বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কখনো যদি থ্রিলার উপন্যাস লেখা হয় সেখানে ক্রিকেটার, সংগঠক, কোচ, আম্পায়ার, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক, মিডিয়া প্রভৃতি মিলে এক বিশাল কলেবর ধারণ করবে। যদি সুস্থ্য থাকি এবং হিউম্যানল্যাব কোম্পানী নিয়ে মার্কেটে টিকে থাকতে পারি, সেই থ্রিলার হয়তোবা নিজেই লেখার চেষ্টা করবো।
সেই থ্রিলারে হাবিবুল বাশারের চরিত্রটা কেমন হতে পারে? আমরা যদি ইলিয়াড অথবা মহাভারতকে স্যাম্পল হিসেবে নিই কল্পনা বা অনুমান করা সহজতর হবে। যদিও এগুলো মহাকাব্য, তবু কাহিনী বিন্যাসে নির্দ্বিধায়ই থ্রিলার হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়।
উপন্যাসে হাবিবুল বাশার চরিত্রটি আসবে বয়সভিত্তিক দলে শ্রীলংকার বিপক্ষে ব্যাট করার সময় দিলহারা ফার্নান্ডোর বলে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেছে এক তরুণ ক্রিকেটার, সেই সংবাদ শুনে কুষ্টিয়ায় তার পরিবারে কান্নার রোল পড়ে গেছে- এমন আবহের মধ্য দিয়ে।
পরের অধ্যায়েই আমরা দেখবো ২০০৭ এর বিশ্বকাপে মাত্র ১৩ গড়ে রান করায় দলটির অধিনায়ককে বাদ দেয়া হলো, এবং তার কিছুদিনের মাথায় আইসিএল নামক ভারতীয় এক ঘরোয়া টুর্নামেন্টে জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার নিয়ে একটি দল অংশগ্রহণ করছে, যার নাম ঢাকা ওয়ারিয়র্স। এখানেই চলে আসবে ক্রিকেট রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতের আসমানসম প্রভাব এবং তার প্রেক্ষিতে আইসিএলকে নিষিদ্ধ গন্ধম ফল বানিয়ে ফেলা, এবং ফলশ্রুতে নিমিষের মধ্যে একঝাঁক ক্রিকেটারের স্বর্গচ্যুতি। সেই দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার!
মহাভারতে কর্ণের রথের চাকা দেবে গিয়েছিলো, যুদ্ধ-ধর্মমতে তাকে হত্যা করা অন্যায় ছিলো অর্জুনের।এই এক এডভান্টেজ নিয়ে কর্ণের পূর্বাপর সকল পাপ আর অপরাধ আড়ালে চলে যায়, তার গঞ্জনা আর বঞ্চনাগুলোই প্রকাশিত হয় বেশি। হাবিবুল কে কি বাংলাদেশ ক্রিকেটের কর্ণ বলা যায়? এই চরিত্রটি আসলে মোহাম্মদ রফিকের সাথে মানায় বেশি। তাছাড়া কর্ণের নিয়তি তার বরণ করতে হয়নি, সে পুনরায় বাংলাদেশ ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করেছে। একে নির্বাসন বা বনবাসের পর রাজ্যলাভ বলা যায়।
আমরা বরং মিডিয়া উদ্ভাবিত পঞ্চপাণ্ডব তত্ত্ব পর্যালোচনা করতে পারি। পঞ্চপাণ্ডবে যে ৫জন ক্রিকেটারের (মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ) নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেই ক্রমে একটা ঝামেলা আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট আজকের যে অবস্থানে এসে পৌঁছেছে তার পেছনে হাবিবুল বাশার এবং ডেভ হোয়াটমোর জুটির এক অনস্বীকার্য প্রভাব রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার একাধিপত্যের যুগে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো; ভারত, শ্রীলংকা, সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয়া- বড়ো দলগুলোর বিপক্ষে সাফল্য পাওয়ার শুরু হাবিবুলের সময়ে। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকের তরুণ বয়সের অধিনায়কও তিনি।
মাশরাফি বাংলাদেশ ক্রিকেটের এমনই এক দুর্লভ আর অদ্বিতীয় চরিত্র তাকে কেবলমাত্র পঞ্চপাণ্ডবে আটকে রাখলে সেই থ্রিলার অসম্পূর্ণ হবে। মহাভারতের রহস্যপূর্ণ চরিত্র কৃষ্ণকে যদি মাশরাফির সাথে মেলাতে যাই, তাহলে হয়তোবা সার্থক প্রতিরূপীকরণ হবে।
সাকিব অর্জুন,তামিম ভিম, মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ ভায়রা ভাই হওয়ায় জমজ নকুল-সহদেব ধরে নিলে বাকি থাকে যুধিষ্ঠির চরিত্রটি। যুধিষ্ঠিরের জুয়া খেলা আর রাজনীতি সচেতনতার অংশটুকু বাদ দিয়ে আমরা যদি তার ধর্মপুত্র এবং সত্যবাদী সত্তাটিকে গুরুত্ব দিই, তবে হাবিবুলকে যুধিষ্ঠির দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে। যুধিষ্ঠিরের সেই বিখ্যাত টেকনিকাল মিথ্যা ‘অশ্বত্থামা হত’- এটাকেও রাখতে হবে।
কে হবে অশ্বত্থামা? মহাভারতের ক্রিটিকালতম চরিত্র অশ্বত্থামার সাথে সবচাইতে সাদৃশ্য পাওয়া যায় আশরাফুলের।
মহাভারতের রিমেক হবে না, তবে এর চরিত্রগুলো এতো বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ, যে কোনো স্থান-কাল এর উপন্যাসের চরিত্রকেই এর অধীনে আনা সম্ভব। মহাভারতের প্রসঙ্গ এনে কেবলমাত্র চরিত্রের ব্যাপ্তি-গভীরতা আর বিস্তৃতির ইঙ্গিত দেয়া হলো।
আমরা এখন শুধুমাত্র হাবিবুল বাশারে নিমজ্জিত থাকবো।
হাবিবুল বাশারকে প্রথম দেখি ১৯৯৭ এর এশিয়া কাপে। দল ঘোষণার পর জাকির হাসানের সাথে তার পাশাপাশি ছবি ছাপা হয়েছিলো পত্রিকায়। প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তান ৩১৯ রান সংগ্রহ করে; আজকের ক্রিকেটে সেটা ৪০০+ স্কোর। পাকিস্তানের অধিকাংশ ব্যাটসম্যান সেদিন লাইফ পেয়েছিলো, প্রায় ৫-৬টা ক্যাচ ড্রপ হয়েছিলো, যার মধ্যে একাই ৩টি ক্যাচ ড্রপ করেছিলেন হাবিবুল। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ ৫টি উইকেট তুলতে সমর্থ হয়েছিলো, প্রতিটিই ক্যাচ আউট, এর মধ্যে আবার দুটির ফিল্ডার হাবিবুল। ফলে সেই ম্যাচে বল শুধু হাবিবুলকেই খুঁজেছে। বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামার পর ওপেনার দুর্জয় পেসার কবির খানকে দুটো বাউন্ডারি মেরে লেগবিফোর হন, তিনে নামেন হাবিবুল; প্রথম বলেই বোল্ড। এমনিতেই ফিল্ডিংয়ে ৩টা ক্যাচ ড্রপ করেছে, তারপর দুর্জয়ের অমন শুরুর পর প্রথম বলেই বোল্ড, এবং যেরকম নড়বড়ে ব্যাটিং স্ট্যান্স- তাতে ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া আমার অভিব্যক্তি ছিলো- এরকম ফালতু প্লেয়ার জাতীয় দলে সুযোগ পায় কীভাবে, এর চাইতে মানিকগঞ্জের মাসুদ ভাই হাজার গুণ ভালো খেলে!
পরের ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে ৫ বা ৬ রান করে আউট, ভারতের বিপক্ষে একাদশ থেকে বাদ। হাবিবুলকে মনে রাখবার কোনো কারণ ছিলো না তাই; তখন মাথায় ঘুরতো আতহার আলি, সাইফুল ইসলাম, এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের দুর্দান্ত স্টাইলিশ খ্যাত আলশাহরিয়ার রোকন; সে কেন জাতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছে না সেটা নিয়েও চিন্তা করতাম।
বিস্মৃত হাবিবুল পুনরায় আমার নজরে আসেন ১৯৯৯ এর ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বাংলাদেশ সফরে। ৩ বা ৪দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। ২ বছর আগের সাথে মেলাতে পারি না। সেঞ্চুরি করলেও তার ব্যাটিং দেখে খুব ভালো লাগে না, স্ট্যান্স দেখে মনে হতো গায়ে বল লাগার ভয় করছে। সেই বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসে সফরে; কোনো এক ওয়ানডেতে ব্যাটসম্যান ওয়াভেল হাইন্ডস খালেদ মাহমুদের বলে মিড অন দিয়ে উড়িয়ে মারতে যান, ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাতে ক্যাচ লুফে নেন এক ফিল্ডার, তখনো পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশী ফিল্ডারের নেয়া সেরা ক্যাচ। ফিল্ডারের নাম হাবিবুল বাশার। ইংল্যান্ড ‘এ’ এর বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেও আগ্রহ জাগাতে সমর্থ না হওয়া ব্যাটসম্যান প্রথম আমার আগ্রহের কেন্দ্রে আসেন ফিল্ডার হিসেবে।
ব্যাটসম্যান হাবিবুলে আগ্রহ জন্মানোর ক্ষেত্রে বোলার জহির খানের সরাসরি সংস্রব রয়েছে। ২০০০ সালে কেনিয়াতে অনুষ্ঠিতব্য আইসিসির নক-আউট টুর্নামেন্টে ভারতের পক্ষে জহির খানের অভিষেক হয়। দুর্দান্ত ইয়র্কার আর সুইং দেখে বেশ পছন্দ হয়। অভিষেক টেস্টের প্রাক্কালেও জহির খানের ইয়র্কারগুলো বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কীভাবে সামলাবে এ নিয়ে পত্রিকায় নিয়মিত লেখা আসতে থাকে। ইনিংসের শুরুতেই অপি তার বলে আউট হয়ে সেই শংকার মেঘ ঘনীভূত করে আরো। কিন্তু মাঠে নেমেই হাবিবুল যেরকম কাউন্টার এ্যাটাক শুরু করেন, জহিরকে আহামরি কোনো বোলার মনে হচ্ছিল না। অভিষেক টেস্টের দলে তাকে না রাখা নিয়ে পত্রিকাতে হট্টগোল বেঁধেছে, সেটা খুব বেশি স্পর্শ করেনি আমায়, কিন্তু জহিরকে যেভাবে মোকাবেলা করেন তা তাকে ব্র্যাকেটের বাইরে নিয়ে আসতে বাধ্য করে। অভিষেক টেস্ট বললেই সবাই আমিনুল ইসলামের ১৪৫ রানের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে, কিন্তু আমার কাছে হাবিবুলের সেই ৭০ রান আমিনুলের ১৪৫ এর চাইতে একটুও কম নয়, কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে একটু এগিয়েও থাকবে।
কারণ, অভিষেক টেস্টের পূর্বে বাইরের মিডিয়াতে দুটো মুখরোচক গল্প ছড়িয়ে পড়েছিলো- টেন্ডুলকার একটু মনোযোগ দিয়ে খেললে লারার ৩৭৫ রানের রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলতে পারবে, অনিল কুম্বলে ২য় বারের মতো টেস্টে ১০ উইকেট নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সেই ভারত মাঠে নেমেই যে হকচকিয়ে গেলো, সাথে আমরা দর্শকরাও- তার প্রাথমিক কারণ তো হাবিবুলের ওই কাউন্টার-এ্যাটাক।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাবিবুলের ব্যাটিং আরো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। টেকনিকের দিক থেকে তার সাথে মিল পাওয়া যায় শেওয়াগের; দুজনের পা-ই যেন পিচের সাথে সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে ফেলা, পেস বোলিং খেলার সময় একচুলও নড়তো না পা; কিন্তু রিফ্লেক্স ভালো হওয়ার কারণে রান করতে অসুবিধা হয়নি। সে তুলনায় স্পিন বলটা ভালো খেলতেন, যদিও তার ডিফেন্স সেই অর্থে কপিবুক ছিলো না এক্ষেত্রেও। স্ট্যান্সের কারণেই লেগ সাইডে তুলনামূলক ভালো খেলতেন। শর্টপিচ বলে খুব কম ক্ষেত্রেই ডাক করতেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শর্ট বলে হাফ পুল-হাফ হুক ধরনের অদ্ভুত এক শট খেলতেন, যেটা খেলতে গিয়ে অসংখ্যবার আউটও হয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক ব্যাটসম্যানকে নিয়ে কথা বলতে গেলে যেখানে ওয়ানডের আশ্রয় নিতে হয়, ব্যাটসম্যান হাবিবুল সংক্রান্ত আলোচনা প্রায় পুরোটাই টেস্টকেন্দ্রিক। ২৪টি হাফ সেঞ্চুরির বিপরীতে সেঞ্চুরি মাত্র ৩টি, একারণে তাকে মিস্টার ফিফটি ডাকা হতো এককালে। তার কনভারসন রেট এত খারাপ হওয়ার একটাই কারণ মনে হয় আমার- ফিটনেস দুর্বলতা। তার ওয়ানডেতে অসফল থাকার পেছনেও ফিটনেসঘাটতিকে সামনে আনতে চাই। ফিল্ডিংয়ের সময় তার বডি মুভমেন্ট এবং ব্যাটিংয়ে রানিং বিটুইন দ্য উইকেট দেখলে যে কোনো কোচই তার ফিটনেস ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। তাদের সময়ের ক্রিকেটে ফিটনেস নিয়ে সচেতনতা এমনিতেও কম ছিলো, সেই মানদণ্ডেও যার ফিটনেস খারাপ, তিনি আসলে কোন্ অবস্থানে ছিলেন এই চিত্র থেকেই বোধগম্য হয়ে যায়।
হাবিবুলকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না এমন কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তার পেশা কী, আমার ধারণা সিংহভাগ মানুষই কলেজের অধ্যাপক, সরকারি চাকরিজীবী অথবা বেসরকারি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলবেন, ক্রিকেটার কারো কল্পনাতেই আসবে না। প্রথম আলো তে তার লেখা কলামগুলো যারা পড়েছেন তারা ক্রীড়া সাংবাদিকও বলতে পারেন।
হাবিবুলের অধিনায়কত্ব পাওয়াটা এক বিকল্পহীনতার উদাহরণ। অন্তর্মুখী হওয়ার কারণে তাকে কখনোই সেভাবে ক্যাপ্টেন্সি ম্যাটেরিয়াল ভাবা হয়নি, এমনকি খালেদ মাহমুদকে সরিয়ে তাকে যখন অধিনায়ক বানানো হয় তখন প্রথম আলোর শিরোনাম ছিলো –‘পারফরম্যান্সের জয়’, অর্থাৎ তার বাকি যোগ্যতাগুলো অবিকশিত রেখে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সই একমাত্র নিয়ামক হয়ে উঠেছিলো। অন্তর্মুখীতার সাথে অধিনায়কত্বের সংঘাতটাকে এক সময় অনিবার্য মনে হতো, সময়ের পরিক্রমায় এখন সেটাকে পুরোপুরিই আরোপিত লাগে।
অধিনায়ক হিসেবে হাবিবুলকে কীভাবে মূল্যায়ন করবো তার পূর্বে সেসময় তার ওয়ার্কফোর্স কেমন ছিলো সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ব্যাটিংয়ে শাহরিয়ার নাফিস, আফতাব, আশরাফুল- যার মধ্যে শেষোক্ত দুজন অধারাবাহিক। রাজিন সালেহ ছিলেন কিন্তু সেরকম পারফরমিং নন। শাহরিয়ার নাফিস মোটামুটি রান করেছেন ২ বছর। বোলিংয়ে মাশরাফি, তাপস, শাহাদাত, নাজমুল, রফিক, রাজ্জাক,এনামুল জুনিয়র- এরাই ঘুরেফিরে।তন্মধ্যে মাশরাফি অতিমাত্রায় ইনজুরিপ্রবণ। সাকিব, মুশফিক, তামিম যুক্ত হওয়ার পর রিসোর্স বাড়ে, কিন্তু তারা তখনো তরুণ ক্রিকেটার, সেই অর্থে নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেনি। একাদশে পারফরমারের সংখ্যা বেশি থাকলে অধিনায়কের কাজটা সহজ হয়ে যায় অনেকাংশে, নন-পারফরমিং একাদশের অধিনায়কের চাইতে দুর্ভাগা ব্যক্তি ২য়টি নেই। তার প্রতিটি সিদ্ধান্তেই সমালোচনা শুনতে হয়, তাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য বোদ্ধার আনাগোণা বাড়তে থাকে।
হাবিবুল তার সীমিত রিসোর্স দিয়ে সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টেও ধরাশায়ী করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। নেহায়েত নার্ভাস ব্রেকডাউনের কারণে ম্যাচটা হেরে যেতে হয়। নইলে রিকি পন্টিংয়ের ক্যাচটা ওইভাবে মিস হয় না, ক্যাচটা নিতে পারলে ইতিহাস অন্যরকম হতো।
বেশ কিছু ক্লোজম্যাচও খেলেছে হাবিবুলের নেতৃত্বে। এতো বছর পরও ফিনিশিং দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি দল। এতো সীমাবদ্ধতার মধ্যে কীভাবে হাবিবুল ম্যাচ জয়ের মন্ত্র তৈরি করতে পেরেছিলেন এটা দীর্ঘদিন পর্যন্ত রহস্য ছিলো। সম্প্রতি উৎপল শুভ্রর লেখা ‘এগারো’ বইসূত্রে সাকিবের জবানীতে জানতে পারি ‘সুমন ভাই এমন একজন মানুষ ছিলেন যার জন্য কিছু একটা করতে ইচ্ছা হতো’।
আবার রফিকের সেই ঘটনা যার কারণে তাকে সিরিজের মাঝপথে দেশে ফেরত পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিলো সেখানেও দৃশ্যপটে ছিলেন হাবিবুলই। রফিক তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন। একজন সাধারণ খেলোয়াড় যখন অধিনায়ককে মারার সাহস পান তার মানে ধরে নিতে হবে অধিনায়ক কতটা ফ্রি এন্ড ফ্র্যাংক, তিনি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেননি। সাথে এটাও স্মর্তব্য, রফিকদের মতো মানুষদের ম্যানেজ করেই তাকে দল সামলাতে হয়েছে।
স্ট্র্যাটেজিকালি তিনি কতটা স্ট্রং ছিলেন সেই বিশ্লেষণ করার মতো পর্যাপ্ত এভিডেন্স আমাদের কাছে নেই। সেই সময়ে প্রায় প্রত্যেক দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান এবং ওপেনিং বোলিংয়ের তালিকায় দুর্ধর্ষ সব নাম থাকতো, যে কারণে যে-ই স্ট্র্যাটেজি নেয়া হোক, তা পে অফ করতো খুব কম। এরকম দলের অধিনায়কত্বের এক্স-ফ্যাক্টর বরং খেলোয়াড়দের কনফিডেন্স বাড়ানো এবং শরীরী ভাষায় তার প্রভাব রাখা। তবু সুনির্দিষ্টভাবে বললে, সৈয়দ রাসেল আর রাজ্জাকের বোলিং রোটেশনটাকে রাখতে পারি। সৈয়দ রাসেল যে ঘরানার বোলার তাকে প্রথম স্পেলেই ৭-৮ ওভার করিয়ে ফেলে রানের চাকা আটকে রাখা প্রথাগত বাংলাদেশী অধিনায়কদের চাইতে ব্যতিক্রমী চিন্তাই বলতে হবে। কিংবা রাজ্জাককে পাওয়ার প্লে বা ডেথ ওভারে বোলিং করানোটাও সাহসী সিদ্ধান্ত সময়ের বিচারে।
যদিও তামিম ইকবালকে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানশিপের আইকন ধরা হয়, আশরাফুলকে প্রথম সুপারস্টার, তবু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এই জায়গাটায় হাবিবুল আরো বেশি নম্বর পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটিং অনেক দিন পর্যন্তই এক চাকার গাড়ি হয়ে ছিলো। বেশিরভাগ ম্যাচেই হাবিবুলকে নেমে পড়তে হয়েছে ইনিংসের ৫ম ওভারের মধ্যেই, বাংলাদেশ তখন নিয়মিত ইনিংস ব্যবধানে হারতো, প্রতিপক্ষ দল ব্যাটিংয়ে নামলে শয়ে শয়ে রান তুলতো, ফিল্ডিংয়ে টপাটপ উইকেট, বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস কেড়ে নেয়া উচিত এমন দাবি শোনা যেত অহরহ; সেই দলের একজন ব্যাটসম্যান ব্যাটিংয়ে নেমেই স্ট্রোকের ফুলঝুরি ফোটাতো- এটা অবশ্যই অনেক বড়ো আস্থাশীলতার বার্তা। তামিম মূলত সেই বার্তাটিই প্রচার করে তাকে আরেকটু উপরের স্তরে নিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে হাবিবুলকেই পায়োনিয়ার বলা উচিত। কিন্তু সেসময় যেহেতু সোস্যাল মিডিয়া বিকশিত আর বিস্ফোরিত হয়নি, ইউটিউবের জোয়ার আসেনি, এবং দল নিয়মিত হারার দরুণ দেশপ্রমিক সমর্থকদের হাট বসেনি, হাবিবুলের দুঃসাহসিকতাগুলো মূল্যায়িত হয়নি।
আশরাফুলের মতো ১৭ বছরেই টেস্ট সেঞ্চুরি না পাওয়ায় কিংবা চোখ ধাঁধানো শট না খেলা কিংবা তামিম ইকবালের ন্যায় তেড়েফুঁড়ে ডাউন দ্য উইকেটে না আসায় দর্শকদৃষ্টিতে তিনি হয়তোবা আগ্রাসী ব্যাটসম্যান নন, ওয়ানডেতে নিয়ন্ত্রিত ফিল্ডিংয়ের কারণে সিঙ্গেলস বের করতে হাঁসফাঁস করতে হয়েছে বলে তার ফ্যানের সংখ্যা কম- তবু বোলার কিলার অভিধায় খেলার কনটেক্সট বিবেচনায় আশরাফুল বা তামিমের চাইতে কোনোদিক থেকেই তিনি পিছিয়ে পড়েন না।
বাংলাদেশের সর্বকালের টেস্ট একাদশ গঠন করলে তামিম, সাকিব আর মুশফিকের নাম অবধারিতভাবে চলে আসে, বাকি ৮টা পজিশনে বেশ কয়েকটা বিকল্পের নাম শোনা যায়। অথচ ৩ নম্বর জায়গাটাও তর্কাতীত হও্রয়ার কথা, সেখানেই বিকল্প নাম দেখে হাবিবুলের মূল্যায়নের যথার্থতা নিয়ে আবারো প্রশ্ন জাগে।
নির্বাচক হিসেবে হাবিবুল কতটুকু ইমপ্যাক্ট রাখতে পারছেন এই প্রশ্নটাই হাস্যকর হয়ে যায় যখন কিছুদিন আগে ক্রিকইনফোতে একটি নিবন্ধ ছাপা হয় ‘বাংলাদেশের কি আদৌ নির্বাচকের প্রয়োজন রয়েছে?’- শিরোনামে। ক্রিকেট বোর্ড একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যে কোনো বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানের মতো এখানেও একক সিদ্ধান্ত, খবরদারি আর অমেধাবী মানুষের বিশ্রী চাটুকারিতা চলে। এখানে হাবিবুলের ক্রিকেটপ্রজ্ঞা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই, চাহিদাও নেই। তিনি বরং নষ্ট-সিস্টেমের খামখেয়ালিপনার শিকার। নির্বাচকদের জব রেসপনসিবিলিটি এবং পারফরম্যান্স বেঞ্চমার্ক কী, জিজ্ঞেস করলে বিসিবির কারো পক্ষেই হয়তোবা সন্তোষজনক জবাব দেয়া সম্ভব হবে না।
নির্বাচক না হলে ক্রিকেটের সাথে থাকার উপায় কী হতে পারতো? বা এভাবে থাকার আদৌ কি কোনো প্রয়োজন ছিলো? এটা যেহেতু তার চাকরি, মানুষ যে কারণে চাকরি করে এটাকেও সেই শ্রেণিভুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা নিশ্চয়ই এতোটাও ভঙ্গুর নয় যে মেরুদণ্ডহীনতার নজির রেখে এর উপরই নির্ভর করতে হবে। তবে মাঠে আসা, খেলা দেখা, খেলোয়াড়দের সাথে কথা বলা- এর মধ্যেও অনির্বচনীয় আনন্দ আছে নির্ঘাৎ, যে কারণে আপাত নিধিরাম সর্দার দশায় থেকেও দায়িত্ব উপভোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। খেলোয়াড়ি জীবনে শোয়েব আখতার বা ব্রেট লি এর বলে অবলীলায় বাউন্ডারি হাকাতে পেরেছেন,কারণ সেটা ছিলো ওয়ান টু ওয়ান দক্ষতার লড়াই। কিন্তু মাঠের বাইরে লড়াইটা ওয়ান টু মিলিয়ন হয়ে যায়, সেখানে একক যোগ্যতা বা দক্ষতাই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে বহু অনুল্লেখিত শর্তের কড়াকড়ি পূরণ করতে হয়। সাহসের অভাব, নাকি কমফোর্ট জোনে থাকতে চাওয়া- কোনটি তার আপোষকামীতার মূল কারণ, তা কেবলমাত্র ভারচুয়াল পর্যবেক্ষণ থেকে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দেয় না। আপোষ করাটাই যে দেশে স্বস্তি আর প্রশান্তির সেখানে হাবিবুলকে এই প্রশ্নে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোও হাস্যকর শিশুপনা।
আকরাম, নান্নু বা পাইলট, দুর্জয়দের প্রজন্মের খেলার ধরনের সাথে আশরাফুল, মাশরাফি বা সাকিব-তামিমদের প্রজন্মের খেলোয়াড়ি মানসিকতার মধ্যে আসমান-জরিপ ফারাক। হাবিবুল বাশার এক্ষেত্রে আশ্চর্য ব্যতিক্রমী এক ক্রিকেটার যিনি আসমান আর জমিনের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে বিমান হয়ে উড্ডয়ন করেন। বিমান শব্দটা লিখবার পরই মনে পড়লো এককালে আবাহনী, মোহামেডানের বাইরে বাংলাদেশ বিমানও ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি ছিলো, যেখানে হাবিবুল খেলেছেন কয়েক মৌসুম!
হাবিবুলকে নিয়ে লেখায় তার পড়াশোনা, অন্তদৃষ্টি, বিবেচনাবোধের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। বিভিন্ন ইন্টারভিউসূত্রে জানতে পারি, তার প্রচুর পড়াশোনার অভ্যাস রয়েছে। যদিও তিনি আজহারউদ্দিনের ফ্যান,তবু এই অভ্যাসের দিক থেকে তাকে রাহুল দ্রাবিড়ের নিকটবর্তী বলা যায়। ক্রিকেটারদের পড়াশোনার অভ্যাস কেন জরুরী সে সম্বন্ধে গুগলে বহু সুপাঠ্য নিবন্ধ রয়েছে, ক্রিকেট যে আদ্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক খেলা- এ কথাও ক্লিশে হয়ে গেছে এখন। তবু ক্রিকেটাররা নেট প্র্যাকটিস বা শারীরিক ফিটনেস বাড়াতে যে পরিমাণ সময় দেন তার এক-দশমাংশও যদি মেন্টাল গ্রোথে খরচ করতেন তাদের পারফরম্যান্স গ্রাফ এবং ব্যক্তিগত জীবনের শৃংখলা দুটোই সমৃদ্ধ হতো।
আমাদের দেশে ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে উঠার কোনো লক্ষণ দেখতে পাই না, সেই ম্যাচিউরিটি ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যেই কম। সাবেক বা বর্তমান ক্রিকেটাররা যখন টকশোগুলোতে আসে তাদের বক্তব্যে প্রজ্ঞা বাদে সবই পাওয়া যায়। কিন্তু ফারুক আহমেদ বা হাবিবুল বাশারের বক্তব্য বাকিদের চাইতে ভিন্ন হয়, ভাবনার খোরাক থাকে সেখানে। এমনকি ক্রিকেট সংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলোও গৎবাঁধা। সবকিছুতে ভারতের নির্ভুল অনুকরণ করেও তাদের ক্রিকেট অনুষ্ঠানের আদলে কিছু নির্মাণ করার যোগ্যতা এতোদিনেও কেন অর্জন করলাম না এটা ভাবতে গিয়ে বরাবরই মেধার সংকট এবং বাকচাতুর্য সমুখে চলে আসে। যে কারণে হাবিবুল বাশারের মতো ক্রিকেট মস্তিষ্কগুলো মাইনেভূক কর্মচারীর ন্যায় নিরুত্তাপ নির্বাচক হয়েই তাদের দায় মেটাতে বাধ্য হচ্ছে।
নির্বাচক হাবিবুল নয়, আমি তাই ব্যাটসম্যান হাবিবুলকেই মানসপটে ধারণ করতে চাই যিনি দলের সকল ব্যাটসম্যান যখন সাহসহীনতায় ভুগতে ভুগতে ব্যাটিং করাকে অভিশাপ গণ্য করতো, সেই সময়েও বিপক্ষের সবচাইতে দুর্ধর্ষ বোলারটিকেও নির্বিকার ভঙ্গিতে স্ট্রেইট ড্রাইভে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দিতেন।