ক্রিকেটসূত্রে সারাজীবনে আমার উপার্জনের পরিমাণ মাত্র ২০ হাজার টাকা; একটা অনলাইন টকশো করেছিলাম কিছুদিন। কিন্তু ৩৫ বছরের জীবনে ক্রিকেটের পেছনে খরচ করেছি হাজার হাজার ঘন্টা।
ক্রিকেট থেকে আমার কোনো রোজগার তো হয়ই না, উপরন্তু ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকার দরুণ বছরে ১টা বই কম লেখা হয়, প্রফেশনাল কনট্রাক্ট মিস করি আনুমানিক ৪ লক্ষ টাকার।
এ তো গেল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আর্থিক লোকসান। ভাবমূর্তি ক্রাইসিসের জায়গায় আসি। প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ অকথ্য গালিগালাজ আসে ইনবক্সে সেগুলো কখনো ওপেন সোর্স করে দিলে অনেক কথারই জবাব দেয়া হয়ে যাবে।
সেদিন কাজিন প্রমা খুবই গুরুতর প্রশ্ন করে বসে- ভাইয়া আপনি এতবছর ধরে ক্রিকেটে এত সময় কেন দেন। কাকতালীয়ভাবে সেদিনই একজন ইনবক্সে লিখে নট আউট নোমান, উৎপল শুভ্র, দেব চৌধুরি, রনি এদের এজেন্ডা আছে বলে সবাই, আপনি কি ধোয়া তুলসি পাতা; আপনারও তো এজেন্ডা আছে, আমরা কি কিছুই বুঝি না? আপনি বিসিবিতে চাকরির ধান্ধায় এসব করেন, এজন্যই পাপন আপনার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় না, পঞ্চপাণ্ডবকে অসম্মান করে নজরে পড়তে চান। কিন্তু ক্রিকেটের বালও বুঝেন না। নিজেই স্বীকার করেছেন লিটনের ব্যাটিং ছাড়া টেস্ট দেখেন না।
যখন তরুণ ছিলাম তখনই চাকরি করিনি, জীবনে কাউকে তোয়াজ করে কথা বলিনি; শেষমেষ বিসিবির মতো একটা লুথা প্রতিষ্ঠান থেকে দুটো পয়সার লোভে লেজুড়বৃত্তি করতে হবে। অপেক্ষায় আছি, কে কবে বলে লিটন দাসের কাছ থেকে মাসে কত করে পান। লিটন আপনার ভাই নাকি মেয়ের জামাই যে সে ভালো খেললে মানুষরে উপহার দেন!
যাহোক ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকার কমপক্ষে ৩টা এজেন্ডা আছে, তবে সেসব কোনো খুচরা এজেন্ডা নয়, সাইজে দশাসই।
ক্রিকেট সংক্রান্ত আমার এজেন্ডা বুঝতে হলে আপনাকে ফিরতে হবে ২০১৪ এর এপ্রিলে, এবং একনাগাড়ে এগিয়ে গিয়ে থামতে হবে ২০১৮ এর অক্টোবরে।
এই সাড়ে ৪ বছরে কী ঘটেছিল, সেই গল্পটা শুনুন।
আমি একটা ক্রিকেট টিম গঠন করেছিলাম। ঢাকা শহরের বিভিন্ন ক্রিকেট একাডেমি থেকে গড়ে ২০-২২ বয়সী ক্রিকেটারদের বাছাই করে ১৯-২০ জনের একটি স্কোয়াড। তারা প্রতি সপ্তাহে একটি করে ম্যাচ খেলত। প্রতিপক্ষ ঢাকার বিভিন্ন একাডেমি। ঢাকার খুব কম একাডেমিই বাকি ছিল যাদের বিপক্ষে আমার টিম ম্যাচ খেলেনি। কোনো কোনো মাসে ঢাকার বাইরের জেলায় ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। এভাবে সাড়ে ৪ বছরে ট্যুর করা হয়েছে ১৮ টি জেলায়। আমরা প্রতিপক্ষ দলের সেরা ব্যাটসম্যান, বোলার এবং বেস্ট ট্যালেন্ট ক্রিকেটারকে স্যুভেনির দিতাম। টিমের কোচকে দিতাম স্বপ্নদ্রষ্টা স্যুভেনির। আমার পরিকল্পনা ছিল সারা দেশের উঠতি ক্রিকেটারদের নিয়ে ডেটাবেইস তৈরি করব।
টিমের স্পন্সর ছিল রকমারি ডট কম, প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা দিত। তাদের নামানুসারেই টিমের নাম রাখা হয় টিম রকমারি। কিন্তু প্লেয়ারদের পারফরম্যান্স বোনাস, খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াত, কিট খরচ মিলিয়ে এত বিশাল বহর মাত্র ৪০ হাজার টাকায় কভার করা সম্ভব হত না। প্রতি মাসে আমার নিজের পকেট থেকে গড়ে ২৫ হাজার ভর্তুকি দিতে হয়েছে। তবু ক্রিকেট টিমের পেছনে সেই খরচটাকে কখনোই বোঝা মনে হয়নি, যদিও এজন্য আমার সাংসারিক জীবনে অভাব-অনটন হয়ে থাকত নিয়মিত ঘটনা।
ক্রিকেট টিমের নিয়ম-কানুন ছিল অত্যন্ত কঠোর, টিম কালচার সবার উপরে। মেন্টাল টাফনেস পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষাও ছিল। এত কঠোর নিয়মের মধ্যে বেশিরভাগ ক্রিকেটারই সারভাইভ করতে পারত না, কিন্তু মাসে ৩-৪ টা ম্যাচ খেলতে পারা, এবং ভালো পারফরম্যান্সের কারণে আর্থিক সুবিধা পাওয়া— এই দুই মোটিভেশনের কারণে প্রচুর সংখ্যক ক্রিকেটার সবসময়ই রাডারে ছিল। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, মূল টিমে চান্স পাওয়ার জন্য ‘পাইপলাইন ক্রিকেটার্স’ নামের একটি বিকল্প টিম গঠনে বাধ্য হই যেখানে ক্রিকেটাররা ম্যাচের খরচ আনুপাতিক হারে নিজেরা বহন করত, সেখানে পারফর্ম করে টিম রকমারিতে ঢুকতো।
টিমের পরিকল্পনায় প্রথম ধাক্কা খাই থার্ড ডিভিশন লীগের সময়। টিমের প্রায় ১০-১২ জন ক্রিকেটার সুযোগ পায় বিভিন্ন দলে। আমার বক্তব্য ছিল এইসব সেকেন্ড ডিভিশন-থার্ড ডিভিশন খেলে কতদূর যাবে, বছরের পর বছর একই লীগেই খেলে যেতে হবে, তার চাইতে নিজেদের স্কিল বাড়াও, আমরা প্রয়োজনে ফার্স্ট ডিভিশন টিমগুলোকে টাকা-পয়সা দিই যাতে আমাদের বিপক্ষে প্র্যাক্টিস ম্যাচ খেলে; সেখানে ভালো পারফর্ম করলে হয়তবা ভাগ্য ঘুরবে। না ঘুরলেই কী; টিম রকমারিতে খেলতে থাকো।
এই প্রস্তাবে ৮০% ক্রিকেটারই রাজি হয়নি। তাদের যুক্তি ছিল টিম রকমারি তো বিসিবি অনুমোদিত কোনো লীগে খেলছে না, এখানে খেলে তার ক্যারিয়ারে কোন ভ্যালুটা যুক্ত হবে; বরং থার্ড ডিভিশনে এক সিজনে ৪০০ রান করতে পারলে পরের বছর ফার্স্ট ডিভিশনে টিম পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। যার ফলশ্রুতে একযোগে বহু ক্রিকেটার টিম ত্যাগ করে।
তবে ঘটনাটা আমাকে আলোড়িত করে। প্রশ্ন জাগে, প্রতি মাসে ৬০-৬৫ হাজার টাকা খরচ করে, নিজের সংসারে এত স্যাক্রিফাইস করে, রকমারি ডট কম এর প্রায় সবার বিরক্তি জাগিয়ে এই টিমটা কেন চালাচ্ছি, এখান থেকে কী এচিভ করতে চাই, এবং যে ছেলেগুলো এখানে খেলছে ওদেরই বা প্রাপ্তিটা কী হতে পারে।
তখনই উপলব্ধি আসে, আমি আদতে ক্রিকেট জগতের অভিজাত সংগঠন মেরিলিবন ক্রিকেট ক্লাব তথা এমসিসি ধরনের কিছু একটা গড়তে চাই, যেখানে ক্রিকেটার তৈরি হবে কালচারাল প্রোডাক্ট হিসেবে, তারা বিসিবির দুর্নীতিযুক্ত সিস্টেমের অংশ হবে না, এবং আমার সেই কল্পিত এমসিসি এর ওয়েবসাইটে সারা দেশের ন্যাচারালি গিফটেড ক্রিকেটারদের বিস্তারিত বর্ননা থাকবে যাতে দুর্নীতিবাজ ক্লাবগুলো মন চাইলে তাদের নক করে। আর আমার দলের ক্রিকেটারদের জন্য থাকবে ব্যক্তিগত স্পন্সর। হয়ত একজন স্কিল্ড ব্যাটসম্যান বা বোলারকে প্রতি মাসে একটি পারিশ্রমিক দিল কোনো একটা কোম্পানি। সেই কোম্পানি কেন দিবে? কারণ আমি তাদের কোম্পানিতে আমার কোনো একটা সার্ভিস দিব। তারা বড় পারসেন্টেজ এ ডিসকাউন্ট পাবে যদি একজন ক্রিকেটারের স্পন্সর হয়।
সেই ভিশন বাস্তবায়নে আনুপাতিক হারে আগাতে পারিনি।।২০১৮ এর আগস্টের পরে রকমারির স্পন্সর বন্ধ হয়ে যায়, তার আগে ওই বছরের এপ্রিল থেকে কনসালট্যান্ট হিসেবে রকমারি তথা অন্যরকম গ্রুপ এ আমার সাড়ে ৮ বছরের জার্নি থেমে যায়। পরবর্তীতে কয়েক মাস ব্যক্তিগত খরচে টিম চালিয়েছিলাম। কিন্তু ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট হিসেবে অবসরে যাবার পরে আমার সেই পরিমাণ ফিনান্সিয়াল ব্যাক আপ ছিল না যার ভিত্তিতে এত বড় টিম চালিয়ে নিতে পারি।
এক পর্যায়ে থেমে যেতে হয়।
কিন্তু ক্রিকেট প্যাশনটা ছিল বা আছে। তাই মাঠের ক্রিকেট সংগঠক হয়ে যায় ক্রিকেট পর্যবেক্ষক বা ক্রিকেট চিন্তক। আমার লেখালিখির টপিকের এত অভাব পড়েনি যে ক্রিকেট নিয়ে লিখতে হবে। আমার প্রকাশিত ১১ টা বইয়ের মধ্য ক্রিকেট বিষয়ক মাত্র ১টা।
কিন্তু যেহেতু এমসিসি ধরনের ক্লাব গড়ার স্বপ্ন আমাকে নিস্তার দেয় না, প্রচুর সময় নষ্ট করে হলেও ক্রিকেট নিয়ে লিখতাম।
এবং লেখার পরই ঘটে গেল মিরাকল৷ অনলানে প্রচুর সংখ্যক কোয়ালিটি মানুষ পেলাম যারা ক্রিকেটকে নিছক খেলা হিসেবে দেখে না, সোসিও পলিটিকাল-সোসিও ইকোনমিকাল পয়েন্ট অব ভিউতে বিচার করে, এবং খুব দ্রুতই আমরা ক্রিকেটসূত্রে কানেক্টেড হয়ে গেলাম।
সাড়ে ৪ বছরে আমার সেই ক্রিকেট টিম ১৪০+ ম্যাচ খেলছে, ১৮ জেলা ঘুরেছে, প্রায় ১২০০+ ক্রিকেটার, ১০০+ কোচের সংস্পর্শে এসেছে। এই দীর্ঘ জার্নি কীভাবে ভুলি। সুতরাং সেই ক্লাবকে পুনর্জীবিত করবোই। প্রতি মাসে ৮০-৯০ হাজার টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেলেই চালু হবে টিম। কিন্তু অর্থ উপার্জন এক ধরনের নেশার মতো৷ উপার্জন বাড়তে থাকলে জীবনের অন্যান্য প্রায়োরিটিগুলো মিইয়ে যেতে থাকে৷ আমিও যাতে সেই লুপে না পড়ি, অর্থ বাড়লে ক্রিকেট সংগঠনের প্যাশন না কমে, মূলত নিজেকে সেই ট্র্যাকে রাখতেই ক্রিকেট বিষয়ে লেখালিখি করি। যদি কোনোদিন এমসিসি স্টাইলের কোনো ক্লাব আসলেই গড়ে তুলতে পারি বলা যাবে এজেন্ডা বাস্তবায়িত হয়েছে। ক্রিকেট লেখালিখি আমার আইসিইউ সাপোর্টে থাকা ক্রিকেট সংগঠক সত্তাকে সতেজ রাখতে অক্সিজেনের ভূমিকা পালন করছে। সেলিব্রিটি-টেলিব্রিটি আমারে টানে না। তাই তাদের ফ্যানরা যখন আহত হয়ে হিংস্র আচরণ করে, বিনোদন লাভ করি।
কিন্তু কীভাবে যেন আমার কিছু অনুরাগী জুটে গেল। তাদের সাথে যে চিন্তা বা মতামত খুব মেলে তা বলবো না, আমরা প্রচুর হেলদি আর্গুমেন্ট করি।যেমন ফুয়াদ ভাই সোহানকে খুবই ইউটিলিটি ক্রিকেটার মনে করে সব ফরম্যাটে, আমি করি না। একুশ তাপাদার ভাই নাজমুল হাসান শান্তকে নিয়ে আশাবাদী, আমি না। শেখ নাবিল ভাই লিটন দাসকে ওভাররেটেড বলে, আমি বলি না। আবার আমি তাসকিনকে টি২০ দলের ক্যাপ্টেন দেখতে চাই, একুশ তাপাদার ভাই হেসে উড়িয়ে দেয়। আমি আফিফ-শেখ মাহেদিকে সাদা বলের ক্রিকেটে হাইরেট করি, একুশ ভাই বলে মিডিওকর। এরকম বহু পয়েন্ট অব ডিসএগ্রিমেন্ট থেকে আমরা যে যার মতো সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করি।
যে কারণে রেন্ডম ফেসবুকারদের সাথে আর্গুমেন্টে সময় দিই না, যদি মনে করি তার কমেন্ট ভ্যালু যুক্ত করছে না ক্ষেত্রবিশেষে ব্লক করে দিই। তাতে অবশ্য একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে আমি বিরোধীতা বা সমালোচনা সহ্য করতে পারি না। এতে একদিক থেকে ভালো হয়েছে। ফেসবুকের কমেন্ট যুদ্ধ শুরু হলে হাশরের ময়দান পর্যন্ত চলমান থাকবে এমন একটা ভাব লক্ষ্য করা যায়। এর চেয়ে বডো অংশের মানুষের চোখে এরোগেন্ট, রুচিহীন, বায়াসড, নার্সিসিস্ট, কূপমণ্ডুক প্রভৃতি তকমা পাওয়া সহজ সমাধান।
বাংলাদেশ ৩৩ বারের চেষ্টায় নিউজিল্যান্ডকে তাদের প্রতিকূল কন্ডিশনে হারিয়ে দেয়ায় এতটাই উচ্ছ্বসিত হই যে সিদ্ধান্ত নিই জয়টা সেলিব্রেট করব সুহৃদদের সাথে। সে লক্ষ্যেই কয়েকজনকে ট্যাগ করে স্ট্যাটাস দিই। অবাকবশত লক্ষ্য করি অপরিচিত অনেকেও আগ্রহী সেলিব্রেশনে অংশ নিতে।
ভেন্যু নির্ধারিত হয় ধানমন্ডি স্টার,
সন্ধ্যা ৭ঃ১৭;
কিন্তু সেদিনই মামাতো বোন সুকল্পা আপু স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাকে না দেখে জয় সেলিব্রেট করি কীভাবে; তাই বিলম্ব হয় কিছুটা। একজন নারায়নগঞ্জ থেকে আসেন সেলিব্রেশনে অংশ নিতে।
স্টার রেস্টুরেন্টটা এত জনবহুল, শুধু খাওয়াটাই হলো, আড্ডা-টাড্ডা হারিয়ে গেল ভিড়-ভাট্টায়। তবু এই যে ক্রিকেট একঝাঁক অচেনা মানুষকে একটা কমন প্লাটফরমে কিছু সময়ের জন্য একত্রিত করলো, এটাই স্পোর্টস এর স্পিরিট।
লিটন দাস যদি কোনোদিন টেস্টে মুশফিকের ২১৮ রানের রেকর্ড ভেঙ্গে দেয় এদিন আগত সকলকে নিজ খরচে খাওয়াবো; হয়তবা সেকারণেই সবার সাথে আলাদাভাবে ছবি তুলে রাখা। ছবি শুধু মেমরি ক্রিয়েট নয়, ডকুমেন্টেড এভিডেন্সও কিন্তু!