২০১৩ সালে যে পরিকল্পনা মাথায় আসার পরও বিবিধ সীমাবদ্ধতাহেতু শুরু করতে পারিনি, হিউম্যানল্যাব এর মাধ্যমে ৬ বছর পরে হলেও অবশেষে সেটি চালু করতে সমর্থ হলাম গত ২২ শে ডিসেম্বর, সকাল ১০টা ২৭মিনিটে। ফাবিহা লামিসা নামের ক্লাস সিক্স পড়ুয়া এক কন্যাশিশু হিউম্যানল্যাবের শিশু উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছে। শিশু উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতি মাসে তাকে ২টি বই পড়তে হবে, শিক্ষক এবং স্কুলের ছোট-বড়ো ছাত্রীদের সাথে গল্প করে (ইন্টারভিউ নেয়া) যা বুঝেছে তা লিখে পাঠাতে হবে, এবং মাঝেমধ্যে কুইজ কম্পিটিশন, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান প্রজেক্ট কিংবা লেখালিখি প্রতিযোগে অংশ নিতে হবে কিংবা প্রোগ্রামের আয়োজন করতে হবে।
হিউম্যানল্যাব থেকে সে একটি আইডি কার্ডের পাশাপাশি ভিজিটিং কার্ড পাবে, এবং মাসিক সম্মানি হিসেবে ৩১টি ১০টাকার নোট এবং১টি ১টাকার কয়েন দেয়া হবে!
শিশু উদ্যোক্তা যেহেতু আমার দীর্ঘদিনের সংকল্প, এই খাতে নিয়মিত খরচ করার ইচ্ছা এবং সাহস রাখি। ২০১৯ সালে বিভিন্ন স্কুল মিলিয়ে সর্বমোট ১৯ জন শিশু উদ্যোক্তাকে গ্রুমিং করবো। ১ জন হয়ে গেলো, বাকি রইলো ১৮ জন! ৪র্থ থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত যে কেউ শিশু উদ্যোক্তা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং ইন্টার পাশ না করা অবধি এই প্রকল্পে যুক্ত থাকতে পারবে।
ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট খাতে জীবনের অগণন সময় বিনিয়োগ করার পর আমার উপলব্ধি হলো, ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট একটা লালঝুঁটিওয়ালা মোরগের পুচ্ছ ব্যতীত কিছু নয়, যার শৈশব আর কৈশোর কেটে গেছে বিস্তর ফাঁকিবাজি আর গলদপূর্ণ সিস্টেমের সর্পিল বাঁধনে যৌবনে এসে সে আৎকা কোন্ মোকাম্মেল মোর্শেদে পরিণত হবে! তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়ে গেছে, সাবালকত্বের চার্মিং শব্দগুচ্ছ তার কণ্ঠ থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। তার কার্যক্রমের বেশিরভাগই চালিত হয় অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে, চাই কি একে ধান্ধাবাজিও বলতে পারি। বয়স ১৯ স্পর্শ করলে জীবন খুব সন্তোর্পণে আমাদের কানের কাছে বলে যায়- ‘ধান্ধা করো, নয়তো ধন্ধেয় পড়ো’। জীবন যেহেতু এক নিম্নমানের চুতমারানীর পোলা, তার ধান্ধাসংক্রান্ত উপদেশকে নেগেটিভলি দেখার সুযোগ নেই; বয়সকালে ইকোনমিক্স সম্বন্ধে উদাসীন থাকলে পরিণত বয়সে ‘আমার খালু মেজর, ফ্রেন্ড ডাক্তার, ভাইয়ের শ্যালক ডিজি’ প্রভৃতি গল্প করেই জাতে উঠার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়, কিন্তু নিজে কী করেন প্রশ্ন শুনলে ‘একটু আসি’ বলে প্যান্টের জিপার টানতে টানতে পালিয়ে বাঁচতে হয়, কিংবা ‘আর বইলেন না ভাই, আমার বাপ-মায়ের জন্য কিছুই করতে পারলাম না জীবনে; তারা আমারে গাইডই করতে পারে নাই’- জাতীয় কথা বলে গলার জোর দেখাতে হয়।
বালেগপ্রাপ্তির পর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হয়তোবা সবারই হয়, কিন্তু অভিভাবক হওয়ার বিরল যোগ্যতা অধিকাংশ নারী-পুরুষেরই নাগালের বাইরে রয়ে যায় আজীবন। আমি তাই মা-বাবা শব্দটাই ব্যবহার করি না, আমাদের দৃষ্টিতে এদের সংখ্যাগরিষ্ঠই হলো প্রোডাকশন লেবার। একটি গরিলা যেভাবে সন্তান পালন করে, মানুষের সন্তান পালন প্রক্রিয়া তার চাইতে উন্নততর কিছু নয় আদতে। সন্তানকে টিউটর রেখে দিয়ে বা কড়া শাসনের মধ্যে রেখেই জনৈক মা-বাবা দেশি মুরগীর সালুন আর নাইলটিকা মাছের দোপেয়াজা দিয়ে ভাত খেয়ে রাতের বেলা দাঁত ব্রাশ না করেই ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই ঘুমিয়ে পড়তো তার বাবা-মা, তার বাবা-মা, তারও বাবা-মা…. এই দুষ্টচক্র ছিন্ন হবার নয়।
এই বাস্তবতা মেনেই ২০১৩ এর দিকে সিদ্ধান্তে আসি শিশুদের দায়িত্বশীল এবং মননশীল বানানোই আসল, সেটা পারলে যৌবনে নিজেরাই ট্র্যাক বাছাই করে নিতে পারবে। আমার একটা ইচ্ছা আছে, স্কুলে স্কুলে বছরব্যাপী প্রশ্ন উৎসব করা। একটা স্কুলে যে ছেলে বা মেয়ে সর্বাধিক কোয়ালিটি সম্পন্ন প্রশ্ন লিখতে পারবে, তাকে এককালীন ৭৯০০০ টাকার বৃত্তি দিবো, তাকে ৭৯ ইঞ্চি লম্বা ক্রেস্ট দিবো ছবিসহ!। মাত্র ৩ বছর যদি এটা চালাতে পারি তখন গল্পপ্রিয় মা-বাবা যারা জিজ্ঞেস করে ‘ভাবী, আমার মেয়েটা তো পড়তেই চায় না। ৬টা টিচার রেখে দিয়েও লাভ হচ্ছে না’, কিংবা ‘জামিল সাহেব, আমার ছেলেকে তো দিলাম ইংলিশ মিডিয়ামে, আপনার ছেলে কোথায় পড়ছে’?- তারাও তখন ভোঁতা হয়ে যাওয়া ছেলে বা মেয়েকে তাগাদা দিয়ে বলবে, ‘সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে রেখে লাভ কী যদি প্রশ্নই করতে না পারিস’!
উদ্যোক্তা হওয়া সমকালীন ট্রেন্ড। ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য একাডেমিক পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু উদ্যোক্তা হতে সুনির্দিষ্ট কোনো একাডেমিক শর্ত নেই, যে কোনো ব্যাকগ্রাউন্ডের এমনকি ড্রপ আউট মানুষও উদ্যোক্তা হতে পারে যদি প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি থাকে। তবে উদ্যোক্তা জার্নি কার কতদূর যাবে তা নির্ভর করে গ্রোথ মাইন্ডসেট আর ভিশনের উপর, যার নিদারুণ অভাবে হাহাকার রব উঠে আমাদের সমাজে। আমাদের মানুষগুলো মোমের তৈরি আর ফিক্সড মাইন্ডসেট দ্বারা চালিত; গ্রোথ মাইন্ডসেট গঠনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ নেয়ার সাহস-সাধ্যে নেই, শর্টকাটে নায়ক শাহীন আলম টাইপ কিছু হওয়ার প্রতিই অপার ঝোঁক লক্ষণীয়।
উদ্যোক্তা হওয়া মানে কমফোর্ট জোন তৈরি না হওয়া, এক্সপ্লোরিং মানসিকতা গড়ে উঠা। ক্লাস ফাইভ-সিক্সের একটা বাচ্চা যখন তার সমবয়সীদের ইন্টারভিউ নিবে কিংবা শিক্ষককে প্রশ্ন করবে স্যার আপনি শিক্ষকতায় কেন এলেন, এটা তার মধ্যে যে স্পার্ক সৃষ্টি করবে তার প্রভাবে পরিণত বয়সে কোনোকিছুকেই জটিল কিছু মনে হবে না। সে মাসে একদিন অফিসে এসে রিপোর্ট করবে, কিন্তু মানি মেকিং কোনো কার্যক্রমের সাথে সে জড়িত নয়, উপরন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কারণে তাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। এই বাচ্চাগুলোর বয়স যখন ১৯ পার হবে, সে বসবাস করবে অন্যদের কল্পনাতীত এক বাস্তবতার জগতে। জমিজমা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির জগত কোনো উত্তরাধিকার নয়, এই জগত নির্মাণ করে নিতে হয় হিমালয়সম প্রচেষ্টা আর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে।
২০২৯ সাল পর্যন্ত যদি সুস্থ্য থাকি, তাহলে আগামী ১১ বছরে ৭৭৯ জন শিশু উদ্যোক্তা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রইলো। কিছুক্ষণ আগে গুগলে VentureLab নামে এক সাইটের সন্ধান পেলাম যেখানে শিশু উদ্যোক্তা তৈরির বিভিন্ন কোর্স করানো হয়। এই কোর্সগুলো কতটুকু ইফেক্টিভ সে ব্যাপারে জানা নেই, তবে এটা ভালো লেগেছে যে শিশু উদ্যোক্তা তৈরির ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়া হচ্ছে।
উদ্যোক্তা কোনো পরিণতি হয়, অভ্যাস। শৈশবকালেই যদি সেই অভ্যাস রপ্ত করতে শেখে মানুষ, তার আত্মসম্মান, ইনটিউশন, ভিশন এবং গ্রোথ মাইন্ডসেট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। জীবনের ২৫-২৬ বছর পরনির্ভরশীল থেকে ২৭তম বছরে এসে বিরাট দায়িত্ববান মানুষ হবে এই ভাবনাই তো দূষিত।
এক স্কুল থেকে সর্বোচ্চ ২ জন শিশু উদ্যোক্তা নেয়া হবে। আমি চাই বিভিন্ন স্কুলে শিশু উদ্যোক্তা স্পিরিট ছড়িয়ে পড়ুক। একারণেই সংখ্যার ক্ষেত্রে এই শর্তারোপ।
আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে,
আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই
আজ যে শিশু মায়ের হাসিতে ভেসেছে
আমরা চিরদিন সেই হাসি দেখতে চাই