প্রত্যেক মানুষ জীবনে কোনো না কোনো মোহ দ্বারা চালিত হয়, এটা বহুচর্চিত কথা। এইসব মোহকে সুনির্দিষ্ট এবং ন্যারো ডাউন করলে তিনটি প্রধান পয়েন্টে এসে ঠেকে- অর্থ, খ্যাতি এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মোহ। তৃতীয় মোহটিকে অন্য কোনো সময় ব্যাখ্যা করার মনোভাব পোষণ করে, প্রথমোক্ত মোহ দুটিতে দৃষ্টিপাত করতে চাই।
খ্যাতির মোহকে আরেকটু এলাবরেট করলে এচিভমেন্ট (অর্জন) এবং রিকগনিশন (স্বীকৃতি) এই দুটো কম্পোনেন্ট পাওয়া যায়। তবে অর্থ আর খ্যাতি, যেটাই বলি, দুটোই সমণ্বিত হয়ে একটি অভিন্ন এনটিটিকে ধারণ করে, সেটা হলো ‘ক্ষমতা’। একজন মানুষের যত অর্থ আছে ,সে আরো অর্থ চায়, কিংবা খ্যাতিমান আরও খ্যাত হতে চায়; এর প্রধান নেপথ্য কারণ তো সেই ক্ষমতা-ই। আমার ১০ কোটি টাকা আছে, এর চাইতে ১০ জন মানুষ আমার কথায় উঠে-বসে, এটা সম্ভবত বেশিরভাগ মানুষকে মানসিক তৃপ্তি দেয়।
গতকাল সেলস এ কাজ করে এমন ৭ জন মানুষের সাথে ৪ ঘণ্টা সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। তাদের একটা প্রশ্ন করেছিলাম: ধরা যাক, আপনি সারা মাসে যা কাজ করেছেন তার প্রেক্ষিতে স্যালারির বাইরেও আপনাকে ৩০০০ টাকা দেয়া হলো, কিন্তু সঙ্গে ২টি সমালোচনা থাকবে। অন্যদিকে, আপনাকে মাস শেষে আপনার অফিস থেকে ২০-২৫ জন মানুষ সুন্দর এসএমএস লিখে পাঠাবে, কেউ ১ জন আপনাকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট লিখলো, এবং আপনাদের মধ্য থেকে ২-১ জনকে কোম্পানীর টপ ম্যানেজমেন্ট ফোন করা হবে। আপনি কোন্ অফারটি নেবেন? ৭ জনের প্রত্যেকেই বলেছে, ৩ হাজার টাকা কোনো না কোনোভাবে খরচ হয়ে যাবে, কিন্তু মানুষের এসএমএস, প্রশংসা বা টপ ম্যানেজমেন্টের ফোন অনেক বড় প্রাপ্তি। আমার ধারণা, ৭০০ জন মানুষকে প্রশ্ন করলেও রেজাল্ট চেঞ্জ হবে না, হয়তোবা ১০০% এর জায়গায় ৮০% হবে।
স্বীকৃতি, প্রশংসা, প্রায়োরিটি এসব জীবনে কেন যেন আনন্দ এনে দেয়। একজন মানুষকে প্রায়োরিটি দেয়া হচ্ছে এটা যদি তাকে কোনোভাবে বোঝানো যায়, সে বোধহয় হৃৎপিণ্ড চিরে দেবে দরকার পড়লে।
স্বীকৃতি এবং প্রশংসার ব্যাপারটা বুঝি। কেউ একজন দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছে, অথচ স্বীকৃতি নেই, একসময় নিজেরই মনে হবে, কেন করছি, কার জন্য করছি। কিংবা, ভুল পথে সময় নষ্ট করছি না তো। অজস্র ঋণাত্মক ধারণা জেঁকে বসে, যতটুকু ফলাফল আসার কথা ছিলো, অর্জন তার চাইতেও কম হয়, এবং ক্রমশ স্পৃহা হ্রাস পেতে থাকে।
বিপরীতক্রমে, আধাখেঁচড়া কাজেও স্বীকৃতি এলে গতি বেড়ে যায়, একধরনের দায়িত্ববোধ জাগে। এবং সামর্থ্য ১১ হলে, এরপরে তা ২৩ হয়ে যায়। নিজেকে উদ্দীপ্ত রাখার প্রয়োজনে হলেও স্বীকৃতির পরশ লাগে। মানুষও তো একরকম যন্ত্রই; গাড়ির ফুয়েল লাগে, মানুষের লাগবে না?
প্রশংসার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। সৎ প্রশংসা যেমন মানুষকে বিকশিত হতে সহায়তা করে, ভুল প্রশংসা তেমনি সীমাবদ্ধ হতেও ভূমিকা রাখে। তবু সৎ-ভুল যেমনটাই হোক, নির্বিচারে মানুষ প্রশংসা শুনতেই ভালোবাসে, যদিও একই মানুষটিই অন্যের প্রশংসার ব্যাপারে পিঁপড়ার হৃদয় ধারণ করে সাধারণত। এতো প্রশংসা দিয়ে কী করে মানুষ? এটাও কি একপ্রকারের স্বীকৃতি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রশংসার চাইতে স্বীকৃতির স্তর অনেক উপরে এবং বেশকিছু ফিল্টারিং প্রসেস পার করে তবেই সেটা পাওয়া উচিত। ধরা যাক, কেউ একজন ভালোমানের প্রোগ্রামার, এজন্য তাকে মেধাবী বলে প্রশংসা করতে পারি, কিন্তু প্রোগ্রামিংয়ের বড় কোনো কনটেস্টে সে যদি পুরস্কার পায় সেটা তার মেধার স্বীকৃতি। এজন্য স্বীকৃতি ব্যাপারটা মোটেও তরল নয়। প্রশংসা অনেকটাই ঢালাও ব্যাপার।
২০০৮ সালের পুরোটাই নেশাসক্তের মতো ব্লগিং করেছি। সেইসময়কার ব্লগীয় অভিজ্ঞতায় খুবই ইন্টারেস্টিং একটা পর্যবেক্ষণ ছিলো। তখন লেখা ভালো লাগলে প্লাস, মন্দ লাগলে মাইনাস রেটিংয়ের ব্যবস্থা ছিলো। কত শত ব্লগার যে নিজেদের মধ্যে ভারচুয়াল যুদ্ধ বাঁধিয়েছে মাইনাস নিয়ে, সে এক মজার অভিজ্ঞতা। এখনো ইউটিউবে কোনো ভিডিও আপলোড দিলে যদি ডিসলাইক পাওয়া যায়, সে নিয়ে কমেন্ট সেকশনে সে কি এগ্রেসিভ প্রতিক্রিয়া। মাঝেমাঝে ভাবি, ফেসবুকে যদি কখনো ডিসলাইক অপশনটা চালু করে, আমরা যারা পোস্ট লিখি, কিংবা সেলফি তুলে আপলোড করি, তাদের মনোজগতে কেমন আলোড়ন সৃষ্টি হবে! তখন নিশ্চিত খবর প্রকাশিত হবে ‘ফেসবুকের ছবিতে ২০০ টি ডিসলাইক পেয়ে তরুণ/তরুণীর আত্মহত্যা’! আমরা এতোটাই প্রশংসার কাঙাল! একটা উদাহরণ প্রায়ই দিই; ধরা যাক, আপনি একজন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন, আপনাকে প্রচুর সুস্বাদু খাবার খাওয়ালো, কিন্তু আন্তরিকতার ঘাটতি ছিলো; অন্যদিকে, আরেকজন খুব খাতির করলো, কিন্তু খাওয়া-দাওয়া সেভাবে হলো না; আপনি পরের বার কার বাড়িতে যেতে চাইবেন’?
আমরা মুখে বলি, তেল দেয়া পছন্দ করি না, স্ট্রেইট-ফরোয়ার্ড বলতে ও শুনতে পছন্দ করি; এটা আসলে মুখেরই কথা, অন্তর বলে অন্যকিছু। তেল দিচ্ছে বুঝতে পারলেও নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগে; মানবিক প্রবৃত্তি, একে অস্বীকার করি কীভাবে! স্পষ্টভাষীতাকে আমরা উপরে উপরে সমর্থন করি, কিন্তু মনে ঠিকই ভয় কাজ করে, কোন্ কথা নিজের বিপক্ষে বলে ফেলে!
২০১৪ সালের দিকে আমি একটি ‘কর্কশ সমালোচনা ’ প্রজেক্টের আয়োজন করেছিলাম, যেখানে আমার সাথে ব্যক্তিগত জীবনে ১১ দিনের বেশি কথা হয়েছে এমন মানুষদের আমাকে নিয়ে কড়া সমালোচনা করতে হবে, যার সমালোচনা সবচাইতে নির্দয় তাকে গ্রিল আর নান রুটি খাওয়ানো হবে। অনেকেই সমালোচনা করেছিলো, যাকে গ্রিল খাইয়েছিলাম তার ১১টা সমালোচনার একটা ছিলো আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ক্রিকেট খেলতে পারো কিনা। সে এতে খুবই অফেন্ডেড ফিল করেছিলো। তার কর্কশ সমালোচনার মূল পয়েন্ট ছিলো, আমি নিজেকে একটি সুপেরিয়র পজিশনে বসিয়ে অন্যদের অফেন্ড করতে পছন্দ করি। ওই ‘কর্কশ সমালোচনা’ প্রজেক্ট না করলে কখনো জানতেই পারতাম না ‘তুমিও ক্রিকেট খেলতে পারো?’ এই কথা শুনে কেউ এতোটা আহত হতে পারে। জীবনে তাহলে কত মানুষকে আহত করেছি, ভাবলেই অবাক লাগে! তবু দিনশেষে, নিজের প্রশংসা শুনলে ভালোই লাগে, কারণ আমার এক বন্ধু বলেছিলো ‘কর্কশ সমালোচনা’ শুনতে চাওয়া আদতে প্রশংসাকেই একটু ঘুরিয়ে শোনার বাহানামাত্র। যেমন, আমি এজীবনে যত মানুষকে বলতে শুনেছি তার ৩টি নেগেটিভ দিক সম্পর্কে বলতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পয়েন্টগুলো আসে এরকম- ‘আপনি ভেতর আর বাহিরে পুরো দুইরকম, এই চাপা স্বভাবের কারণে মানুষ আপনার সম্পর্কে ভুল ধারণা করে; আপনি মানুষকে বোঝার চেষ্টা করেন, কিন্তু নিজেকে বুঝতে দেন না; আপনি খুব এলোমেলো’। …. খেয়াল করে দেখুন, এগুলো কিন্তু সমালোচনার আড়ালে স্তুতিবাক্যই, যা শুনলে মানুষটি পক্ষান্তরে খুশিই হয়।
সমালোচনা মানে নিন্দা নয়। সম+আলোচনা, এর সমণ্বয়েই সমালোচনা গঠিত হয়। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, সমালোচনার অর্থ দাঁড়িয়েছে অভিযোগ অথবা দোষ আবিষ্কার। ফলে, সমালোচনা শুনতে আমি, আপনি, আমরা ভয় পাই।
কেন এই ভয়?
আমরা সর্বক্ষেত্রে আড়াল পছন্দ করি, নিজেদের সাথেও আড়াল বজায় রাখি। ফলে, আমাদের জীবনে গোপনীয়তা এতো বেশি, মনে হয় এগুলো লুকিয়ে রাখি। আমাদের ধারণা, আমাদের দুর্বলতাগুলো অন্য মানুষ ধরতে পারবে না, যে কারণে সত্য শুনে তা হজম করার মতো মানসিক শক্তি বেশিরভাগেরই থাকে না।
প্রশংসার বেলুনে ক্রমাগত গ্যাস ভরতি হতে দেখলে, আমাদের মন উৎফুল্ল হয়ে উঠে।
সর্বশেষ ৮-৯ বছরে যে শব্দগুলি বহুবার শুনেছি তার মধ্যে ‘পারসোনাল ম্যাটার, প্রাইভেসি’ এগুলো শীর্ষ। ইনডিভিজুয়ালিজম (ব্যক্তিস্বাতন্ত্র) এর ভূত আমাদের মধ্যে এতো প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছে যে, বুঝে না বুঝে আমরা এর প্রোমোশনে ব্যস্ত। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’- এই কথা যখন প্রবাদের মতো ছড়িয়ে পড়ে, তখন বুঝতে হবে কোথাও একটা সমস্যা আছে। আমাদের ডান হাতের সংবাদ বাম হাত জানে না, ডান চোখ যা দেখে বাম চোখে তা জানে না; এমনই জম্পেশ পারসোনাল ম্যাটার আমাদের বন্দী করে ফেলেছে। হিসেব করে দেখুন, আপনি কি এতে ভালো আছেন? যদি জিজ্ঞেস করি, বিগত ৩ মাসে প্রচণ্ড খুশি হয়েছেন এমন ৩টি ঘটনা বলুন, গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, খুঁজে পেতে হিমশিম খাবেন, আর যদিওবা পান, দেখবেন, সেগুলো একক নয়, অন্য মানুষের ইনভলভমেন্ট ছিলো। ‘পারসোনাল ম্যাটার’ আপনাকে একজন হতাশ এবং বিষাদগ্রস্ত মানুষে রূপান্তরিত করে ফেলেছে বুঝতেই পারেননি। অবশ্য তাতেও বিচলিত হবেন না আপনি, আপনি তো কবেই বলে দিয়েছেন, ‘ who the hell are you? Don’t interfere, I know better than you.দূরে গিয়ে মরো’!
প্রশংসা প্রসঙ্গে এতো দীর্ঘ আলাপের কারণ, প্রায়োরিটি ফ্যাক্টরকে আরেকটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করা। আমরা আসলে প্রায়োরিটি কেন চাই? একটা উদাহরণ দিই। কেউ একজন এসে বললো, ভাই/আপু, আপনাকে দেখে আমি অনেক ইনস্পায়ারড, আপনি আমার আইডল। নিশ্চিত করে বলতে পারি, আপনার যুক্তিবোধ তখন কাজ করবে না, আপনি কেবল আইডল হবার ইন্দ্রিয়তাড়নাকে স্যাটিসফাই করতে ব্যস্ত থাকবেন। কিংবা, আপনার সাথে একজন মানুষের দেখা করার কথা, একই সময়ে তার আরও ১টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো। সে তবু আপনার সাথেই দেখা করতে এলো এবং জানালো আপনার জন্য সেই কাজটি সে করেনি, আপনার সাথে দেখা করাটাই বেশি জরুরী মনে হয়েছে। ব্যস, সে আপনার গুডবুকে ঢুকে পড়লো। আরও সংক্ষিপ্ত করে বলি, আপনার ছবিতে বা লেখায় দীর্ঘ মন্তব্য করলো, আপনার মনে হবে, সে আমাকে এতো প্রায়োরিটি দিচ্ছে!
প্রায়োরিটির সঙ্গে প্রশংসা, এবং ইনডিভিজুয়ালিটি সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। আমরা প্রত্যেকেই নিজের জন্য বাঁচি, কিন্তু বাহানা দিই অন্য অনেক কিছুর। ফলে, আমাদের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু আমরা নিজেরা। একজন বিজ্ঞানী যখন কিছু আবিষ্কার করেন, সেখানে কমিউনিটির ভাবনা যতখানি থাকে, তার চাইতে বেশি থাকে নিজের ভালো লাগা। একজন লেখক জীবনভর যত গল্প, কবিতা লিখেন প্রত্যেক লাইনে নিজেকে উপস্থানের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করে, একজন চিত্রকর প্রতিটি চিত্রে আসলে নিজেকেই ধারণ করেন। মানুষের মতো আত্মকেন্দ্রিক প্রাণী দ্বিতীয়টি নেই। কিছুদিন ব্যাঙ নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম; স্বভাবের দিক থেকে মানুষের সাথে সবচাইতে বেশি মেলে ব্যাঙের।
যেহেতু মানুষমাত্রই কম-বেশি নার্সিস্ট, এবং আত্মচৈতন্যবিলাসী, সে তো নিজের প্রায়োরিটি খুঁজবেই। কিছুদিন আগে এক জুনিয়রকে বলেছিলাম, তোমাকে টানা ৭ দিন বকাঝকা করি, দেখবে বিগত ৩ বছরের ভালো আচরণ, সুসম্পর্ক সবকিছু মিথ্যে হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত, প্রায়োরিটিই ম্যাটারস।
আমরা হয়তো ভাবি, টাকা হলেই জীবন সুন্দর হয়ে যাবে, তাই যে কোনোভাবে টাকা উপার্জন করাটাকেই ব্রত ধরে নিই। কিন্তু আমরা নিজেরাও জানি না, টাকার চাইতে প্রশংসা এবং প্রসিদ্ধি কত বেশি প্রলুব্ধ করে আমাদের। পোস্টারে বা পেপারে নিজের ছবি ছাপা হয়েছে, এটা যতখানি আনন্দ দেয়, মাসে দেড় কোটি টাকা উপার্জনের আনন্দ সে তুলনায় কিছুই নয়। তাই যদি হতো, তাহলে মাছের আড়তদার, বালু ব্যবসায়ী এই মানুষগুলোর রোজগার বিপুল পরিমাণে হওয়া সত্ত্বেও মানুষ এসব পেশায় না এসে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটার, নায়ক, লেখক, সাংবাদিক হতে চায়।
একবার ভাবুন, এই মুহূর্তে মাশরাফি মর্তুজা, সাকিব আল হাসান কিংবা শাকিব খান কত বড় তারকা। ১০ বছর পরে এরা যখন অবসর নেবে বা শাকিব খান নায়ক ইমেজ ছেড়ে বাবা-চাচার চরিত্রে অভিনয় করবে, কে তাদের খোঁজ রাখবে! আমার পরিচিত একজন মন্তব্য করেছিল- ‘একসময় রাজ্জাককে দেখার জন্য পুলিশের বাড়ি খেয়েছে মানুষ; এখন রাজ্জাক সারাদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়ালেও কেউ মনে হয় পাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেসও করবে না, ভাই কেমন আছেন’? খ্যাতি বরাবরই সাময়িক। বুদ্ধিবৃত্তিক খ্যাতিগুলো অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরও বাড়ে। যেমন, জাফর ইকবাল ১০ বছর আগে যত মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন, ১০ বছর পরে সংখ্যা বাড়বে। তবু সামগ্রীকভাবে, খ্যাতির স্থায়ীত্ব এবং ইমপ্যাক্ট কোনোটাই বৃহত্তর কিছু নয়।
জীবন বিষয়টাই একটা মোহ। অসংখ্য জিজ্ঞাসা, শূন্যস্থান আর অজানা রহস্যের ভারে চিন্তা যাতে জেরবার না হয়, সে লক্ষ্যে আমরা মানুষেরা কোনো না মোহের পেছনে পড়ে যাই, যাতে রহস্যগুলো মাথাকে জ্যাম না করে দেয়। ‘আমি কে’- এই ছোট্ট প্রশ্নটাই যদি কখনো জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে, জীবন সেখানেই খতম। এই প্রচণ্ড চাপ থেকে বাঁচতেই আমরা মোহমুগ্ধতার রাজ্যে প্রবেশ করি; যত তার গভীরে প্রবেশ করি, তত যেন রাজ্যের সীমানা বাড়ে। আলবেয়ার কাম্যুর ‘মিথ অব সিসিফাস’ যারা পড়েছেন তারা জানেন এবসার্ডিটির কোনো আদিঅন্ত হয় না। সিসিফাস দিনভর পাথর ঠেলে উঠায়, পাথর আবারো নেমে যায়; ফলে উঠা-নামার অন্তহীন চলাচল কেবল সময়ক্ষেপণই করবে, ফলাফল দিবে না কিছু। সুতরাং এবসার্ডিটিকে উপেক্ষা করার ম্যাজিক হিসেবে কিছু পরিমাণ মোহ যদি আমাদের শিউলির সুবাস দেয়, মোহেরই বিজয় হোক নাহয়।
মোহের মোহে বিমোহিত হওয়ার চরম মুহূর্তেও বলতে চাই, ‘মোহ-মায়ার ক্ষয়িষ্ণু জীবনে ৭টি ইচ্ছাপূরণ করাই যথেষ্ট’!