একা রিকশা, পাঠাও, কিংবা সিএনজিতে চড়লে সাধারণত চালকের সাথে গল্প করি আমি। এই শ্রেণির পেশাজীবীরা গল্প করতে সচরাচর আপত্তি করে না। ব্যতিক্রম এক্ষেত্রেও থাকে অবশ্য। এইসব গল্পের বিষয়বস্তু থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এবং বিশ্বরাজনীতি বিষয়ে তাদের অভিমত। মাঝে মাঝে তাদের চিন্তা শুনে হকচকিত হই। নাপিত, চাওয়ালা এবং চালকশ্রেণির চিন্তাধারা নিয়ে যদি কোনোদিন বই লিখতে পারতাম সেটা অসাধারণ এক চিন্তা আর্কাইভ হতে পারতো। হয়নি বলে অনুযোগ করছি না, কোনো একদিন হয়েও যেতে পারে।

আমি যে ৩টা কোম্পানীতে বিজনেস ফিলোসফি সার্ভিস দিই তার একটা Wedevs;মূলত ওয়ার্ডপ্রেস ভিত্তিক প্লাগিন বানায় তারা। মিরপুর ডিওএইচএস
এ অফিস তাদের। আজ সেখান থেকে সিএনজিযোগে ফেরার পথে সিএনজি চালকের মুখে যেসব বক্তব্য শুনলাম, আমার মনে হচ্ছে কথাগুলো সংরক্ষণ করা উচিত। আমি কেবলই শ্রোতা ছিলাম, তাকে যথাসম্ভব বলার স্পেস দিতে।
চালকের নাম আবুল বাশার, থাকে লালবাগে, তিন ছেলের একজন অনার্সে, একজন ক্লাস নাইনে, একজন ক্লাস ফাইভে পড়ছে।

গল্পের মোড় ঘুরে যায় সাগুফতা মোড় থেকে সামান্য এগুনোর পরই। অপরপাশ দিয়ে আসা রিকশাওয়ালারা তাকে নিষেধ করে সামনে যেতে, পরিবহন শ্রমিকরা নাকি আগুন জ্বালিয়েছে, ফলে রুট পরিবর্তনে বাধ্য হতে হয়। রুট পরিবর্তনের সাথে সাথে তার বক্তব্যও পলিটিক্যাল হতে শুরু করে। প্রথম কথাটিই ছিলো, ভাই পরিবহন শ্রমিকরা খেইপা গেছে, অনির্দিষ্ট কালের অবরোধ দিবো দেইখেন। শাহজাহান সাবের পদত্যাগ চাইছে না পোলাপান? এইবার দেখেন পরিবহন শ্রমিকরা কী জবাব দেয়। এই লোকের কথায় পরিবহন সেক্টর উঠে-বসে।
খানিক বিরতি দিয়ে সে পুনরায় শুরু করে।’ভাই দোষ দুই দিকেই আছে। এই যে পোলাপানগুলা রাস্তায় নামছে, এমনি কইরা কি ওরা কিছু করতে পারবো? কয়দিন পরই কাবজাব শ্যাষ। মালিকগুলা সব হারামি। বাসের ড্রাইভার, হেল্পার কারো ফিক্সড বেতন নাই, মালিক টার্গেট দিবো, সেইটা পূরণ করতে হইবো। এইডা কোনো কথা হইলো কন? এই যে আমি সিএনজি চালাই, প্রতিদিন মালিকরে ১০০০ টাকা জমা দিতে হইবো, গ্যাস লাগে ৪০০ টাকার, খাওয়া দাওয়া ধরেন ২০০ টাকা; এইবার তাইলে দেখেন কয় টাকা নিয়া ঘরে যাইতে পারি’। প্রসঙ্গ বদলায় হঠাত- ‘ গতকাল শনির আখড়ায় সারাদিনে ৪০-৫০ হাজার টাকা চাদাবাজি হইছে। লাইসেন্স দেখতে চাইয়া ৫০০ টাকা শুরু কইরা ১০০০০ পর্যন্ত টাকা খাইছে’। আমি অবিশ্বাসের স্বরে বলি- কী বলেন, ওইটুক পোলাপান চাদাবাজি করে’! সে আমার সংশয় দূর করে- আমি কি কইছি পোলাপান চাদাবাজি করছে? পোলাপানের মধ্যে গাঞ্জুট্টি, হিরোইঞ্চি ঢুইকা পড়ছে ছাত্র সাইজা। ছাত্র দেখলে আমরা চিনি। এয়ারপোর্ট এলাকায় গেছি, ধানমন্ডিতে গেছি, পোলাপান সুন্দর কইরা কয় মামা লাইসেন্স আছে, মামা বাম দিক দিয়া যান। কিন্তু শনির আখড়াতে যেগুলারে দেখছি ওইগুলার পোশাকের ঠিক নাই, মুখের ভাষার ঠিক নাই, ওইগুলা ছাত্র না।
আমরা আগাতে থাকি, আশপাশে অনেকগুলো থেমে থাকা গাড়ি, ভাঙচুর করা হয়েছে সবগুলোই। সে বলে, এই গাড়িগুলা ভাঙ্গাতে খুব খুশি হইছি আমি। ঢাকা শহরে যত গাড়ি চলে, মিরপুর রুটের গাড়ি হইলো সবচে হারামজাদা। এইগুলার একটারও লাইসেন্স নাই, গাড়ির মালিক বড়ো কোনো নেতা। আমি ভাই ২৬ বছর ধইরা গাড়ি চালাই। রেন্ট এ কার এ চালাইছি, ট্রাক চালাইছি, বাস চালাইছি; ২-৫ টাকা ভাড়ার জন্যে মা-বাপ তুইলা গালিগালাজ করে, এইটা মানা যায় না। এখন সিএনজি চালাই, ইচ্ছা হইলে খ্যাপ মারি, নাইলে ঘুমাই, জীবনে শান্তি আছে।
তার ক্ষোভ গিয়ে পড়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের ওপর। ‘ এই ব্যাটা ইলিয়াস কাঞ্চন, তারানা হালিম এরা আছে লাইসেন্স নিয়া। আরে ব্যাটা লাইসেন্স হইলো একটা প্লাস্টিকের জিনিস, টাকা দিলে কুত্তারেও লাইসেন্স দিবো। দালালরাই সব ম্যানেজ কইরা দেয়, আপনে খালি ফিঙ্গার প্রিন্ট দিবেন। আপনে বি আরটি তে কোনোদিন গেছেন কিনা, ওইখানে যেইভাবে পরীক্ষা নেয়া হয় ওইডা একটা বালের সিস্টেম। ম্যাজিস্ট্রেট আমারে প্রশ্ন কোড়ছে- বলেন দেখি রক্ষিত আর অরক্ষিত রেলস্টেশন কী। আমি তারে পাল্টা প্রশ্ন করছি- স্যার স্টেশন অরক্ষিত থাকবো ক্যান? ওইখানে কোনো এক্সিডেন্ট হইলে সেইটার জন্যে তো গভমেন্টের নামে মামলা করা উচিত’। একটুপর সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে- ভাই, এই দেশে সব হইলো টাকার খেলা। ড্রাইভারগো কেউ মানুষ মনে করে না। কয়েকদিন আগে আমার বউরে নিয়া ঢাকা মেডিকেলে গেছি, এক সিএনজি ড্রাইভাররে নেশার ওষুধ খাওয়াইয়া গাড়ি ছিনতাই কইরা নিয়া গেছে। ড্রাইভারের মুখ দিয়া ফেনা বাইর হইতেছে, কেউ তার কাছেও আসতেছে না। আমি ওয়ার্ডবয়রে কইলাম, আমারে ধমক মাইরা কইলো, শালা ড্রাইভার থাকুক পইড়া। আপনের কি মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী যে দুই পরিবাররে ২০ লাখ টাকা দিছে ওরা পুরা টাকা পাইবো? আমি ক্ষতিপূরণ কইতে চাই না, কারণ জানের বিনিময় টাকা হয় না। তবু টাকা যেহেতু দিছে সেইটা প্রধানমন্ত্রীর একাউন্ট থিকা সরাসরি তাগো একাউন্টে যাইবো। কিন্তু দেইখেন, এই টাকা হেরা তুলতে তুলতে ২-৫ লাখ টাকা গায়েব হইয়া যাইবো। তার মানে প্রধানমন্ত্রীর টাকায় ঘুষ খাওয়ার মতো মানুষও দেশে আছে’।
আমি ইলিয়াস কাঞ্চনের পক্ষ নিয়ে বললাম, আপনার মতে ইলিয়াস কাঞ্চনের কী করা উচিত ছিলো? সে বলে- প্রাইমারি স্কুলের পাঠ্যসূচীতে নিরাপদ সড়ক বিষয়ডা ঢুকানো উচিত। ওই বাচ্চারা তাইলে বুঝবো, বড়ো হইলে মানবো। এক্সিডেন্টের জন্যে খালি ড্রাইভারগো দোষ দিলে হইবো না। ফুটওভার ব্রিজ তো কম না, কয়জনে ব্যবহার করে? আপ্নে ড্রাইভারগো ট্রেনিং দিতাছেন। আরে ভাই, আমি গাড়ি চালাই ২৬ বছর ধইরা, আপ্নে আমারে কিসের ট্রেনিং দিবেন। একটা কথা কই ভাই, শাহবাগ থিকা কাকলী মোড় পর্যন্ত কোনো ড্রাইভার যদি নিরাপদে আপ-ডাউন করতে পারে সে এশিয়ার যে কোনো দেশে পাশ করবো। গতকাল টকশোতে একজনের কথা খুব পছন্দ হইছে। সে মনে হয় ঢাকা ভার্সিটির টিচার ছিলো আগে। সে কইছে, ড্রাইভারগো লাইসেন্সে পয়েন্ট রাখা উচিত। সে অঘটন ঘটাইলে পয়েন্ট ১ কইরা কমবো, কইমা শূন্যতে নামলে লাইসেন্স বাতিল হইয়া যাইবো। পয়েন্ট কমার সাথে সাথে তার ন্যাশনাল আইডি কার্ডের একটা কইরা সংখ্যা বাতিল হইবো। তখন সে কিন্তু কোনোকিছুতে এপ্লাইও করতে পারবো না। চিন্তাডা পছন্দ হইছে’।
আমি অবাক হয়ে বলি- আপনি টকশো দেখার সময় পান? সে বলে হ্যাঁ, দেখার মধ্যে ওইটাই দেখি শুধু।

আমি গন্তব্যের খুব কাছাকাছি আসি, সে বলে- ভাই এখন যে কথাটা কমু সেইটা শুনলে ছাত্ররা তো সব সিএনজি ভাঙচুর করবো। বাসে স্টুডেন্টের জন্যে হাফ ভাড়া করছে।বুঝলাম ওরা পড়াশোনা করে, উপার্জন নাই, অগো স্পেশাল সুবিধা দেয়া উচিত। কিন্তু সেইটা খালি বাসের জন্যে ক্যান? বাস ভাড়া কয় টাকা? তুমার পকেটে ২০-৩০ হাজার টাকার ফোন, তুমি ফাস্টফুডে খাইতে যাইয়া ৩ হাজার টাকা বিল দাও, তখন তো ছাত্র বইলা হাফ বিল রাখে না। ডাক্তারের কাছে গেলে হাফ ভিজিট রাখে না, অথবা স্টুডেন্ট ভাড়া দিলে বাড়ি ভাড়া তো অর্ধেক হয় না। খালি বাসে উঠলে স্টুডেন্টের কথা মনে পড়ে, এইটা কেমন কথা!

আমি শ্যামলি প্রিন্স বাজারের সামনে নামি। দুজনে মিলে দুটো ডাব খাই। ডাবওয়ালার ভাষা শুনেই সে বুঝতে পারে, তারা একই এলাকার মানুষ। ডাব খাওয়া শেষে আমি তার ফোন নম্বর নিই। বলি, ভাই আপনার সাথে আরেকদিন লেগ রোস্ট খাইতে খাইতে আলাপ করুম। আপনে জ্ঞানী লোক, আপ্নারে পছন্দ হইছে আমার। সে বলে- ভাই আপনের পেশা কী আসলে?
আমি স্মিত হেসে উত্তর দিলাম- কিছুই করি না ভাই, মাঝেমধে বিভিন্ন কোম্পানীতে বিজনেস এডভাইজ দিই, বাকি সময় আপনাদের মতো মানুষদের সাথে গল্প করি।
সে কী বুঝলো জানি না। শুধু বললো, কোনো দরকার পড়লে ফোন দিয়েন।

এরকম মানুষকে তো আমার প্রতিদিনই দরকার, কতবার ফোন করবো আমি!