স্কুল লাইফে ভাবনা ছিলো জীবনের কোনো এক পর্যায়ে ২ লক্ষ বইয়ের এক বিশাল লাইব্রেরি বানাবো। পরিণত বয়সে অনুভব করি, বই সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়; একটা বই পড়া হয়ে গেলে অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া যেতেই পারে; ফিলোসফিকালি চিন্তা বরলে বইয়ের কোনো মালিকানা থাকতে নেই, পাঠক হতে পারে সর্বোচ্চ। আবার নিজে একটি বই পড়তে চাইছি সেটা কারো না কারো কাছে আছেই। তার সাথে একটি বই বদল করে নিলেই তো বইটি পাওয়া যায়। দৃষ্টিভঙ্গির এই ছোট্ট পরিবর্তনটুকুই মানসিক দূরত্ব এবং আত্মকেন্দ্রিক জীবনভাবনা থেকে বাঁচিয়ে মানুষকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চায় সহায়তা করতে পারে অনেকখানি। জন্ম নিতে হয় একা, বাঁচতে হয়, ভাবতে হয় সামষ্টিকভাবে। এই ভাবনা থেকেই আমি একটি নতুন প্রকল্প শুরু করতে চাচ্ছি চলতি মাস থেকে। প্রকল্পের নাম ‘সহভাবুক প্রকল্প’। এর থিম হিসেবে নির্বাচন করেছি- ‘একা ভাবে পোকা’।

এই প্রকল্পের ভিশন কী যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বলবো, ২৩ লক্ষ বইয়ের একটি লাইব্রেরি বানানো, যার কোনো একক ব্যক্তিগত মালিকানা নেই, সমগ্র পৃথিবীই বইয়ের সূত্রে থাকবে কানেক্টেড। ঠাকুরগাঁওয়ের খোকনের বাসায় যতগুলো বই আছে সেগুলোতে আমার যতটুকু অধিকার, আমার নিজের কাছে থাকা সমস্ত বইয়ের অধিকারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। আবার, আমি একটা বই কেনার আগে জানতে চাইলাম এই বইটা সহভাবুক কারো আছে কিনা, থাকলে সেই টাকাটা দিয়ে অন্য কোনো বই কিনবো যেটা হয়তো অন্য একজন সহভাবুক পড়ার জন্য খুঁজছে। বইয়ের সূত্রে চিন্তা বিনিময়ের যে চর্চা এর মধ্য দিয়েই একটি কমিউনিটি এনলাইটেনমেন্ট প্রজেক্ট শুরু করতে চাই। যেহেতু আমি একদমই বিত্তশালী মানুষ নেই, আমি সর্বনিম্ন ১১ থেকে সর্বোচ্চ ১৭ জন মানুষকে এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিমাসে কানেক্ট করতে পারবো। লেগে থাকলে এবং ইনটেনশন সৎ হলে ১৭ বছর পরে ২৩ লক্ষ বইয়ের বিশ্ব লাইব্রেরি হয়েও যেতে পারে। পৃথিবী একবিন্দু শিশিরের চাইতেও ক্ষুদ্র এখন!

কোইনসিডেন্স১: ‘সহভাবুক’ শব্দবন্ধটা মাথায় আসে দুদিন আগে পুরনো এক বন্ধুকে চিঠি লেখার সময়। লিখবার পরই শব্দটা বেশ ভালো লেগে যায়। আমার কিছু ভালো লাগা মানেই সেটাকে একটা বাস্তব রূপ দেয়া।

কোইনসিডেন্স২: বৈষয়িক কাজে চরম অনাগ্রহ আর অদক্ষতায় বিরক্ত হয়ে সেপ্টেম্বর মাসে একজন ব্যক্তিগত সহকারী নিয়োগ দিই যে আমাকে এইসব খুচরো কাজের বিব্রতা থেকে আংশিক অব্যাহতি পেতে সহায়তা করবে। ছেলেটা ক্রিকেটার হওয়ার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, আমি একটা ‘ক্রিকেট ট্যালেন্ট প্লেসমেন্ট প্রজেক্ট’ পরিচালনা করি; সেখানে ৪ বছর ধরে যুক্ত আছে; দলে থাকে, শৃঙ্খলাবঙ্গের কারণে বাদ পড়ে, অনুতপ্ত হয়ে পুনরায় ফেরত আসে। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি ছেলেটার প্রেম নিখাদ। দারিদ্র্য তার প্রতিবেশি, তবু ক্রিকেটকে ছেড়ে যায় না। আমার বৈষয়িক অদক্ষতা পুষিয়ে দেয়ার আদলে ওকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা করা যায় কিনা এই ভাবনা থেকেই ওকে নিয়োগ দেয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, আমার জীবনে ওকে দেয়ার মতো বৈষয়িক কাজের সংখ্যাও অপ্রতুল। যে কারণে ওকে বেতন দেয়াটাও সবসময় জাস্টিফাইড হয় না। সেদিন ভাবছিলাম প্রতিমাসে অন্তত ৩ দিন নির্দিষ্ট কাজ না থাকলে সেটাকে কর্মসংস্থান হিসেবে চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। তখনই মনে হলো, ওই ৩ দিন খুবই ইমপ্যাক্ট সম্পন্ন কোনো কাজে ব্যয় করা যায় কিনা।

কোইনসিডেন্স ৩: ভার্সিটির বন্ধু প্রিয়ম মজুমদারের প্রোফাইলে একটা বুকশপের সন্ধান পেলাম সেদিন। নিজের ২টা পুরোনো বই জমা দিয়ে নাকি সেখান থেকে একটা বই আনা যাবে। চিন্তাটা বেশ পছন্দ হয়।

কোইনসিডেন্স ৪: এবছর একটা শব্দের সাথে পরিচিত হই- ‘গ্রোথ হ্যাকিং’। এর মানে কী বোঝায় এ নিয়ে বিশাল কলেবরের বই লেখা হয়েছে, আমি এধরনের বইয়ে বরাবরই অনাগ্রহ বোধ করি, তবে আলোচনা শুনে এই শব্দকে আমি ইন্টারপ্রেট করি এভাবে, ‘এর মূল থিম হলো এফিশিয়েন্সি বাড়ানো যেখানে টাকার খরচ কম, কিন্তু বুদ্ধির খরচ অনেক বেশি যার মধ্য দিয়ে কনভারসন বাড়বে এবং ইমপ্যাক্ট মেজার করা যাবে’। বইয়ে যা ইচ্ছা লেখা থাকুক, এই ইন্টারপ্রিটেশনটা আমার ভালো লাগে এবং সিদ্ধান্ত নিই একে আমার থট প্রসেস ডেভেলপমেন্ট উদ্যোগগুলোতে প্রয়োগ করবো। বিগত ৪ বছরে এই খাতে আমার বিপুল সময়, শ্রম আর অর্থ খরচ হয়েছে, কিন্তু মানুষের চিন্তা ও ভাবনাজগতে যে মাত্রাগত পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলাম, সে উদ্দেশ্যে ন্যূনতমও সাফল্য আসেনি। পর্যালোচনা করে পেলাম, আমার উদ্যোগগুলো বড্ড রেন্ডম, এর কিছু মেজারমেন্ট ক্রাইটেরিয়া থাকলে ধরতে পারতাম কোথায় আরও ইনটেনসিভ এফোর্ট দেয়া দরকার ছিলো।

কো-ইনসিডেন্স ৫: মানব গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ বিষয়ে নামহীন, দামহীন বই লিখছি একটা, যে বইটা পেতে হলে একটা ইমেইল করতে হবে ‘বইটা কেন পড়তে চাই’ এই বিষয়ে। ২২ জন ইমেইল করেছে ইতিমধ্যে। বইটা লিখি আর মনে হয় মানুষ নিয়ে যত কাজ করা উচিত ছিলো, ধারেকাছেও যেতে পারিনি। এই অপ্রাপ্তিবোধ প্রতিনিয়ত তাড়িত ও ব্যথিত করে।

জীবনে ২০১৭+ বায়োগ্রাফি, ৪০০০০ এর কাছাকাছি ইমেইল/চিঠি/মেসেজ, আর ৩০০০+ ইন্টারভিউ নেয়াসূত্রে এখন কনফিডেন্টলি বিশ্বাস করি মানুষ হয়ে জন্ম নেয়াটা একটা কোইনসিডেন্স, এবং মানুষ জীবনভর যা কিছু করে প্রতিটি এক্টিভিটিই অসংখ্য ছোট ছোট কোইনসিডেন্সের ফলাফল। একা ভাবে পোকা, থিমের আমার এই ‘সহভাবুক’ প্রকল্পটিও নিঃসন্দেহে উপরোক্ত ৫টি কোইনসিডেন্সের দৃশ্যমান রিফ্লেকশন।

সহভাবুক প্রকল্প যেভাবে পরিচালিত হবে:

• উল্লিখিত নামে ইতিমধ্যেই একটি ভারচুয়াল প্লাটফরম (ফেসবুক গ্রুপ ) চালু করা হয়েছে। যারা বই আদান-প্রদান করতে আগ্রহী তারা সেখানে যুক্ত হতে পারেন।
গ্রুপ লিঙ্ক: https://www.facebook.com/groups/1359852257477016/?notif_id=1511352454897299&notif_t=group_added_to_group&ref=notif
• আপনি যে ৩টি বই এক্সচেঞ্জ করতে চান, সেগুলোর নাম লিখে গ্রুপে পোস্ট করবেন। সেই পোস্টের ভিত্তিতে আগ্রহীরা মন্তব্য করবেন, এবং ওই বইটির সাথে তিনি বিনিময় করতে চান, নিজের সংগ্রহে থাকা এমন সম্ভাব্য ৩টি বইয়ের নাম উল্লেখ করবেন মন্তব্যে। তারপর আপনি যাকে নির্বাচন করা সঙ্গত বোধ করেন।
• মাসকে ৩টি ১০ দিনে বিভক্ত করা হয়েছে। আমার নির্বাচিত প্রতিনিধি মাসের শুরুতেই সেই ৩টি দিন নির্দিষ্ট করে গ্রুপে পোস্ট দেবে। অনিবার্য কারণে তারিখ পরিবর্তন হলে আগে থেকেই জানানো হবে। ৩দিন মিলিয়ে আমার টার্গেট থাকবে প্রতিমাসে ন্যূনতম ১১ জন এবং সর্বোচ্চ ১৭ জনকে এই সুবিধা দেয়ার।
• গ্রুপের মাধ্যমে আগে থেকেই জেনে যাবেন কাদের বই আদান-প্রদানের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। আমার প্রতিনিধি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করে একজনের বই অন্যের কাছে পৌঁছে দেবে। বই কোনো কারণে হারিয়ে গেলে সেই ক্ষতিপূরণ দেয়ার দায়ভার আমার।
• আদান-প্রদান দুই মডেলে হতে পারে: ১. আপনি স্থায়ীভাবে বইটি এক্সচেঞ্জ করছেন। ২. বইটি পড়া শেষে আপনি তার সাথে নতুন একটি বই এক্সচেঞ্জ করবেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রথম মডেলটাই পছন্দ করবো।

সার্ভিস চার্জ কি প্রযোজ্য?
এই প্রশ্ন উদ্ভট এবং অবান্তর। তাহলে এই প্রকল্পে আপনার যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। মানি মেকিং এক্টিভিটিতে আমি বরাবরই দুর্বল; আমার জীবনের একমাত্র আনন্দ থট প্রসেস ডেভেলপমেন্ট এবং কমিউনিটি এনলাইটেনমেন্ট এক্টিভিটিতে কন্ট্রিবিউট করা। যেহেতু বই বাহককে আমি ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি, এবং এই উদ্যোগটাও তার কাজেরই অংশ, সার্ভিস চার্জ আকাশের নীল ছোঁয়ার অভিযানে ব্যয় করিয়েন।

একটি শর্ত:
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য যেহেতু কমিউনিটি এনলাইটেনমেন্ট আপনি একা বই বিনিময় করলে সেটাও আত্মকেন্দ্রিকতাকেই প্রোমোট করা হয়। তাই এই প্রকল্পে যুক্ত থাকার একটাই অলিখিত শর্ত: যে বইটি বিনিময় করলেন, পড়ার পর সেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিং (রিভিউ নয়) গ্রুপে পোস্ট করুন। এমন নয় যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং না লিখলে যুক্ত থাকা যাবে না, তবে এইটুকু প্রত্যাশাকে বাড়াবাড়ি বলারও সুযোগ নেই বোধহয়।

নভেম্বর শেষ হওয়ার আগেই এই প্রকল্প শুরু করে দিতে চাই। বিশ্বলাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার ইচ্ছেটা ঈষৎ ইলশেগুড়ি বৃষ্টি থেকে মহাপ্লাবনে রূপ নিক একদিন।

চলুন চিন্তায় চলি, কল্পনায় বাঁচি