উদাহরণ দুটোই।
এক, মোটর বাইক কিনে না দেয়ায় বাবাকে খুন করেছে বখাটে ছেলে।
দুই, একটা ছেলে গত বছর চুয়েটে চান্স পেয়েছিল, কিন্তু বাবা মেডিকেলে পড়াবে বলে সেখানে ভর্তি হতে দেয়নি, এবছর কোথাও চান্স না পেয়ে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে।
দুটোই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এটা দিয়ে সামাজিক প্রবণতা বুঝতে চাওয়া উচিত হবে না। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় ঘটনাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সন্তানের আত্মহত্যার ব্যাপারটি হয়তোবা অহরহ ঘটে না, কিন্তু নিজেদের অপূর্ণ স্বপ্ন সন্তানকে দিয়ে পূরণের নামে বাবা-মা সন্তানকে যে মানসিকভাবে নিষ্পেষণ করেন, এটা অবশ্যই একটি সামাজিক প্রবণতা, এবং এটা নিয়ে আরও বেশি করে কথা বলা উচিত।
জনশ্রুতি আছে, পাশ্চাত্য দেশগুলোতে বয়স ১৮ হয়ে গেলে নাকি সন্তানরা বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে যায়, ওল্ড হোম বা বৃদ্ধাশ্রম ওখানে খুব জনপ্রিয় কনসেপ্ট। আমাদের কালচারে বন্ডিং একটি অত্যন্ত পজিটিভ ব্যাপার, আমরা অতিথিপরায়ণ, রাস্তায় একটি লোক বিপদে পড়লে তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে অসংখ্য অচেনা লোক। এগুলো আমাদের পজিটিভ এনার্জি। আমরা যতই বাসে উঠে সরকারকে গালিগালাজ করি, চায়ের দোকানে বসে দেশ উদ্ধার করি, হিন্দি সিরিয়াল দেখা নিয়ে কলহ বাঁধাই, অন্যের ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর বিষয়ে অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাই, এটা সত্যি আমাদের আবেগই আমাদের শান্তি। এই এক্সট্রিম বা চরম কোনোকিছু আমরা উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাতে চাই না। সন্তানের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার বিরোধীতা করলেই যদি পাশ্চাত্যের উদাহরণ চলে আসে সেটা বাজে এনালোজি। মাথা কেটে ফেলা নিশ্চয়ই মাথা ব্যথার সমাধান হতে পারে না।
সন্তানের জীবনে বাবা-মা ছায়ার মতো। বিভিন্ন লেখালিখি, গান এবং অন্যান্য টিচিং মিডিয়ামে এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে, বাবা-মা সন্তানের জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করেন, বাবা-মায়ের কথাই শেষ কথা। এর কোনোকিছুরই বিরোধীতা করার অবকাশ বা ইচ্ছা নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার একটু ভাবা যেতে পারে; একটা বাচ্চাকে বাবা-মা যেভাবে বড় করে তোলে, এটা যদি বাচ্চার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কারণ হয়ে থাকে, একইভাবে বাচ্চাটা যে কত খুশির উপলক্ষ্য এনে দিলো, এত সুন্দর করে মা ডাকে, আব্বু বলে- এজন্য মা-বাবারও কি সন্তানের প্রতি কৃতজ্ঞতা নেই? সন্তান তাদের সত্তার অংশ, পানি সর্বদা নিচের দিকে প্রবাহিত হয় ( একারণে বাবার বাবা যতটুকু প্রিয়, বাবার ছেলে বা মেয়ে কিন্তু বাবার কাছে প্রিয় বেশি। মায়ের ক্ষেত্রেও তা-ই)- এইসব যুক্তি মেনে এটা বলা যেতেই পারে যে, বাব-মায়ের ঋণ শোধ হবার নয়। এটা নিয়ে বিতর্কেরও কিছু নেই। কিন্তু তার মানে কি এটাই যে, সন্তান তার নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে চাইলে সেটা বাবা-মায়ের প্রতি অসম্মান করা হয়, তাদের অবদানকে খাটো করা হয়? এটা তো তাহলে একতরফা সামাজিক চুক্তির মতো হয়ে গেল। সম্পর্ক তো চুক্তি মেনে হয় না, সম্পর্কে স্যাক্রিফাইস থাকবে, বাবা-মা কিছু ছাড়বেন, সন্তান কিছু ছাড়বে- দুয়ের যোগসাজশেই তো সুসম্পর্ক। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রে বাবা-মা ই নিয়ন্ত্রক ও বিচারক হয়ে উঠলে সম্পর্কটা মনিব-মোসাহেব ধরনের হয়ে যায়।
বাবা-মা এর দায়িত্ব আসলে কী? আমি মনে করি, ৩টি মেজর এরিয়া বাদে বাকি সব ক্ষেত্রে সন্তানকে বাবা-মা এর ছেড়ে দেয়া উচিত, নইলে সে স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে কখনোই আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। সেই তিনটি মেজর এরিয়া এরকম:
১. সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে কি না
২. সন্তান এন্টিসোশ্যাল হয়ে উঠছে কি না
৩. সন্তানের মোরালিটি এবং এথিকস কতোটা স্ট্রং।
এই তিনটি এরিয়াতে সর্বোচ্চ এফোর্ট দিতে পারলে নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার সন্তান অবশ্যই কোয়ালিটি সম্প্ন মানুষ হবে।
অথচ বাস্তবে ঘটছে কী? একদম ছোটবেলা থেকেই সন্তান এটা করতে পারবে, ওটা পারবে না, এরকম শত সহস্র বিধি-নিষেধের অতিকায় ফর্দ। ফলে ত্রুটিপূর্ণ পারসোনালিটি, বিবর্ণ শৈশব নিয়ে, প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক একজন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠে অধিকাংশ বাচ্চা। এরা কি কখনোই মা-বাবাকে সত্যিকারের রেসপেক্ট করতে পারবে? পরীক্ষায় পাশের জন্য পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য রচনা লিখে খাতার পৃষ্ঠা ভরবে, কিন্তু আন্তরিকভাবে কখনোই ফিল করবে না বাবা-মায়ের ভূমিকা, বরং এক ধরনের ভয় আর অপছন্দ তাদের ছেয়ে রাখে বা রাখবে।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলেন সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। কিন্তু বাস্তবে এটা থাকে কেতাবি বুলি হয়ে। বন্ধু বলতে হবে নির্ভরতা আর নির্ভারতা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভারতার বালাই থাকে না, নির্ভরতার প্রেক্ষাপট পুরোটাই অর্থনৈতিক। জীবন ধারণের জন্য সন্তান একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে বাবা-মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। দীর্ঘদিন একই বাসা,একই টেবিলে খাওয়া, একসাথে চলাফেলার কারণে একধরনের মায়ার বাঁধন তৈরি হয় সত্যি, কিন্তু মানসিক দূরত্ব সহসা ঘুঁচে না। গড়পড়তা বাবা-মা এর কাছে বিষয়টা থাকে জেনারেশন গ্যাপের। আপনার ছেলে যদি আপনার সাথে বলতে পারে না স্কুল পালানো কেমন মজার, স্কুলের স্যারকে কীভাবে বোকা বানিয়ে বন্ধুর করা এসাইনমেন্ট নিজের নামে জমা দিয়েছে, কিংবা পাশের বাড়ির সমবয়সী মেয়েটিকে দেখলে কেমন যেন লজ্জা লাগে, তবু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, তাহলে কিসের বন্ধু! বরং আপনাকে দেখে ভয় পেয়ে যদি প্রোগ্রেস রিপোর্ট কার্ডে বন্ধুকে দিয়ে বাবার সাইন করায় সেটা কি খুব ভালো হবে? আপনার ছেলে যে এথিকসচ্যুত হলো, বড় হলে এ যে খুব সহজেই ফাইল আটকে রেখে ৫ লাখ টাকা ঘুষ চাইবে, সেই ভিত তো আপনিই গড়ে দিচ্ছেন। আপনি নিজে শৈশব-কৈশোরে স্কুল পালান নি? ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখেননি? বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে সিগারেট খাননি? বা আপনার মেয়ে যদি গান গাইতে চায়, প্রথা-প্রতিষ্ঠান মানতে না চায় বা একটু বেশি সাহসী হয় সেটা কি খুব অপরাধ। আপনি নিজে খুব সাধু টাইপ মানুষ ছিলেন? তাহলে বাবা কিংবা মা হয়ে যাওয়ার পর এই সন্ত টাইপ ইমেজ গড়ে তুলতে চাওয়ার মানে কী? সন্তানের কাছে কী প্রমাণ করতে চান? ওরা কি অবুঝ, নাকি বেকুব? আপনি যে মিডিওকার, অসাধারণ কেউ নন, বা আপনার রাগ-হম্বিতম্বি এসব যে আপনাকে ওদের কাছে আরও হাস্যকর করে তোলে এটা বুঝেন না?
বাবা-মা সবসময় তুলনা করতে পছন্দ করে।অমুকের ছেলে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে, তমুকের মেয়ে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, তুই কী করলি, এই আফসোস আর মানসিক চাপ তারা ক্রমাগত সন্তানের মধ্যে সঞ্চার করতে চায়। বিশেষ করে, কলিগদের ছেলে-মেয়ে নিয়ে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বীতা কাজ করে। রাসেলের চাইতে ৫ নম্বর কম পেলি কেন, এই অপরাধে কত ছেলে যে মা-বাবার পিটুনি খায় অবিরত, সেই পরিসংখ্যান বাংলাদেশ স্ট্যাটিসটিক্স ব্যুরোর রেকর্ডে নেই। কিংবা মিলি ঢাকা ইউনিতে চান্স পেয়েছে, তুই আমাদের মুখে চুনকালি মেখে দিলি- এই অপরাধে কত মেয়ে যে মা-বাবার মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে চলেছে সেই ১৯৮০ সাল থেকে (৮০ সালের আগে ভার্সিটিতে মেয়েরা কম পড়তো), সেই স্ট্যাটিসটিক্সটাও আমাদের জানা নেই। কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে এরকম কমপ্লেক্সিটি কখনো কাজ করে না, তারা কখনো বলে না, রাসেলের বাবা মাসে ১ লাখ টাকা বেতন পায়, আর তুমি পাও মোটে ২০ হাজার, কিংবা মিলির মা ডাক্তার, আমার মা হাউজওয়াইফ। তারা বড়জোড় না বুঝে আবদার করে বসে, কিন্তু নিজের অক্ষমতা মেনে নিয়ে বোঝালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানরা মেনে নেয়।
সন্তান কী হতে চায়, কোনটা ভালো লাগে, জীবন নিয়ে প্ল্যান কী এসব নিয়ে বাংলাদেশের ৮০% অভিভাবকই কখনো কথা বলে না। তারা মনে করে বাচ্চাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে, তার পেছনে দামী টিউটর রেখে দিয়ে আর ভালো খাবার, ভালো পোশাক দিলেই সন্তান আদর্শ মানুষ হয়ে উঠবে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে কোনো বইকেই আমাদের গড়পড়তা সমাজে নিষিদ্ধ বস্তু হিসেবে দেখা হয়। যে কারণে পড়ুয়া বাচ্চারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বই পড়ে বালিশের নিচে লুকিয়ে অথবা পাঠ্যবইয়ের ভেতরে গুজে দিয়ে, যদি কখনো ধরা পড়ে যায় সেজন্য শাস্তি বরাদ্দ তো থাকেই। একটা বাচ্চা শৈশবে যতোটা কল্পনাপ্রবণ, কৌতূহলী থাকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে ভোঁতা হতে থাকে, এবং এই চাপে পিষ্ঠ হয়ে যখন ভার্সিটিতে উঠে প্রথমবার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে বখে যায়, নয়তো পাল্টে যায়। বাচ্চার শৈশব নষ্ট করার লাইসেন্স অভিভাবক কোথা থেকে পেয়েছে? সন্তান জন্ম দেয়াই যদি অধিকারের সনদ হয়ে যায়, সেই সনদকে মেনে নিতে আমার ব্যক্তিগতভাবে আপত্তি আছে।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বোধহয় ৭০ বছর। কিন্তু ইফেকটিভলি বাঁচে আসলে ৫০ বছর পর্যন্ত, এরপর শরীর ভেঙ্গে পড়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। কচ্ছপের মতো শতায়ু পেলে সেখান থেকে নাহয় কিছু বছর খরচার খাতায় ছেড়ে দেয়া যেত, কিন্তু এত ক্ষুদ্র একটা জীবন যদি অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটা কি মেনে নেয়া সঙ্গত হবে? কিসের দায়? ধরা যাক, একজন পুরুষ ৩০ বছরে বাবা হলো, একজন নারী ২৮ বছরে, বাচ্চার বয়স যখন ২০-২২ হবে ততদিনে তারা ৫০ এ পৌঁছে গেছেন। অর্থাৎ জীবনের লম্বা রেসটা বাচ্চাকে একাই পাড়ি দিতে হবে, গাইড করার জন্য বাবা-মা বেঁচে থাকবে না। কাজেই সেই জার্নিতে সে কীভাবে সারভাইভ করতে পারে সে ব্যাপারে তাকে প্রস্তুত না করে ক্রমাগত বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে রেখে তাকে সীমাবদ্ধ মানুষে পরিণত করছেন। ১৩ বছর বয়সে যে দায়িত্ব নিতে শিখেনি, ক্রিটিকাল পরিস্থিতিতে উপস্থিত বুদ্ধি খাটানোর সুযোগ পায়নি, ৩৩ এ গিয়ে সে আপনার দায়িত্ব নিবে, এই আশার তো কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না।
সন্তানকে ঘিরে বাবা-মা সবসময় অনিশ্চয়তা, আতঙ্কে ভুগেন। এই বুঝি ছেলে খারাপ সঙ্গে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল, মেয়ে বাজে ছেলের পাল্লায় পড়লো। অথচ এটা ছেলেকে বা মেয়েকে বোঝান না খারাপ মানুষের সাথে মিশেও ভালো থাকা যায়, মদখোর-গাজাখোরদের সাথেও স্বচ্ছন্দ্যে কীভাবে চলাফেরা করা যায়, কারণ তারা ভরসা পান না, সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখতে চান। নিজেকে আদর্শ গার্ডিয়ান ভেবে তৃপ্তি পান, সন্তানের জন্য ভবিষ্যত কিনছেন ভেবে দুই ঢোক পানি বেশি খান। অথচ এটা তারা বুঝবেনই না, সন্তানকে জাস্ট ছেড়ে দিন, ওর ওপর আস্থা রাখুন, ওকে নিজেরা খারাপ ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আইডিয়া দিন, ও কখনো খারাপ হবে না। ওকে বলুন, গাজা খেলে মানুষের বোধ থাকে না, পর্ণ দেখলে নৈতিকতা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, পারসোনালিটি ডেভেলপমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। ও তখন বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে চটি বই পড়বে না, মেয়েদের রেসপেক্ট করবে, গুগলে পর্ণ সাইট ভিজিট করার আগে আপনার কথাগুলো মাথায় রাখবে। তা না করে শাসন করবেন, আবার দামি স্মার্ট ফোন কিনে দেবেন, আপনার কোন্ ইনস্ট্রাকশনটা সে মানবে?
বাবা-মা এর করণীয় হচ্ছে সন্তানকে হেল্প করা। একটা বাচ্চা হয়তো ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে, বাবা-মা এর উচিত ক্রিকেট খেলায় ওর প্রতিভা যাচাই করা, যদি দেখে ওর প্রতিভা কম, তাহলে বুঝানো যে বাবা তোমার এখানে প্রতিভা কম, তুমি অন্য কিছু চেষ্টা করবে কিনা ভেবে দেখো। কিংবা একটা মেয়ে পড়তে চায় ইকোনমিক্স এ, সেক্ষেত্রে তাকে ডাক্কারি পড়ার জন্য চাপ না দিয়ে ইকোনমিক্স এর আগ্রহটা কীভাবে বাড়ানো যায় সেই লক্ষ্যে চেষ্টা করা, ইকোনমিক্স নিয়ে ক্যারিয়ার কীরকম হতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তা করা।
তা না করে বাবা-মা এরকম ভিলেনের আচরণ কেন করে? কারণটা সাইকোলজিকাল। তারা সবসময় মনে করে উই আর রাইট, এবং তাদের চোখে সন্তান কখনো বড় হয় না, ইম্যাচিউর থেকে যায়। কিন্তু ৭ বছর হয়ে যাওয়ার পরই বাচ্চারা সবকিছু বুঝে, ওর সাথে যে কোনোকিছু শেয়ার করতে পারেন, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনার ভাবনার চাইতেও অনেক বেশি বুদ্ধিমান আচরণ করতে পারে বাচ্চারা। আপনি/আপনারা কেবল নিজেদের চিন্তা-চেতনাতেই অবসেশড থাকেন, বাচ্চা যে একজন স্বতন্ত্র মানুষ, ওরও যে নিজের জীবন নিয়ে স্বপ্ন-ভাবনা এসব থাকতে পারে, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না। দ্বিতীয় কারণটা আরও গভীর। প্রায় প্রত্যেকটা মানুষ নিজেকে ভিকটিম ভাবতে ভালোবাসে, নিজেদের মিডিওক্রিটি তারা মানতে পারে না, আবার উচ্চমেধা তাদের অনেক ক্ষেত্রেই করে তোলে এরোগেন্ট। ফলে ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হয়ে উঠে নেক্সট জেনারেশন। দেখা গেল, একজন নারী বা পুরুষ কিছু একটা স্বপ্ন দেখেছিল আর্লি এজ এ, কিন্তু সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতায় সেটা পূরণ করতে পারেনি। তখন তারা ঠিক করে আমার ছেলে বা মেয়েকে দিয়ে এই স্বপ্ন পূরণ করে নেব, তাহলেই আমার শান্তি। অথচ, এই সিম্পল ব্যাপারটা তারা বুঝতে হিমশিম খায়, সন্তানেরও স্বপ্ন থাকতে পারে, সেটা ভুল বা সঠিক যেমনই হোক, স্বপ্নপূরণে ওকে হেল্প করা উচিত। কিন্তু তাদের মধ্যে ইগো কাজ করে, সন্তানের ইচ্ছা মেনে নেয়া মানে একধরনের নৈতিক পরাজয়। ফলে সন্তানের ইচ্ছা বনাম নিজেদের ইচ্ছার এক অদৃশ্য লড়াই কাজ করে, যেখানে বয়স এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার সুযোগে অভিভাবক বিজয়ী হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।
আরেকটা বড় কারণ প্যারেন্টিং নিয়ে সচেতনতার অভাব। জনক-জননী হওয়া তেমন কঠিন কাজ নয়, বয়স ১৩ পার হলেই সেই ক্ষমতা চলে আসে বায়োলজিকালি। কিন্তু বাবা কিংবা মা হওয়া অনেক সাধনার ব্যাপার,দুঃখজনক হলেও আমাদের সোসাইটিতে জনক-জননীর আধিপত্য, পিতা-মাতার পারসেন্টেজ এখনো বেশ কম।
আমাদের যারা বাবা-মা তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, তাদের বাবা-মা রা বৃটিশ শাসন দেখেছেন, ফলে ইনসিকিউরিটি ফিলিং তাদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি, তারা স্যুট-টাইকে এখনো সাহেবী প্রতীক মনে করেন। এখন যাদের বয়স ৪০ এর আশপাশে তাদের সন্তানেরা যখন বড় হবে, আশা করা যায় তারা আরেকটু স্মার্ট বাবা-মা হবেন। তারা নিজেরা সন্তানকে ফেসবুক একাউন্ট খুলে দেবেন, ছেলেকে সাথে নিয়ে সিনেমা দেখবেন, নায়ক-নায়িকার প্রেম নিয়ে কথা বলবেন, কিংবা ছেলের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে খাবেন, মেয়ের বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেবেন। জেনারেশন গ্যাপের দেয়ালটা পুরোপুরিই মানসিক, এখানে বয়স কোনো ফ্যাক্টরই নয়। যদি সন্তানের ভালো চান, দেয়াল ভেঙ্গে ফেলুন। পরীক্ষায় ১০০ নম্বর পাওয়ার চাইতে, ২ জন নতুন মানুষের সাথে ভালোভাবে মেশার গুণটা বেশি কাজে দেবে প্র্যাকটিকাল লাইফে। এতোকিছু বোঝেন, আর এটা বুঝেন না, তাও হয় নাকি!