১. মিডিয়া আসলে কতটা শক্তিশালী?
২.পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী প্রোডাক্টের নাম তথ্য, এ ব্যাপারে আপনি কতটুকু দ্বিমত?
৩.বাংলাদেশের নাটক, সিনেমা, মিউজিক, সাহিত্য— অর্থাৎ বিনোদন মাধ্যমের কোনোটাই এক্সিলেন্স লেভেলের সর্বোচ্চতে প্রতিনিধিত্ব করে না, এরা বড্ড স্থানিক। বিনোদনের বিকাশে আমরা কূপমণ্ডুকতায় আচ্ছন্ন। ক্রিকেটই একমাত্র বিনোদন মাধ্যম যেখানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশের বিচরণ এবং পরিচিতি রয়েছে। ১৫ বছর আগেও ক্রিকেটকে আমরা বিনোদন হিসেবেই দেখতাম, স্পোর্টস যে ন্যাশনালিজমের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এটা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী অনুভব করে, তাহলে ফুটবলে সেটা নেই কেন? আমাদের দেশের ফুটবলপ্রেমিরা ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা নিয়ে যেমন উত্তেজনা দেখায়, তার সাথে তো জাতীয়তাবাদের কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু মাত্র এক দশকে ক্রিকেট দেশপ্রেম হয়ে গেল কীভাবে; কেন ফুটবল বা হকি নয়?
যেহেতু ক্রিকেট ছাড়া আরো কোনো বিনোদন মাধ্যমে আমরা ঘরের চৌকাঠ পার হতে পারিনি বা বিচ্ছিন্ন ২-১টা উদাহরণ ব্যতিত পার হতেও পারি না, তাই বিনোদন মিডিয়ায় ক্রিকেটকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আকাশচুম্বী উচ্চতায়।
বাংলাদেশী সিনেমার সুপারস্টার শাকিব খান, নাটকের মোশাররফ করিম/চঞ্চল চৌধুরী, মিউজিকের জেমস। ধরা যাক আপনি একটি বড়ো কোম্পানী চালান,ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে সেলিব্রিটি কাউকে মনোনীত করতে চান। বিনোদন জগতের এইসব সুপারস্টারের চাইতে আপনার আগ্রহ জাতীয় দলের জনপ্রিয় কোনো ক্রিকেটারের প্রতি। হতে পারে সেটা মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ, তামিম। তাতেই যে টাকা খরচ হবে সেটা অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমের সেলিব্রিটিদের তুলনায় বেশি। আর যদি সাকিব বা মাশরাফিকে নিতে চান সেই খরচের হিসাব না তোলাই ভালো।
কিন্তু প্রমীলা ক্রিকেটার বা জাতীয় ফুটবল দলের কাউকে অনেক কম টাকায় এম্বাসেডর বানানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আপনি সেপথে হাঁটবেন না, যেহেতু তাদের জনপ্রিয়তা নেই।
বিনোদন মিডিয়ার ভূমিকা কী? তারা প্রথমে আপনার হাতে কেরোসিন আর ম্যাচের কাঠি তুলে দিয়ে আগুন জ্বালাতে উস্কানি দিবে, তারপর ফায়ারব্রিগেডে খবর দিয়ে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করবে, এবং সবশেষে আপনি এবং ফায়ারব্রিগেডে দুপক্ষকেই ভিলেন বানিয়ে আগুন নেভানো পণ্যের বিজ্ঞাপন করবে।
কঠিন হয়ে গেল?
ঠিক আছে, গরুর উদাহরণ দিই। প্রথমে সে আপনার কাছে গরুকে হাতি হিসেবে বিক্রি করবে। আপনাকে প্রতিনিয়ত বিশ্বাস করাবে আপনি হাতি কিনেছেন, সুতরাং হাতির যত্ন নিন। তারপর যখন গরুর বেপারির সাথে স্বার্থের সংঘাত বাঁধবে তারপর আপনাকে উত্তেজিত করে তুলবে, গরুর বেপারির চাইতে নিকৃষ্ট বাটপার ২য়টি হয় না, তারা আপনার কাছে জরাজীর্ণ এক গরু গছিয়ে দিয়েছে হাতি হিসেবে; এই অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ বেপারিকে বর্জন করুন।
এ সংক্রান্ত সবচাইতে টাটকা উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হেড কোচ স্টিভ রোডসকে অপসারণের খবরটি।
স্টিভ রোডস কোচ হিসেবে কাউন্টি দলে চলতে পারে, একটি রাইজিং দলে কখনোই নয়, সে কোনো গেমপ্ল্যান দিতে পারে না, খেলোয়াড়রা তাকে মানে না, কম্পিউটার এনালিস্ট খেলোয়াড়দের ব্রিফ করে, তার চিন্তা-ভাবনা ওল্ড স্কুল ঘরানার, আয়ারল্যান্ড সফরের সময় থেকেই বিসিবি তার প্রতি নাখোশ, দল জিতলেও তাতে কোচের ভূমিকা সামান্য, একমাত্র বাংলাদেশ সেমিতে উঠলেই সে টিকে যেতে পারে, অবশ্য সেখানেও যদি কোচের পর্যাপ্ত ভূমিকা পাওয়া যায়।—- চিন্তা করে দেখুন তো এই কথাগুলো আপনি কোথায় পেয়েছেন? বিশ্বকাপ চলাকালে প্রথম আলোর রিপোর্টে। তার মানে কোচ নিয়ে বিসিবি বেশ কিছুদিন ধরেই অস্বস্তিতে ছিল, তার সাথে চুক্তির একটি ধারা ছিল, বিশ্বকাপের পরে পারফরম্যান্স রিভিউ হবে।
প্রথম আলোর সেই রিপোর্টের মূল বক্তব্য- কোচের যোগ্যতা নেই, বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপে খারাপ করছে এর প্রধান দায় কোচের। এবং তাদের বক্তব্যের সোর্স- বোর্ডের কোনো কর্মকর্তা যিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন, কিংবা জাতীয় দলের সিনিয়র ক্রিকেটার, সেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
সুতরাং বিশ্বকাপ চলাকালে কোচের পক্ষে-বিপক্ষে দুটো দল তৈরি হয়ে গেল।
বিশ্বকাপ শেষে রোডস দেশে ফিরেছিলেন মূলত জবাবদিহি মূলক আলোচনার উদ্দেশ্যেই (এটাও আমরা জানতে পারি কালের কণ্ঠের অনলাইন ভারসন মারফত)
অনুমিতভাবেই রোডসকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু পরদিনই ভোল পাল্টে ফেলেছে প্রথম আলো। গতকাল তারা রিপোর্ট লিখলো ‘স্টিভ রোডসের এ কেমন বিদায়’! সেখানে তাকে দেখানো হলো একজন আদর্শ অভিভাবক হিসেবে, যিনি খেলোয়াড়দের নির্ভার হয়ে খেলার সাহস দেন। কম্পিউটার এনালিস্ট বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে কোচের চাহিদা আর নির্দেশনা অনুসারে, সুতরাং এটা কোচেরই কৃতিত্ব। গেমপ্ল্যান যে কম্পিউটার এনালিস্ট ব্রিফ করতো এর কারণ রোডসের ব্রিটিশ একসেন্ট বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটারেরই বুঝতে সমস্যা হয়, ভারতীয় এনালিস্টের হিন্দিতে বলা ব্রিফিং সহজেই বুঝে যায়, তার সাথে খেলোয়াড়রা কথাও বলে হিন্দিতে। পরে যোগ হলো, সাকিব আল হাসান রোডসের কোচিং দর্শনের অনুরাগী। এবং সবশেষ বক্তব্য হলো, বাংলাদেশে কোনো কোচই দীর্ঘস্থায়ী হয় না, এটা কোচিং সংস্কৃতি নিয়ে যে নেতিবাচক ইমপ্রেসন বাংলাদেশের, তা যেন আরো দৃঢ় হলো।
এবার ভিলেন কে? বিসিবি এবং এর সভাপতি; কোচ অত্যন্ত সফল। তার আমলে এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেছি, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দেশে-দেশের বাইরে হারিয়েছি, জিম্বাবুইয়েকে হারিয়েছি, আয়ারল্যান্ড টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ( যদিও এটা বলে না ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে ৪৩ রানে অল আউট হয়ে ২ টেস্টেই হেরেছি, দেশের মাটিতে দুর্বল জিম্বাবুইয়ের কাছে টেস্ট হেরেছি, নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ হয়েছি, আড়াই দিনে টেস্ট হেরেছি)
এমন দুমুখো সাপ রিপোর্টিংয়ের পরে গতকালই বিসিবি সভাপতি গাজী টিভিকে জানান, রোডস এখনই যাচ্ছেন না, তার ব্যাপারে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হবে। (যদিও রোডস আজই চলে যাচ্ছে)
প্রথম আলোর এই দুই পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট জার্নালিজমের কোন এথিক্স মান্য করে জানার খুব ইচ্ছা। রোডসকে নিয়ে প্রথম যখন রিপোর্টটা করা হলো, তখন কি এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মাথায় ছিলো না, তখন কেন লেখা হলো না? এবং গতকালই প্রথম আলোর খেলার পাতায় এক কোনে সংবাদ এসেছে ‘ অনুশীলনে ফিরলেন তামিম’!
আগের দুই রিপোর্ট এবং তামিমের সংবাদ– এগুলো পরস্পর সংযুক্ত। ডটগুলো যোগ করলেই পাওয়া যাবে, মিডিয়া সবসময়ই ক্রিকেটার বা সেলিব্রিটিকে নায়ক বানানোর এজেন্ডায় থাকে। নায়ক মূল্যহীন যদি জাঁদরেল ভিলেন না থাকে। তাই বেশিরভাগ সময় বিসিবি আর মাঝেমধ্যে কোচকে রাখতে হয় ভিলেনের ভূমিকায়।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বাজে খেলছিল, এর প্রধান দায় মাশরাফি আর তামিমের। সেটাকে আড়াল করতে কোচকে ভিলেন বানিয়ে দাও, সাইফুদ্দিনের ইনজুরি নিয়ে মকশো করো, তারকা ক্রিকেটাররা বেঁচে যাবে।
বিশ্বকাপ শেষ, কোচিং স্টাফ বরখাস্ত, এবার কোপ পড়তে পারে তারকা ক্রিকেটারদের উপর। সুতরাং কপিল দেব, ইয়ান বিশপ, সুনীল গাভাস্কারদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নাও বাংলাদেশ দারুণ উন্নতি করেছে, সাকিব গ্রেট ক্রিকেটার, এরপর মাশরাফির জন্য বিদায়ী সিরিজের আয়োজন নিয়ে রিপোর্ট করতে থাকো, তারপর তামিমের ইন্টারভিউ নাও, অনুশীলনের খবর ছাপাও; তাতেও শেষরক্ষা হবে না। সুতরাং চিরাচরিত অব্যর্থ ফরমুলা, বিসিবিকে ভিলেন বানাও।
বিসিবি রোডসের রিপোর্টের পর সতর্ক হয়ে যাবে। তারা তামিমের দিকে নজর দিতে গেলেই গত ৪ বছরে তার ব্যাটিং গড় চলে আসবে, গাপ্টিল-গেইলরা বিশ্বকাপে কেমন বিবর্ণ সেই রেফারেন্স চলে আসবে, সেই সাথে বিকল্প ওপেনার হিসেবে লিটন, সৌম্য কেমন অধারাবাহিক, বাইরে ইমরুল ছাড়া কেউ নেই সেসব খবরও চলে আসবে। আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন তামিমকে রিপ্লেস করার মতো ক্রিকেটার নেই, পাইপলাইনে কোনো ক্রিকেটার নেই, বিগ ফাইভ অবসরে গেলে বাংলাদেশ ভূটানের বিপক্ষেও ৫ উইকেটে হারবে ( আফগানিস্তান ‘এ’ দলের বিপক্ষে এই প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর ক্ষেত্রে রুচিবর্ধক ভিটামিনের কাজ করেছে)২০২৩ সালে বর্তমান বিগ ফোরের প্রত্যেকের বয়স হবে ৩৫-৩৬, (আসল বয়স আরো ২-৩ বেশি হবে)। ধোনির চাইতে ফিট ক্রিকেটার কতজন দেখেছেন এই জীবনে? সেই ধোনিও বয়সের কারণে রিফ্লেক্স হারিয়ে স্ট্রাগল করলো। আমাদের তথাকথিত বিগ ফোরের কার ফিটনেস এখনকার শেষ বেলার ধোনির চাইতে ভালো? ৪ বছর পরে এদের কী অবস্থা হবে অনুমান করুন। বিশ্বকাপে কোনো দলের একাদশে যদি ৪ জন ৩৫+ ক্রিকেটার থাকে, তাদের পারফরম্যান্স কেমন হয় একটু অতীত স্ট্যাটিসটিক্স দেখে নিয়েন। সেখান থেকে ভুল ইনসাইট পাবেন। তার চাইতে ২০১০ এর পরে যে ৩টি আসর হলো সেখানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর খেলোয়াড়দের বয়সের ডেটা নিয়ে দেখুন তো কোনো দলে ৪ জন ৩৫+ ক্রিকেটার ছিলো কিনা?
কেন থাকে না, এটা নিয়ে চিন্তা করলেই হয়।
আগামী দেড়-দুই বছরে তামিম-মাহমুদুল্লাহ-মুশফিক যদি একটানা ৫-৬টা সিরিজ অবিশ্বাস্য পর্যায়ের খারাপ না খেলে ( ২০ এর ঘরে রান) তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন, ২০২৩ বিশ্বকাপের একাদশেও আপনি তাদের দেখতে পাবেন। সাকিব হয়তোবা ক্যারিয়ার লম্বা করতে তার আগেই ৩ ফরম্যাটের কোনো একটা থেকে অবসর নিয়ে নিবে ( আমার ধারণা সেটা টেস্ট ক্রিকেট)।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, মিডিয়া সেলিব্রিটিদের মহানায়ক কেন বানায়?
মানুষের আগ্রহ এবং ফ্যান্টাসি কাজ করে বলে। একটা ইন্টারেস্টিং কেইস নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বলুন তো, বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচাইতে পরিচিত কে- দুজনের নাম আসবে; মুস্তাফিজ আর মেহেদী হাসান মিরাজ। মুস্তাফিজ অনেকটা একা হাতে ভারতকে হারিয়ে দিয়েছে, আইপিএলে ভালো করেছে, অন্যতম ফাস্টেট গতিতে ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট পেয়েছে; সে একজন ম্যাচ উইনার; তাকে নিয়ে লেখা হতেই পারে। কিন্তু যেহেতু সে ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির, মিডিয়াকে খুব বেশি আমল দেয় না, তার এক্সপোজার হয়তোবা প্রাপ্যের চাইতে কম।
কিন্তু মেহেদী মিরাজ ৩৫ টা ওয়ানডে খেলে কী এমন করেছে যে তাকে ভবিষ্যতের অধিনায়ক ভাবা হচ্ছে, সে টি২০ দলেও সুযোগ পেয়ে যায়?
আপনি তাকে দেখছেন কীভাবে? সে দলের অন্যতম সেরা ফিল্ডার, মাঠে ১০০% এফোর্ট দেয়, ইকোনমি রেট ভালো, সে ভবিষ্যতের সাকিব।
আপনার মধ্যে এসব পারসেপশন এলো কীভাবে? টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর প্রধানমন্ত্রী তাকে বাড়ি উপহার দেয়ার ঘোষণা দেন, দেশের মাটিতে টেস্টে সে যথেষ্ট ইফেক্টিভ। কিন্তু বিদেশের মাটিতে বোলিংয়ে ২৫০ রান দেয়াও আপনার নজরে আনা হয় না, এবং এটাও আপনাকে জানানো হয় না টেস্ট আর ওয়ানডে পুরোপুরি আলাদা খেলা। একজন স্পিনার যদি উইকেট টেকার না হয়ে রান আটকানো বোলার হয় এর চাইতে অভিশাপের কিছু হয় না। রান আটকালে উইকেট পাওয়া যাবে না একথা কোথায় লেখা আছে? এমনকি ওয়েস্ট ইন্ডিজের এশলে নার্সও উইকেট টেকিং বোলার।
তবু মিরাজ আপনার দৃষ্টিতে পটেনশিয়াল ক্রিকেটার, কারণ মিডিয়াতে তার সমর্থন আছে। তেমন কোনো পারফরম্যান্স ছাড়াই সে মিডিয়ার আনুকূল্য পেল কীভাবে? সে দলের সিনিয়রদের সাথে লিয়াজোঁ রক্ষা করে চলে।
পক্ষান্তরে সৌম্য সরকার ৫২ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ৮ টা ম্যাচ জয়ে সরাসরি কন্ট্রিবিউট করেছে ( পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩য় ওয়ানডে-২০১৫, সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ২য়, ৩য় ওয়ানডে- ২০১৫, জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৩য় ওয়ানডে- ২০১৮, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩য় ওয়ানডে-২০১৮, আয়ারল্যান্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩ ওয়ানডে- ২০১৯), ২০১৬-২০১৭ তে টানা বাজে খেলার পরও ব্যাটিং গড় ৩৫ এর উপরে, স্ট্রাইক রেট ১০০, ম্যাচ জয় কন্ট্রিবিউশন অনুপাত ৬.৫, যা বাংলাদেশের যে কোনো ক্রিকেটারের চাইতে অনেক বেশি।
এবার আসা যাক লিটন দাস প্রসঙ্গে। যদিও ২০১৫ তে ভারত সিরিজে তার অভিষেক হয়েছিল, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তার উত্থান মূলত ২০১৮ এর টি২০ নিদহাস ট্রফি থেকে। কিন্তু সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে সে টেস্টে ফিফটি করেছে, শ্রীলংকার বিপক্ষে ৯৪ করেছে, সাউথ আফ্রিকার মাটিতে ৭০, ভারতের বিপক্ষে ফিফটি– ওয়ানডে বা টি২০ তে নিয়মিত হওয়ার আগেই ব্যাটিং ক্যালিবার সে দেখিয়েছে। নিদহাস ট্রফিতে শ্রীলংকার ২১৫ চেজ করে জেতার প্রথম বিপ্লব এসেছিল তার মাধ্যমে। এরপর দুটি টি২০ সিরিজ খেলা হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।।সেখানে ৩টি কার্যকরী ইনিংস।
এশিয়া কাপের আসর থেকেই মূলত তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার সচল হয়। এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে সেঞ্চুরি দিয়েই বোঝা গেছে বড়ো ম্যাচে সে নার্ভ শক্ত রাখতে পারে। তার আগের ৪টি ইনিংসে একটি ৪০+ রান ছিল, পরের ৬ ইনিংসে একটি ৮৩, একটি ৪০+, মানে ওয়ানডের জন্য সে প্রস্তুত হচ্ছে। কিন্তু সেই ইঙ্গিত আমরা ভুলে গেলাম নিউজিল্যান্ড সফরে ৩টি ১ করার দরুণ। সেই সিরিজে তামিম ইকবাল ৩ ম্যাচে ৫,৫,০ করেছিল। প্রথম আলোতে রিপোর্ট এসেছিল তামিম বেঁচে যাচ্ছেন অতীত পারফরম্যান্সের কারণে, কিন্তু লিটনের সেই সুযোগ নেই।
ক্রিকেট টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের খেলা, সৌম্য-লিটন দুজনই ম্যাচ উইনিং সামর্থ্যে ওয়ানডে-টি২০ বিবেচনায় মিরাজের চাইতে ১০০ গুণ এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও আমাদের মিডিয়া তাদের সামর্থ্যের চাইতে অধারাবাহিকতাকেই বড়ো করে দেখবে, তাদের প্রমোট করবে না। কারণ তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। প্রথম আলো বা অন্যান্য মূল ধারার মিডিয়ায় পাকিস্তানের আফ্রিদি, ওয়াসিম আকরাম বা ভারতের আজহারউদ্দিনকে এতো প্রমোট কেন করতো? শুধুই কি খেলোয়াড়ি দক্ষতা, নাকি মুসলমান হওয়াটা বড়ো কারণ? এদেশের সিংহভাগ মুসলিম পরিবার যতটা ইসলামপ্রিয় তার চাইতে অনেক বেশি হিন্দুবিদ্বেষী। যে কারণে তামিম বা মুশফিক বাজে পারফর্ম করলে গালি খায়, কিন্তু সৌম্য-লিটন খারাপ করলে শুধু গালিই যথেষ্ট থাকে না, জুটে যায় ‘হিন্দু কোটার খেলোয়াড়’ এর তকমা। মিডিয়া বাণিজ্য পাবলিক সেন্টমেন্ট খুব ভালোই বুঝে, একারণে তারা মিরাজের মতো নির্বিষ ওয়ানডে ক্রিকেটারকেও প্রমোট করে যাবে, সৌম্য বা লিটনকে নিয়ে ২-৪ কথা লিখতে গেলেও ১০ বার ভাববে, এর পাবলিক রিএকশন কী হতে পারে। ৯০ এর দশকের সাউথ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের যেমন স্ট্রাগল করতে হতো, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে লিটন-সৌম্যের স্ট্রাগল তার চাইতেও বেশি।
তার উপর সমস্যা হয়েছে, দুজনই অতিরিক্ত ইনট্রোভার্ট, মিডিয়াবাজিতে মন নেই, যে কারণে দলে এখনো থিতু হতে পারলো না।
সৌম্য ৫২ ম্যাচ খেলতে গিয়ে দল থেকে বাদ পড়েছে ৩ বার। লিটন ৩৩ ম্যাচ খেলতে গিয়ে বাদ পড়লো ৩ বার।
তামিম ইকবাল একবার মাত্র বাদ পড়েছিল, সেটাও চাচার প্রতিবাদ আর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বাস্তবায়িত হয়নি।
ক্যারিয়ারের প্রথম ৫২ ম্যাচে তামিম বা মুশফিক কয়টি ম্যাচ জিতিয়েছে, অনুপাতটা দেখলেই বুঝবেন সৌম্য তাদের তুলনায় কত বেশি ম্যাচ উইনিং ক্ষমতাসম্পন্ন।
মিডিয়া কেন সেলিব্রিটিদের সাথে লেনদেনের সম্পর্ক বজায় রাখি। বলিউডের পেজ থ্রি আর হিরোইন মুভি দুটো দেখলে এর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
আশরাফুলের মতো অধারাবাহিক ব্যাটসম্যান ১২ বছর ক্যারিয়ার চালিয়ে নিলো কীভাবে, ভাবলে অবাক লাগে না? আশরাফুল হটাও আন্দোলনও হয়েছে সেসময় সামহোয়ারইন ব্লগে। আশরাফুল অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছে, অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে সত্যি, কিন্তু আশরাফুল যে পরিমাণ ম্যাচে ফ্লপ মেরেছে সেই অনুপাতে তার পারফরম্যান্স সংখ্যা একেবারেই কম।
আপনি বলতে পারেন, বিসিবির হাতে রিসোর্স ছিল না। এটা ডাহা মিথ্যা কথা। ২০০০- ২০০৭ এই সময়টাতে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ট্যালেন্ট পুল ছিল সেটা এমনকি ২০১৯ সালেও নেই।
তবু আশরাফুলকে বিসিবি খেলিয়েছে কেন? কারণ, পেপার খুললেই আমাদের চোখে পড়তো ভারত, পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার আশরাফুলের প্রশংসা করেছে, স্টিভ ওয়াহ তাকে নিজের গ্লাভস উপহার দিয়েছে, মুরালিধরন যে ৪ জন ব্যস্টসম্যানের বিপক্ষে বল করতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো সেখানে আশরাফুলের নাম আছে, আরো কত গল্পকথা।
তবু আশরাফুল বাদ পড়েছে। কিন্তু ঘরোয়া লীগে সেঞ্চুরি মেরে দিয়েছে, অনেকেই মারে, কিন্তু আশরাফুলের সেঞ্চুরি খেলার পাতায় বিশাল সংবাদ হিসেবে ছাপা হয়েছে, বিসিবি আবার তাকে সুড়সুড় করে ফেরত এনেছে।
তবে অধিনায়কত্ব হারানোর পর মিডিয়া ব্যাক আপ এর ধরনে পরিবর্তন আসে। তখন আমরা জানতে থাকি, কোচ জেমি সিডন্স আশরাফুলের ব্যাটিং গ্রিপ পরিবর্তন করায় সে পারফর্ম করতে পারছে না, ব্যাটিং অর্ডারে জায়গা ফিক্সড না থাকায় পারছে না, এসব করেও আশরাফুলকে রক্ষা করা যায়নি তার পারফরম্যান্সহীনতার বিপরীতে সাকিবের ডোন্ট কেয়ার এটিচুড এর ফলশ্রুতে। এরপর যখন ম্যাচ ফিক্সিংয়ে আশরাফুল দোষী সাব্যস্ত হলো, একে একে জানা গেল আইসিএল কাণ্ডেও সে ছিল নাটের গুরু। তখন আশরাফুলকে বিক্রি করে তারা কন্টেন্ট গেলানো শুরু করলো।
মাশরাফিকে নিয়ে আমরা আগ্রহী হলাম কীভাবে?
সে যতটুকু পারফর্ম করেছে, মিডিয়া তার চাইতে বেশি করে উপরে উঠিয়েছে। মিডিয়া ফ্রেন্ডলি হওয়ায় ইনজুরিতে পড়ার পরও বারবার মিডিয়া তার প্রতি সহমর্মী থেকেছে। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে প্রিমিয়ার লীগে সে স্পিন বোলিং করেছে, পুরো রান আপ এ বোলিং করতে পেরেছে খুব কম ম্যাচেই, তবু তাকে দলে রাখতে হবে, এবং ক্যামেরার সামনে কান্নাকাটি করে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, মেসেজটা এমন সাকিব ইচ্ছা করে তাকে দলে নেয়নি।
পারফরম্যান্স তার কখনোই চোখে পড়ার মতো খারাপ ছিল না, এটাকে মিডিয়া আরো ভালোভাবে ইউটিলাইজ করতে পেরেছে। কিন্তু ২০০৭ এর পর থেকেই সে যে স্ট্রাইক বোলার নেই সেটা এড়িয়ে গেছে। বরং হাঁটুতে ৭ বার অপারেশন হয়েছে, বাকি জীবন পঙ্গু হয়ে কাঁটাতে পারে এমন খবরই বেশি বেশি করে এসেছে।
অধিনায়ক হওয়ার পর তো মাশরাফির পরিচয়ই পালটে গেল। কারণে-অকারণে একিটার পর একটা ইন্টারভিউ, সেখানে ক্রিকেটের চাইতে জীবনবোধের কথাই বেশি। রাতারাতি ক্রিকেটার থেকে মাশরাফি হয়ে গেলো কাল্ট লিডার। পরিসংখ্যান বলতে থাকে তার উইকেট সংখ্যা বেশি, সুতরাং ম্যাচের কোন পরিস্থিতিতে উইকেট এসেছে তা আর বিবেচ্য থাকলো না। ২০১৫ এর আগেও আমরা তামিমকে নিয়ে নেতিবাচক খবর পড়েছি। বিমানের টিকিট ছিঁড়ে ফেলা, ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে ঝামেলা বাঁধানো, ঘরোয়া লীগে আশরাফুলের সাথে মারামারি বাঁধানো। তামিমকে সাধারণ দর্শক বেয়াদব হিসেবেই চিনতে থাকে। কিন্তু ২০১৫ থেকেই তামিমের পরিচয় সে মাশরাফির ১ নম্বর ভক্ত, সে খাদ্যাভ্যাস বদল করেছে, সে প্রচুর প্র্যাক্টিস করে। মানে মাশরাফি তার মিডিয়া ফ্রেন্ডলি স্বভাব তামিমকে হস্তান্তর করেছে।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশের সবচাইতে বিতর্কিত ক্রিকেটার সাকিব। বিতর্কে থাকার মতো কাজ সে কম করেনি সত্যি, তবু মিডিয়া ব্যাক আপ থাকলে তার পাবলিক ইমেজ নিশ্চিতভাবেই এখনকার চাইতে উজ্জ্বলতর হতো৷ হয়নি, কারণ মিডিয়াকে সে খুব বেশি প্রশ্রয় দেয় না। আশ্চর্যজনকভাবে ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে কখনোই টানা খারাপ সময় যায়নি, নইলে ২০১৪ তেই সাকিব ইতিহাস হয়ে যেত।
তবে সফল মানুষদের মিডিয়া এড়িয়ে চলাও আরেক ধরনের গল্পের জন্ম দেয়, সেটা বিক্রি করে মিডিয়া ভিন্ন লেভেলের টার্গেট মার্কেটে ফিট করে নিজেদের।
ভাবছেন, সোস্যাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারে মূলধারার মিডিয়া কোনঠাসা। আপিনি মহাবোকা। সোস্যাল মিডিয়ায় যেসব ইস্যুতে ঝড় তুলেন সেগুলো আপনার কাছে আসে সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি ইনফরমেশন হিসেবে, তথ্যের প্রাইমারি সোর্স এখনো মূলধারার মিডিয়া– হোক সেটা টেলিভিশন, প্রিন্টেড কাগজ, বা অনলাইন পোর্টাল। আর সোস্যাল মিডিয়ার কোনো কনটেন্ট যদি ভাইরাল হয়ে যায় সেটা একমাত্র মূলধারার মিডিয়াতে আসার পরই সেখান থেকে চেঞ্জ আসে।
ফলে সোস্যাল মিডিয়ায় আপনি যা বলছেন তাও আদতে মিডিয়া আপনাকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে।
মিডিয়া বিক্রি করে তথ্য; একই তথ্য কুমিরের বাচ্চার মতো ৭ বার উল্টিয়ে পালটিয়ে বিক্রি করে।
সেলিব্রিটি তাদের এই বিক্রির ক্ষেত্রে প্রধান মার্কেটপ্লেস। তাকে ঘিরে মিথ তৈরি করতে পারলেই বিক্রি, বেতন, বোনাস- সবকিছু।
বাংলাদেশি মিডিয়াকে আমি বলবো চরিত্রহীন। তারা কিছুটা ব্রিটিশ-ভারতীয় ঘরানার, যে কোনোকিছুকে অতিরঞ্জিত করতে ওস্তাদ, আবার ধামাচাপা দেয়ার ক্ষেত্রে বাঙালি মীরজাফরপনা। কিন্তু ভারত-ব্রিটিশ মিডিয়ায় সেলিব্রিটিদের তুলোধুনো করতেও কুণ্ঠা বোধ করে না। যে কারণে বাংলাদেশী বিনোদন মিডিয়া মোসাহেব- তাবেদার চরিত্র ধারণ করে।
সমালোচনা লিখলে সেলিব্রিটির সাথে ব্যক্তিসম্পর্কের টান পড়বে, নিউজের কাটতি বাড়ানো যাবে না। যেহেতু আমাদের মিডিয়া জার্নালিস্টদের খুব কম অংশকেই প্রজ্ঞাবান মনে হয়েছে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে,গঠনমূলক সমালোচনা তখনই লিখে যখন স্বার্থে টান পড়ে; সেটা তখন সমালোচনা না হয়ে বিষোদগারে রূপ পায়।
মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মমূল্যায়নের শক্তি অর্জন না করবে, চিলে কান নিয়েছে শুনে চিলের পেছনেই ছোটা বন্ধ না করবে, ততক্ষণ মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত ১০ ফুট বাই ১০ ফুট কারাগারে থাকাই নিয়তি, এবং সময়ে সময়ে বিভিন্ন সেলিব্রিটি আসবে পীর, আউলিয়ার চেহারায়, যাদের নুরানি চেহারা আর বচনামৃতে মোহাবিস্ট হয়ে কাঙালের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবো তার বা তাদের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেয়ার প্রতীক্ষা-প্রত্যাশায়।।
সুতরাং মার্কেটে নতুন কোন পীর-আউলিয়া আসছে তা জানতে-বুঝতে চোখ রাখুন পেপারে, মিস যাতে না হয় সেজন্য আপনার হকারকে আজই জানিয়ে রাখুন।
কিন্তু খবরদার,
কেন বিশ্বকাপে ভরাডুবি হলো এ নিয়ে প্লেয়ারদের সমালোচনামূলক কোনো লেখা মিডিয়ায় আশা করেছেন তো আপনার বিরুদ্ধে ফেসবুকে হুলিয়া জারি করা হবে, অথবা কল্লা কেটে পদ্মা ব্রিজে দিয়ে দেয়া হবে।
আপনার কল্লা হেফাজতে রাখুন