আমার জীবনের সর্বাধিক আনন্দদায়ক মুহূর্ত কোনটি?
– ২০১০ এর ২৫ অক্টোবর বুয়েট অডিটরিয়ামে আমার নির্মিত টেলিফিল্ম ‘একদা একসময়’ এর প্রদর্শনী৷ অডিটরিয়াম ভরতি দর্শক আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছে, শো শেষে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে অবিরল। এই অনুভূতি আজীবনের আর্কাইভ।
সবচাইতে মর্মবিদারক অধ্যায় ?
-২০১৮ এর ২৫ এপ্রিল ‘অন্যরকম গ্রুপ অব কোম্পানি’ র ক্রিয়েটিভ কনসালটেন্ট পদ থেকে অবসর/অব্যাহতি/ইস্তফা গ্রহণ। মাত্র ২৩ বয়সে শুরু হয়েছিল যে জার্নি, ৯ বছরের কাছাকাছি সময়ে থেমে গেল। অন্যরকম গ্রুপ নামটা অপরিচিত। তবে রকমারি ডট কম, উদ্ভাস, উন্মেষ, বিজ্ঞানবাক্স, পাই ল্যাবস, টেকশপ নামগুলো স্বতন্ত্রভাবে যথেষ্ট পরিচিত। মিস করার অনুভূতি আমার নেই বললেই চলে, তবু ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট পদ থেকে সরে আসাটা আমার জন্য ছিল শোচনীয়তম মানবিক বিপর্যয়।
সবচাইতে আনন্দদায়ক এবং বেদনাদায়ক উভয় অনুভূতির সাথেই মাহমুদুল হাসান তথা সোহাগ ভাই এমন নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত যে, তার ইমপ্যাক্টকে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা দুঃসাধ্য।
তার সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছে ২০১৮ এর ৩ মে, অর্থাৎ কেটে গেছে ৪ বছর যোগাযোগহীনতায়, এবং আমাদের সম্পর্কের বর্তমান যে ডায়নামিক্স তাতে ৪ এর ডান বা বামে ডিজিট যুক্ত হয়ে বিরতির দৈর্ঘ্যই বাড়াবে সম্ভবত।
তবু সোহাগ ভাইকে স্মরণ করেই লিখতে হচ্ছে দীর্ঘ লাইন। কারণ ঘনিষ্ঠ মানুষ মাত্রই আমার ’41fantasy’ সম্বন্ধে অবগত, এবং ৭ জুন সোহাগ ভাইয়ের ৪১তম জন্মদিন।
প্রস্থানের জাগতিক নিয়মে কে কখন নেমে পড়ে ব্যক্তিগত গন্তব্যে জানার সুযোগ তো নেই, তখন যেন আফসোস না করতে হয় সোহাগ ভাইয়ের ৪১ তম টার্মিনাল স্পর্শে ছিলাম নির্বিকার। ফিলিস্তিন-ইসরাইল ও বিশেষ দিনে অস্ত্রবিরতি রাখে, সে তুলনায় আমাদের মধ্যকার সম্পর্কটা অনেক বেশি আত্মিকতার জায়গায় ছিল একটা সময় পর্যন্ত; ইগো আর দূরত্ব মাঝেমধ্যে নির্বাসনেই যদি না গেল মানুষ হওয়ার মাজেজাটা থাকলো কোথায়। এজন্যই মহিষ এত পছন্দ, মহিষ ইগোতে ভুগে না, প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে৷
এ জীবনে উপার্জন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব সোহাগ ভাইয়ের, আমার ক্রেজি এবং উইয়ার্ড কাজ-কর্মের পেছনে ফ্লেক্সিবল শর্তে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার বিনিয়োগ ছিল, সেখান থেকেই মূলত গড়ে উঠেছে কাল্ট ফিগার ব্যক্তিসত্তা, নির্মিত হয়েছে নিজস্ব পোর্টফোলিও।
আবার আমি যে এতটা বয়সেও স্টেবেলিটি পেলাম না সেখানেও দায় তাকেই নিতে হবে। কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টেই যদি কারো সময়ের সিংহভাগ খরচ হয় তার গ্রোথ কীভাবে সম্ভব?
মহাভারতের অর্জুন বৈশ্বিক মানদন্ডে চিন্তা করতে ব্যর্থ হত যদি না বারো বছরের জন্য নির্বাসন নিত। আপাতদৃষ্টিতে নির্বাসনটা কষ্টকর হলেও অর্জুনের নিজের সমৃদ্ধিতে, পরের লেয়ারে উত্তীর্ণের ক্ষেত্রে এটাই ছিল উৎকৃষ্ট সিদ্ধান্ত।
সোহাগ ভাইয়ের নেটওয়ার্ক থেকে বিযুক্ত হওয়াটা অনিবার্যই ছিল। বড় গাছের নিচে থাকলে বনসাই হয়েই বাঁচতে হয়। তাছাড়া একই পরিবেশে থাকলে ভিন্ন কালচার, ভিন্ন চিন্তাধারার সাথে পরিচয় গড়ে উঠবে কীভাবে?
তাই প্রস্থানে খুশি ছিলাম, তবে প্রস্থানের প্রক্রিয়াটা স্পোর্টিং হয়নি, এক্ষেত্রে ৭৯% দোষ আমারই।
আজ এতবছর পরে পিছন ফিরে দেখি, ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট হিসেবে আমার যদি থাকত আলাদা অফিস, তারপর সোহাগ ভাইয়ের সাথে সুনির্দিষ্ট প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতাম, অভ্যন্তরীণ কোনো ইস্যুতে মতামত দেয়া থেকে বিরত রাখতাম নিজেকে, যেমনটা এখন করি বিভিন্ন অর্গানাইজেশনের সাথে, তাহলে আমার বর্তমান ক্লায়েন্ট লিস্টে রকমারি বা বিজ্ঞানবাক্স এরও নাম থাকত এতদিনে।
কিন্তু সোহাগ ভাইয়ের সাথে সম্পর্কটা যে স্তরে উপনীত হয়েছিল সেখানে সংস্রবহীন থার্ড পার্টি মডেলে কাজ করার চিন্তাটা সেই সময়ের বাস্তবতায় ছিল অসম্ভব।
সোহাগ ভাইকেও যদি শুরুর প্রশ্ন দুটো করা হয় সামান্য পরিমার্জিত ভাষায়, অর্থাৎ সবচাইতের জায়গায় ‘অন্যতম’ অব্যয়টি ব্যবহৃত হয়, নিশ্চিতভাবে সেখানে আমার অন্তর্ভুক্তি থাকবে।
যেমন সোহাগ ভাইকে একবার কেউ একজন জিজ্ঞাসা করেছিল স্মরণীয়তম জন্মদিন কোনটা, সে ২০১২ এর জন্মদিন উল্লেখ করেছিল। উদ্ভাসে এডমিশন মৌসুম চলছে৷ ছাত্রলীগ কর্মীরা বাড়তি ডিসকাউন্টের জন্য কোনো এক ব্রাঞ্চে গিয়ে গণ্ডগোল বাঁধায়, ফোনে অকথ্য গালিগালাজ করে তাকে৷ তার মনে হয় এমন একটা বিজনেস করি যেখানে জন্মদিনেও নোংরামি থেকে বাঁচা গেল না। ততক্ষণে জনৈক ছোটভাই ফেসবুক নোটস এ ইভেন্ট আয়োজন করেছে ‘সোহাগ ভাই সমীপে ১৭ মিনিট’ শিরোনামে, যেখানে পরিচিতরা ১৭ মিনিট সময় নিয়ে তার সম্পর্কে লিখবে। সেইসব মন্তব্য তাকে উদ্দীপ্ত করেছিল।
ছোট ভাইয়ের নাম হিমালয়!
দুঃখদায়ক অনুভূতির তালিকাতেও আমার অনেকগুলো এন্ট্রি থাকার কথা। আমার অনবরত নেগেটিভ ইমেইল, আমার ভূমিকা নিয়ে ব্যবসায়িক পার্টনার আর সিনিয়র টিম মেম্বারদের সাথে ক্রমাগত মতানৈক্য, এবং সবশেষ আমার বায়োফিকশন নামহীন বইতে তার কোম্পানি এবং তাকে ঘিরে যেসব ফ্যাক্ট লিখেছি— এগুলো অস্বস্তির বাইরে বেদনাদায়ক বটে।
তাই সোহাগ ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা সাংঘাতিক প্যারাডক্সিকাল। যখন তার প্রশংসা করি সেখানে আমার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার মতো থাকে না, সমালোচনা শুরু করলে মার্কেটে তাকে ঘিরে যেসব নিন্দা বা সমালোচনা প্রচলিত সেগুলোকেও ছাপিয়ে চলে যাই বহুদূরে৷
তবে মার্কেটে তাকে নিয়ে যেসব সমালোচনা প্রচলিত তার ৯৭% ই প্রোপাগাণ্ডা এটা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, যদি না ২০১৮ এর পরে তার ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্টেশন ঘটে থাকে। তার সমালোচনার এত বেশি জেনুইন গ্রাউন্ড রয়েছে সেগুলোর জন্যও তার শুভ্রতা প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। আমি খুবই ব্যথিত যে, এত বছরেও তার জেনুইন ক্রিটিক দেখলাম না কাউকে; অন্ধ ভক্ত অথবা প্রোপাগাণ্ডা মেশিন নিন্দুক।
অথচ বাংলাদেশের বাস্তবতায় সোহাগ ভাইয়ের সোস্যাল ইমপ্যাক্ট সমকালীন যে কারো সাথেই আলোচনাযোগ্য। তাকে নিয়ে লেখা উচিত চিন্তাগ্রাফি অথবা বায়োফিকশন। ২০১৮ তে উদ্যোগ নিয়ে বেশ কিছুদূর কাজ এগিয়ে নিয়েছিলামও, তারপরই ২৫ এপ্রিলের কালসন্ধ্যা এবং আমার অকালপ্রয়াণ। মৃত্যু ব্যাপারটাকে আমি শারীরিক এর চাইতে আধ্যাত্মিক এসেন্স দিয়ে অনুভব করি। আমি মৃত্যুকে দেখি স্থায়ী এবসেন্স এর মেটাফররূপে। সোহাগ ভাইয়ের সাথে আমার যে সংযোগ সেখানে যে শূন্যতা তা চিরস্থায়ী। দৈবক্রমে যদি আগামীতে পুনঃসংযোগ গড়েও উঠে সেই আমি, সেই সোহাগ ভাই দুজনই ভিন্ন সত্তার কেউ। ২০১০ থেকে ১৬ সাল পর্যন্ত সেই সংযোগের সাথে সেটা হবে না তুলনাযোগ্য। এজন্যই ‘অকালপ্রয়াণ’ শব্দটার ব্যবহার।
তবু 41 Fantasy এর তীক্ষ্মতা এত বেশি, কল্পনা করতে ইচ্ছা জাগে যদি ৭ জুন ২০১৬ তে সোহাগ ভাই পদার্পণ করত ৪১ এ, কী ধরনের উদ্যোগ নিতাম?
সোহাগ ভাইয়ের পরিবার, বন্ধু, শিক্ষক, কলিগ মিলে ৪১ জন মানুষের তালিকা বানাতাম। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪ মিনিট ১০ সেকেন্ডের ভিডিও বার্তা সংগ্রহ করতাম।
সোহাগ ভাইয়ের বায়োগ্রাফিকে ভিত্তি ধরে ৪১ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করতাম।
সোহাগ ভাইয়ের একটা ইন্টারভিউ নিতাম, সেখানে তার জীবনের ৪১টি সিগনিফিক্যান্ট ব্যর্থতা সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করতাম।
রকমারি ডট কম থেকে ৪১ জন রেন্ডম ক্রেতাকে ৪১টি বই উপহার দিতাম নিজ উদ্যোগে, এবং সারাদিন ৪১% ডিসকাউন্ট থাকতো সকল ক্রেতার জন্য।
উদ্ভাসের ২০০২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ইন্টার ব্যাচ মিলিয়ে ৪১ জন শিক্ষার্থী বাছাই করে তাদের কাছ থেকে ৪১ লাইনের চিঠি সংগ্রহ করতাম।
আমার পরিচালিত ক্রিকেট টিম, পিঁপড়া টিম এবং সাইকো টিম মিলিয়ে ৪১ জনকে দায়িত্ব দিতাম ৪১ পদের উপহারসামগ্রী নিয়ে দুপুর ১১ টা ৪১ এ তার অফিসে পৌঁছে সারিবদ্ধভাবে তাকে উপহার দেয়া।
এবং সমগ্র প্রোগ্রামের নাম দিতাম ’41 image carnival’!
একটা থিমসং লিখে ফেলতাম ’41’ বিষয়ে।
আমাকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনে না এই আয়োজন তাদের কাছে অতিরঞ্জিত, অবাস্তব এবং চাপাবাজি মনে হতে বাধ্য।
কিন্তু আমার সাথে নিবিড় উঠাবসা আছে এবং 41 fantacy সম্বন্ধে অবগত এমন যে কাউকে জিজ্ঞেস করুন, বা স্বয়ং সোহাগ ভাইয়ের কাছে যান, একটাই উত্তর পাবেন- ‘হিমালয় এরকম করে বলেই তো হিমালয়, অবিশ্বাসের কী আছে!’
ছোটবেলায় Exclamatory Sentence এর উদাহরণ বলতেই আসত- Alas! I am undone. সোহাগ ভাইকে নিয়ে লেখায় বহুবছর বাদে সেই আপ্তবাক্যটিই মনে পড়ে গেল। কী কী করতাম ভাবতে গিয়ে যখনই উত্তেজনায় টগবগে ফুটছি তখনই মনে পড়লো সালটা ২০২২ এবং আমি আর কোথাও নেই, এই আমি বয়ে বেড়াচ্ছি পূর্বজন্মের ফসিল!
হায় সোহাগ ভাই!
৯ বছরে সোহাগ ভাইয়ের ২১টা ইন্টারভিউ নিয়েছি, ইমেইল লিখেছিলাম ৮৩৫টা; জানি না পরের ৪ বছরে পপুলিস্ট প্রশ্নের বাইরে অরিজিনাল প্রশ্নে ইন্টারভিউ দেয়ার সুযোগ তার কয়টা হয়েছে, কিংবা তার আইডিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ আদৌ আছে কিনা আশপাশে, নাকি সবাই ভাইয়া ভাইয়া আর মোটিভেশনাল স্পিকার এর ঘেরাটপে তাকে বানিয়েছে বিমর্ষ সিসিফাস। গত ৪ বছরে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আর ভঙ্গুরতায় এত বেশি খাবি খাই সোহাগ ভাইকে নিয়ে গবেষণায় নেই আর নতুন অগ্রগতি। গবেষণার ক্যারেক্টার না পেলে মুষড়ে পড়ি। আমাকে সতেজ রাখার দায়িত্ব নিয়েছে ক্রিকেটার লিটন দাস আর স্টোরিটেলার সারাফান সাহুরা৷
তবু এইসব গবেষণার উচ্চস্তরে গিয়ে সোহাগ, লিটন আর সারাফান কোথায় যেন একীভূত হয়ে যায়।
41 উৎসবে স্বাগত সোহাগ ভাই। দুঃখগুলো মুছে ফেলেছি, আনন্দগুলোর স্কেচ একে টাঙিয়ে দিয়েছি দেয়ালে দেয়ালে। দেয়ালের অন্যপ্রান্তে আবার কখনো দেখা বা কথা হতেই পারে ভিন্ন ফিলোসফিকাল কনটেক্সট এ। বড় আপার পরে আপনিই ছিলেন একমাত্র মানুষ যাকে শিক্ষক গণ্য করতাম। দ্রোণাচার্যের সাথে এমনকি কুরুক্ষেত্রেও যুদ্ধ হয়নি অর্জুনের, আজও হবে না, যতই তারা থাকুক প্রতিপক্ষ শিবিরে, এবং হোক একে অপরের অনিষ্টের বড় কারণ। অশ্বত্থামা হত ইতি গজ বলার জন্য যুধিষ্ঠিররা সর্বযুগেই ফিরে ফিরে আসে।
জার্নি উপভোগ্য থাকুক।