সঙ্গীতা আপুর সাথে আমার সংযোগটা নিছক ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র-জুনিয়র হলে ক্যাম্পাস ছাড়ার ১১ বছর পরেও তাকে প্রায়োরিটি তালিকায় উপরের দিকে রাখার কোনো কারণ থাকতো না। বিশেষত যে ইঞ্জিনিয়ারিং আমার জীবনে কোনোরকম জায়গাই বরাদ্দ পায়নি সেখানকার অন্য অনেক সিনিয়রের ভিড়ে একজন রেন্ডম সিনিয়র কতটুকুই বা প্রাসঙ্গিকতা বহন করে। আমি নিজেই কি ইঞ্জিনিয়ারিং বা বুয়েটের এমএমই ডিপার্টমেন্টকে ওউন করি?
কখনোই না।
তবু প্রায় ১৪-১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সঙ্গীতা আপু আমার দার্শনিকতা আর হিউমার অনুশীলনে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
ইতোপূর্বে তাকে নিয়ে স্বতন্ত্র এক আর্টিকেল লিখেছি। তাই সেসব আলাপে গেলাম না। কারো বাড়তি আগ্রহ থাকলে আমার ব্যক্তিগত ব্লগ himalaypiডটcom এ ‘ইমাজিনারি সঙ্গীতা আপু’ পড়ে নিতে পারেন।
তবে পরিতাপের বিষয় হলো সঙ্গীতা আপু কোনোভাবেই বিশ্বাস করে না আমি যেসব মানুষের প্রতি বায়াসড এবং কিউরিয়াস, যাদের সাথে সংলাপে কমফোর্টেবল ফিল করি সেই সংক্ষিপ্ত তালিকায় সেও আছে প্রখর আর প্রবল বিক্রমে। তার কথা আগে আমাকে বুঝা কেন আমি তালিকায় স্থান পেলাম। ওদিকে আমি লেখার ক্ষেত্রে যত স্বতঃস্ফূর্ত, মুখে বলার বেলায় ততটা বা তার চেয়েও বেশি আড়ষ্ট। যখনই বলি কারণ ব্যাখ্যা করতে ১৯ হাজার শব্দের আর্টিকেল লিখতে হবে সে সপাটে জানিয়ে দেয় পড়ার সময়-ধৈর্য নাই।
এর চাইতে অনেক অনায়াসে আমার কথাকে বানোয়াট বা ফান হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়। সে সেপথেই হাঁটতে চায়, আবার মায়াবশত থেমে যায়।সেও পড়েছে মহাফাঁপড়ে!
সম্ভবত তার এমনও মনে হয়, যেহেতু সে নামী কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, এসব মনভুলানো গল্প শুনিয়ে আমি তার থেকে কাজ বাগিয়ে নিতে চাই। আমি করি না চাকরি, বা ব্যবসা। কিন্তু ব্যয়বহুল ঢাকা শহরে সিএনজি বা উবার/পাঠাওযোগে পরিবার নিয়ে চলাচল করি, এই টাকা আসে কোত্থেকে; নিশ্চয়ই ধান্ধাবাজি থেকে।
সুতরাং সেও আমার প্রসপেক্টিভ ক্লায়েন্ট!
কিন্তু যখন সে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে, ১৩-১৪ বছর পূর্বে যখন তার ছিল না নামী কোম্পানি বা পদবি তখনো তাকে আমার ২ টা ফিল্মেই প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে ইন্টিগ্রেট করেছিলাম, আমি নিজেও তখনো ছাত্র ছিলাম; তখন তাহলে মোটিভ কী থাকতে পারে৷ নাহ তাহলে মনে হয় ছেলেটা ধান্ধাবাজ না, কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ধরনের, কিন্তু হার্মলেস—- এই সমীকরণ মিলিয়ে তার মন কিঞ্চিৎ আর্দ্র হয় আমার প্রতি, কিন্তু তবু স্বীকার করবে না আমি তাকে তেমন কোনো ভ্যালিড কারণ ছাড়াই পছন্দ করি।
আমার লেখার ক্যারেক্টারগুলো সবাই বাস্তব মানুষ৷ আরমান, হাসান মাহবুব কাকা, চমক হাসান, জিয়া ভাই, ইমু, জাহাঙ্গীর, জনি ভাই, লিটন দাস, সোহাগ ভাই, সারাবন বুবু, ইমরুল কায়েস, নাঈম শেখ, সঞ্চিতা দে, পাপড়ি, লুবনা, শুক্লা, অজন্তা হালদার, ফারহানা ব্রতী, নাবিল ভাই— প্রত্যেকেই তীব্রভাবে জৈবিক মানুষ। সঙ্গীতা আপুও যে ক্যারেক্টার হতে পারে, এটা তার বিবেচনাতে আসে না, এবং সে যে উৎকৃষ্ট বই উৎসর্গ ম্যাটেরিয়াল সেটাও মানতে আপত্তি। আমার ১১ টা বই উৎসর্গ করা হয়েছে ১১ জন পৃথক ব্যক্তিকে, পরবর্তী বইয়ের কোনোটায় যদি সঙ্গীতা দত্ত নামটা অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় তাতে অবাক হওয়ার হেতু বা ইস্যুটা কী, আমার বোধগম্য হয় না।
যেহেতু বাস্তব জীবনে উল্লেখযোগ্য স্মৃতি নাই, স্রেফ কল্পিত পৃথিবীর ইন্টারেকশনের উপর ভিত্তি করে একজন অপ্রকৃতিস্থ জুনিয়রের দার্শনিকতায় স্থান পাওয়াটা উদ্ভট লাগতেই পারে।
তাই ভুল ভাঙাতে তার সাথে গল্প করার পরিকল্পনা নিই। কিন্তু সে যেখানে থাকে সেখান থেকে ৭ কদম হাঁটলেই শুরু হয় নারায়নগঞ্জের সীমানা; আমার বাসা থেকে দূরত্বটা এত বেশি যে রওয়ানা হওয়ার সময়কার ক্লিন শেভড চেহারাটা গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাঁড়ি-গোফের আখড়া হয়ে উঠে।
তবু
সঙ্গীতা আপু বলেই দূরত্ব জয় করে তার বাসাতে যাওয়া পড়েছিল সপরিবারে। কিন্তু সামাজিকতা আর খাওয়াদাওয়ার আদিখ্যেতায় সবই হলো, গল্পটা রয়ে গেল বাকি। যে কারণে তাকে গুরুত্ব দেয়ার পেছনে আমার মতলবহীনতার ব্যাপারটিও পরিষ্কার করা হয় না আর।
ইতোমধ্যে বলেছি, কোন ক্যালকুলাস-পাটিগণিত হিসাব করেও যখন আমাকে ধান্ধাবাজ ভাবতে কনভিন্সড হতে পারে না, তার মন আর্দ্র হয়। যেমন কোনো এক সূত্র থেকে সে জেনেছে বইমেলাতে আমার বই বিক্রি হচ্ছে না একদমই। মানুষ স্টলে এসে বইটা নেড়েচড়ে দেখে রেখে চলে যাচ্ছে।
আহারে ছোট ভাই আমার, এত কষ্ট করে বই লিখিস, কেউ কিনে না; যা, আমিই কিনে তোর বিক্রির খাতা চালু করব। সেই ভাবনা থেকে সে আমায় ফোন করে বইমেলায় যাব কিনা জানতে চায়। প্রতিবছর মেলায় যাই ৫-৬ দিন, এবছর ইতোমধ্যে ৩ দিন যাওয়া হয়ে গেছে। তদুপরি ২১শে ফেব্রুয়ারিতে মহিষের ভিড়ে মেলায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু
সঙ্গীতা আপুর সাথে গল্পের সুযোগ মিস করাটা অন্যায় হয়ে যাবে। সুতরাং সপরিবারে মেলায় চলে গেলাম। যার মেলায় আসার কথা বিকাল ৪ টায়, সে বাসা থেকেই রওয়ানা হয় ৫ টা বাজার ৭ মিনিট পূর্বে, যতক্ষণে পৌঁছায়, মেলা তখন মধ্যগগন পেরিয়ে গেছে। যথারীতি আভিজাত্য আর টাকার গরম দেখিয়ে সে আমার গ্যাপশেডিং বইটি কিনে নিতে উদ্যত হয়, এবং আমি যখন বলি আপু টাকার সৎকার অন্য কোথাও করেন, আমার বইটা আপনার জন্য স্যুভেনির হিসেবে দিলাম, সে পুনরায় অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখলো পুরো ব্যাপারটাকে। ভাবলাম চা খেতে খেতে গল্প করি, জানলাম কিছুক্ষণ পরই একটা পারিবারিক দাওয়াতে যেতে হবে, এক কর্পোরেট অনুরাগীর বই প্রকাশিত হয়েছে; কিনতে হবে, গল্প করলে দিন যাবে!
তাই
চায়ের পরিবর্তে কফিটুকুই খাওয়া হলো, গল্পের দেখা পেলাম না। মেলা থেকে বের হওয়াটা পদতলে পিষ্ট হয়ে মরার অভিজ্ঞতা নিয়ে আসছিল আর একটু হলে।
অতএব,
আজও আর গল্পের ঝাঁপির উন্মোচন হলো না। যেহেতু সঙ্গীতা আপু সেমি-ঢাকায় বসবাস করে(নারায়নগঞ্জ বর্ডার), তাই বলে রাখলাম এরপর কখনো ঢাকায় এলে যেন জানানোর সৌজন্যটুকু দেখায়; বাসাবো কিংবা জুরাইন, কিংবা হোক বেগুনবাড়ি, গল্পের প্রয়োজনে ঠিকই দেখা করতে যাব।
কথাটা সে শুনলো বটে, আমল দিল না।
সঙ্গীতা আপুকে তাই কবে কীভাবে বুঝাতে পারবো আমার উল্লেখযোগ্য কোনো মতলব বা ধান্ধা নেই, সে চিন্তায় নানা ধরনের প্লট তৈরি হচ্ছে।
হতে থাকুক।