সেলস কি একাডেমিক পড়াশোনার সাবজেক্ট হতে পারে, বা বাংলাদেশে সেলস নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স, নিদেনপক্ষে ডিপ্লোমা করা যায় এরকম কোনো ইনস্টিটিউট কি আছে? শুধু বাংলাদেশ নয়, গ্লোবাল প্র্যাকটিস কী বলে; আছে নাকি সেলস এর কোনো ডিসিপ্লিন? পৃথিবী সম্পর্কে আমার ধারণা সামান্য, তবু অনুমানের উপর নির্ভর করে বলছি, সম্ভবত প্রতিক্ষেত্রেই উত্তরটি ‘না’। অথচ, লক্ষণীয় বিষয় হলো, সবচাইতে চাকরি বেশি সেলস এ, ক্যারিয়ার গ্রোথও বেশি এখানেই। কমিশন, ইনসেনটিভ প্রভৃতি বেতনবহির্ভূত সুবিধাদিও প্রধানত সেলস এর জন্যই প্রযোজ্য। টার্গেট, এচিভমেন্ট সবকিছর সাথেই সেলস জড়িত। তবু সেলসকে পড়াশোনার সাবজেক্ট হিসেবে চালু না করার ক্ষেত্রে কারণ কী হতে পারে? মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস প্রভৃতি নামে ডিপার্টমেন্ট আছে বহুদিন হলো। বলা যেতে পারে, এসবের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে সেলস তো আছেই, কারণ এসব কর্মযজ্ঞের মূল লক্ষ্য তো সেই সেলস এ কনভার্ট করাই। বিজনেস টিকে থাকে সেলস রেভিনিউ ভলিউমের উপর; আপনার কোম্পানীর সুনাম আছে, পলিসি ভালো, কিন্তু সেলস নেই; এই কোম্পানী বছরের পর বছর চালাতে পারবেন না, একটা পর্যায়ে বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। সেলস ই ফার্স্ট প্রায়োরিটি, অন্যগুলো সেকেন্ডারি। তবে একথার মানে কিন্তু এই নয় যে, যত পারো সেলস বাড়াও, অন্য কিছুতে গুরুত্ব দিতে হবে না। এটা শোষকনীতি, পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম চাওয়া; এটা মানুষকে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত করে। টিকে থাকতে হলে সেলস লাগবে, টিকে থাকার পর অপটিমাম লিমিট এবং সোস্যাল পেব্যাক- এরকম নীতিও থাকা উচিত, যদিও মুদ্রা এতোবেশি পাওয়ারফুল যে, একবার এর মধ্যে ঢুকে পড়লে ইটস এ নেভার এন্ডিং গেম। সঙ্গে যোগ করুন, ভোগবাদী মানসিকতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা; অর্থের লিমিট কীভাবে পাবেন! বাংলাদেশে সেলস আর মার্কেটিংকে একত্রিত মনে করার একটা সাধারণ প্রবণতা আছে, যদিও দুটোর সম্পর্ক বহুদূরবর্তী। যে মানুষটি সেলস এক্সপার্ট সে মার্কেটিং ভালো বুঝবে এটা ভাবার কারণ নেই, আবার যে মার্কেটিংয়ে ভালো, সে সেলস এ সফল হবে এটাও সর্বৈব সত্য নাও হতে পারে। মার্কেটিং অনেক বেশি স্ট্র্যাটেজিক, আর সেলস অনেকটাই এপ্লিকেশন বা এক্সিকিউশন ওরিয়েন্টেড। ফলে দুই কাজের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদের পারসোনালিটি প্রোফাইলও ভিন্নধর্মী। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু মার্কেটিং বলতেই সেলস বোঝায়, এবং ১০ টাকায় কিনে ১৩ টাকায় বিক্রি করাকেই বিজনেস মনে করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, আমরা না পারি ভালো মার্কেটর হতে, না পারি সেলসম্যান হতে। আমরা বরং ‘টাক মাথার লোকের কাছে চিরুনি বিক্রি করাই সার্থক মার্কেটিং’- এই ধারণাকে প্রোমোট করে শান্তি পাই। অথচ, এটা আনএথিকাল; যার যে জিনিসের প্রয়োজন নেই, তাকে জোর করে প্রয়োজন বোধ করানো, এটাকে এথিকাল প্র্যাকটিস বলা যায় না কোনোভাবেই। আমাদের তথাকথিত সেলস এক্সপার্টরা এই নীতিই ইনজেক্ট করে, এবং সমাজে ভাইরাল করে। সেলস সাধারণত দুইভাবে হতে পারে, কর্পোরেট সেলস এবং রিটেইল সেলস। এছাড়া, ডিরেক্ট সেলসও বেশ প্রচলিত হয়ে উঠছে, বিশেষত এমএলএম কোম্পানীগুলোর বিস্তারের কারণে একসময় বাংলাদেশে ডিরেক্ট সেলস খুব চলতি হয়ে উঠেছিলো। সেলস এর উপর অনার্স বা মাস্টার্স না থাকার একটা বড় কারণ হতে পারে, রিটেইল সেলস এর আধিক্য। সাধারণত, রিটেইলে যারা কাজ করে (হোক সেটা এফএমসিজি বা স্লো-মুভিং প্রোডাক্ট) তাদের এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড খুব ভালো থাকার আবশ্যকতা কম পড়ে, স্যালারিও তুলনামূলক অনেক কম, এবং এর চাইতেও বড় চ্যালেঞ্জ শারীরিক শ্রম। রোদে পুড়ে একের পর এক যেভাবে রিটেইলারকে ভিজিট করতে হয়, এবং প্রোডাক্ট নেয়ার জন্য ইনফ্লুয়েন্স করতে হয়, এটা মোটেই সহজ কোনো কর্ম নয়। একটু জরিপ চালালে দেখা যাবে, সেলস এ কাজ করে এদের ৭০% মানুষই (১০ জনে ৭ জন) এই কাজটা পছন্দ করে না, তবু করে কারণ অন্য কোনো অপশন নেই। কর্পোরেট সেলস এর আরেক সংকট হলুদ খাম। বিক্রি করতে যাবেন, পারচেজ অফিসারকে খুশি করতে হবে, এরকম একটা কালচার অনেকদিন ধরেই প্রতিষ্ঠিত। ফলে সেলস দক্ষতা বা ভালোবেসে সেলস করার ক্ষেত্রগুলো কেবলই সংকুচিত হয়ে আসে। আরেকটা জনপ্রিয় ভুল কনসেপ্ট হলো সেলস মানেই সপাটে কথা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বা প্রচলিত বাংলায় বললে, চাপাবাজি করা। ৩০০ টাকার এনার্জি লাইট ১০০ টাকায়, এরকম কথা সারাদিন ধরে বলে গেলে সেলস হয়তো কিছু হতে পারে, কিন্তু কোম্পানীর রেপুটেশন কোন্ তলানীতে গিয়ে ঠেকে সেটাও ভেবে দেখবার বিষয়। অনেক সিচুয়েশনই আছে যখন বলার চাইতে শুনলে বেশি সেলস করা যায়। আমি মনে করি, মুভি বা বিজ্ঞাপন বানানোর চাইতে সেলস কম ক্রিয়েটিভ কোনো কাজ নয়। সেলস বরং বেশি চ্যালেঞ্জিং। একজন মানুষের মন বুঝে আচরণ করা এবং তাকে নিজের চাওয়ার সাথে সমর্পিত করা, পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটি। শুধুমাত্র কথা দিয়ে এটা হওয়ার সম্ভাবনা কম, এর জন্য প্রয়োজন হিউম্যান সাইকোলজি এবং বিহেভিয়ার বিষয়ে গভীর আগ্রহ এবং সেটাকে একশনে কনভার্ট করা। একাডেমিক থিওরিটিকাল পড়াশোনার ৮০% ই ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইফে কোনো কাজে আসে না। যে ছেলে বা মেয়েটি ফিলিপ কটলারের বই গুলিয়ে খেয়েছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মার্কেটিংয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখবে রিয়েল লাইফ সিনারিও কত আলাদা। তাকে সবকিছু নতুন করে শিখতে হয়। বরং ভার্সিটি লাইফে যারা ব্রান্ডিং বা মাইন্ড কনটেস্ট এ পার্টিসিপেট করে, তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা একটু হলেও বেশি। তবু সেলস এর একটা ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা উচিত। তাতে প্রচুর বেকার জনগোষ্ঠী অন্তত নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা তৈরির একটি সুযোগ পাবে। সমাজে প্রচলিত মতবাদ হলো, দেশে চাকরি নেই, বেকারত্ব বেশি, অন্যদিকে চাকরিদাতাদের প্রায় সবারই অভিযোগ, চাকরি দেয়ার মতো মানুষ পান না তারা। দক্ষতার এতোটাই অভাব! ডিপ্লোমা চালু করলে, এবং সেখানে সেলস এ কাজ করা মানুষগুলোই যদি ক্লাস নেয়, সেটা তাদের সত্যিকারের কাজ করার আভাস দেবে; বইয়ের প্রথাগত কথাবার্তা নয়, একদম মাঠ পর্যায়ে কাজ করে আসার গল্প। বাইরের দেশে সেলস সংক্রান্ত প্রচুর বই-পত্র পাওয়া যায়। ব্রায়ান ট্র্রেসি নামে এক সেলস ট্রেইনার আছেন, যিনি ইউটিউবে প্রচুর মূল্যবান রিসোর্স জমা করেছেন। আরও অনেকেই আছে। বলতে পারেন, বাংলাদেশের সাথে ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মার্কেট মিলবে না, কালচার মিলবে না; কাজেই ওখানকার ধারণা এখানে অচল। এই অভিযোগ সর্বাংশে ভুল। দেশ যেটাই হোক, কাস্টমার একজন মানুষ, এবং প্রত্যেক মানুষের ইমোশনাল বিহেভিয়ার আছে। সুতরাং, কালচার-কান্ট্রি বুঝে সেই মানুষটির মনের ভেতর কীভাবে ঢুকবেন, এইসব রিসোর্স থেকে সেই ইনসাইট বা অন্তদৃষ্টি পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। বলতে পারেন, পড়ার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে সেলস এ চাকরি নিলাম, আবারো সেই পড়া! ঠিক আছে, রিডিং হ্যাবিট সবার না-ই থাকতে পারে, কিন্তু যিনি পড়ে কনসেপ্টগুলো বুঝেছেন তার সাথে সময় কাটান, প্রশ্ন করতে করতে জানুন; একটাও যদি না করেন, তাহলে তো বলবেনই বিদেশের ধ্যান ধারণা চলবে না! সবকিছুতে সমস্যা দেখতে পাওয়াটা, অভিযোগ করাটা ভালো লক্ষণ নয়। সেলস ইনস্টিটিউট গড়ার একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো, শেষ পর্যন্ত এটাও একটা রিক্রুটিং এজেন্সি হয়ে উঠবে, এবং একে অবলম্বন করে একটা বিজনেস ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে। ফলে, বুঝে না বুঝে মানুষ এই ডিপ্লোমা করার জন্য ভর্তি হবে, এবং প্রচুরসংখ্যক প্রতারণার ঘটনা ঘটবে। এজন্য দরকার যৌথ উদ্যোগ বা কোলাবরেশন। ধরা যাক, কয়েকটি কোম্পানী মিলে একটি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করলো, সেখানে ভালো পারফরম করাদের জন্য জব প্লেসমেন্টের নিশ্চয়তা থাকলো; বেশ কয়েকটা যৌথ উদ্যোগ নিলে তখন ট্রেনিংগুলো ভ্যালু বহন করবে। এবং এই পুরো প্রোগ্রামটা যেহেতু এক্সপেন্সিভ, এটা চালিয়ে নেয়ার জন্য যদি কোনো বিজনেস মডেল থেকেও থাকে, সমস্যার কিছু দেখি না। বাংলাদেশে রিক্রুটিং এজেন্সি বোধহয় বেশ কয়েকটাই আছে। তারা যেসব হিউম্যান রিসোর্সের যোগান দিচ্ছে, সেগুলোর আউটপুট আশানুরূপ হচ্ছে না বলেই বোধহয় এই সেক্টরটা এখনো ডেভেলপড নয়। কিন্তু এজেন্সিগুলোর ব্যর্থতার পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে কি? সম্ভবত, অর্গানাইজেশনের ডিমান্ড, বাস্তবচিত্র আর তার বিপরীতে তাদের প্রদেয় কনটেন্টের কোরিলেশনে ঘাটতি আছে। শুধুমাত্র সেলস নয়, প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই দক্ষ জনশক্তির অভাব। তবু সেলসকে ফোকাস করার কারণ, এই ফিল্ডেই চাকরিপ্রার্থী বেশি, অথচ স্বেচ্ছায় কেউ এখানে আসতে চায় না। বৈপরীত্যের এই বাস্তবতাই যত সমস্যার মূল। যদিও বলা হয়, পৃথিবীতে প্রত্যেকেই সেলস করে; কেউ বুদ্ধি বেচে, কেউ বেচে শারীরিক শ্রম; আজকের দুনিয়ায় নিজেকে যে যত ভালোভাবে সেলস করতে পারবে, সেই তত সফল মানুষ, আমি তবু ব্যক্তিগতভাবে এইসব বুলিতে আস্থা পাই না। পৃথিবীর সবকিছুর সাথেই সবকিছু কানেক্টেড, তার মানে পড়া আর শোয়া এক হয়ে যায় না। নিজেকে সেলস করা, এই থিওরির মধ্য দিয়ে মানুষকে আরও বেশি শো-অফ, আরও প্রবলভাবে আত্মকেন্দ্রিকতায় উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু সেলস করা হচ্ছে একটা অর্গানাইজেশনকে টিকিয়ে রাখতে, নিজে আরেকটু ভালো থাকতে- এর মধ্যে সামষ্টিক চেতনা আছে। তাই সেলস শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত না হয়ে, সামাজিক দায়বোধের জায়গাতে থাকাই বেটার। বাংলাদেশে সত্যিই কোনোদিন সেলস ইনস্টিটিউট হবে কিনা জানি না, তবে হলে বহু মানুষ উপকৃত হবে। সেই সুদিনের প্রত্যাশায়……