আমার ঘৃণা সংক্রান্ত শব্দের নাতিদীর্ঘ তালিকা আছে একটা।তালিকার শীর্ষতম শব্দ ‘ভক্ত’; কোনো রুচিশীল, আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন এবং বিচক্ষণ মানুষ স্রেফ রূপ, গুণ, ক্ষমতা, খ্যাতির কারণে আরেকজনের ভক্ত হতে পারে এটা কখনোই সুস্থ্যচিন্তা লাগে না। এডমাইরার হতেই পারে, হওয়া উচিতও। এতে এপ্রিসিয়েশন কালচার গড়ে উঠে।
কিন্তু যখন কেউ ভক্ত হয়ে পড়ে তখন একমাত্র এপ্রিসিয়েশনটাই কাম্য, সামান্য সমালোচনাতেও তীব্র দহন হয়, সমালোচনাকারীর ধ্বংস বা ক্ষতি কামনা করা হয়। নিচ্ছিদ্র এডমাইরেশন থেকেই বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি ঘৃণা জন্মে। যখনই একজন মানুষ এডমাইরার থেকে ভক্ত হয়ে উঠে তার বিবেচনা বোধ লুপ্ত হয়, তার চিন্তাচরণ আবর্তিত হয় দাসদের প্যাটার্নে।
গঠনমূলক সমাজের প্রধান ব্যাকটেরিয়া ভক্তকুল, যারা দ্রুত বিস্তার লাভ করে, এবং সেই ব্যাকটেরিয়াকে নিয়ন্ত্রণের কোনো এন্টিবায়োটিক কাজ করে না।
ভক্ত এমনই ব্রেইনওয়াশড থাকে যে, সে তার আইডলের জন্য জীবন দিতে পারে, প্রয়োজনে জীবন নিতেও পারে। ফ্যানাটিক শব্দের হরেক রকম বাংলা হতে পারে, আমি বেছে নিবো ‘উন্মাদ’ শব্দটি।
অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যে পশ্চাৎপদ দেশের মানুষদের মধ্যে উন্মাদ ফ্যান হবার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। এডমাইরার হতে হলে নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করতে হয়, নিজস্ব আদর্শিক অবস্থান তৈরি করতে হয়, সেই ফ্রেমওয়ার্কে এডমাইরেশন নিঃশর্ত এবং নিরঙ্কুশ হয় না কখনো। কাউকে এডমায়ার করা মানে তার ভালো এবং মন্দ দুটোকেই ক্রিটিকালি দেখতে পারার সক্ষমতা।
ভক্ত হওয়া মানে মাথা বর্গা দেয়া এবং মানসিকভাবে সমর্পিত হওয়া।
পৃথিবীতে মানুষ ৩ ধরনের– আইডল, ফ্যান এবং এডমাইরার। আইডল হয়তোবা ৫%, এডমাইরার ১০%, বাকি ৮৫% মানুষই ফ্যান কমিউনিটিভুক্ত। মানুষ যদি ফ্যানাটিকতা থেকে মুক্ত হতে পারতো পৃথিবী বসবাসের জন্য আরো বেটার জায়গা হতো।
ভক্তের একটি ধারাবাহিক বেড়ে উঠা প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথম সে ভক্ত হয় ধর্মপ্রচারক বা সমাজ সংস্কারকের, এরপরে ভক্তি আসে রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের প্রতি। পরের স্তরে আসে ইন্ডিভিজুয়ালের প্রতি, তথা গায়ক, নায়ক, লেখক, মোটিভেশনাল স্পিকার, ক্রিকেটার প্রভৃতি।
ভক্তির সীমা এতদূর ছড়িয়ে পড়ে যে, আইডল বা দলকে কিছু বলা মানে ভক্তের বুকে আঘাত করা। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কিংবা সালমান খান- শাহরুখ খান এর ফ্যানদের মধ্যে ব্যক্তিগত শত্রুতা না থাকলেও কেবলমাত্র ফ্যাননীতির কারণে তারা তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে।
একটি রুচিশীল সমাজে এডমাইরার আর ফ্যান এর মধ্যে ব্যবধান যত কমবে সেটি তত বেশি উৎকর্ষের পানে ধাবিত হবে।
***
গত ক্রিকেট বিশ্বকাপ থেকেই ফেসবুকে ব্লক আর আনফ্রেন্ড চর্চা বাড়িয়ে দিয়েছি। অনলাইনে লেখালিখির বয়স ১ যুগ হয়ে গেলেও এই দুটো অপশন ব্যবহার করতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সময় নিয়েছি। দেখতে চাইছিলাম ফ্যানরা কতদূর যেতে পারে। বিশ্বকাপে মাশরাফির জঘন্য পারফরম্যান্সের পর মানুষজনের স্ট্যাটাস আর মন্তব্য পড়ে উপলব্ধি করি, ফ্যানদের থেকে দূরে থাকার এটাই উপযুক্ত সময়। ফ্যানের মনোজগত বুঝতে প্রচুর সময় দিয়ে ফেলেছি, আর প্রয়োজন নেই।
ফ্যানদের ওই সমস্ত লেখা বা মন্তব্য চোখের সামনে এলে তা একাগ্রতা বিঘ্নিত করে। তাদের সূত্রে সার্কাস দেখার সুযোগ পাই ঠিকই, কিন্তু অপরিমিত সার্কাস চিন্তার অগ্রগতিতে হানিকর।
ফ্যান কেন হয় মানুষ?
যে কারণে মানুষ জঙ্গি হয়, একই কারণ, কেবল বহিঃপ্রকাশের ধরন আলাদা। সে আইডলকে অনেকটাই পূজা-অর্চনা করে, ত্যাগ স্বীকার হয়ে পড়ে রিচুয়ালের অংশ, দূর থেকে তার আইডল ঠিকই তার মেহনতে খুশি হবে এই ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভক্ত তাকে ঘিরে উন্মাদনা দেখায়।
ধরা যাক, আপনি সুন্দর গান করেন। আমি আপনার প্রতিটি গান শোনার চেষ্টা করি, এটা এডমাইরেশন। আপনি ইয়াবা সেবন করলে বলবো না এটা ক্রিয়েটিভ মানুষদের লক্ষণ। আপনি উচ্ছৃঙখলতা দেখালে বলবো না গুডি বয় দিয়ে সমাজ চলে না, সমাজের প্রয়োজন দ্রোহী মানুষ। এমনকি আপনার সব গানকেও হয়তো পছন্দ করবো না। আপনার সাথে আমার সংযোগের ভিত্তি স্কিল আর পারফরম্যান্স, এজন্য ব্যক্তি আপনার প্রতি কিছুটা পক্ষপাত কাজ করতেই পারে, কিন্তু আপনি সর্বাবস্থায়ই আমার সাপোর্ট পাবেন, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মাত্রই এডমাইরার থেকে নির্বোধ ফ্যানে পরিণত হয়েছেন।
ফ্যানের একটাই বিশেষণ, সে নির্বোধ। সে রবীন্দ্রনাথ, স্টিফেন হকিংয়ের ফ্যান, নাকি হিরো আলম বা সাবিলা নুরের তাতে কিছুই আসে-যায় না। ফ্যান আর নির্বোধ একে অপরের জমজ সহোদর।
যে কোনো বড়ো ঘটনা ঘটলেই আমি ফ্যান ছাঁটাই করতে শুরু করি। ফ্যানের কয়েকটি সনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে-
বৈশিষ্ট্য১– এরা খুব দ্রুত ঘটনার পক্ষ-বিপক্ষ সনাক্ত করে সেই অনুসারে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করে। একজন নায়ক, আরেকজন ভিলেন তাদের মনোজগতে ঘুরপাক খায়।
বৈশিষ্ট্য২- ঘটনার ব্যাপ্তি যতদিন ধরে থাকে, ততদিন পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় তারা একই বিষয়ে স্ট্যাটাস প্রসব করে, এবং নানা আশংকা প্রকাশ করতে থাকে।
বৈশিষ্ট্য৩- নিজের মতাদর্শের মানুষ পেলেই শুধু চলবে না, বিরুদ্ধবাদীদের ‘সুশীল’ ট্যাগ দিয়ে তাদের নিয়ে খিস্তিখেউর চালাতে হবে।
ফ্যান টাইপ মানুষের সাথে যত বেশি উঠা-বসা করবেন আপনার আত্মবুদ্ধি লোপ পেতে থাকবে, আপনি রূপান্তরিত হতে থাকবেন অন্তঃসারশূন্য এক প্রতিক্রিয়াশীল মানুষে।
***
বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুসরণ করি ১৯৯৫ এর সার্ক ক্রিকেট থেকে। বিভিন্ন জেনারেশনে কোনো না কোনো ক্রিকেটারের এডমাইরার ছিলাম
জেনারেশন ১- আতহার আলি, সাইফুল ইসলাম, আলশাহরিয়ার, শাহরিয়ার বিদ্যুত, রফিক
জেনারেশন২- আশরাফুল, মাশরাফি, তালহা জুবায়ের, শাহরিয়ার নাফিস
জেনারেশন৩- সাকিব, মুশফিক, তামিম
জেনারেশন৪- লিটন দাস, সৌম্য সরকার, মোসাদ্দেক
জেনারেশন৫- আফিফ
জাভেদ ওমর, ইমরুল কায়েস, রকিবুল— এই ৩ জন ব্যতীত কোনো বাংলাদেশী ক্রিকেটারের প্রতি চরম বিরক্তও হইনি কখনো। বাকিদের এডমায়ার- নিন্দা কোনোটাই করেনি।
অনলাইনে বাংলাদেশের ক্রিকেট-ক্রিকেটার নিয়ে লেখার প্রধান গোলযোগ ফ্যানদের কদর্য মানসিকতা। ক্রিকেটাররা হয় ফেরেশতা অথবা দানব, যে কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কী-বোর্ডবাজি চলে আলোচনার নামে।
অতঃপর সাকিব আল হাসান:
এখনো পর্যন্ত সাকিব বাংলাদেশের একমাত্র গ্লোবাল ক্রিকেটার, এবং সম্ভবত ধনীতম ক্রিকেটারও। সাকিবের দুই রকম পাবলিক ইমেজ রয়েছে
ইমেজ১- সাকিব অর্থলোভী এবং অহংকারী। তার ভাবনাজুড়ে কেবলই টাকা, কোনোরকম এমপ্যাথি তার কাজ করে না।
ইমেজ২- সাকিব বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট ব্রেইন, খেলার সময় সবটা দিয়ে খেলে, নিজের সীমাবদ্ধতাকে বুদ্ধি দিয়ে জয় করে। তার মানসিকতা অস্ট্রেলিয়ানদের মতো, বাংলাদেশের কালচারের সাথে তা মেলে না বলেই সংঘর্ষের সূত্রপাত।
দুই ইমেজের কারণে সাকিবের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রতিপক্ষও রয়েছে
১.মুরাদ টাকলা জনগণ: সাকিবভক্তরা এই গ্রুপটিকে দিনের মধ্যে ১৪-১৫ বার স্মরণ করে। সাকিব বেয়াদব, হোটেল ব্যবসায়ী, তার বউ পর্দা করে না,সে টাকার জন্য খেলে প্রভৃতি বাক্যগুলো মুরাদ টাকলা জনগণ যতবার না বলে তার চাইতে বেশি ফ্যানেরা উস্কানি দিতে ব্যবহার করায় এই প্রতিপক্ষকে কেউ আমল দেয় না।
২.বিসিবি (প্রকারান্তরে নাজমুল হাসান পাপন): ২০০০ সালের দিকে যারা ডব্লিউডব্লিউ ই এর রেস্লিং দেখতেন তারা রিলেট করতে পারবেন ব্যাপারটা। স্টোন কোল্ড স্টিভ অস্টিন নামে এক দুর্দান্ত জনপ্রিয় রেসলার ছিল, ম্যাচ শেষে বিয়ার দিয়ে উদযাপন করতো, তার থিম ছিল don’t trust anybody; স্টিভ অস্টিনের সাথে প্রায় সময়ই চেয়ারম্যান ভিন্স ম্যাকমোহনের শত্রুতা লেগে থাকতো। ম্যাকমোহন চেয়ারম্যানের পাশাপাশি অন্যতম হিল বা ভিলেন চরিত্রেও অভিনয় করতো। সাকিব আর পাপনের ব্যাপারটার সাথে ডব্লিউ ডব্লিউ ই এর ঘটনা খুব চমৎকার মিলে যায়। ফ্যানদের মতে, সাকিবের প্রধান শত্রু পাপন, সে বারবার ইচ্ছা করে সাকিবকে বিপদে ফেকতে চায়, কারণ সাকিব তাকে সমঝে চলে না।
পাপন সাকিবের প্রধান শত্রু হয়ে উঠে ২০১৪ তে তাকে নিষিদ্ধ করায়। একজন ক্রিকেটার অন্যায় করলে শাস্তি পাবে না? ফ্যানদের কি চাওয়া ছিল, ক্রিকেটারটি যেহেতু সাকিব তার সাতখুন মাফ করে দেয়া হোক? কিন্তু খুনের সংখ্যা ৮টা হয়ে গেলে তখন কী হবে ফ্যানদের তা জানা নেই।
ব্যক্তি এবং সংগঠক হিসেবে পাপন স্বৈরাচারী এ বিষয়ে সংশয় নেই, সে দুর্নীতিবাজ তাও সত্য, তার আচরণ ইম্যাচিউর টিন এজারদের মতো সেটাও স্বীকার করে নিতে হবে, তবু সাকিবের বিরুদ্ধে পাপনের যেসব অভিযোগ সেগুলোকে খারিজ করে দেয়া মানে নগ্ন ফ্যানের মতো আচরণ করা।
পাপনের পদত্যাগ চাইলাম। তার পরিবর্তে কাকে বসাতে চান; সাবের হোসেন? সেও তো একই গোয়ালের শেয়াল। ২০০০ সালের দিকে ক্রিকেটাররা যখন ধর্মঘট ডেকেছিল সেই সময়ে বিসিবি প্রেসিডেন্টের নাম কী ছিল? কিংবা কোচ গর্ডন গ্রিনিজকে বরখাস্ত করেছিল কে? সাবের আর পাপন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। পার্থক্য সাবের চৌধুরী গুছিয়ে কথা বলে, পাপনের কথা-বার্তা কমেডিয়ানের মতো।
সাকিবের আঙ্গুলে ইনফেকশন সেখানেও পাপনের প্ররোচণা, সাকিব বিশ্বকাপ ফটোশ্যুটে আসেনি, সেটাও পাপনের দোষ— কেন সে বিশ্রি জার্সি অনুমোদন দিল।এবং সর্বশেষ ধর্মঘটের পরপরই সাকিবের নিষেধাজ্ঞা আসছে আইসিসি থেকে, এটাও পাপনের কারসাজি। অন্যদিকে দাবিদাওয়ার বেশিরভাগই দ্রুততম সময়ে মেনে নেয়া হলো, এর সমস্ত কৃতিত্ব সাকিবের! — এরকম এন্টারপ্রেটেশনের মানুষের সংখ্যাই বেশি। সাকিবের ইস্যু উত্থাপিত হওয়ার পর এখনো পর্যন্ত ২০ জন ফ্যানকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি। উপলব্ধি করছি, ফ্যানরা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৩.মাশরাফি: আবারো রেসলিং দিয়েই উদাহরণ দিই। স্টিভ অস্টিনের প্রতিদ্বন্দ্বী রেসলার অনেকেই ছিল, তবু দ্য আন্ডারটেকার এদের মধ্যে বিশেষ। অস্টিনের ফ্যান হতে হলে কেবল তার গুণকীর্তন করাই যথেষ্ট নয়, সাথে দ্য আন্ডারটেকারকে নিয়ে নেগেটিভ কথা বলতে হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের আন্ডারটেকার হলো মাশরাফি মুর্তজা, সাকিবের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যেমনই হোক, ফ্যানবেইসকে রসদ যোগাতে হলেও মিডিয়া হাউজ এই দুই হেভিওয়েট ক্রিকেটারের মধ্যে ইগো কনফ্লিক্টের একটা গল্প ফেঁদে রাখবে।
সাকিব বিতর্ক:
সাকিব আইসিসির একটি ধারায় ফেঁসে গেছে। তাকে ২ বছরের নিষেধাজ্ঞা (১বছরের স্থগিতাদেশ সহ) দেয়া হয়েছে। আগামী বছর ২৯ শে অক্টোবর থেকে সে খেলায় ফিরতে পারবে। কিন্তু ফ্যান সমিতি এরই মধ্যে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে হাজির। সাকিবের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছে, সাকিব না খেললে বাংলাদেশের খেলা বর্জন করবে, আরো কত কি!
অথচ বাংলাদেশ যদি ভারতকে একটা টি২০ তেও হারিয়ে দেয় এই ফ্যানেরাই বলবে ভারতকে হারাতে আমাদের সাকিবকে লাগে না। ছাগলের ৩ নং বাচ্চা সম্বন্ধে বহু গল্প শোনা যায়, ফ্যানরা যদিও মানুষ প্রজাতিতে বিলং করে, তবু কখনো যদি ছাগল ছানা দিয়ে তাদের উপমিত করা যেত, তাহলে ৭ বা ১০ নম্বর বাচ্চা হিসেবেই বেশি মানানসই হতো।
‘সাকিবের পাশে দাঁড়াই, সাকিবের পাশে আছি’— এইসব চটুল কথার মজেজা কী?- সাকিব ম্যাচ ফিক্সিং করেনি, সে গুরুতর অসুস্থ্য নয়।
পাশে দাঁড়ানো বলতে কি সাকিবকে সান্ত্বনা দেয়া, নাকি তার জন্য রাস্তায় নামা? সান্ত্বনার মিষ্টি সে খায় না, নিজের ব্যাপারে সে অতি সেয়ানা,সুতরাং সান্ত্বনা নিজের পকেটে রাখুন।
দ্বিতীয়ত, এটা বিসিবির সিদ্ধান্ত নয় যে মিরপুর ঘেরাও করলেই মত ঘুরে যাবে। রাস্তায় নামতে হলে টাকা খরচ করে বিমানে চেপে দলে দলে আইসিসির সদর দফতর ঘেরাও করুন।
আরো দুটো মুখরোচক গল্প খুব মার্কেট পাচ্ছে।
মার্কেট১- আন্দোলনের পরপরই এই নিষেধাজ্ঞা আসছে কেন, ২ বছর তারা কোথায় ছিল। এখানে নিশ্চয়ই পাপন ডার্টি গেম খেলেছে। শুধু সাকিব নয়, মুশফিককেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আকসু। তার কাছ থেকে কোনো আলামত না পাওয়ায় সে বেঁচে গেছে। পাপন ডার্টি গেম খেললে ভারত সফরের পরে খেলতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে ইডেন গার্ডেন টেস্টের ঘন্টা বাজাবেন শোনা যাচ্ছে, সেখানে পাপন সাকিবকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হবে, এরকম শিশুতোষ বোকামি সে কেন করবে? বরং উল্টো দিক থেকে দেখার অবকাশ রয়েছে।নিষিদ্ধ হয়ে যাতে পাবলিক সেন্টিমেন্ট না হারায় সেকারণেই আন্দোলনের জন্য এমন একটা সময় বেছে নেয়া হতে পারে। অধিকাংশ মানুষ যে মনে করছে সাকিব ষড়যন্ত্রের শিকার এটাই আন্দোলন থেকে তার সেরা প্রাপ্তি।
তার বিরুদ্ধে আইসিসি ষড়যন্ত্র করেছে? ৩টা ঘটনা সে গোপন করেছে, এটা কী মিন করে একটু চিন্তা করে দেখা যেতে পারে। বেখেয়ালবশত ১ বার ভুল হতে পারে, তাই বলে ৩ বার?
সাকিবের এখন সবচাইতে বেশি প্রয়োজন বিসিবির সহায়তা। তাদের জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতাতেই হয়তোবা ১বছর ৬ মাসে নেমে আসবে। নইলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব অধ্যায় শেষ চ্যাপ্টারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। সময় হিসেবে ১ বছর নেহায়েত কম নয়।
পাবলিক সেন্টিমেন্ট দিয়ে বিসিবিকে চাপে রাখা+ নিজে ক্লিন থাকার যে প্ল্যান সেটাতে সে যে সফল আজকের সারাদিনের স্ট্যাটাসগুলোই তার প্রমাণ।
আন্দোলন বিষয়ে আমি একটা পোস্ট লিখেছিলাম, বহু মানুষ গালমন্দ করেছিল; এখন সেই লেখাটা নতুন করে পড়লে হয়তোবা যোগসূত্রটা মেলাতে পারবে।
এন্টারটেইনমেন্ট আমাদের যা দেখায় আর আদতে যা ঘটে দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। যেমন, ২২ তারিখ থেকেই বিভিন্ন ক্রিকেট সাংবাদিক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, আন্দোলন হয়েছে ২১ তারিখে। চ্যানেল একাত্তরের রিপোর্টার দেব চৌধুরীর একটা স্ট্যাটাসে দেখলাম ২২ তারিখ থেকেই তারা ব্যাপারটা জানে, কিন্তু অফিসিয়াল ডিক্লেরাশেন না আসায় এটা নিয়ে নিউজ করেনি। সমকাল পত্রিকা নিউজের ভ্যালু বুঝে লোভ সংবরণ করতে না পেরে লিড নিউজ করেছে।
মার্কেট২- ভারতকে সুবিধা দিতে আইসিসি এই কাজ করেছে। এরা নিখাদ বিনোদন এবং অবলা প্রাণী; এদের প্রতি সদয় হওয়া উচিত।
ক্রিকেট ধ্বংসের ন্যাকামি কথা:
পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতকে হারানোর ম্যাচে সাকিব দলেই আসেনি। ২০২২-২৩ এর পরে বাংলাদেশ যখন খেলবে সেই দলে সাকিবের থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, যদি থাকেও ২০২৭ সালের বিশ্বকাপে সাকিব যে দলে থাকবে না এটা ১০০% নিশ্চিত।
কিন্তু নিম্নবুদ্ধির ফ্যানদের মাতম দেখে মনে হয় সাকিবই বাংলাদেশ। তারা কথায় কথায় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে জিম্বাবুইয়ে আর কেনিয়ার কাতারে নিয়ে যায়, ফুটবল ধ্বংস হয়েছে, ক্রিকেটও সেপথে হাঁটছে ভবিষদ্বাণী করে। ২০০৩ বিশ্বকাপে সেমিতে খেলেও কেনিয়া হারিয়ে গেল কেন? কারণ ক্রিকেটে তাদের বাজেট এবং বিনিয়োগ নেই; আমাদের দেশে খো খো বা ভলিবল খেলার যতটুকু জনপ্রিয়তা, তাদের ওখানে ক্রিকেটও তাই।
জিম্বাবুইয়ে হারিয়ে গেছে দুটো কারণে। প্রথমত, দেশে চলমান কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ দ্বন্দ্বের রাজনীতিতে ক্রিকেটারদের জড়িয়ে পড়া। দ্বিতীয়ত, কলপ্যাক চুক্তির অধীনে নামী ক্রিকেটারদের অনেকেই ইংল্যান্ডে যাওয়ায় ভ্যাকুইয়াম বা শূন্যস্থান তৈরি হওয়া।
বাংলাদেশে যখন যে দলই ক্ষমতায় আসুক ক্রিকেটের প্রতি সফট কর্নার কাজ করে। মাত্র ৫-৬ টা দেশ ক্রিকেটে রাজত্ব করে, টেস্ট খেলুড়ে দেশের সংখ্যা মাত্র ১২ টি, টি২০ এর কারণে সহযোগি কিছু দেশে ক্রিকেটে চর্চা হচ্ছে, উপমহাদেশের বাইরে তেমন জনপ্রিয়তাও নেই৷ সুতরাং এরকম এক গণ্ডিবদ্ধ খেলার সর্বোচ্চ আসরে খেলার মধ্যেও কৃত্রিম আভিজাত্য রয়েছে। বিসিবির টাকার কমতি নেই, বিশ্বকাপে ভরাডুবির পরই ‘এ’ দল, এইচপি দল, ইমার্জিং দল, অনুর্ধ্ব১৯ দলগুলোর ম্যাচ সংখ্যা বেড়েছে। নতুন প্লেয়ার না হলে যে আর চলছে না তা বুঝে গেছে তারা। সামগ্রীকভাবে ক্রিকেট খেলাটারই ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন। ২০৩০ এর দশকে এই খেলাটার পরিসর এবং কলেবর দুটোতেই ব্যাপক পরিবর্তন আসবে, ২০৪০ এর দশকে লুথা একটা খেলায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
তাই জিম্বাবুইয়ে বা কেনিয়ার উদাহরণ টানা হাস্যকর।
যদি সাকিব সত্যিই ১ বছর নিষিদ্ধ থাকে এটাকে আমি গ্রেট স্যাক্রিফাইস ফর আ গ্রেটার পারপাস হিসেবে দেখছি। নতুন খেলোয়াড়দের তৈরি করা যাবে। এই সময়ে আফিফ যদি উপরে ব্যাট করে, সাথে বোলিং চালিয়ে যায় সে একজন সম্ভাবনাময় অলরাউন্ডার হতে পারবে; ইয়াসির রাব্বি যদি সুযোগ কাজে লাগায় সেটা টি২০ বিশ্বকাপে দলের কম্বিনেশন আরো শক্তিশালী করবে। সাকিব তার ‘পারফরম্যান্স অব লাইফ’ বিশ্বকাপে দেখিয়ে দিয়েছে, পরের বিশ্বকাপ আসতে আরো ৪ বছর; এর মধ্যে বয়স বাড়বে, ক্ষিপ্রতা কমবে। ধোনীর অবস্থা দেখলেই ২০২৩ বিশ্বকাপের সাকিব সম্পর্কে আঁচ করা যায়।
বরং পঞ্চপান্ডব নামের যে রাবিশ এক মিথ আর সিন্ডিকেটের চক্করে পড়েছিল দল, সেখান থেকে সহসা পরিবর্তন আসবে।
টেন্ডুলকার যখন খেলতো, দর্শকরা বিশ্বাসই করতে পারতো না তারও সমাপ্তি হবে কোনোদিন। সে অনসরে গেছে তাও তো ৭ বছর হয়ে এলো প্রায়।
তবে মানুষের এন্টারপ্রেটেশনের শোচনীয় অবস্থার কারণে, অনেকে ধরেই নিতে পারে আমি সাকিব বিদ্বেষী। সাকিবের এই ঘটনা দুঃখজনক, খারাপ লাগছে, তবে কেন যেন মনে হচ্ছে এটা তার প্রাপ্যই ছিল।
প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়।সাকিব সম্ভবত অপরিহার্যতা সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্বকাপের ফটোশুটে অনুপস্থিতি, ফিট থাকা সত্ত্বেও শ্রীলংকা সিরিজে খেলতে না যাওয়া, গ্রামীণফোনের সাথে প্রোটোকল ভেঙ্গে চুক্তি করা— সবকিছুর মধ্যেই ‘হু আর ইউ, আই এম দ্য ম্যান’ এটিচুড প্রকট হয়ে উঠেছিল। একবার ভাবুন, ভারতের বিশ্বকাপ ফটোশ্যুটে ভিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মা অনুপস্থিত, সেদেশের দর্শকরাই তাদের ধুয়ে দিত। অথচ আমাদের ফ্যানবাজরা একে এটিচুড হিসেবে বাহবা দিয়েছে। খুবই প্যাথেটিক!
ধরা যাক, আপিলে সাকিবের শাস্তি কমলো না, বা আপিল করার সুযোগ নেই, তবে কি সাকিব অধ্যায় সমাপ্ত?
এই দীর্ঘ সময়ে তাকে ছাড়া বাংলাদেশ অনেকগুলো সিরিজ খেলবে, নতুন টিম কম্বিনেশন তৈরি হয়ে যাবে, সাকিবহীনতাই অভ্যস্ততায় পরিণত হবে; সেখানে ফিরে আগের জায়গা পুনরুদ্ধার করাটা কঠিন কিনা জানি না, তবে ওয়ার্নার বা স্টিভ স্মিথের ১ বছর মেয়াদী সাজার সাথে সাকিবের সাজার পার্থক্য হলো তারা খেলার মধ্যে থাকতে পেরেছিল, বাইরের দেশের লীগগুলোতে খেলেছিল। সাকিব কোথাও খেলার সুযোগ পাবে না। এমনিতেই সে প্র্যাক্টিস কম করে, খেলার মধ্যে না থাকলে ফিটনেস এবং কনফিডেন্স দুটোতেই ধাক্কা লাগার কথা। সেই ধাক্কা শামলে সে যদি ফিরে আসে আগের স্বরূপে তাহলেই তাকে চ্যাম্পিয়ন ডাকাটা সার্থক হয়।
কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচাইতে বড়ো নক্ষত্রটি হঠাৎ করেই খসে পড়বে। বয়সটাই যা গোলযোগ বাঁধিয়েছে, নইলে ১ বছর তো হাই তুলতেই শেষ হয়ে যেত।
you will be missed by miles