লেটস লাইক লিলিয়ান গার্সিয়া
কীভাবে কখন তৈরি হয় লেখার চরিত্র? চেনা পৃথিবীর প্রতিদিনকার মানুষেরা চরিত্র হয়ে উঠতে পারে কদাচিৎ, যারা থাকে যোগাযোগসীমার বাইরে তারাই সাধারণত ডানা এবং দানার সমারোহে ভাসমান চরিত্ররূপে স্থায়িত্ব পায়।
যে সীমিত সংখ্যক মানুষ আমার বই পড়েন তারামাত্রই জানেন মুখবন্ধ অংশটাতে অজন্তা হালদার নামক নারীর বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিই, এবং মৌনতা ক্লাব বইটি আবর্তিত হয়েছে কথিত সেই অজন্তা হালদারকে ঘিরেই। ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত যারাই বই পড়ে প্রায় প্রত্যেকেরই অবধারিত প্রশ্ন- অজন্তা হালদার আদতে কে; সে কি কৈশোর বা তারুণ্যে ভালো লাগা কোনো নারী যার প্রতি তৈরি হওয়া অবদমন নিষ্কাশন করি বইয়ের মাধ্যমে? গালগপ্পো শোনাই সুবিধামতো, কোনোটা বিশ্বাস্য কোনোটা বা বিশ্বাস্যহীন।
তবে
প্রকৃত সত্য হলো বাস্তব পৃথিবীতে অজন্তা হালদার নামে কোনোদিন কারো সাথে দেখা বা কথা হয়নি। নামটি নির্বাচন করা হয়েছে পরিচিত পৃথিবীর দুজন পৃথক নারীর একজনের ফার্স্ট অন্যজনের লাস্ট নেম জোড়াতালি দিয়ে, যাদের কারো সাথেই ঘনিষ্ঠতা তৈরির অবকাশ ছিল না।
তবে কি অজন্তা হালদার সেই দুই নারীর সন্নিবেশ? একদমই না।
কল্পিত অজন্তা হালদার গান করে; সে সংস্কৃতিমনা এবং কথা-বার্তায় সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত।
কোথা থেকে এলো এসব বৈশিষ্ট্য?
উত্তর জানতে ফিরে যেতে হবে ২০০০ সালের ইটিভি, আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে একজন রেসলিং উপস্থাপিকার কাছে। ১৩ বয়সের জনৈক কিশোর তার বাচনভঙ্গিতে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল, সেই জট খুলেনি বা খুলতে চায়নি পরবর্তী ২১ বছরেও!
কী নাম তার?
গতকাল জনৈক তরুণ আমার উদ্দেশে প্রশ্ন রেখেছে পৃথিবীর যে কোনো ১১ জন ব্যক্তিত্বের ইন্টারভিউ নেয়ার সুযোগ পেলে কাদের রাখবেন।
উত্তরে ক্রিকেট থেকে রাহুল দ্রাবিড়, শোয়েব আখতার; সাহিত্যে ওরহান পামুক; ফিল্মে রূপা গাঙ্গুলী, ক্রিস্টোফার নোলান; রাজনীতিতে জার্মান চান্সেলর, ডোনাল্ড ট্রাম্প; মিউজিকে জেমস, কোরস ব্যান্ডের ভোকাল আন্দ্রেয়া, ব্যবসায়- অ্যালন মাস্ক এবং রেসলিংয়ে একজন উপস্থাপিকা যার নাম লিলিয়ান গার্সিয়া!
অন্য দশটি মনোনয়ন অবাক না করলেও শেষ নামটি অনেকের জন্যই অচিন্তনীয় হতে পারে। ২০০০-০১ দুই বছর বাদে রেসলিং কখনোই সেভাবে আকর্ষণ করেনি, তবু দীর্ঘদিন পর্যন্ত এর খবরাখবর রাখবার অন্যতম কারণ রেসলার কেইন, তবে মূল কারণ অবশ্যই উপস্থাপক লিলিয়ান গার্সিয়া।
কণ্ঠস্বরের প্রতি সুতীব্র আসক্তির ব্যাপারে বহু লেখালিখি করেছি। ক্রিকেটে টনি গ্রেগ আর মাইকেল হোল্ডিংয়ের ধারাভাষ্যে চুম্বকের ন্যায় আকৃষ্টের কারণ যতটা ক্রিকেটিয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি কণ্ঠস্বরের মাদকতা।
উইকিতে পড়াশোনা করলেই লিলিয়ান গার্সিয়া সম্বন্ধে পর্যাপ্ত তথ্য জানা সম্ভব, জানিনি কারণ যত জানবো তাকে বিনির্মাণের সুযোগ হতে থাকবে সংকীর্ণতর। ইউটিউবে লিলিয়ান গার্সিয়ার গান শুনি মাঝেমধ্যে, আহামরি প্রতিপন্ন হয় না সেসব। তখন রেসলিং ক্লিপিংয়েই রাখতে হয় আস্থা।
এতক্ষণে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে অজন্তা হালদারের মূল প্রভাব আদতে লিলিয়ান গার্সিয়া থেকে উৎসারিত।
আমি কি লিলিয়ান গার্সিয়ার ফ্যান বা অনুরাগী? নইলে অজন্তা হালদারের মতো স্থায়ী চরিত্র কেন তৈরি হলো তাকে ঘিরে কল্পনায়? এর কারণ সম্ভবত রেসলিং এন্টারটেইনমেন্টের প্রকৃতি। খেলাটা পুরোপুরি শারীরিক কসরত, তীব্র মাংসপেশীকেন্দ্রিক। সার্কাসে পারফরমাররা যেমন এক দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যায় রেসলিংও কৌশলের দিক থেকে সমানুবর্তী। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের ন্যায় রেসলিং সার্কিটে চূড়ান্ত মিসফিট একজনকে অনবরত দেখার দরুণ এক পর্যায়ে সে হাজার মাইল দূরবর্তী থেকেও হয়ে উঠে অতি চেনা একজন।
ক্রিটিকাল বা অ্যানালিটিকাল দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কেবলমাত্র কণ্ঠস্বরের মাধূর্যের কারণে কাউকে ২১-২২ বছর ধরে বয়ে বেড়ানো চিরায়ত ফ্যানবয়সুলভ আচরণ। এই বাস্তবতা অনুধাবন করি বলেই অজন্তা হালদার অনেক বেশি সাহসী, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং যুক্তিবাদী, কিছুক্ষেত্রে থ্রিলার উপন্যাসের নায়িকার ন্যায় রহস্যময়। বইয়ের মুখবন্ধে অজন্তা হালদার আমার প্রতি সেসব প্রশ্ন ছুড়ে দেয় যা শুনতে চাই না বা উত্তর দিতে অনীহা কাজ করে। কিংবা একজন ক্রিটিকের চোখে বইয়ের যেসব দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা আবিষ্কৃত হবে কল্পনা করি অজন্তার কণ্ঠনিঃসৃত জিজ্ঞাসাগুলো তারই প্রতিধ্বনি। লিলিয়ান গার্সিয়ার বর্তমান বয়স ৫৫, দুই বছর আগে প্রকাশিত মৌনতা ক্লাব এ অজন্তা হালদারের বয়স বলা হয়েছে ৪৩; সে নিরিখে বর্তমানে তার ৪৫ চলমান! কিন্তু সে আমার সাথে যে ভাষাভঙ্গিতে আলাপ চালায় অচেনা যে কেউ সমবয়সী ভেবে নেবে।
চাইলে তাকে সমবয়সী বানানোই যেত, কিন্তু ১৩ বয়সে যখন প্রথমবার পরিচিতি গড়ে উঠে লিলিয়ান গার্সিয়ার সাথে তখনই সে ত্রিশোর্ধ্ব নারী। তাকে ভেবে নির্মিত চরিত্রের বয়স কিছুটা কমতে পারে, কিন্তু একটানে ২০-২২ বছর কমিয়ে দিলে সেটা সম্ভবত গার্সিয়ার পরিবর্তে অন্য কারো প্রতিবিম্ব হত। রঙপ্যাথি বইয়ে হাভিয়ের গঞ্জালেস নামে এক স্প্যানিশ কূটনীতিক চরিত্র রেখেছিলাম। অন্য দেশ না হয়ে স্পেন কেন সহজেই ধর্তব্য যখন জানবেন জন্মসূত্রে লিলিয়ান গার্সিয়া একজন স্প্যানিশ।
চরিত্রের প্রতিবর্ণীকরণ গোলার্ধের দুই প্রান্তে অহরহ ঘটে থাকে। যেমন ইলিয়াডের একিলিসের শৈশবের সাথে দুর্দান্তভাবে মিলে যায় মহাভারতের ভীষ্মের; এটা কি নিছকই কাকতালীয়, কিংবা রাজা প্রিয়াম যেন প্রতিমূর্তি ধৃতরাষ্ট্রের। তাই রেসলিংয়ের উপস্থাপক লিলিয়ান গার্সিয়া যখন অজন্তা হালদার হয়ে মৌনতা ক্লাব নামে বিচিত্র চায়ের দোকান চালায়, মনে হয় পৃথিবীটা আসলেই ক্ষুদ্র।
কণ্ঠস্বর ব্যতীত লিলিয়ান গার্সিয়ার কী কী বৈশিষ্ট্য ছিল যার প্রভাবে তাকে লেখার চরিত্র বানানো হলো পরিণত বয়সে? এক্ষেত্রে বায়াসনেস এ অনুপ্রবেশ ঘটে। সুন্দর কণ্ঠস্বরের একজন মানুষ, হোক সে পুরুষ অথবা নারী, তার সাথে কথা বলবার ক্ষেত্রে যতটা উদ্দীপনা বোধ করি সেই প্রভাবে অনেকসময়ই তাকে ভুলভাল মূল্যায়ন করে বসি,যদি গতানুগতিক কণ্ঠের মানুষ পায় না বিশেষ শৈথিল্যটুকু।
তবে কি যে কোনো কণ্ঠশিল্পীর প্রতিই কিছুটা মানুষিক দুর্বলতা কাজ করে? লিলিয়ান গার্সিয়ার গান শোনার ব্যাকুলতা তো কাজ করে না, কিংবা শোনার পরেও বিশেষায়িত বোধ সক্রিয় হয় না। কিংবা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করা তরুণ-তরুণীদের ইস্ত্রি করা বাচনভঙ্গিতে রীতিমত অ্যালার্জিক অনুভূতি কাজ করে। আবৃত্তিশিল্পীদের বাচনভঙ্গিও টানে না। বরং যারা কোনোরূপ পারফর্মিং আর্টের সাথে সংযুক্ত নয় অথচ ভোকাল টোন সাধারণের চাইতে ব্যতিক্রম সেই মানুষগুলোই সচরাচর বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করে ফেলে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো বাহ্যিক সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা বা অর্থ-বিত্ত দেখে কারো প্রতি আকৃষ্ট হওয়া যদি নিন্দনীয় হয় সামাজিকভাবে, কণ্ঠস্বরের প্রতি দুর্বলতাকেও কি একই কাতারে স্থান দেয়া উচিত নয়? পাল্টা প্রশ্ন তখন এসেই পড়ে, একজন মানুষ অপরের প্রতি আকৃষ্ট তবে হবে কীভাবে; কোনো একটা কারণ তো থাকতেই হবে। ‘ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য’ কথাটাই কি ভেক নয়, কেননা উল্লিখিত প্রতিটি আকর্ষক প্যারামিটার মিলিয়েই তো তৈরি হয় ব্যক্তিত্ব।
তাছাড়া আকর্ষণের আউটপুট কী সেটাও বিবেচ্য? লিলিয়ান গার্সিয়ার কণ্ঠস্বর থেকে জন্ম নিলো চরিত্র, কতগুলো বই, যা ৫ জন হলেও মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়ায় ইমপ্যাক্ট রেখেছে। যখন আমার লিখিত বইয়ের সংখ্যা ৩০ অতিক্রম করবে ততদিনে কি অজন্তা হালদার চরিত্রটি পরিণত হবে না কাল্ট ফিগারে? অথচ সে এসেছিল রেসলিংয়ের মতো মাংসল এন্টারটেইনমেন্ট থেকে। যখনই কিছু লিখতে বা গবেষণা করতে যাই দিনের পর দিন ইউটিউবে নিম্নমানের বাংলা সিনেমা দেখি, সস্তা লিরিকের গান শুনি, ফোনে আলাপ করি সেইসমস্ত মানুষের সাথে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না বহুবছর, কিংবা মেসেজ পাঠাই সঞ্চিতা দে, লুবনা, পাপড়ি সহ অজানা মানুষদের যারা অবস্থান করছে কয়েক হাজার মাইল দূরত্বে। অর্থাৎ এমন সব এক্টিভিটি চালাই যা সুস্থ্য-স্বাভাবিক দশায় স্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হবে অনেকে। এসব অপাঙক্তেয় এবং আপাত আনপ্রোডাক্টিভ কর্মকাণ্ডে বুঁদ হয়ে যখন প্রচণ্ড গ্লানি আর হতাশায় আচ্ছন্ন হই, তখনই তৈরি হয় চরিত্র, বা কনসেপ্ট বা গবেষণার পারপাস-অবজেক্টিভ।
সেই সমস্ত ক্ষণে কোথায় থাকে লিলিয়ান গার্সিয়া? তাকে খুঁজবার অভিপ্রায়েই তো উচ্ছন্নে যাওয়ার যজ্ঞ চলে। আমি মানসিকভাবে উচ্ছন্ন অভিমুখে যাত্রা করে শেষ মুহূর্তে ফিরে আসি অজন্তা হালদারের সাথে মৌনতা ক্লাব এ চা খাওয়ার আহ্বানে!