রেসলিং এন্টারটেইনমেন্ট এর ভোক্তা ছিলাম কিশোর বয়সে। সুনির্দিষ্ট করে বললে ২০০০-২০০২ এই সময়টাতে, তখন বয়স কত আর ছিলো, ১৫-১৬। এই ২০১৬ তে এসেও রেসলিং এর টুকটাক খোঁজখবর রাখা হয়, তবে সেটা এন্টারটেইনমেন্ট মাধ্যম হিসেবে নয়, একটা স্ততন্ত্র ইন্ডাস্ট্রির পর্যবেক্ষক হিসেবে বলা চলে। তারও আগে ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে, যখন দেশের চ্যানেল বলতে ছিলো শুধুমাত্র বিটিভি, বিকাল সাড়ে ৪টার সময় রেসলিং প্রচারিত হতো। ক্লাস থ্রি কি ফোর এ পড়তাম, অত কিছু বুঝতাম না, তবে এভাবে একজন আরেকজনকে চেয়ার দিয়ে পেটাচ্ছে, মাথা ফাটিয়ে ফেলছে এসব দেখে মায়া হতো। মনে পড়ে, মিস্টার ওয়ান্ডারফুল নামে একজন রেসলার ছিলো, সঙ্গে বান্ধবী/স্ত্রী নিয়ে আসতো, তার সাথে ডাক্টার ডেথ নামে এক রেসলারের ভয়ানক ফাইট চলতো। ৯৬ এর ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখাসূত্রে পরবর্তী বছরগুলোতে ক্রিকেটের সুপারগ্লু ফলোয়ার হয়ে যাই, সম্ভবত বিটিভিতেও রেসলিং দেখানো বন্ধ করে দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে ৯৫ পরবর্তী ৫ বছরে রেসলিং পুরোপুরি বিস্মৃত হই। রেসলিং এর সঙ্গে পুনরায় এবং প্রকৃত যোগাযোগ গড়ে উঠে ক্লাশ এইটে পড়াকালীন, ২০০০ সাল তখন। হঠাৎই একদিন এক ক্লাসমেট রেসলিং সম্পর্কে জানায় এবং দ্য রক, স্টিভ অস্টিন, আন্ডারটেকার, ট্রিপল এইচ, বিগ শো, কেইন প্রভৃতি রেসলার এর ছবি এঁকে এঁকে তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে। এদের মধ্যে কেইনকে আলাদাভাবে ভালো লেগে যায়। ভোকাল কর্ড নষ্ট, মাস্ক পড়ে থাকে, লাল পোশাক, চেয়ার দিয়ে বাড়ি দিলেও কিছু হয় না, গলা ধরে আছাড় মারে—প্রভৃতি শুনে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগে। দেশে তখন ইটিভি সবে চালু হয়েছে। সৌভাগ্যবশতই বলবো, সেদিন সন্ধ্যায়ই ইটিভিতে দ্য বিগ ফাইট নামে একটা প্রোগ্রাম দেখায়। তখন থেকেই রেসলিং ভক্ত হয়ে পড়া। সেসময় প্রতি বুধবার পেপারে একজন রেসলারকে নিয়ে ফিচার করতো, প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে সেগুলো পড়তাম, এবং কার সাথে কার শত্রুতা, কে জিতবে এসব নিয়ে ঘোরের মধ্যে থাকতাম, বিশেষত ম্যাচ চলাকালে বাইরে থেকে ভিলেন রেসলার যেন ইন্টারফেয়ার না করে সেজন্য মনে মনে প্রার্থনা করতাম, এবং যদি করেই ফেলতো দর্শকদের ওপর প্রচণ্ড রাগ হতো; তারা কিছু বলে না কেন। কিছুদিন পর পেপারেই ভিন্স ম্যাকমোহনে নিয়ে একটা ফিচার আসে,যার শিরোনাম ছিলো ‘পুতুল নাচের কারিগর?’ এই লেখায় ইঙ্গিত দেয়া ছিলো, রেসলিং এ আমরা যা দেখি তা আসলে সাজানো পুরোটাই। যদিও লেখাটায় দাবি করা হয়নি যে রেসলিং স্ক্রিপ্টেড, স্রেফ বলা হয়েছিল অনেকে বলে থাকেন- এরকম একটা ঢঙে, তবু লেখাটা পড়ার পর ধাক্কা খেয়েছিলাম। ২০০৩ এ ঢাকা চলে আসার পর অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, রেসলিং সত্যিই স্ক্রিপ্টেড। তখন থেকে রেসলিং এর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
তবে কৈশোরের কৌতূহল বলেই কিনা, কেইন এর প্রতি আগ্রহটা অটুট রয়ে যায়। মনে পড়ে, ২০০১ সালে গ্রামে নানীর বাড়িতে এক বাচ্চা ছেলেকে দুষ্টুমি করে চোকস্ল্যাম মারা কেন্দ্র করে বড়সড় একটা ঝগড়াই বেধে গিয়েছিল। ভার্সিটির ছুটিতে বাসায় গেলে টিভির চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে রেসলিং এ এসে পড়লে অপেক্ষা করতাম কেইন এর কোনো ম্যাচ পাওয়া যায় কি না। এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করতাম, ২০০০ এর দিকের ক্যারিশমাটিক ভীতিকর কেইন একদমই সাদামাটা এক রেসলার এ পরিণত হয়েছে, তার চাইতে অনেক পরে এসে জন সিনা হয়ে উঠছে ইন্ডাস্ট্রির সবচাইতে বড় সুপারস্টার।
২০১৩ তে রেসলিং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আমার ৩য় অধ্যায়ের সূচনা হয়। এবার অবশ্য শুধুই পর্যবেক্ষক হিসেবে। আমি তখন স্টোরিলাইন, গিমিক, ফেস, হিল এই শব্দগুলো সম্পর্কে জানি গুগলসূত্রে, রেসলিং ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে ঘাটাঘাটি করি এবং তার আলোকে কেইন কে বুঝার চেষ্টা করি। কেইন সম্ভবত ডব্লিউডব্লিউই এর সবচেয়ে দীর্ঘদিনের এমপ্লোয়ি (২০ বছরের বেশি)। কিন্তু সেই অনুপাতে তার প্রাপ্তি বলতে কিছুই নেই। আনসাঙ হিরো সব ইন্ডাস্ট্রিতেই থাকে, কেইনের বেলাতেও সেই ব্যাপারটিই ঘটেছে। কেইনকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই রেসলিং আরও বিবিধ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। সেইসূত্রে রেসলিংয়ের আড়ালে ড্রাগস, যৌনতা, ইলুমিনাটি কানেকশনের মতো ডার্ক ম্যাটার এর সাথে যেমন জানাশোনা আছে, অনুরূপভাবে স্ট্রাগল, স্টারডম, রিলেশন, পলিটিক্স এর মতো থ্রিলারও জানা গেছে। একটি ইন্ডাস্ট্রি আসলে অসংখ্য মানুষের নিযুত নিঃশ্বাসের ইতিহাস।
কখনো কখনো মনে হয় রেসলিং ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে উপন্যাস লিখি। যেটা ঠিক ইতিহাসের ধারাবাহিক বর্ণনা হবে না, গল্পাশ্রিত ইতিহাস হবে, কেইনকে ইন্টারসেকশন পয়েন্ট ধরে রেসলিং ইন্ডাস্ট্রিটা এক্সপ্লোর করার এক দীর্ঘ জার্নি হবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি জায়গা যেখানে বইয়ের দাম ২০০ টাকা হলেই সেটা দামী বইয়ের তকমা পেয়ে যায়, এবং প্রিজমা, পোকেমন এর মতো নিরন্তর হাইপের রেলগাড়ি চলে, সেই মার্কেটপ্লেস এ বসে এরকম কনটেন্ট এ উপন্যাস লেখা মানে পণ্ডশ্রম। মার্কেট ব্যাপারটা হাইলি ইম্পরটেন্ট, কারণ ইকোনমিক্সকে ইগনোর করে উদ্যোগ নিলে সেটা মোটাদাগে আনপ্রোডাক্টিভ খেতাবই পেয়ে থাকে।
আরও একটা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে লেখার খুব ইচ্ছা। বাংলা ভাষার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। বাংলায় লিখলে বইগুলো উইপোকার খাদ্য হবে, ইংরেজিতে লিখলে তার একটা আর্কাইভ ভ্যালু থাকতে পারে তবু্। দেখা যাক। এরকম কত কিছুই তো ভেবেছি জীবনে, বাস্তবায়ন করেছি তার এক সহস্রাংস মাত্র। ওভারথিংকিং মানুষের এচিভমেন্টের পাল্লা কেবলই হাল্কা করে। এটা একধরনের রোগও বটে। অধিকাংশ ক্রিয়েটিভ মানুষ এই রোগের ধারক ও বাহক আমার ধারণা।