২০ মিনিট ধরেই ক্ষণে ক্ষণে প্রশ্ন জাগছিল– আসবে সে , নাকি বিশ্বাস করতে পারেনি আমায়? নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বাড়তি কিছুক্ষণ অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেক্ষণে বেজে উঠে ফোন- ‘স্যার আমি শাহ আলম, আপনার বাসার গেটের সামনে আছি’।

শাহ আলমের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল মানিকগঞ্জ তৃপ্তি প্লাজার সামনে; নিজের রিকশায় বসে ছিল চুপচাপ। যাত্রীহীন যে কোনো রিকশাচালকের বিশ্রামের ধরনই এমন। তার রিকশায় চেপে ফেরা হয় বাসায়। অন্ধকারের মধ্যে টাকার নোট চিনতে অসুবিধা বোধ করি– ২০ আর ৫০০ টাকাকে লাগে একইরকম। ভাড়া মেটানোকালে নোট হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করি- কত টাকার নোট। সে বলে- ২০ টাকা, অন্ধকারে বুঝাও যায় না।

চেহারার সঙ্গে কণ্ঠটা মেলাতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল অন্য কেউ তার হয়ে ডাবিং করে দিচ্ছে।

মনে হওয়াটা ভালো লাগে হঠাৎ

-‘তোমার মোবাইল আছে? আমার নম্বরটা সেভ করে রাখো। কাল বিকালে তোমার সঙ্গে চটপটি খাবো। কিছু উপার্জনেরও ব্যবস্থা করে দেব’—- আমার কথায় সে অপ্রস্তুত হয় না একচিলতেও, হয়ত প্রিভিলেজড শ্রেণির এরকম শখের শিকার হওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল তার।

সে আমাকে মিসকল দেয়ার চেষ্টা করে, ব্যালেন্স না থাকায় নিজের নম্বরটা মুখে বলে। সোজাসুজি বলি নম্বর লাগবে না, তুমি কাল ৫টায় বাসার গেটে এলেই হবে।

ঢাকায় ইতোপূর্বে ৩ জন রিকশাওয়ালার সঙ্গে অনুরূপ ডিল করেছিলাম, যোগাযোগ করেনি একজনও।

রিকশায় উঠেই শাহ আলমকে বেউথা ব্রিজের গন্তব্য ধরতে বলি। বাসা থেকে ১০-১৫ মিনিটের রিকশাপথ বড়োজোর। চলতিপথে খুলে দিই ভাষার অর্গল।
-‘মানিকগঞ্জে আছো কয় বছর?’

-‘৩-৪ বছর হইবো’।

-‘বাড়ি কই তোমাগো’?

-‘গাইবান্ধা’।

– ‘গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে গেছিলাম ক্রিকেট টিম নিয়া। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় আমার এক বন্ধু চাকরিও করতো’

-‘আমাগো বাড়িও সুন্দরগঞ্জের এক গ্রামে’।

-‘রিকশা চালাইতে এত দূরে আসছো কেন? গাইবান্ধায়ই তো চালাইতে পারতা। নাকি নিজের এলাকায় রিকশা চালাইলে ইজ্জত থাকতো না?’

– ‘ওইখানে টাকা-পয়সা নাই। মানুষজন খুব গরীব৷ রিকশায় উঠে না বেশিরভাগই’

-‘তোমরা কয় ভাই-বোন?’

-‘৪ বোন ২ ভাই। বাবা মারা গেছে। সে কৃষিকাজ করতো। মা বাড়িতেই থাকে। আমরা ভাইয়েরা টাকা পাঠাই, বোনগো বিয়া হইয়া গেছে’।

-‘বোনরা মায়েরে টাকা পাঠায় না?’

-‘তারা পাঠাইবো কেন, বিয়া হইয়া গেছে তো। আমাগো পাঠানোরও ঠিক নাই। যতটুক যা পারি দেই। কোনো মাসে ৫০০, কখনো ১০০০; নিজেরও তো খরচ থাকে। এইখানে শুধু ঘর ভাড়াই দেই ১৫০০ টাকা’

-‘বাচ্চা-কাচ্চা কয়টা’?

-‘এখনো হয় নাই। বিয়া করছি বেশিদিন হয় নাই, অক্টোবরে ১ বছর হইবো। বউয়ের বয়স কম’

-‘কী কও মিয়া, তোমার যা বয়স মাত্র ১ বছর বিয়ে হওয়া তো মিলে না’

-‘বোনে গো বিয়া দিতে টাকা জমাইতে হইছে।’

আমরা পৌঁছে যাই বেউথা ব্রিজে। মানিকগঞ্জবাসীর বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র এই ব্রিজ। ওপারে গড়ে উঠেছে রং-বেরঙের রেস্টুরেন্ট। ব্রিজের ধারেকাছে গেলেই কৌতুক এবং উৎকণ্ঠা বোধ করি। শাহ আলমকে বলি ব্রিজে উঠার দরকার নেই, মডেল স্কুলে চলো।

মডেল স্কুল ১৫ মিনিটের পথ হবে হয়ত। পুনরায় শুরু হয় গল্প

-‘তোমার ইনকাম হয় কেমন’?

-‘করোনার আগে দিনে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত হইতো, এখন ৪০০-৫০০ উঠানোই কষ্ট হইয়া গেছে। মানুষ আগে পায়ে চালানো রিকশায় উঠতো, এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা ছাড়া চড়ে না।’

-‘ব্যাটারিচালিত রিকশায় বেশি উঠতেছে কেন’?

-‘ তাড়াতাড়ি রিকশা থিকা নামতে চায়। বেশিক্ষণ থাকলে যদি ভাইরাসে ধরে।আমি ৫ হাজার টাকা পুঁজি যোগাড় করছি কষ্টে-শিষ্টে, ওই দিয়াই রিকশাডা নিছি। ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনতে ৪০ হাজার টাকা লাগবো; অত পুঁজি পামু কই!’

-‘মানিকগঞ্জে তো রিকশাভাড়া কম; ১৫-২০ টাকার বেশি ভাড়া উঠানোই কঠিন। ৫০ টাকা ভাড়া পাইতে হইলে কয়েক কিলো চালাইতে হইবো। তুমি ঢাকায় চালাও না কেন?’

-‘ ঢাকায় রিকশা চালানোর পরিবেশ আছে? কিছুদূর পরপরই রাস্তা ব্লক। ওই রাস্তায় রিকশা চলবো না, ওইডা বন্ধ। দুনিয়ার সব গাড়ি চলে, খালি রিকশা চলতে গেলে আপত্তি। এর মধ্যে প্রতিদিন গ্যারেজে টাকা দেওন লাগে; নিজের কিছুই থাকে না। আমি ঢাকায় রিকশা চালাইছি ৫ বছর। থাকতাম বাসাবোতে। রিকশা নিয়া সেই মহাখালি, গুলশান পর্যন্ত চইলা গেছি। এখন তো বেইলি রোডেই রিকশা ঢুকতে দেয় না’।

-‘বাসাবো থেকে গুলশানে গেছো? পুলিশ বাধা দেয় নাই?’

-‘আমি ২০০৭-০৮ এর কথা কইতেছি। ওই সময়ে রিকশা চলায় এত কড়াকড়ি আছিল না। ইনকামও ভালো হইতো৷ তখন তো জিনিসপত্রের দামও এত বেশি আছিল না’

-‘পড়াশোনা কতদূর করছো?’

-‘ক্লাস এইটে উঠছিলাম। পড়া ঢুকতো না মাথায়’

রিকশায় বসে আলাপ করাটা জমছিল না, তাকে আউটার স্টেডিয়ামে নিতে বলি রিকশাটা; চটপটি খাব। মাঠে দেলোয়ারের চটপটি বিখ্যাত। কতটা প্রখ্যাত তার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মানিকগঞ্জে ফুডপান্ডায় অর্ডার দিয়েও পাওয়া যায় দেলোয়ারের ভ্রাম্যমাণ দোকানের চটপটি।

রিকশা মাঠের ভেতরে এক কোণে রেখে শাহ আলম চেয়ার টেনে বসে মুখোমুখি।

-‘বিয়ে কি নিজের পছন্দে করছো, নাকি বাড়ি থিকা করাইছে?’

-‘আমিই পছন্দ করছিলাম, পরে দুই পরিবার কথা বইলা ঠিক করছে।’

-‘তুমি না মানিকগঞ্জে থাকো এতদিন ধইরা। গাইবান্ধায় পাত্রী পছন্দ করলা কেমনে?’

-‘ বাড়ি যাই তো। গেলে ১-২ মাস থাইকা আসি। তখনই পছন্দ করছিলাম। বন্ধুরা দেখাইছিল, দেইখা ভাল্লাগছে। তারপর কথা-টথা হইতো গোপনে।’

-‘বিয়েতে যৌতুক নিছিলা?’

-‘শ্বশুরবাড়ি থিকা কী কী জানি দিব কইছিল, দেয় নাই। আমিও আর চাই নাই। পছন্দের বিয়া, নিজেরা আগে প্রস্তাব দিছি— এইজন্যে তারা একটু ভাব নেয়ার সুযোগ পাইছিল। দেখি সামনে কিছু দেয় কিনা।’

-‘তুমি রিকশা কেন চালাও? এলাকায় দোকান-টোকানও তো দিতে পারতা’।

-‘ অত পুঁজি পাইলে তো দিতামই। দোকান নিয়া মাল উঠাইতেই লাগবো ২ লাখ টাকা। মাসে চা-সিগারেট আর সদাই বাকি দেয়া লাগবো ১০-২০ হাজার, সেই টাকা আর উইঠা আসবো না ধইরা নিতে হইবো। চলুম কেমনে?’

-‘প্রতিদিন ৫০০ টাকা ইনকাম হইলে মাসে ১৫ হাজার টাকা, জমাইতে-টমাইতে পারো কিছু’?

-‘ইনকাম দেখলেন ব্যয় দেখবেন না? প্রতিদিন ১০০-১৫০ টাকার বাজার লাগে ২ জন মানুষের। বাড়িভাড়া, টুকিটাকি খরচ, মায়েরে দিয়া থাকে না কিছু। বিয়ার আগে থাকতাম মেসে। ১০০ টাকা দিলে ৩ বেলা খাওন দিত, জেলের কয়েদিগো মতো গাদাগাদি কইরা থাকতাম। তখন জমানো যাইতো কিছু, এখন তো ইনকামও অর্ধেক হইয়া গেছে; দেনা আছে কত জায়গায়।’

-‘করোনার সময় চলছো কেমনে?’

-‘২ মাস গাইবান্ধায় আছিলাম। মরিচ আর লবণ দিয়া ভাত খাইছি খালি। কর্জ করছিলাম একজনের কাছে, পরে ধান বেইচা শোধ দিছি’।

-‘করোনার মধ্যে মানুষ টাকা ধার দিছে?’

-‘দিবো না কেন? ১০০০ টাকায় প্রতিমাসে ২০০ টাকা লাভ দিলে তো বিরাট ব্যবসা। আমাগো গ্রামে করোনার সময় কতজনে সুদের ব্যবসা কইরা আরো ধনী হইলো! আমি ২০০০ টাকা কর্জ নিছিলাম, ২ মাস পরে ২৮০০ ফেরত দিছি।’

– ‘সরকার যে ত্রাণ দিলো পাও নাই?’

-‘যাগো দায়িত্বে দিছে তাগো আত্মীয়-স্বজনই সব নিয়া গেছে। অবস্থা ভালো, তাও নিছে। আমরা পামু কেমনে?’

-‘তোমার যা বয়স তাতে মাত্র এই কয় বছরের রিকশা চালানো দিয়ে কভার হয় না। আর কী কী করছো কও’

-‘আমি ২০০০ সালের দিকে বাড়ি থিকা পলাইয়া ঢাকায় চইলা আসি। বাপে খালি স্কুলে যাইতে কইতো।বাসে কইরা সায়দাবাদে আইসা নামছি। সেইখান থিকা ৬টাকা ভাড়া দিয়া গেছি গাবতলী। তখন তো কোনো কর্ম জানি না। এক টাউটের পাল্লায় পড়লাম। সে আমারে কয়- আমার সাথে কাজ করবা? আমি কইলাম করুম। সে কয় টাকা-পয়সা কিছু আছে সাথে? আমি কইলাম পকেটে ৩০ টাকা আছে। সে আমারে নিয়া যায় মিরপুর মাজারে। নানা কিসিমের মানুষ সেইখানে বইসা রইছে। টাউট আমার কাছ থিকা টাকাডা নিয়া মাজারের গেটের সামনে খাড়াইতে কইয়া সেই যে ভাগে আর খবর নাই। বইসা আছি তো আছিই। এক হোটেল মালিক আমারে দেইখা কইলো আমার দোকানে কাজ করবা? রাজি হইলাম। ৬ মাস তার হোটেলে কাজ করছি। কাস্টমারগো পানি দিতাম, টেবিল মুছতাম, পরে মেসিয়ার হইছিলাম। ৬ মাস পরে কইলাম- ওস্তাদ বাড়ি যামু। তখন সে হিসাব কইরা আমারে ১৮০০ টাকা দিয়া কয়, আবার কখনো ঢাকায় আইলে চাকরি লাগলে দোকানে আইসো।’

-‘এতদিন বাড়ির সাথে যোগাযোগ ছিল না, তারা কী করেছে?’

-‘তখন তো মোবাইল আছিল না দেশে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে খোঁজ কইরা না পাইয়া ভাবছে হারাইয়া গেছি। তারপর ভুইলা গেছে। বাড়ি যাওয়ার পরে বাপে কইলো- তরে আর পড়া নিয়া কিছু কমু না। বাপের সাথে কৃষি কাজে মন লাগাইলাম। কিন্তু তাতে অভাব কমতেছিল না। এলাকার কয়েকজন ঢাকায় রিকশা চালাইতো, তাগো লগে আবার ঢাকায় যাই। কয়েকবছর চালাই। বইনের জামাই জিরাবোতে এক গার্মেন্টদ এ সাবকনট্রাক্টে কাজ করতো, পয়সা করছিল। সে কইলো- রিকশা চালাইয়া কী করবি, গার্মেন্টস এ আয়। ঢুইকা গেলাম। এখন তো ৫৩০০ টাকা দিয়া শুরু হয় শুনছি, তখন আরো কম আছিল বেতন।’

-‘তুমি গার্মেন্টস এও চাকরি করেছো?’

-‘হ, ওয়াশ অপারেটর আছিলাম। আমার আন্ডারে ২০ জন কাজ করতো। কিন্তু আমার ম্যানেজার আমার এসিসটেন্টের সাথে সিস্টেম কইরা বিপদে ফালাইতো খালি। অসম্ভব টার্গেট দিত সব। বেতনও বাড়ায় না। তখন অন্য আরেক গার্মেন্টস এ ঢুকি, জিরাবোতেই। ওয়াশে কাজ কইরা এমব্রোয়ডারি সেকশনে ঢুকছিলাম। ম্যানেজারের সাথে ঝগড়া কইরা চাকরি ছাইড়া দিলাম।’

-‘আর চাকরির চেষ্টা করো নাই?’

-‘নাহ, সিদ্ধান্ত নেই আর কখনো চাকরিই করুম না। রাইগা গেলে অনেক সিদ্ধান্ত নেয় না মানুষ, ওইরকম’।

-‘তাই বইলা গার্মেন্টস ছাইড়া রিকশা চালাবা।’

-‘জেদে মানুষ কত কী করে!’

-‘ হলে সিনেমা দেখ?’

-‘আগে দেখছি অনেক। এখন হলের পরিবেশ ভালো না, সময়ও পাই না। আমার হলে দেখা প্রথম সিনেমা আছিল রানি কেন ডাকাত আর বনের রাজা টারজান’

-‘তুমি কি জসীমের সিনেমা দেখ?’

– ‘সে তো অনেক পুরানা নায়ক। আর বেশি ভোটকা। আমার পছন্দের নায়ক আছিল মান্না। আমি আবার হিটের ছবি না হইলে দেখি না’।

-‘হিটের ছবি মানে কি মারামারির সিনেমা?’

-‘হ। এইজন্যে সাকিব খানরে সহ্য হয় না আমার। সে আছে খালি প্রেম পিরিতি নিয়া।’

-‘নায়িকা কারে ভালো লাগে’।

-‘শাবানা আর পূর্ণিমা। শাবানা বুইড়া হইয়া গেছে, পূর্ণিমার অভিনয়ডা খুব ভাল্লাগে’।

-‘অভিনয় ভালো কিনা বুঝো কেম্নে?’

-‘সিনেমা দেখতে বসলে বুঝা যায়। আমি আপনেরে বুঝাইয়া কইতে পারুম না, কিন্তু একই সময়ে পূর্ণিমা আর শাবনুরের সিনেমা হইতেছে, আপনে টিভি দুইডা পাশাপাশি রাইখা দেখবেন, মনে হইবো পূর্ণিমার সিনেমাই দেখি’।

-‘ডিপজলরে কেমন লাগে?’

-‘আগে ভালো লাগতো না, এখন ভালোই লাগে। তার ছবিতে গল্প থাকে। কয়েকদিন আগে টিভিতে একটা সিনেমা দেখলাম, ডিপজলের নাম থাকে লাখপতি। খুব ভাল্লাগছে’।

-‘হিন্দি সিনেমা দেখ’?

-‘সালমান খান আর শাহরুখ খানের সিনেমা দেখি সময় পাইলে।’

-‘শাহরুখ তো হিটের সিনেমা কম করে’

-‘করুক। যেসব সিনেমায় গল্প থাকে ওইগুলা দেখতে ভাল্লাগে। হিন্দি বুঝি না, কিন্তু দৃশ্য দেইখা বুঝা যায়’।

-‘খেলা দেখ?’

-‘ফুটবল ভালো লাগে। সময় পাইলে দেখি। দেশি-বিদেশি সব ফুটবলই দেখি’।

-‘ক্রিকেট দেখো না?’

-‘বাংলাদেশের খেলা হইলে টুকটাক খোঁজ রাখি।’

-‘কার খেলা ভালো লাগে?’

-‘এমপি হইলো অর নাম জানি কী?’

-মাশরাফি

-‘হ, অরে দেখতে ভালো লাগে। আরেকজন আছে না বাউয়া বল করে। সাকিব। এরে সহ্য হয় না, গদ্দার মনে হয়।’

-গদ্দার কেন?

-‘এমন একটা ভাব নিয়া থাকে, জানি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। এত ভাব হইলে তর খেলার দরকার কী। এইটা গদ্দারি না?’

-‘বিড়ি-সিগারেট খাও নাকি? এতেও তো খরচ হওয়ার কথা।’

-‘অইসব নেশা নাই। মাঝেমধ্যে পান-টান খাই।খরচে পোষাইতে হইবো তো। ৩-৪ রকম তরকারি খাইতে হইবো তা তো না, এক তরকারি দিয়াই খাই। সকালে ডিম করলো সাথে ভর্তা, দুপুরে ডাল, কখনো মাছের দাম কমলে গুড়া মাছ। বড়ো মাছ তো কিনতে পারি না। প্রত্যেকটা পয়সাই হিসাব করা।’

-‘মুরগি খাও না?’

-‘অনেক দাম তো। বাড়িতে মেহমান আইলে পোলাও-মুরগি করা হয়, তাও সব মেহমানের জন্যে না। আর নাইলে ৪-৫ মাসে একবার মনে হইলো মুরগি খাওয়া দরকার। বাড়িতে তো ফ্রিজ নাই। একটা মুরগি একদিনই খাইতে হইবো।’

-‘তোমার বাড়িতে টিভি আছে? নাটক-টাটক দেখ?’

-‘গ্রামের বাড়িতে টিভি আছে, এইখানে নাই। নাটক দেখি না, ভালো লাগে না। আমার ওয়াইফ পাশের বাড়িতে গিয়া চারু দেখে স্টার জলসায়’।

-‘করোনার সময় যে বাড়ি চইলা গেলা এইখানকার বাসার ভাড়া দিতে হয় নাই?’

-আরো কয়েকজন রিকশাওয়ালারে সাথে নিয়া মালিকের সাথে বইছিলাম। সে ১ মাসের ভাড়া মওকুফ কইরা দিছে। ৩ মাসের বাকি পড়ছে। সে কইছে প্রতি মাসে বাড়তি ৫০০ কইরা দিয়া শোধ কইরা দিতে। সে মানুষ ভালা। পেশায় উকিল, ঢাকায় থাকে।’

-‘তুমি কি হুমায়ূন আহমেদের নাম জানো?’

-‘ছোটকালে ঠাকুরের কয়েকটা লেখা পড়ছিলাম, কী পড়ি মনে থাকে না।’

-তুমি কি গান শোনো?

– ‘ সব ধরনের গানই শোনা হয়। শরিফের গান বেশি শুনি, ভান্ডারির গানও ভাল্লাগে। মারফতি গান শুনি।’

-‘আসিফ, মনির খান, মমতাজের গান শোনো না?’

-‘মমতাজের গান শুনি টুকটাক। অন্য দুইজনের গানে ভাব আসে না’।

-‘ব্যান্ডের গান শোনো?’

-‘মইরা গেলো ওই ব্যাটার নাম কী জানি!’

-‘আইয়ুব বাচ্চু’

-‘উনার এক আকাশের তারা তুই একা গুনিসনে গানটা ভাল্লাগে’।

-‘জেমস, আজম খান এর গান শোনো না?’

-‘দোকানে গেলে দোকানদার মোবাইলে যেসব গান ভইরা দেয় ওইগুলাই বেশি শোনা হয়। সে কার গান ভইরা দিবে তা তো কইতে পারি না’।

-‘তুমি কি সোলায়মান সুখন, আরিফ আর হোসেন, ডাক্তার আইজুদ্দিন, আরিফ জেবতিক– এদের নাম শুনেছো কখনো?’

-‘ নাহ। কী করছে তারা; সিনেমার নায়ক, নাকি গান গায়?’

-‘তোমার ফেসবুক একাউন্ট আছে?’

-‘আগে আছিল। যে মেশিন দিয়া খুলছিলাম ওইডা হারাইয়া গেছে, তাই ঢুকা হয় না অনেকদিন।’

-‘স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় তোমার তো ইনকাম কইমা যাইতেছে। আবার যদি লকডাউন দেয় কী করবা?’

– ‘সরকারের ইচ্ছা হইছে তাই লকডাউন দিছে। আমাগো কথা চিন্তা কইরা কি লকডাউন দিছে? তার রাস্তা, সে যদি রিকশা চালাইতে না দেয় আমি কী করতে পারুম৷ আবার সুদে টাকা নিয়া লবণ-মরিচ দিয়া খাইতে হইবো।’

-‘ধনী লোকেরা তো লকডাউন দিতে কয়।’

-‘কইবোই তো। সব বন্ধ থাকলে তারা সুদের ব্যবসা করবো, মাস্ক বেচবো– তাগো জন্যে তো আরো সুবিধা। আমার টাকা থাকলে আমিও মাস্ক বেইচা ধনী হইয়া যাইতাম। আমার মতো রিকশাওয়ালা যদি শেষ হইয়া যায় তাতে ধনী, সরকার কারোরই কিছু যায়-আসে না।’

-‘তার মানে তুমি বলতে চাইতেছো লকডাউনটা ইচ্ছা কইরা দেয়া হইছে’

-‘তাই তো মনে হয়। ভাইরাস জিনিসটা কী আমারে বুঝান। যে রোগের কথা কইতেছে এইটা আগেও আছিল, ভবিষ্যতেও থাকপো; এইডা কি যাইবো কোনোদিন? আমার কাছ থিকা আপনার রোগ হইলেই মইরা যাইবেন? তাইলে আর আল্লাহয় বিশ্বাস কইরা লাভ কী হইলো! গরম থিকা যখন ঠাণ্ডা পড়বো মানুষের শরীরে ঘাম বসবো, সেই থিকা জ্বর-সর্দি-কাশি হইতেই পারে। আবার শীত শেষে গরম আইলে তখন কি মানুষের জ্বর আসে নাই? এই যে ভাইরাসের কথা কইতেছে, এইটা আসার পরে ডাক্তারের কাছেও যাওয়া যায় না। ডাক্তার জিগায়- জ্বর-সর্দি আছে? যদি কই হ্যাঁ, কয় তোমার চিকিৎসা দেয়া যাইবো না৷ আপনে ফার্মেসিতে গিয়া এইচ প্লাস, আর কোট্রিম ডিএস কিইন্যা নিয়া খান ১ সপ্তাহ, এমনিই সাইরা যাইবো।

-‘কোট্রিম ডিএস এর নাম তুমি জানলা কীভাবে’?

-‘অনেক কিছুই জানা লাগে স্যার। এই যে স্কুল বন্ধ রাখছে তাতে লাভটা কী হইছে? ঢাকার পোলাপান তো ফার্মের মুরগি, ঢাকার বাইরের পোলাপান সবই করতেছে। এই যে মাঠে দেখেন কত পোলাপান; এখন করোনা নাই। সবকিছু চলতেছে, ক্লাসে যাওয়ার সময় করোনার কথা মনে পড়ে। ঢাকা আর বিদেশে থাকা কিছু ফাতরা মানুষের জন্যই দেশটা শেষ হইয়া গেল গা স্যার।

-‘তুমি ঈদে বউরে জিনিসপাতি কিইন্যা দাও না?’

-‘ বিয়ার সময় যা যা দিছি ওইগুলা দিয়াই চলতেছে। বেশিদিন তো হয় নাই। মার্কেটে যে ভিড় আর জিনিসের যা দাম, ওইগুলা কেনার সাধ্য নাই। তাও মহিলা মানুষ, হাল্কা-পাতলা কিছু তো কিনতেই হয়। আমি নিজে কিনি না। ধরেন লুঙ্গি ছিড়া গেল, গেঞ্জি ডিসকালার হইয়া গেল, স্যান্ডেলে আর জোড়াতালি দেয়া যাইতেছে না— তখন কিনি আরকি’।

-‘আর কতদিন রিকশা চালাইবা’?

-‘১-২ বছর চালাইতে পারি। তারপর গ্রামে ফিরা যামু। অচেনা জায়গায় কতদিন থাকতে ভালো লাগে!’

-‘মানিকগঞ্জে ভালো রেস্টুরেন্ট কী কী আছে?’

-‘ব্রিজের ওইপারে অনেকগুলাই আছে। গাঙ খুব ভালো। ক্যাসল নামে হইছে নতুন একটা। মানুষ ধুমাইয়া খায়।’

-‘তুমি খাইছো কখনো?’

-‘প্যাসেঞ্জার নিয়া তো ম্যালাবারই গেছি। ওইখানে খাওয়া কি আমার পোষাইবো?’

-‘তোমার নম্বরটা রাখলাম। এরপরে যখন মানিকগঞ্জে আসি তোমারে বউসহ খাওয়ামু। গাঙ নাকি ক্যাসলে খাইবা ঠিক কইরা রাইখো।’

গল্পে গল্পে বুড়িয়ে যায় সময়। সন্ধ্যার যৌবন ফুড়ে জন্ম নেয় রাত্রি, বাড়তে থাকে শহরের নির্জনতা।শাহ আলম তার জীবিকাতন্তুতে চাপিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয় আমায়।

নেমে তার হাতে ৪টা ১০০ টাকা, ২টা ২০টাকা আর ১টা ১০টাকার নোট তুলে দিয়ে বলি- ‘যদিও আমার সঙ্গে ৩ ঘন্টা সময় কাটানোর জন্য ৩ হাজার টাকা দেয়া উচিত, কিন্তু আমার নিজের অবস্থাও তোমার চাইতে আহামরি উন্নত কিছু না। তোমার পুরো ১ দিনের উপার্জন আছে এখানে। ৫০০ টাকা দেয়ার নিয়ত ছিল, চটপটির বিল দিতে গিয়ে ৬০ টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমার মানিব্যাগে আপাতত আর টাকাও নাই। মানিকগঞ্জ এমন এক আজগুবি শহর এটিএম বুথগুলোও কাজ করে না। আজ তোমার পয়সায় চটপটি খেলাম, পরেরবারের দাওয়াত তো দিয়েই রেখেছি’।

শাহ আলমের চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতা দেখলাম না কোনো। হুমায়ূন আহমেদের নাটক-সিনেমায় এধরনের পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্তরা যেরকম ভক্ত বা বিগলিত হয়ে পড়ে, তেমন কিছুও ঘটেনি। সে টাকাগুলো পকেটে পুরে রিকশার প্যাডল চাপতে চাপতে বলেছিল-
‘ঠিক আছে স্যার, পরেরবার আইলে ফোন দিয়েন’!