যদি একটিমাত্র অপশন থাকে এবং বলা হয় সিনেমা আসলে কী, এন্টারটেইনমেন্ট, নাকি হায়ার ইন্টেলিজেন্সের সাথে কানেকশন? আমার ধারণা ৯৭% ক্ষেত্রেই উত্তরটা এন্টারটেইনমেন্ট আসবে। সর্বত্র তো এভাবেই লেখা হয়, সিনেমা হলো সবচাইতে বড় এন্টারটেইনমেন্ট বা বিনোদনমাধ্যম। আজ পর্যন্ত কোথাও পড়িনি, সিনেমাকে হাইয়ার ইন্টেলিজেন্স বা মানুষের হাইয়ার ইমাজিনেশনের রিফ্লেকশন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তবে আমি বিনোদনের যে সংজ্ঞায় বিশ্বাস করি সেটা মানলে হাইয়ার ইমাজিনেশনকেও বিনোদনের খোরাক বলা যেতেই পারে। আমার মতে বিনোদন হলো সেই কার্যক্রম যা কোনো কারণ ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিত্তকে উদ্দীপ্ত করে, এবং চিন্তাকে কলুষিত হওয়া থেকে দূরে রাখে। এই সংজ্ঞায়, আমার কাছে বিনোদনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম স্পোর্টস, এবং সিনেমা চলে যায়, হাইয়ার ইন্টেলিজেন্স কানেকশন এবং ইমাজিনেশনের আওতায়।
ফলে সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যকে আমি এন্টারপ্রেট করার চেষ্টা করি। যেমন, মারামারি দৃশ্য নিয়ে একসময় প্রচুর হাসাহাসি করতাম, মনে হতো ফ্যান্টাসি, একজন মানুষ এতোজনের সাথে পারে নাকি, কিংবা এত অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও ভিলেন কীভাবে হেরে যায়! তখন মনে হতো, মানুষের ইন্টারনাল ফ্যান্টাসিকেই বিবর্ধিত করতে এসব দৃশ্যায়ন। মনে মনে প্রতিটি মানুষ নিজেকে সুপারহিরো ভাবে যে একাই একশো। কিন্তু দীর্ঘদিন পর এর চাইতে বেটার এক্সপ্লেনেশন পেয়েছি। এখন মনে হয়, সমাজে অন্যায়, অত্যাচার আর নানাবিধ প্রতিকূলতা একজন মানুষকে দমিয়ে রাখে, এর মধ্য থেকেও কিছু মানুষ সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে ঠিকই সফল হয়, যাদের আমরা নায়ক বলি। অধিকাংশ মানুষই প্রতিকূলতার মুখে ভেঙ্গে পড়ে, যে কারণে সিনেমাতেও দেখা যায় নায়কের ভাই বা প্রতিবেশী খুব সহজেই ভিলেনের কাছে ধরাশায়ী হয়। অনেক অস্ত্রশস্ত্র, স্বাস্থ্যবান গুণ্ডা-পাণ্ডা মিলে প্রতিকূলতার ব্যাপকতাটাই মেটাফোরিকালি রিপ্রেজেন্ট করে।
ভায়োলেন্সের দৃশ্যকেও এন্টারপ্রেট করতে পারি। জীবনের বিভৎসতা আমাদের মধ্যে এক বিরামহীন টেনশন তৈরি করে, অস্বস্তি অনুভূতি জাগায়, তবু আমাদের মনোজগতে ভায়োলেন্সের জয়জয়কার।
গানের দৃশ্যকেও মনে হতো ফালতু। পরবর্তীতে এন্টারপ্রেট করি এভাবে, মানুষ তার পরম সুসময় বা চরম দুঃসময়ে এক গভীর ইমোশনাল জার্নির মধ্য দিয়ে যায়, সেটাই গানের মধ্য দিয়ে সারমর্ম আকারে প্রেজেন্ট করা হয়।
কিন্তু বহু চিন্তা করেও সিনেমায় যৌনতার দৃশ্যায়ন নিয়ে আজ অবধি কোনো এন্টারপ্রেটেশন দাঁড় করাতে পারিনি। হতে পারে অগভীর পর্যবেক্ষণ, চিন্তার সীমাবদ্ধতা, তবু যৌনতার দৃশ্যায়নের তরজমা কী তা আজও বুঝে উঠতে পারলাম না।
ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম- এই তিনটি তাড়না প্রত্যেক প্রাণী জন্মগতভাবেই লাভ করে। একজন মানুষকে কখনোই কেউ শেখায় না কীভাবে খেতে হবে, ক্ষুধা লাগলে যে কোনো উপায়েই হোক সে খেয়ে নেয়, পিপাসা লাগলেও পান করে। যৌনতার ব্যাপারটাও তেমন; প্রশিক্ষণ দিয়ে শেখানোর দরকার পড়ে না কীভাবে শারীরিক সংসর্গ হবে, বয়সের সাথে সাথে এই জ্ঞান আপনাআপনিই চলে আসে। ধরা যাক, সিনেমায় নায়ক-নায়িকা শারীরিকভাবে মিলিত হলো; এই দৃশ্য ডিটেইলভাবে দেখিয়ে আসলে কোন উদ্দেশ্যটা পূরণ করতে চায়? যৌনতার প্রক্রিয়া শেখানো, নাকি কীভাবে অনাবৃত হবে, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন কেমন হবে সেই আচরণের প্রশিক্ষণ? এর মধ্যে হাইয়ার ইমাজিনেশন-ইন্টেলিজেন্স কোথায়, চিন্তাকে নিষ্কলুষ রাখার সংজ্ঞাবদ্ধ বিনোদন কোথায়, কিংবা আটপৌরে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি কোথায়? যৌনতা যেহেতু জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, সিনেমায় সেটা আসতেই পারে অবধারিতভাবে, কিন্তু কোন্ প্রক্রিয়ায় যৌনতা সম্পন্ন হচ্ছে সেই ডিটেইলিংয়ের যৌক্তিকতা কতটুকু সুস্থ চিন্তার লক্ষণ? শরীরের খোঁয়াড় হওয়াই কি মানুষের নিয়তি তবে?
যৌনতা দুজন ব্যক্তির মধ্যে পরম আস্থার এক সমঝোতা স্মারক, যেখানকার প্রধানতম ভিত্তি নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা; যৌনতাকে বলা যেতে পারে দুজন মানুষের মধ্যে ভীষণ আনঅর্থোডক্স এবং আনকনন্ডিশনাল কমিউনিকেশন এপ্রোচ যেখানে তারা পরস্পরের মধ্যবর্তী সকল দূরত্ব ঘুঁচিয়ে ফেলে- আড়ালেই তার পরিশুদ্ধ আবরণ রক্ষিত হয়। এরকম উচ্চমার্গীয় শৈল্পিক জীবনাচরণকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার মাধ্যমে জীবনের এবসোলিউট ডিসেন্সি নষ্ট হয়ে যায়, পারস্পরিক কমিটমেন্টের মৌলিক জায়গাটি ক্ষতবিক্ষত হয়, সর্বোপরি মানুষ হিসেবে নিজেদের জীবনবোধের চরম অধঃপতন ঘটে।
দুটো কুকুর নির্বিঘ্নে প্রকাশ্য রাস্তায় যৌনতায় লিপ্ত হতে পারে। ক্যামেরার সামনে দুজন মানুষ যৌনতার নিখুঁত অভিনয় করছে, হলজুড়ে বিশাল স্ক্রিনে বা কম্পিউটারের মনিটরে লাখ লাখ মানুষ সেই দৃশ্য দেখছে; মানুষ আর কুকুরে তফাৎটা কোথায় থাকে তখন! যৌনতার প্রক্রিয়াকে ক্যামেরাবন্দী করে ডিরেক্টর দুটো কামার্ত কুকুর আর লক্ষ-কোটি অবদমিত চেতনাকেই একই লাইনে এনে দাঁড় করিয়ে দেন যেন; অভিনেতা-অভিনেত্রী নয়, কামার্ত কুকুরগুলোই জীবন্ত হয়ে উঠে, এবং খুঁজতে থাকি এর এন্টারপ্রেটেশন কী! পারফিউম মুভিতে একটা দৃশ্য আছে যেখানে শত শত মানুষ খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত রাস্তার মধ্যে উন্মত্ত যৌনতায় লিপ্ত হয়। প্রতিটি সিনেমার যৌনদৃশ্য আদতে ওই পারফিউম মুভির দৃশ্যটিরই রেপ্লিকা, যারা নেশায় বুঁদ হয়ে সকল প্রকার ভব্যতা, সভ্যতা আর ডিসেন্সিকে বিসর্জন দিয়ে স্রেফ কামার্ত কুকুরে পরিণত হয়ে উঠে।
উপমহাদেশের সিনেলোচনায় চরিত্রের প্রয়োজনে খোলামেলা পোশাক পরা, দৃশ্যের প্রয়োজনে নগ্ন হওয়া প্রভৃতি মুখরোচক কথা-বার্তা খুব শোনা যায়। ছত্রাক বা কসমিক সেক্স জাতীয় সিনেমায় পাওলি দাম, ঋ সেন দের অভিনয়কে বলা হয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার নিদর্শন। এইসব কথাকে বুলশিট বলে খারিজ করে দিলে তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ট্যাগিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা বলেন, যৌনতাকে ট্যাবু মনে করা বাঙালি এই সাহসিকতা হজম করতে পারবে না, শরীরকেন্দ্রিক শিল্পের কদর বুঝতে পারে না, অথচ দিনশেষে কয়েকটা পরকীয়া করা, পরস্ত্রী বা পরের স্বামীকে ঘিরে যৌন ফ্যান্টাসিতে ভুগে জীবন পার করে দেয়! এই যাদের যুক্তির বাহার তারা প্রগতিবাদীই বটে! যৌন প্রক্রিয়া দেখানো, খোলা বুক, ক্লিভেজ- এই সমগ্র ব্যাপারটির মেসেজ বা বক্তব্য কী? জেনিটাল বা সেনসিটিভ অর্গান দেখানোর মধ্য দিয়ে কোন্ শিল্পটি উদ্ধার করা হয় আসলে? যৌনতাকে গ্লোরিফাই করার জন্য বিশাল লাভজনক পর্ণ ইন্ডাস্ট্রি আছে, পর্ণোগ্রাফির ধুন্ধুমার চাহিদা আছে, যেখানে রাখঢাকের কিছু নেই, একেবারে নির্ভেজাল আদিম প্রবৃত্তির পরিচর্চা চলবে। কিন্তু এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়াম নাম দিয়ে সেখানে যৌনতাকে পুশ এবং প্রমোট করার চর্চাটি হাইয়ার ইমাজিনেশন নয়, লালসার রূপায়নই মূখ্য মনে হয়।
তবে বিনোদন সংজ্ঞাতেই হয়তোবা সচেতনভাবে ঢুকে পড়েছে যৌনতা। ইন্টারনেটে সবচাইতে বেশি ভিজিট করা হয় পর্ণ সাইটগুলো, পৃথিবীজুড়ে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের নাম কামসূত্র; অনিয়ন্ত্রিত যৌনতাবোধ অন্যতম প্রমিজিং মার্কেটপ্লেস। সিনেমা তো কেবল হাইয়ার ইমাজিনেশন নয়, এটা একটা পুরোদস্তুর বিজনেস সেক্টর। সুতরাং প্রোডাক্ট হিসেবে যৌনতার হাই সেলিং ভ্যালুকে বিবেচনায় রেখে সিনেমায় সেটিকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়তোবা খুবই বৈষয়িক ভাবনার দৃষ্টান্ত। এবং যৌনতার মধ্যেও পিতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব স্পষ্ট, যেকারণে এসব দৃশ্যে নায়কের চাইতে নায়িকার এক্সপ্রেসন, উপস্থাপন অনেক বেশি ভাইটাল হয়ে উঠে সবসময়।
চুম্বনদৃশ্য বা ধর্ষণদৃশ্য কি যৌনদৃশ্যের মধ্যে পড়ে? চুম্বন এমন এক অমীমাংসিত ইমোশনাল বিহেভিয়ার যেখানে স্নেহ যেমন বোঝানো যায়, প্রচণ্ড কামার্ততাও বোঝানো যেতে পারে, নির্ভর করছে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেই এপ্রোচের ওপর। তবে সিনেমার চুম্বনদৃশ্যগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কামার্ততার রিপ্রেজেন্টেশন হয়ে থাকে। প্রাইভেসি বিষয়টা যখন লঙ্গরখানা হয়ে যায় তখন সেটা সৌন্দর্য হারিয়ে কদর্যতার রূপ পরিগ্রহণ করে। রোমান্স যখন জনসমাবেশ হয়ে উঠে সেটা আর রোমান্স থাকে না, সার্কাস হয়ে যায়। চুম্বনদৃশ্যকে বরাবর তাই সার্কাস হিসেবেই এন্টারপ্রেট করে এসেছি।
কিন্তু ধর্ষণদৃশ্যের যৌক্তিকতাকে মূল্যায়ন করা কঠিন মনে হয়। ইরেভারসিবল সিনেমায় মনিকা বেলুচ্চির ধর্ষিত হওয়ার দৃশ্য, কিংবা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ সিনেমায় সেই সাইকো স্টাইলে ধর্ষণ দৃশ্য এগুলো দেখলে ভিক্টিমের প্রতি প্রচণ্ড সিমপ্যাথি জাগে, কিন্তু উপমহাদেশের সিনেমায় ধর্ষণদৃশ্য মানে ধস্তাধস্তি, পোশাক ছেঁড়া, শরীর লেহন- এই উপস্থাপনের এন্টারপ্রেটেশন কী? এটাও সেই ব্যবসায়ের প্রয়োজনেই আরোপিত দৃশ্য সংযোজন, এতোটাই যৌন প্যারালাইজড মানুষে ভরতি পৃথিবী! কারো তীব্র অনিচ্ছায় পাশবিক আক্রমণে তার সাথে মিলিত হওয়া এই দৃশ্য বোঝানোর জন্য এতো আয়োজনের মধ্যে কোথায় যেন একধরনের গোষ্ঠীগত অবদমিত চেতনা লুকিয়ে থাকে। এক ধর্ষকামী প্রজন্ম তৈরির এজেন্ডা তৈরি হয়ে যায় অজান্তেই; যে কারণে পুরো ছবি না দেখে বারবার শুধু সিনেমার ওই বিশেষ দৃশ্যগুলো দেখা মানুষের সংখ্যাই বাড়তে থাকে দিনদিন।
সিনেমায় যৌনতা নতুন কোনো বিষয় নয়, একদম প্রারম্ভিক কাল থেকেই এটা ছিলো, যেহেতু মানুষের জীবনের মাল-মশলা নিয়েই সিনেমা তৈরি হয়। তখন যৌনতার উপস্থাপন হতো সুনির্দিষ্ট কিছু কৌশলে- দুজন মানুষ বিছানায় বসে পরস্পরের হাত একত্রিত করেছে, ক্যামেরা রোল করে ঘরের কোনো ছবিতে স্থির হয়ে কাট আউট হয়েছে, কিংবা ছাতার নিচে, বাতি নিভে যাওয়া প্রভৃতি সংকেত থেকেই দর্শক বুঝে নিতো মূল ঘটনা। কিন্তু সময়ের চলমানতার সাথে সাথে উপস্থাপনেও আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠলো; আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি পর্ণের ব্যাপারে কড়াকড়ি না থাকলে এতোদিনে পর্ণোগ্রাফি আর মেইনস্ট্রিম সিনেমার মূল পার্থক্য থাকতো স্টোরিলাইন ফ্যাক্টর। যৌনতার দৃশ্যায়নকে বিরোধীতা করলে যারা যৌনতাকে ট্যাবু হিসেবে উপস্থাপন করে ইন্টেলেকচুয়াল সাজবার প্রয়াস চালান, তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে মলত্যাগও তো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সিনেমায় এই দৃশ্য তো কখনো দেখি না। কিংবা মলমূত্র কখনো দেখায় না কেন? বড়জোড় কমোডের উপরে বসে থাকার দৃশ্য ধারণ করা হয়। তখন যদি রুচির প্রশ্নে আটকে দেয়া যায়, যৌনতার মতো এমন প্রবল গোপনীয় কমিটমেন্টকে ডিটেইল উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সেই রুচি থাকে কোথায়? যৌনতার আনঅর্থোডক্স পারস্পরিক যোগাযোগকে সম্মান জানানোর চর্চা নেই, কমিটমেন্টকে মূল্যায়ন বা সম্মান জানানোর ভ্রুক্ষেপ নেই, কেবল নগ্ন শরীরের জড়াজড়ি দেখিয়ে নিজেদের এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ফ্যান্টাসিকে স্যাটিসফাই করো; এই বিকৃত দাসত্বের মধ্যে শিল্প কোথায়, হাইয়ার ইমাজিনেশন কোথায়, আর বুদ্ধিবৃত্তিই বা কোথায়!
বহুবছর আগে বুয়েটে পড়াকালে আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক জ্ঞানী বন্ধু বলেছিলো, ‘বুঝলে হিমেল সভ্যতা বলো, পৃথিবী বলো, সম্পর্ক কিংবা সমাজ- যা-ই বলো, পুরো দুনিয়াটা নিয়ন্ত্রিত হয় মাত্র তিনটি মৌলিক ফ্যাক্টর দ্বারা- ইকোনমিক্স, পলিটিক্স আর সেক্স’। ইকোনমিক্স আর পলিটিক্সের ব্যাপারে দ্বিমত করার অবকাশই নেই, কিন্তু বিভিন্ন কার্যক্রম এবং আশপাশের সবকিছু পর্যবেক্ষণ শেষে এতোদিনে নিশ্চিত হয়েছি, সেই জ্ঞানী বন্ধুটি একদম যথার্থ মন্তব্য করেছিলো।
শুধু যৌনদৃশ্য নয়, পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যৌনতা ফ্যাক্টরটাই প্রাধান্য পায়। উপমহাদেশ বা বলিউড, যেখানেই হোক, নায়িকার পোশাক এবং দৃশ্যের সাপেক্ষে সেই পোশাকের যৌক্তিকতা বোঝার চেষ্টা করলেই অনুধাবন করা যায় মূল ইনটেনশনটা কোনদিকে। আসলে পরিচালক নায়িকার পোশাকে সমগ্র ম্যাসিভ পপুলেশন সাইকোলজিরই অবদমনকে উপহাস করেন; কতটা ডিপ্রেসড এবং বঞ্চিত হলে ম্যাসিভ পপুলেশন পোশাকের ফাঁকে বুঁদ হয়ে থাকে, এই মাত্রা ব্যবসায়ী মন বুঝতে একটুও ভুল করে না, এবং সেটাকে পুঁজি করেই অর্থ-বিত্ত-খ্যাতি অর্জন করে নেন।
ক্রিটিকরা তাদের লেখায় ‘প্রাপ্তমনস্ক’ নামক চার্মিং শব্দটি অতিব্যবহারে জীর্ণ করে ফেলবেন, উদ্ভাবন করবেন উত্তরাধুনিকতা, উদারনৈতিকতার তত্ত্ব, এবং বিরুদ্ধিবাদীদের শিল্পমূর্খ, কূপমন্ডুক প্রভৃতি গালিগালাজ উপহার দিয়ে বিদগ্ধতা উদগীরণ করবেন, পিউরিটান শব্দটা হবে নেগেটিভিটি সঞ্চারক আর হাসাহাসির অবলম্বন। কিন্তু যুক্তিবাদী মনে চিন্তাও করতে পারবে না, যৌনতার দৃশ্যায়ন এতো ডিটেইলভাবে উপস্থান করে মানুষকে সেক্সুয়ালি স্টিমুলেট করা ছাড়া কোন্ বিরল শিল্পসৃষ্টিতে তা ভূমিকা রাখতে পারলো! আর্ট-ফার্ট না বলে সরল ভাষায় ‘শরীর কারখানা’ হিসেবে সিনেমাকে স্বীকার করে নিলেই তো হয়।
বস্তুবাদীতার আধিক্যে যুক্তিবাদী বোধ অনেকটাই লুপ্ত হয়ে গেছে, ইন্দ্রিয়বিলাসই চূড়ান্ত প্রাপ্তি এখন মানুষের। পৃথিবীজুড়ে যত মানুষ তার চাইতেও বেশি ইন্দ্রিয়পূর্তির উপায়সংখ্যা। এরকম এক পৃথিবীতে সিনেমায় যৌনতার দৃশ্যায়নের এন্টারপ্রেটেশন খোঁজাটাই নির্বুদ্ধিতার বহিঃপ্রকাশ, এবং ইম্যাচিউরিটি। আমরা যা দেখতে চাই সিনেমা সেটাই আমাদের দেখায়, এখানে হাইয়ার ইমাজিনেশন ভেকমাত্র। আমরা বেশি করে নায়ক-নায়িকার ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখে উত্তেজিত হতে চাই, সিনেমাও সেটাই দেখিয়ে চাহিদা নিবৃত্ত করতে কন্ট্রিবিউট করছে। এর মধ্যে কিন্তু খোঁজাটা তো ক্লীবতার নামান্তর।
এতোটা বয়স হয়ে গেলো, এখনো আর্ট ব্যাপারটাই বুঝলাম না, দেহতত্ত্বের নান্দিকতাকে নিজের মতো করে বুঝতে চেয়ে পণ্ডিতবর্গের প্রদর্শনমুখী দর্শনকে ইডিয়ট আখ্যা দিয়ে জনবিচ্ছিন্নই থেকে গেলাম জীবনভর। এতো বিপুল জনগোষ্ঠীর অফুরন্ত যৌন ফ্যান্টাসিকে প্রকাণ্ডতা দিতে অবদান রাখা পরিচালক, শিল্প নির্দেশক, বোদ্ধা, এবং সর্বোপরি যৌনতার দৃশ্যে অভিনয় করা সাহসী কলাকুশলীদের প্রত্যেকের জন্য সমবেদনা। ভয় নেই, একদিন এমন এক পৃথিবী হবে যেখানে সেন্সর বোর্ড থাকবে না, পিউরিটান মানসিকতা থাকবে না, তথাকথিত ট্যাবু থাকবে না, ঘর বলতে কিছু থাকবে না, চৈত্রের ভরদুপুরে গাছের নিচেই মানুষ পরম নিশ্চিন্তে যৌনশিল্পে মত্ত হবে; সেদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যৌনদৃশ্যগুলো সেলুলয়েডে ধারণ করে ডিসেন্সির শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও ধূলিসাৎ করা চাই কিন্তু।
তবু কথা থেকে যায়। আমি বা আমরাই এইসব যৌনদৃশ্যের নির্লজ্জ ভোক্তা; আমাদের নিজেদেরই ডিসেন্সি বলতে কিছু নেই, সিনেমা তো সেটারই সুযোগ নিচ্ছে মাত্র। সুতরাং হাইয়ার ইমাজিনেশনটা থিওরি হিসেবেই ভালো হয়তো, বাস্তব জীবনে তার চর্চা করতে গেলে বিনোদনের বাজার চলতি সংজ্ঞার কাছেই ধরাশায়ী হতে হবে। ইন্টেলিজেন্স, ইমাজিনেশন সবকিছুই অনিয়ন্ত্রিত ইমোশনের কাছে পরতে পরতে ধোঁকা খেয়ে যায়। এতো পরাজয় নিয়ে বেঁচে থাকে কোন্ আশায় মানুষ!
এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধরো
এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর করো