বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের সংবাদ শুনে প্রথম প্রতিক্রিয়াটিই ছিল- থট ম্যানুফ্যাকচারিং নামে অদূর ভবিষ্যতে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং কি চালু হতে পারে আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে?
এর চাইতেও গুরুতর প্রশ্ন, এধরনের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আদৌ কি ডিমান্ড আছে মার্কেটে? যার ডিমান্ড নেই সেটি মার্কেটে পাওয়া যায় না। এত বছরেও যেহেতু এরকম কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং চালু হয়নি, ধরে নেয়াই যেতে পারে মার্কেটে চলবে না।
তবু বুয়েটের সংবাদটা জেনে পরবর্তী কয়েক ঘন্টা কেটে গেল বিবিধ ভাবনার বাবল নির্মাণ আর ভাঙনের মধ্য দিয়ে।
১৭ বছর আগে কোনো এক রাতে হঠাৎ কলেজ বন্ধু নাফি ফোন করে জানায় বুয়েটে তার মেরিট পজিশন এসেছে ১৪, রোল জানলে আমার রেজাল্টও জানাতে পারবে ।
কিছুক্ষণ পরে জানলাম আমার মেরিট পজিশন ৯০৩, অর্থাৎ ওয়েটিং লিস্টে আছি। নাফি বললো ‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই, চারটা সাবজেক্ট এর কোনো একটা (মেটালার্জি, ওয়াটার রিসোর্স, নেভাল আর্কিটেকচার, ইউআরপি) পেয়ে যাবা’।
নাফির বাবা ছিলেন বুয়েটের শিক্ষক, সিভিল ডিপার্টমেন্টের। বড় ভাইও বুয়েটে পড়তেন। তাই ওয়েটিং লিস্টে আছি শুনে মনের দিক থেকে চনমনে হলেও আম্মু আর বড় আপার মন খারাপ দেখে মনমরা হয়ে থাকতে হয়েছিল, নইলে তাদের দুঃখের ইউটিলাইজেশন হতো না। কারণ বুয়েট ছাড়া কোথাও ফর্ম তুলিনি, এবং সেখানে যেহেতু চান্স পাইনি, ইয়ার লস যাওয়ার আশংকা।
কিন্তু ৯০৩ পজিশনটা অনির্বচনীয় আনন্দ দেয়। নটরডেম কলেজে আমার রোল নম্বর ছিল ১২৯, ছিলাম গ্রুপ ৭ এ; দুয়ের গুণফলে ৯০৩ ই হয়। মনে হচ্ছিল কো-ইনসিডেন্স রক্ষার পরম্পরা৷ অথচ সামাজিক বিষন্নতার উৎসবে কো-ইনসিডেন্সের আনন্দটা উদযাপনই করা যায়নি।
বুয়েটে ভর্তির পূর্বে ইলেক্ট্রিকাল, সিএসই, সিভিল, মেকানিকাল, আর্কিটেকচার আর কেমিক্যালের বাইরে অন্য সাবজেক্টগুলোর নামই শুনিনি। অবশ্য মেরিট পজিশন প্রথম বা মাঝামাঝি দিকে থাকলে কোন বিষয়ে পড়বো তাও ভেবে রাখিনি। কেমিক্যাল শব্দটা শ্রুতিমধুর লাগতো, হয়তবা স্রেফ শব্দের কারণেই ওটা নিতাম।
আমি শুধু বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকতে চেয়েছিলাম। কার্যকারণ ছিল নিতান্তই গৌণ!
সেই বয়সে মনে হয়েছিল ভবিষ্যতে যেভাবে জীবন কাটাতে চাই তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা এবং তুলনামূলক কম পারিবারিক বাধা পাওয়া দুটো শর্তই পরিপূর্ণভাবে পালিত হতে পারে বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেলে।
প্রথমত নাফির সূত্রে আগেই জেনেছিলাম বুয়েটে প্রথম দিন থেকেই একটা ছেলে হলে সিঙ্গেল সিট পায়, কোনো ডাবলিং নেই, এবং সিনিয়র-জুনিয়র একসাথে সিগারেট খাওয়াতেও ঝামেলা বাঁধে না, মোটামুটি ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক।
দ্বিতীয়ত ঢাকার অন্যতম নিকটবর্তী শহর হলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মানিকগঞ্জ অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশ খানিকটা অনগ্রসর। প্রতিবছর জেলা থেকে খুব বেশি ছেলেমেয়ে চান্স পেত না বুয়েটে। যদিও আমার কলেজ জীবন কেটেছে ঢাকায়, শিকড় তো মানিকগঞ্জেই। তাই বুয়েটে একবার ঢুকতে পারলে অন্তত ৪-৫ বছর সবাই চুপচাপ থাকবে। এই সময়টুকুই যথেষ্ট কাঙ্ক্ষিত জীবন পথের পুঁজি সংগ্রহের জন্য।
কাঙ্ক্ষিত জীবনটা আসলে কেমন ছিল?
প্রচুর মানুষের গল্প শোনা, ব্যক্তিমানুষের সম্পর্ক বোঝা, সম্পর্ক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা, ২-১টা বই লেখা বা ১টা ফিল্মের স্ক্রিপ্ট।
এরপরে ৩০-৩২ বয়সে দেহত্যাগ করা।
যেহেতু তেমন কিছু এচিভ করার স্পার্ক পাচ্ছি না, দীর্ঘজীবন দিয়েই বা করব কী।
জীবনে প্রচুর বায়োগ্রাফি পড়ার কারণে কিশোর বয়সেই উপলব্ধি তৈরি হয়েছিল পরিবার একপ্রকারের পিছুটান, এবং ক্রিয়েটিভ বা থিংকার প্রকৃতির মানুষেরা প্রায় প্রত্যেকেই আইসোলেটেড বা বিচ্ছিন্ন থেকেছেন জীবনের একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত।
কিন্তু বুয়েটে ঢোকার পরে দেখি জীবনের লেয়ারগুলো অন্যরকম।
রিজেকশন, হিউমিলিয়েশন আর পেইন এর যে ত্রিমাত্রিক কম্পোজিশন তার স্বাদ এত গভীরভাবে আস্বাদন করেছি প্রতিমুহূর্তে, তারই প্রেক্ষিতে কো-ইনসিডেন্স ব্যাপারটার সৌন্দর্যময়তার সাথে গড়ে উঠে অভেদ্য সখ্য, যা রূপ নেয় প্রণয়ে।
কীভাবে উপার্জন করব ১৮ বছর আগেও ভাবিনি, এখনো ভাবি না, কো-ইনসিডেন্স নামের প্রেয়সী প্রতিবারই আমার মানিব্যাগের দেখভাল করেছে। প্রচুর উপার্জন কখনোই করিনি, তবে একেবারে দীন-দরিদ্র দশাতেও থাকতে হয়নি৷ কেবলমাত্র ২০১৭ তে উনিশ-তেইশ প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্ম নেয়াহেতু এনআইসিইউ সাপোর্ট লেগেছিল ৪২ দিন, প্রায় ৭-৮ লাখ টাকা দরকার পড়ে হুট করে, সঞ্চয় করি না বলে মানুষের কাছে ঋণ চাইতে হয়েছিল ফেসবুকে, এবং নিঃস্বার্থভাবে পরিচিত-অপরিচিত অসংখ্য মানুষের ঋণসহায়তা পেয়েছিলাম। উনিশ-তেইশকে তাই পাবলিক প্রোপার্টি গণ্য করি তখন থেকেই৷
যেহেতু উপার্জন বিষয়ে কিছুটা ইনফরমাল প্রকৃতির ছিলাম এখনো পর্যন্ত খুব কম মানুষকেই বোঝাতে পেরেছি আমার কাজ। সম্প্রতি একটা নতুন শব্দ ভেবেছি- ‘চিন্তা ম্যানুফ্যাকচারিং’; ভেবে দেখলাম আমার কাজকে যথার্থ পোরট্রে করা যায় এই শব্দের মাধ্যমেই। বিভিন্ন মানুষ বা কোম্পানিকে আমি আসলে চিন্তা সরবরাহ করি৷ সেগুলোর কিছু অংশ কারো কাজে লাগে, কিছু লাগে না।
ম্যানুফ্যাকচারিংও ইঞ্জিনিয়ারিং আমার ধারণা।
বিশেষত আমাদের প্রায় সকল চিন্তাই আমদানিনির্ভর৷ ইউরোপ বা আমেরিকান কালচারভিত্তিক চিন্তা ভিন্ন কালচার-ডেমোগ্রাফি-এথনিসিটির মানুষের ভূখণ্ডে হুবুহু ফিট করে যাবে এই চিন্তা অসম্পূর্ণ লাগে আমার। একজন ইউরোপিয়ান স্কলার যতই স্মার্ট আর স্কিল্ড হোক বাংলাদেশে এসে এখানকার আবহাওয়া-জলবায়ু-খাদ্যাভ্যাসের সাথে মানিয়ে নিতেই লেগে যাবে দেড় বছর, সেখানে তার উৎপাদিত চিন্তা বা তত্ত্ব এখানে খাটবে এমন ভাবনারই তো অবকাশ দেখি না৷
চিন্তার লোকালাইজেশন বিষয়ে সেই করোনা ভাইরাসের সময় থেকে লেখালিখি করছি, একটা আস্ত বই প্রকাশিত হয়েছে৷
কিন্তু একজন বিচ্ছিন্ন ইনডিভিজুয়ালের কতটুকুই বা ক্ষমতা!
এরকম যখন মনোভাব তখন হঠাৎই মনে পড়লো ছাত্রজীবনে শুনেছিলাম ঢাকা ভার্সিটির কোনো একটা সাবজেক্টে নাকি প্রতিবছর মাত্র ১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়া হয়৷ সম্ভবত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা মাইক্রোবায়োলজি। বুয়েটেও যদি ‘থট ম্যানুফ্যাকচারিং’ নামে কোনো বিভাগ চালু হয় যেখানে সর্বোচ্চ ৮-১০ জনই সুযোগ পাবে, সেটা একটা বৃহৎ প্যারাডাইম শিফটিং হতে পারে।
বাংলাদেশের সোস্যাল কনটেক্সট খুবই গুবলেটপূর্ণ লাগে। যে কোনো ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজকেই কীভাবে যেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সোস্যাল সাইন্সেও সাইন্স কম, হিউম্যানিটিস বেশি। সামাজিকতার ধারণায় যে বৃহৎ ফাটল তৈরি হয়েছে তাতে সোস্যাল সাইন্সের চাইতে সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অধিকতর প্রাগম্যাটিক মনে হয়। ভার্সিটি কারো ক্যারিয়ারের দায়িত্ব নেয় না, তাকে ভবিষ্যত ক্যারিয়ারের জন্য গ্রুমিং করে বড়জোর। থট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে ৪ বছরের গ্রাজুয়েশন করলে একজন শিক্ষার্থীর জীবিকা কী হবে সেটাও যথাসময়ে ঠিক হয়ে যায় আসলে।
প্রবলেম লোকাল, অথচ সমাধান আমদানীকৃত— এই মডেলের প্রধান ত্রুটিই হলো এটা আপনি ওউন করতে পারবেন না, মনে হবে আরোপিত। যেমন আমার একটা ইচ্ছা প্রায়ই কাজ করে ২০০০ সালের পরে যে দুটো দশক গেল প্রতি দশককে আলাদা স্ল্যাব হিসেবে ধরে বুয়েটে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থীদের ব্যাকগ্রাউন্ড এনালাইসিস করে কোনো ট্রেন্ড বের করা যায় কিনা। এক্ষেত্রে আমার প্রাথমিক কনছার্ন স্কুল। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে চান্স পাওয়ার রেশিওতে সিগনিফিক্যান্ট পরিবর্তন আসছে কিনা। কিংবা বিভাগীয় শহরগুলো থেকে চান্স পাওয়ার হারের সাথে মফস্বলীয় স্কুলের হার একই থাকছে নাকি বড় পরিবর্তন আসছে।
এইসব ইনডেক্স একই সাথে অনেক কিছুর ইন্ডিকেটরও। আগামীর সমাজ ব্যবস্থায় এগুলো নানারকম সমীকরণের জন্ম দিবে। মাইগ্রেট করে ইউরোপ বা আমেরিকায় চলে গেলে তো আলাদা চ্যাপ্টার তৈরি হয়েই গেল। কিন্তু বৃহৎ অংশই মাইগ্রেশনের সুযোগ না পেয়ে এই অনুকরণসর্বস্ব ভৌগলিক সীমারেখায় শরীর পালনে বাধ্য কিংবা অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। তাদের শরীর মনের স্ফৃর্তি স্মুথ করতে বা যন্ত্রণা লাঘবে এধরনের অলটারনেটিভ এপ্রোচে ইন্সটিটিউশনাল পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।
কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কিংবা সোস্যাল মিডিয়া ট্রলিংয়ের চাপে এসব প্রকল্প করা হবে না কখনোই। বরং বেসরকারি ইউনিভার্সিটিগুলো এক্সপেরিমেন্টালি কিছু চেষ্টা করে দেখতে পারে। দেখা গেল পড়াশোনা করছে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সেখানে ৬ ক্রেডিটের থট ম্যানুফ্যাকচারিং কোর্স পড়তে হচ্ছে।
যাহোক বুয়েটের শহীদ মিনার, ক্যাফেটেরিয়া, মাঠ, বসে থাকার দেড়ফুটি সিমেন্টের বেঞ্চ, হলের করিডোর, রাতের পলাশী প্রতিটি জায়গাতেই প্রচুর হেঁটেছি, বসে থেকেছি, গল্প করেছি, অপমানিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছি বিস্তর— তবে চিন্তা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের যে প্রশিক্ষণ সেখান থেকে পেয়েছিলাম, তার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলে ব্রুটাস আমায় অভিশাপ দেবে।
বিদায় নিব বলেই বারেবারে অভিবাদনের লৌকিকতা।