শুভ জন্মদিন আমার শোনা ক্ষ্যাত এবং মিনিংলেস একটি বাক্য, যা ন্যূনতম স্পার্কই তৈরি করে না। প্রতিটি জন্মই শুভ; কেউ কি বলতে পারবে অমুকের জন্ম অশুভ? কিংবা জন্মের উপর যদি কারো নিয়ন্ত্রণই না থাকে সেটার শুভ-অশুভ তাকে মনে করিয়ে দেয়ার কী আছে!
মানুষ মূলত তার কর্মফল দ্বারাই জীবন চালনা করে৷ সেই কর্মফলে ৩য় পক্ষের কন্ট্রিবিউশন স্কোপই বা কতটুকু! শুভকামনা জানানোর বাইরেও জন্মদিন আরো বর্ণিল এবং ব্যাপকবিস্তৃত কমপ্লিমেন্ট ডিজার্ভ করে। অন্তত মহাক্ষ্যাত ‘শুভ জন্মদিন’ এর চাইতে আলাদা কিছু তো বটেই।
কিন্তু জন্মদিন তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়, কারণ আমরা স্পার্ক বোধ করি না; সব স্পার্ক জমে থাকে ক্যামেরার লেন্সে।
বাল্যকাল থেকে জেনে আসছি ২৩ জুলাই মানেই বড় আপার জন্মদিন। যদি নিজে জন্মদিন বাছাইয়ের সুযোগ থাকত বড় আপা জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহকেই পছন্দ করতো, নাকি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর কিংবা ফেব্রুয়ারি-মার্চ?
নাকি ৪২ বছর ধরে একটা দিনকে জন্মক্ষণ জানতে জানতে এর বাইরে অন্য কিছু আর ভাবনাতেও আসে না?
জন্মদিন উৎসবটাও কি একসময় বিয়ের দাওয়াতের মতো ছকবদ্ধ হয়ে পড়ে? পোলাও-রোস্ট-বিফ/মাটন-কাবাব-জর্দা/ফিন্নি, শেষ বৈঠকে বোরহানি। উপহার হিসেবে ডিনার সেট অথবা নগদ অর্থ?
অনুরূপ জন্মদিনেও খুব সুন্দর একটা বার্তা পাওয়া, কেক কাটা, প্রিয়জনদের কেক খাইয়ে দেয়া, অধিক ঘনিষ্ঠদের থেকে আসা গিফট— সবটাই যেন স্ক্রিপ্ট মেনে আগানো। প্রতিটি জন্মদিনে আগেরটার চাইতে ভিন্ন কিছু ট্রাই করা, এত এনার্জি পাবে কোথায় মানুষ! প্রায়ই শুনি মানুষের নাকি মন ভালো নেই।
ধরা যাক ঘনিষ্ঠ কারো জন্মদিনে তাকে ঘিরে একটা ট্রিবিউট লিখলাম। ফি-বছর যদি নতুন ট্রিবিউট লিখতে হয়, তার মানে এই সময়ের মধ্যে তাকে পুনরাবিষ্কার করতে হবে। আন্তঃমানবিক মিথস্ক্রিয়াগুলো কি এতটা ডায়নামিক আদৌ? আমরা কারো সাথে ৫ বছরের বেশি মিশলেই তার ফাইল ক্লোজ করে দিই, তখন সবটাই চালিত হয় অভ্যাসবশত।
আবার তাকে এমন একটা গিফট দিলাম যা কেউ তাকে দেয়নি বা সহসা দিবেও না— এটাও কি প্রতিবছর চালিয়ে যাওয়ার জোশ বজায় থাকে। গত বছর লাল রঙা টি-শার্ট দিয়েছি, এবার তবে দিই পাঞ্জাবি, কিংবা গতবার ২ হাজার টাকা দিয়েছিলাম, এবার আড়াই—- এর মধ্যে স্পার্ক পাওয়া যায়? ব্যতিক্রমী গিফট দেয়ার জন্য সেই ব্যক্তির প্রতি এটাচমেন্ট বোধ করতে হয়, তাকে ওউন করতে হয়।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে ইনডিভিজুয়ালিজম নামের নবধর্মের যে প্রাদুর্ভাব সেখানে কাউকে গভীরভাবে ধারণ করার বাস্তবতা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ব্যক্তি হয় আনুগত্য দেখায়, অথবা সিমপ্যাথি— দুটোই সুপ্রিমেসির আরাধনা। তাই এটাচমেন্টও শেষ পর্যন্ত রূপ পায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্তৃক সত্যায়িত ডকুমেন্টে।
আমার সমগ্র শৈশব এবং কৈশোরের অর্ধাংশ পর্যন্ত আম্মু এবং বড় আপার সমস্ত কথায় হ্যাঁ বলতাম বিনা প্রশ্নে। কলেজে উঠবার পরে অনুধাবন করি হ্যাঁ খুবই জটিল রেসপন্স, কোনোকিছুতে হ্যাঁ বলা মানে সেই সময়ে আর যা যা অপশন থাকা সম্ভব সবকয়টিকে না বলে দেয়া। যেমন বিকাল ৫টায় কারো সাথে দেখা করার প্রস্তাবে হ্যাঁ বলা মানে, ওই সময়ে যা যা করতে পারতাম সবগুলোই বাতিল হয়ে যাওয়া। হ্যাঁ বলার ক্ষেত্রে অতি সিলেক্টিভ হওয়ার প্রথম প্রশিক্ষণই শুরু হয় আম্মুকে হ্যাঁ বলা থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু এত বয়সেও বড় আপার ক্ষেত্রে হ্যাঁ জারি রাখার চর্চা থেকে সরে আসা সম্ভব হয়নি। এতে উপকারের চাইতে সীমাবদ্ধতা বেড়েছে বেশি। তার সাথে মেলামেশায় সুপারক্রেজি মুডটা নিষ্ক্রিয় করে রাখি, যে কারণে আন্তরিকতার মুখস্থ টেম্পলেট এর বাইরে একদম raw কোনোকিছু ট্রাই করার চেষ্টা চেকপোস্টে ধরা খেয়ে যায় বারবার। কিছুক্ষেত্রে এটা আমার ব্যক্তিগত ধর্মের সাথে হয়ে উঠে সাংঘর্ষিক।
‘কানেক্টিভিটি’ নামের যে ধর্মের আমি অনুসারী তার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ রিচুয়াল মানুষকে আনইউজুয়াল উপহার দেয়া, এবং মেমরি ক্রিয়েট করা। এই রিচুয়ালের সর্বোচ্চ উপলক্ষ জন্মদিন। কারণ অন্যান্য সকল উপলক্ষ্যেই ব্যক্তি একা নয়, তার সাথে সম্পৃক্ত থাকে আরো স্টেকহোল্ডার। এটাই একমাত্র যেখানে সবটাই শুধু তার অধীনে৷
স্পার্ক বোধ করাটা এক্ষেত্রে প্রধানতম পূর্বশর্ত। যার প্রতি স্পার্কই কাজ করে না তাকে ভেবে কিছু লেখা বা এক্সক্লুসিভ উপহার চিন্তা করা, দুরূহ ব্যাপার।
কাদের প্রতি স্পার্ক বোধ করি সেই মানুষদের আছে এক সুদীর্ঘ তালিকা। স্পার্কের ক্ষেত্রে পারিবারিক-অপারিবারিক কোনো ইস্যুই নেই, একমাত্র বিবেচ্য- তার সংস্পর্শে গেলে কতটুকু কমফোর্ট বোধ করি। ডিগ্রি অব কমফোর্টেবিলিটির ভিত্তিতেই স্পার্কের পরিমাণে তারতম্য ঘটে।
আমার ৯০ শতাংশ স্পার্কই একপাক্ষিক, অর্থাৎ আমি নিজের নিয়মে ক্রেজিনেস চালিয়ে যাই, অপরপক্ষ থেকে সাড়া মেলে কদাচিৎ৷ বড় আপা সেইসব বিরল মানুষের অন্যতম যেখানে স্পার্কটা উভমুখী। বরং দুই পক্ষের স্পার্ক উদগীরণের এক্সটার্নাল অডিট চালালে আমি পরিমাণে এগিয়ে থাকবোই, এটা কনফিডেন্টলি বলার সাহস অপর্যাপ্ত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
জন্মদিন উদযাপনের চিরন্তন রেসিপি হলো আগের রাতে একটা কেক কিনে আনা, এবং ঘড়ির কাটা ১২টা পেরুলে সেটাকে দ্বিখণ্ডিত করা। এই রেসিপি বড় আপার জন্মদিনে ইতোপূর্বে প্রয়োগ করেছি বার কয়েক। উনিশ-তেইশের স্মৃতিতে নেই এই রেসিপির কোনো অনুলিপি৷ পক্ষান্তরে এবারই বড় আপা স্পর্শ করলো ৪২, তাই বোধ করলাম উনিশ-তেইশ এ সমপাতিত হওয়ার এটাই উৎকৃষ্ট লগ্ন। তাতে গিফট বা জন্মদিন সংক্রান্ত আমার ফিলোসফি প্রিম্যাচিউর দশায় থাকলেও মানুষকে সাময়িক আনন্দ দিতে ফিফটি বা সেঞ্চুরি না করেও অনেক সময় একটা দর্শনীয় স্ট্রেইট ড্রাইভও কার্যকরী হয়ে উঠে।
পরের জন্মদিন অবধি বড় আপার জীবনে বিপর্যয়ের সংখ্যা সহনীয় মাত্রায় থাকুক, এবং অন্তত ২টা তীব্র উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ্য তৈরি হোক— সেই প্রার্থনার জন্যও কি নেগোশিয়েশনের দরকার, নাকি চাওয়াটা লিমিটের মধ্যেই থাকছে?
Let’s toss!