহ জাগানো দল, দেশের মাটিতে আরও ভয়ঙ্কর। অথচ দলে পারফরমার বলতে সেই পুরনো খেলোয়াড়গুলোই, নতুন কোনো পারফরমার আসেনি, ৩ নম্বর পজিশনে কোনো ব্যাটসম্যান আসেনি, ওপেনিংয়ে তামিমের সাথে স্টেবল কোনো ওপেনার তৈরি হয়নি, মিরাজের আবির্ভাবহেতু টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারানো গেছে। মিরাজ দলে ঢোকার আগে থেকেই ভবিষ্যতের তারকা, এবং বাংলাদেশে খেলোয়াড়দের ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে দেখা যায়, অভিষেকের পর কয়েকটা ম্যাচে দুর্দান্ত পারফরম করে পরে স্তিমিত হয়ে গেছে। হাথুরু ইমরুল কায়েস, শুভাশিস, তাইজুল, শহীদ, শফিউলের মতো অমেধাবী ক্রিকেটারদের মধ্যে কি এম্বিশন ক্রিয়েট করতে পেরেছে? তারা আগে যা ছিলো, এখনো তা-ই আছে, এম্বিশনের টোটকা তাহলে গেল কোথায়?
হাথুরুর নির্বাচিত ৫ উক্তি:
একজন মানুষকে বোঝার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার দেয়া বক্তব্যকে ব্যবচ্ছেদ করতে হয়। এরকম ৫টি উদ্ধৃতি আমার মনে পড়ছে যার মধ্য দিয়ে তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনুমান করা যেতে পারে:
– এই সাকিব ২০১০ এর বোলার সাকিবের ছায়া [ শ্রীলংকা সফরে ১ম টেস্টের পর]
– ম্যাচটা আমরা হেরে গেলাম শুধু তাইজুল যা তা বোলিং করার কারণে [ ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের কাছে ম্যাচ হারার পর]
– নাসির দলে নেই একই টাইপ প্লেয়ার অনেক বেশি থাকায় [ মোসাদ্দেক, সাব্বির, মাহমুদুল্লাহ, নাসির একই ক্যাটাগরির প্লেয়ার মন্তব্য]
– আইসিসির যদি ওদের দুজনের একশন নিয়ে সন্দেহ থাকে তবে আমারও তাদের একশন নিয়ে সন্দেহ আছে [২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপে আরাফাত সানী, তাসকিনের বোলিং একশন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর আইসিসির সমালোচনা]
– আবেগী জাতি, নাকি সেরা একাদশ, কোনটা [ ২০১৭ তে অস্ট্রেলিয়ার সাথে প্রথম টেস্টের পূর্বে মমিনুলকে একাদশে রাখা না রাখা বিষয়ে টুইট]
উদ্ধৃতিগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় সে একজন স্বাধীনচেতা এবং লাগামহীন বেপরোয়া মনোভাবের মানুষ। সে বিশ্বাস করে মানুষের ইগো হার্ট করলে হয় ভেঙ্গে পড়ে, অথবা জেদী হয় আরও। একারণে সে প্রকাশ্যে যে কারো সমালোচনা করতে পিছপা হয় না। অন্যদিকে সে নিজে একরোখা মানুষ, বিরুদ্ধচিন্তা বা বিরুদ্ধভাবনার প্রতি রেসপেক্ট নেই, তাতে যুক্তি আছে কি নেই ব্যাপার না, সে যেটা ভাবছে সেটা ভুল হলেও মানবে না, লেগেই থাকবে। কোনো কারণে সফল না হলে সর্বোচ্চ খারাপ পরিণতি কী হতে পারে; চাকরি চলে যাবে? তাতে কী হয়েছে, অন্য কোথাও চাকরি হবে; এরকম ড্যাম কেয়ার মাইন্ডসেট থাকলে সেই মানুষের সাথে মেলামেশা বা যৌথ কাজ করতে গেলে অন্যদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত বাঁধা অনেকটাই অনিবার্য।
হাথুরুর কার্যক্রম বোঝার চেষ্টা করলে মনে হয়, সে জানে তার হাতে সময় আছে ২-৩ বছর, এর মধ্যে সিরিজ পাওয়া যাবে বড়জোর ১০-১২ টা, প্রতিটাতে যদি ১-২টা ম্যাচ জেতা যায়, তাতেই দেশের দর্শক খুশি, বোর্ড খুশি, কারণ খুশি হওয়ার উপলক্ষ্য তো আসেই না বলতে গেলে। এই কারণে হাথুরুর পছন্দ এগ্রেসিভ খেলোয়াড় যারা হয় ছক্কা অথবা অক্কা, টাইপ নীতিতে চলে। যেমন, ইমরুল টাইপ খেলোয়াড়রা কখনো ম্যাচ জেতাতে পারবে না, এরা বড়জোর সম্মানজনক হার নিশ্চিত করতে পারে; অন্যদিকে সৌম্য-সাব্বির-তাসকিন টাইপ খেলোয়াড়গুলো ভরডরহীন খেলবে, ৫ ম্যাচ খেলে ১টাতেও যদি দাঁড়িয়ে যায় সেই ম্যাচটা জেতা যাবে। ঠিক একই কারণে টেস্টের চাইতে ওয়ানডে বা টি২০ তার বেশি পছন্দ, কারণ এই ফরম্যাটগুলোতে জেতা তুলনামূলক সহজ।
হাথুরুর প্লেয়ার সিলেকশনের দিকে নজর দেয়া যায়। সে পছন্দ করেছে সৌম্য সরকারকে, সম্প্রতি সাইফুদ্দিনকে, অর্থাৎ সে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার চায় ৮ নম্বরে যে ১০ ওভার বোলিং করবে, এবং ব্যাটিংয়ে নেমে ১৫ বলে ৩৫ রান করবে। সে পছন্দ করেছে জুবায়ের লিখনকে, তানবীর হায়দারকে, উভয়েই লেগস্পিনার। সে বিশ্বাস করে লেগস্পিনার বাইস উইকেট। সে ঘরোয়া লীগের ম্যাচ দেখার আগ্রহ বোধ করে না, কারণ বিসিবিতে ঘোরাঘুরি বা পত্রিকাসূত্রে সে এটা বুঝে গেছে ঘরোয়া ক্রিকেটের খেলাগুলো মাঠে নয়, টেবিলে হয়। যে দলের কর্মকর্তারা বিসিবিতে প্রভাবশালী তারাই চ্যাম্পিয়ন হবে বা ভালো পজিশনে থাকবে, আম্পায়ার, মাঠ সব তাদের। এই খেলা দেখা না দেখা একই কথা। আমাদের কাগজে কলমে ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট কমিটি আছে, কিন্তু সেখানে রিসার্স এবং এনালাইসিস ইউনিট কোথায়, তাদের এক্টিভিটি কী, এবং সেটার আউটকাম কী; কোচ তো একজন আউটসাইডার এবং ভাড়াটে বুড়ো; তার কি দায় পড়েছে এসব নিয়ে ভাববার! সে ভাববে ২-৩ বছরে যে ১০-১২টা সিরিজ পাবে সেখানে কয়টা ম্যাচ জেতা যায় সেই রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড বিষয়াদি নিয়ে! তার চাইতে বিভিন্ন ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াডে যেসব খেলোয়াড় খেলে তাদের কাউকে রেন্ডমলি পিক করে কাজ করা যেতে পারে। একারণেই নেটে বোলিং বা ব্যাটিং দেখেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফিডেল এডওয়ার্ডস, পাকিস্তানের ওয়াকার ইউনিস দুজনই নেট থেকে আসা খেলোয়াড়। হাথুরুর সমগ্র প্রসেসটাই রেন্ডম, একদমই মেথডলজিকাল নয়, যে কারণে হাথুরুকে কোচ না বলে একজন বাজিকর বা জুয়াড়ি বললেই যথার্থ হবে।
বাংলাদেশের যে স্কোয়াড তাতে ১২-১৩ জন প্রায় অটোচয়েজ থাকে, ১-২টা পজিশন নিয়ে সামান্য সংশয় থাকে, এবং সেগুলো নিয়েই বিতর্ক হয়। এখনো ১টি পজিশনের জন্য ৩ জন লড়াই করছে এরকম পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব হয়নি, সর্বসাকুল্যে ২৫ জন খেলোয়াড় আছে হয়তো, ঘুরেফিরে তারাই আসে বারবার, অথচ ৮ বছর আগেও এমনটি ছিলো না। হাথুরু তাই নতুন করে কোনো সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের দিকে যায়নি, সে চেয়েছে সর্বময় ক্ষমতা, বিনিময়ে সাফল্য যদি দিতে পারে, তাতে বোর্ডের আপত্তি কিসের! পেইনকিলারের কাজ ব্যথা উপশম করা, তাতে শরীরে অন্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো কিনা সেটা বুঝবে ডাক্তার। দুঃখের বিষয় হলো, পেইনকিলারই ডাক্তার হয়ে গেছে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য তৈরি তো থাকতে হবেই।
একটি প্রতিবেদন:
২০১৫ এর ১১ই এপ্রিল New Age এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো। সেখান থেকে কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছি:
-বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের কারণে দলের খেলোয়াড় ও অন্যান্য স্টাফদের চাইতে ৭ গুণ বোনাস পাবে হাথুরু। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের বোনাস যেখানে ২২০০ ডলার, হাথুরু পাচ্ছে ১৪৭০০ ডলার।
-ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের কারণে হাথুরু পাবে ১০০০ ডলার, অন্যরা ৮০০ ডলার। মূল চুক্তির শর্তানুসারে, বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে উঠায় হাথুরুকে দিতে হচ্ছে অতিরিক্তি ১২৫০০ ডলার।
-বিশ্বকাপ ফাইনালে খেললে ১০০০০০ ডলার, এবং চ্যাম্পিয়ন হলে পরিমাণটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তার কর্মীকে কোন্ ফ্যাসিলিটিসের শর্তে চাকরিতে নিয়োগ দেবে এটা একান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ পলিসি, কিন্তু অবাক লাগছে বোনাসের অংকে পার্থক্য দেখে। পৃথিবীতে বাংলাদেশই বোধহয় একমাত্র ক্রিকেটখেলুড়ে দেশ যেখানে কোচের বোনাস খেলোয়াড়দের চাইতে এতো বেশি হয়, অর্থাৎ খেলোয়াড়দের চাইতেও কোচের ইনফ্লুয়েন্স-ইম্পর্ট্যান্স বেশি। এ সংক্রান্ত আর্টিকেল খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, অনিল কুম্বলে ভারতের কোচ হওয়ার প্রাক্কালে বোর্ডকে যে প্রোপোজাল দিয়েছিলো সেখানে কোচের বেতন অধিনায়কের বেতন ৬০% হতে হবে এমন একটা দাবি ছিলো, এবং সেটাই নিউজ হয়েছিলো। অথচ বাংলাদেশে খেলোয়াড়দের ৭ গুণ বোনাস পাচ্ছে কোচ! সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বেই কোচের ভূমিকা যেখানে কেবলমাত্র হিউম্যান ম্যানেজমেন্ট আর স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্টে অধিনায়ককে সহায়তা করা, এক বাংলাদেশে সেটা হয়ে গেছে পুরোপুরি কোচ নিয়ন্ত্রিত পুতুল নাচ। চীন বা আর্জেন্টিনায় ক্রিকেট বিকাশের জন্য একজন কোচের যে ভূমিকা, আমাদের মতো টেস্ট প্লেয়িং একটা দেশেও কোচের ভূমিকা হুবুহু এক, এটাই আমাদের মেরুদণ্ডহীনতাকে প্রকটভাবে প্রকাশ্য করে তোলে। এরকম পরিস্থিতিতে হাথুরুসিংহে শুধু নির্বাচক কমিটিতে কেন, বিসিবির ডিরেক্টরশিপ চাইলেও হয়তোবা পেয়ে যাবে যদি প্রতি সিরিজেই ১টা করে ম্যাচ জিতে যায় দল। ম্যাচ জেতায় সাকিব, তামিম, মুস্তাফিজরা, ক্ষমতা বাড়ে হাথুরুর; বড়ই অদ্ভুত কারসাজি!

হাথুরুর কতিপয় ‘কেন’ বোঝার প্রয়াস: ২০১৫ এর পর থেকে হাথুরুর ডেসপারেটনেস আরও বেড়েছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সমালোচনা। আমি সমালোচনায় যেতে চাচ্ছি না, তার কাজগুলোর একটি ‘কেন’ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি।
১. সৌম্য সাব্বির টেস্টে কেন: ক্রিকইনফোতে একটা আর্টিকেল পড়লাম যেখানে বলা হয়েছে টেস্ট ম্যাচ ৪দিনে নামিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়েছে ১৯৮০ পর্যন্ত ৭৫.২% টেস্ট ৫ম দিন পর্যন্ত গড়িয়েছে, ৮০ এর দশকে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭.১% এ, এরপর থেকে পারসেন্টেজ কমে আসতে থাকে, গত দশকে এসে দাঁড়ায় ৫৮.৩% এ, এবং ২০১৭ তে মাত্র ৫২% ম্যাচ ৫ম দিনে গেছে। অর্থাৎ টেস্টগুলো এখন ৩য় বা ৪র্থ দিনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা টেকনিকালি সাউন্ড নয়, তারা ডিফেন্স করতে গেলে রানও করতে পারে না, আউটও হয়ে যায়, হাথুরুর দরকার সেরকম কিছু ব্যাটসম্যান যারা টেস্টের আঁটোসাটো বোলিংয়ের সুযোগ নিয়ে কিছু রান করে দেবে, এবং কোনোভাবে ৩০০ বা তার আশপাশে ফার্স্ট ইনিংস স্কোর করবে। এরপর স্পিন বোলিংয়ে যদি কলাপস করানো যায় প্রতিপক্ষ দলকে। আলটিমেটলি রান করাটাই লক্ষ্য, কীভাবে এলো সেটা বড় নয়, প্রথাগত টেস্ট টেম্পারমেন্ট বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নেই, অধিকাংশ ব্যাটসম্যানই বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ বলতে খেলে কেবল টেস্ট ম্যাচ, সমগ্র জীবনে ৫০০ বল একটানা ব্যাটিং করেছে কিনা সন্দেহ। এজন্য প্রথাগত টেস্টের চাইতে এটাকিং খেলে কিছু রান দাঁড় করানোই স্ট্র্যাটেজি, তারপর যদি মিরাকল ঘটে এবং বিপক্ষ দলের ব্যাটিং কলাপস করে!

২. মমিনুল কে অপছন্দ কেন: হাথুরু আসার আগেই মমিনুল টেস্টে কিছু ভালো ইনিংস খেলে ফেলেছিলো, এবং তার ব্যাটিং গড় ভালো ছিলো। মাত্র ৬-৭টি ম্যাচের গড় নিয়ে মিডিয়াতে যেভাবে লেখালিখি করে মমিনুলকে অপার সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিলো, এবং তাকে ঘিরে প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছিলো, ব্যাপারটা নিজে ফেস করতে গিয়ে সম্ভবত মানতে পারেনি হাথুরু। মমিনুল এই মুহূর্তে সম্ভবত সবচাইতে খর্বাকৃতির টেস্ট ক্রিকেটার, তার শট রেঞ্জও খুব কম, স্কোরিং জোনও নির্ধারিত, এবং আউটগুলো খুবই ক্যাজুয়াল; এই সবকিছু থেকে মমিনুলকে সে একটা ফ্লুক এবং ওভাররেটেড ব্যাটসম্যান হিসেবে ধরে নিয়েছে। যেহেতু সে নিজেও রেন্ডম মমিনুলের পারফরম্যান্সটাকেও সে রেন্ডম হিসেবেই ধরে নিয়েছিলো। তাছাড়া জাতীয় দলে ঢোকার আগেও মমিনুল এমন কোনো উল্লেখযোগ্য পারফরম করে আসেনি, তার তুলনায় বরং মোসাদ্দেক সৈকত বেশি ডিজার্ভিং ছিলো। কিন্তু মিডিয়া মমিনুলকে যেরকম আগামীদিনের ভরসা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলো সেটা মেনে না নেয়া থেকেই এই মানসিক বিকর্ষণের শুরু, এবং যখন কাউকে অপছন্দ হওয়া শুরু হয়, তখন তার ত্রুটিগুলোই বেশি চোখে পড়ে, আর সামর্থ্যকে মনে হয় ভাগ্যক্রমে পাওয়া। যেহেতু হাথুরু একজন ভিনডিক্টিভ এবং লাগামহীন মনোবৃত্তির মানুষ, অপছন্দকে জাস্টিফাই না করা পর্যন্ত স্বস্তি আসবে না।

৩. টি-টোয়েন্টি থেকে তামিম, মুশফিককে বাদ দিতে চায় কেন: আমি অবশ্য এই চিন্তার সাথে শতভাগ একমত। তামিম, মুশফিকের বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ নিয়েই বেশি মনোযোগী থাকা উচিত। টি টোয়েন্টি বরং পুরোটাই এক্সপেরিমেন্টের জায়গা হওয়া উচিত।

৪. নিউজিল্যান্ড সফরে এত বিশাল বহর কেন: এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আঁচ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতি তার করুণা ছাড়া কিছুই নেই, এজন্যই আগামী দিনে জাতীয় দলে আসতে পারে এরকম ২-৩ জন ক্রিকেটারকে দলের সাথে রেখে ওদের দেখে নিতে চাওয়া, যাতে প্লেয়ার সংকট হলে কাউকে টানতে পারে। সৌম্য সরকার ব্যর্থ হওয়ার পরও যে বাদ পড়ে না এর কারণ এটা নয় যে সৌম্যকে হাথুরুর খুব পছন্দ, বরং সৌম্যের জায়গায় আসার মতো শক্ত কনটেন্ডার নেই বাইরে। কনটেন্ডার সেই ইমরুল কায়েস, যে একজন প্রুভেন ফেইলার। ইমরুল আর সৌম্যের মধ্যে হয়তোবা সৌম্য মন্দের ভালো। বিজয় ডাবল সেঞ্চুরি করেছে, বিপিএল এ ২টা ভালো ইনিংস খেললেই সাউথ আফ্রিকা সিরিজ শেষে ইমরুল-সৌম্যের যে কোনো একজন অথবা উভয়ই পরবর্তী সিরিজের দল থেকে বাদ পড়বে।

৫. সে এতো পাওয়ার প্র্যাকটিস করে কেন: ক্রিকইনফোতে হাথুরুর একটা ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছিলো, সেখানে এ ব্যাপারে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছিলো। হাথুরু বলেছিলো, সে শুধু তার কাজটা করছে। আমারও তা-ই মনে হয়। যেহেতু জয়-পরাজয়ের জন্য তাকেই জবাবদিহি করতে হবে, সুতরাং সর্বময় কর্তৃত্ব নিয়েই দায়ভার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের ক্রিকেট, ক্রিকেটার কারো ম্যাচিউরিটির প্রতিই তার সামান্যতম আস্থা আছে মনে হয় না।

হাথুরুর জন্য প্রেসক্রিপশন:
হাথুরুর পর্যবেক্ষণ ও গেম রিডিং অসাধারণ, যে কোনো উন্নয়নশীল ক্রিকেট দেশের জন্য সে হতে পারে স্বপ্নের কোচ, যেখানে তার ইচ্ছাই সবার জন্য আদেশ বলে গণ্য হবে। তার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিলো আরব আমিরাতের কোচ হয়ে; ওমান, হংকংয়ের মতো দেশগুলোও ক্রিকেটে সিরিয়াস হতে চাইছে। সেইসব দেশে সে সুপার ফিট। কিন্তু টেস্ট খেলুড়ে একটি দেশের কোচের ক্ষমতার পরিধি যতটুকু এবং সে যতটুকু প্রত্যাশা করে দুইয়ের মধ্যে ৭ মহাদেশের ব্যবধান। কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও সে উপযুক্ত হতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যেত কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের কোচ হিসেবে তাকে দেখতে পাওয়া যাবে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ মনে হয়। যদিও কিছুদিন আগে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম, শ্রীলংকার কোচ ফোর্ড চলে যাওয়ার পর হাথুরুকে তার স্থলাভিষিক্ত করার পরিকল্পনা চলছে, কিন্তু সেই জল্পনা আর বাস্তবে আসেনি।

হাথুরু সংক্রান্ত প্রেডিকশন:
শিংমাছ যেমন পিচ্ছিল, হাত থেকে ফসকে যায়, হাথুরুর ব্যাপারটাও হয়েছে তেমন। তাকে ধরার জন্য মুখিয়ে আছে দর্শকরা, কিন্তু কীভাবে যেন বাজি জিতে যাচ্ছে। শ্রীলংকা সফরে মাহমুদুল্লাহকে নিয়ে যে কাণ্ড ঘটলো, শততম টেস্টে ৪টি পরিবর্তন করে দল সাজানো হলো, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মমিনুলকে স্কোয়াড থেকে বাদ দিয়ে চাপের মুখে দলে নিতে বাধ্য হওয়া কিন্তু প্রথম টেস্টের একাদশে না রাখা, ২য় টেস্টে মমিনুলকে ৮ নম্বরে ব্যাট করানো, এসবকিছু কোনোটাই বড় হতে পারছে না বাংলাদেশ জিতে যাচ্ছে বলে। কিন্তু জুয়ার হেরে গেলেই হাথুরুর অবস্থান টালমাটাল হয়ে যাবে। সাউথ আফ্রিকা সিরিজ যদি জয়হীন কাটে, শ্রীলংকা সিরিজেও যদি একই অবস্থা হয় এবং ২০১৮ তেও সেই ধারা জারি থাকে, হাথুরু আসলেই বিপদে পড়ে যাবে। ২০১৯ বিশ্বকাপে মাশরাফি খেলবে কিনা সেটা নিশ্চিত নয়, সেক্ষেত্রে ২০১৯ এ দলের অধিনায়ক হবে সাকিব যার সাথে ক্যারিয়ারের শুরুতেই একটা বড় ঝামেলা বাঁধিয়েছে, এবং সাকিব যে ধরনের পারসোনালিটি ফিগার তার সাথে হাথুরুর কর্তৃত্ব কতটুকু খাটবে সেটাও একটা প্রশ্ন এবং জনরোষ তো আছেই। যদিও ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত হাথুরুর সাথে চুক্তি, কিন্তু আমি নিশ্চিত ২০১৮ এর সেপ্টেম্বরের আগেই হাথুরু অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। সেক্ষেত্রে বিসিবির উচিত এখনই নতুন কোচ সোর্সিংয়ে মনোনিবেশ করা, তার কর্মপরিধি ও জবাবদিহিতার জায়গা জোরালো করা, প্রয়োজনে শ্যাডো কোচ হিসেবে এখন থেকেই কাউকে মাথায় রাখা। নইলে ২০১৯ এর আগে যখন হুট করে কোচহীন অবস্থা আবিষ্কার করবেন, তখন কিন্তু সামাল দেয়া কষ্ট হয়ে পড়বে। ১ বছর আগেই বলে রাখলাম কথাটা, সময়মতো মিলিয়ে নিয়েন।

হাথুরু সংক্রান্ত কনক্লুসান:
ক্রিকেট বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেয়ার জন্য হাথুরু একজন আদর্শ অপশন, কিন্তু ………(বুঝে নিয়েন)