ক্রিয়েটিভ মানুষ কাকে বলে সে সংক্রান্ত একটি চলতি ধারণা গণমানসে থাকে বোধকরি, সাব-ক্রিয়েটিভ সেই মানসে একটি অচেনা দ্যোতনা হলেও হতে পারে। ‘সাব’ অব্যয়টির  বহুল ব্যবহার আমরা পাই সাব-স্ট্যান্ডার্ড, সাব-রেজিস্টার, সাব-কন্ট্রাক্টর, সাব-জজ প্রভৃতি শব্দে, সেই নিরিখে মনে হতে পারে সাব-ক্রিয়েটিভ মানে হয়তোবা ক্রিয়েটিভিটির ক্ষুদ্রাবস্থা, যেমনটা নেতা আর পাতি-নেতার পার্থক্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। তবে যে উদ্দেশ্যে শব্দটির অবতারণা তা এতটা লিনিয়ার নয়।

 

অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-ব্যবসা সর্বক্ষেত্রে  ক্লিশেতম শব্দ ‘স্ট্রাগল’,বিশেষত সফল মানুষের জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করলে সেখানে স্ট্রাগলের যেমন সুনিপুণ বর্ণনা পাই তাতে স্ট্রাগলকে অনেক বেশি অনিবার্য এক শর্ত মনে হতে বাধ্য। স্ট্রাগল এক শ্রেণিনিরপেক্ষ অভিজ্ঞতা। স্ট্রাগল যেন এক সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গ যার শেষপ্রান্তে সোনালি সূর্য।

 

খটকাগুলোর সূচনাও এখান থেকেই।

 

সাব-ক্রিয়েটিভ মানুষেরা আত্মপ্রবোধের জন্য স্ট্রাগল ব্যাপারটিকে যেরকম মহিমাণ্বিত করার চেষ্টা করে স্ট্রাগল কি আদতেই উল্লেখযোগ্য কিছু? একজন মানুষকে কখন প্রতিষ্ঠিত বলা যায় তার কাঠামোযুক্ত এক সামাজিক ধারণা রয়েছে, তবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানেই কি স্ট্রাগলের  সমাপ্তি; এরপর অন্তহীন সাফল্যসুখের আখ্যান? বরং সামাজিক মানদণ্ডে প্রতিষ্ঠিত মানুষের সাথে দীর্ঘ গল্প করে উপলব্ধি করেছি প্রতিষ্ঠার পরিসর যত বাড়ে স্ট্রাগল আরো বিচিত্র আর বিকট হয়।

 

ধরা যাক আপনি একজন জেলা প্রশাসক অথবা গ্রুপ অব কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর, আপনার প্রতিপত্তি ব্যাপক, এটা ধরে রাখা বা বৃদ্ধি করার স্ট্রাগলটা কি আরো কঠিন নয়?

 

একটা দীর্ঘ সময় অবধি ক্রিয়েটিভিটি সংক্রান্ত আমার যে মনোভাব ছিলো সম্প্রতি সেখান থেকে বেশ খানিকটা বাঁক নিয়েছি। ক্রিয়েটিভিটিকে স্কিল বা প্রবণতার চাইতে ব্যয়িত সময় এবং ইনটেন্ট- এই দুই ফিল্টারকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে শুরু করেছি। ক্রিয়েটিভিটিকে দেখি এভাবে, একজন ব্যক্তি যদি কোনোকিছু প্রচলিত রীতির চাইতে ভিন্নভাবে ভাবতে, দেখতে এবং উপস্থাপনের যোগ্যতা রাখে এবং ভালো লাগার কাজে প্রতিদিন গড়ে ৮ ঘণ্টা ‘কোয়ালিটি সময়’ অতিবাহিত করে তাকে  ক্রিয়েটিভ বলা উচিত। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম, বিনোদন, জৈবিক তাড়নার  যে পঞ্চবটিকা এবং সাথে সামাজিকতা— সবমিলিয়ে যে পরিমাণ সময় ব্যয়িত হয় সেখান থেকে প্রতিদিন ৮ ঘন্টা কোয়ালিটি সময় ভালো লাগার কাজে নিবেদন অনেকাংশেই অসম্ভব বহু মানুষের ক্ষেত্রে। সেইসাথে ভাবা, দেখা আর উপস্থাপনে ভিন্নতা রাখার যোগ্যতা, সেও এক দুরূহ ব্যাপার।

 

আমার এখনকার পর্যবেক্ষণসূত্রে, ক্রিয়েটিভিটি কোনো বাই ডিফল্ট বৈশিষ্ট্য নয়, অর্থাৎ কেউ একজন ক্রিয়েটিভ মানে আজীবনের শর্তে ক্রিয়েটিভ নয়,এটি অনেকটাই ত্রৈমাসিক চক্রে ব্যক্তির ইনটেন্ট এবং কোয়ালিটি সময় এর উপর নির্ভরশীল। প্রতি ৩মাস পর সে ক্রিয়েটিভিটির নতুন চক্রে প্রবেশ করে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বছরকে ৪টি কোয়ার্টারে বিভক্ত করে সেলস টার্গেট নির্ধারণ করা হয়, ক্রিয়েটিভিটির মডেলটাও সেরকম। এমনটা হতেই পারে বছরের ৩ মাস ক্রিয়েটিভ, বাকি ৯ মাস আনক্রিয়েটিভ,  এমনকি সমগ্র বছরই আনক্রিয়েটিভ অথবা সাব-ক্রিয়েটিভ।

সৃজনহীনতাকে আমি সংজ্ঞায়িত করি- খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম, বিনোদন, জৈবিকতা আর সামাজিকতা মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৩-১৪ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করা এবং ভালো লাগার কাজে সময় নিবেদনের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা। এর চাইতেও ইন্টারেস্টিং হলো, এদের ভালো লাগার কাজের সংখ্যা অনির্দিষ্ট এবং অনিয়ন্ত্রিত, ফলত সময় বণ্টনের ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যকর গড় ধরে রাখা কঠিন।

 

আনক্রিয়েটিভ মানুষ সনাক্ত করা তুলনামূলক অজটিল, প্রকৃত ক্রিয়েটিভকে সনাক্ত করা বহুদূর, খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর যদি নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত উদ্যম না থাকে। এই জটিলতা তৈরি হয়েছে সাব-ক্রিয়েটিভদের জন্য। এরা ক্রিয়েটিভিটির কিছু শর্ত খণ্ডিতভাবে পূরণ করে, কিন্তু বাহ্যিকতা বা বহিঃপ্রকাশে ক্রিয়েটিভিটিকে সুনিপুণভাবে ধারণ করার দরুণ সাব-ক্রিয়েটিভদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপগোষ্ঠী তৈরি হয়।

 

যাদের লেখা পড়ি, কথা শুনি, অনুসরণ করি, আইডিওলাইজ বা আদর্শ মানি প্রায় প্রত্যেকেই সাব-ক্রিয়েটিভের খাপে চমৎকারভাবে এঁটে যায়।

 

সাব-ক্রিয়েটিভ ধারণাটা পেলাম কীভাবে তার পশ্চাৎপট উল্লেখ করার আবশ্যকতা বোধ করছি। ২০১৯ এর শেষভাগে এসে অনুভব করি, গত দশকের একটা রিভিউ হওয়া উচিত নিজের জীবনের, সঙ্গে পূর্ব দশকের সাথে তুলনা। রিভিউ করতে গিয়ে আবিষ্কার করি শূন্য দশকে নিজের যতটা বিকাশ ঘটেছে, যেভাবে চিন্তা করতাম ২০১০ এর দশক পুরোটাই বিকাশহীনতার মধ্যে কাটিয়েছি, অনেকটাই কূপমণ্ডুকতায়। এর মূল কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাব-ক্রিয়েটিভিটি বাদে ভিন্ন কিছু পাওয়া যায়নি। জীবনভর চেনা পরিমণ্ডলে ক্রিয়েটিভ মানুষ হিসেবে যে পরিচিতি পেয়েছি আদতে তা মূল্যায়ন ত্রুটি, কেননা বছরের শেষের দিকে এসে ক্রিয়েটিভিটির যে নিক্তিতে আস্থা রাখতে আরম্ভ করছি সেই নিয়ামকগুলোর শর্ত পালন করতে পারলাম কই! সেই আত্মোপলব্ধিকে সম্প্রসারিত আর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে স্থাপন করার কালেই সাব-ক্রিয়েটিভিটি বিষয়ে আরো ব্যাপক পরিভ্রমণ শুরু হয়।

 

ক্রিয়েটিভিটির সাথে এস্টাব্লিশমেন্ট সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পরে হলেও ক্রিয়েটিভ মানুষের মূল্যায়ন হবেই, সেটা পৃথিবীর যে দেশ বা সমাজই হোক না কেন।সাব-ক্রিয়েটিভরা জীবদ্দশাতেও এমন কোনো কর্মের নিদর্শন রাখতে পারে না যা দিয়ে মৃত্যুর পরে সে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। এ ব্যাপারে সে নিজেও নিশ্চিত থাকে। এই নিশ্চয়তা তাকে অনিরাপদ করে তোলে, আত্মগ্লানি তৈরি করে, ব্যক্তিগত ভ্রুকুটি থেকে বাঁচতে সে সামাজিক পশ্চাৎপদতা, মানুষের রুচিহীনতা-নিম্নবুদ্ধিতা প্রভৃতি ট্যাগিংকে অবলম্বন করে। তাতেও যখন শেষ রক্ষা হয় না তখনই ‘স্ট্রাগল’ নামের জাদুকরী শব্দটি পরিবেশন করা হয়।

 

স্ট্রাগল মানে কি অর্থনৈতিক স্ট্রাগল, নাকি প্রতিষ্ঠার স্ট্রাগল? অর্থনৈতিক স্ট্রাগল থেকে উত্তরিত হতে হলে অর্থদায়ী কাজে যুক্ত হতে হবে, এর তো বিকল্প নেই। তাই এটাকে স্ট্রাগল বলারই অবকাশ দেখি না। যে ব্যক্তির মাস চলাই দুষ্কর তার একমাত্র কারণ সে অর্থোপার্জনে ততটা সিরিয়াস নয়, সেখান থেকে তাকে উদ্ধারের দায়িত্ব নেবে কে? কিংবা এখন সংসার চলছে না, খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করছে, ১০ বছর পরে সে প্রচুর অর্থ-সম্পদের অধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সেটাকে স্ট্রাগল বলা উচিত নয়। সে আদতে বিনিয়োগ করছে। মানুষের স্ট্রাগল মূলত এস্টাব্লিশমেন্টের যার কোনো পরম গন্তব্য থাকতে পারে না। আমেরিকা বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও একজন ব্যক্তির এস্টাব্লিশমেন্ট অভিযাত্রা সমাপ্ত হয়ে যায় না।

 

তবু স্ট্রাগলের বাহারি গ্ল্যামারের উৎস কী?

 

সাব-ক্রিয়েটিভ মানুষদের জীবনাচরণ পর্যবেক্ষণ করলে এ প্রশ্নের আশ্বস্তযোগ্য উত্তর মিলতেও পারে। সাব-ক্রিয়েটিভ মানুষদের জীবনে বিশ্রাম আর বিনোদনের জন্য বিপুল পরিমাণ সময় বরাদ্দ থাকে। পারিবারিক পরিমণ্ডলে তারা সাধারণত অকর্মণ্য এবং অসামাজিক মানুষ হিসেবে পরিচিত, তাদের সময় কাটে আত্মনিমগ্নতায়। এই নিমজ্জনতার দরুণ ব্যবহারিক দক্ষতা সেভাবে গড়ে উঠে না, তারা প্রায় সবকিছুকেই বিচার-বিশ্লেষণ করে তাত্ত্বিক এবং আদর্শিকভাবে, যেখানে ফ্যাক্টের পরিমাণ খুবই সামান্য।ফলে সোস্যাল ডাইনামিক্সকে সে এমপ্যাথির পরিবর্তে নিজের পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে এবং ভয়ানক আশাহত হয়, যা তার মধ্যে প্রতিক্রিয়া জমাতে থাকে, ক্রিটিকালিটির পরিবর্তে ক্রমশ তার মধ্যে জন্ম নেয় নেগেটিভ ব্যক্তিসত্তা।

 

নেগেটিভিটিই তাকে গড়ে তোলে একমাত্রিক নার্সিসিস্ট হিসেবে, তার স্পৃহা হ্রাস পেতে শুরু করে। নিজের পরিমণ্ডলের অধিকাংশ মানুষ এবং কাজকর্মের প্রতি সে মানসিকভাবে অনাস্থা জ্ঞাপন করে, বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে নিজের সুপেরিওরিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। সে তুলনায় তাদের কাজে মনোনিবেশ যথেষ্ট কম। ধরা যাক একজন সাব-ক্রিয়েটিভ মানুষ গানের সুর করে। যদি প্রশ্ন করা হয়, প্রতিদিন সুরের পেছনে কোয়ালিটি সময় কতটুকু ব্যয় করেন সে উত্তর দিবে সারাক্ষণই তো সুরের ঘোরে থাকি, সময় মেপে বলতে পারবো নাকি! সম্পূরক প্রশ্ন যদি করি, আপনি যেহেতু সর্বক্ষণ সুরের ঘোরে থাকেন আপনার সুরকৃত গানের সংখ্যা কি আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল না? সে তখন কোয়ালিটি-কোয়ান্টিটির চিরন্তন দ্বৈরথের উদাহরণ দিবে। সব সুর গান আকারে প্রকাশিত না-ই হলো, প্রচুর পরিমাণে অব্যবহৃত সুর তো থাকার কথা, যেগুলো অনুশীলন বা খসড়া কাজ হিসেবে থেকে গেছে; সেগুলো কই? সে তখন নিশ্চিতভাবেই সামাজিক অবক্ষয়, আর্থিক অনিশ্চয়তা, অন্যদের অসহযোগিতা প্রভৃতি নিয়ামকের কথা বলে নিজেকে হতাশার একজন ভিক্টিম হিসেবে উপস্থাপন করবে। যে কোনো শাখার সাব-ক্রিয়েটিভ মানুষের জন্যই কথাটা একইরকম সত্য।

 

আনক্রিয়েটিভ এবং সাব-ক্রিয়েটিভ মানুষের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত মূলত বিকর্ষণজনিত, এরা আন্তঃমিথস্ক্রিয়ায় আলোড়িত না হয়ে বরং বিমর্ষ হয়ে পড়ে, নিজেদের কল্পিত রাজ্যে এরা একে অপরকে ব্যাঙ কিংবা টিকটিকি জাতীয় প্রাণী হিসেবে স্থান দিয়ে সম্মানের ভিত্তিটাকে নড়বড়ে বানায়, যদিও আচরণে তা বোঝা যায় না সচরাচর। আনক্রিয়েটিভ মানুষের জীবনযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ‘তাৎক্ষণিকতা’, এটাই তাদের অস্তিত্বশীলতাকে অর্থবহ করে তোলে। পক্ষান্তরে সাব-ক্রিয়েটিভিটি এক ধরনের মনোবৈকল্য, সীমিত ক্যাপাসিটি নিয়েই তারা মহীরূহ হওয়ার অভিলাষ ধারণ করে, যদিও জানে মহীরূহ হওয়ার কঠিন-কর্কশ সাধনা করার বাসনা তার মধ্যে অনুপস্থিত। যে কারণে সচেতনভাবে সে ভুল অডিয়েন্সের পেছনে মেহনত করে এবং প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রবোধ দেয় নিজেকে। যেমন যে সাব-ক্রিয়েটিভ কবি কবিতা লিখে সে সেই সমস্ত মানুষের কাছেই কবিতার গল্প করবে যারা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কখনোই কবিতা পড়েনি। সে তখন মানুষ কবিতা পড়ছে না বলে হাপিত্যেশ করবে, কবিতা যারা পড়ে তারা অন্যের নিম্নমানের কবিতা পড়ছে—এসব প্রবঞ্চনায় সে নিজেকে দুর্ভাগা ভেবে পুলকিত হয়ে সিঙ্গারা খাবে। ফলে তার মধ্যে ভর করে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি, কোনো জায়গাই তার আত্মিকৃত হয়ে উঠে না।