অদ্ভুত লাগলেও, মৃত্যু বলতে কিছু আছে এই বোধের সাথে আমি প্রথম পরিচিত হই চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল মারা গেছে, রেডিওতে এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর। তখন বয়স ছিলো ৪ কি ৫; অবশ্য মৃত্যু সংক্রান্ত আঁচ পেয়েছিলাম আরও আগে। জন্ম থেকেই শুনে আসছি আমি দেখতে অবিকল আমার দাদুর মতো, কিন্তু কোথায় তিনি এই প্রশ্ন করলে উত্তর পেতাম তিনি আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। জাফর ইকবাল মারা যাওয়ার পর বড়দের কথা-বার্তা থেকে বুঝি, মারা যাওয়া মানে পৃথিবী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া। সেই বুঝ প্র্যাকটিকালি দেখতে পাই ৯৫ সালে আমার বড় চাচা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর। মানিকগঞ্জ থেকে প্রাইভেট কারে চড়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন, যাওয়ার আগেও দুপুরবেলা আমাদের বাসায় এসে খেয়ে গেছেন, গল্প করেছেন, বরাবরের মতো আমাদের ছোট ছোট শাস্তি দিয়েছেন, কিন্তু সন্ধ্যায়ই শুনি তিনি মারা গেছেন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে তার লাশবাহী গাড়ির সামনের সিটে বসে রাতের বেলা গ্রামের বাড়ি যাই, পরদিন তার দাফন হয়। তখন থেকেই বিরাট খটকা কাজ করতে শুরু করে মনে, যে মানুষটি দুপুরবেলা এসেও এরকম গল্পগুজব করে গেলো, সন্ধ্যার আগেই সে মারা গেলো! এই অদ্ভুত রহস্যের মানে কী; আব্বু বয়সে বড়, তাহলে চাচা আগে মারা গেল কেন! আত্মীয়-স্বজন সবাই শোকাহত, তার ৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে, থমথমে পরিবেশ, কিন্তু আমার মাথায় একটাই ভাবনা ছিলো, মানুষ যে কোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারে। কাছাকাছি সময়ে টেলিভিশন সংবাদ মারফত জানি, পপশিল্পী ফিরোজ সাঁই কোনো একটা প্রোগ্রামে গান গাওয়ার সময়ই মারা গেছেন; দীর্ঘদিন পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি একটা মানুষ গান গাইতে গেলে মরে কীভাবে!

১০ বছর বয়সে গৌতম বুদ্ধের জীবনি পড়ার পর নিশ্চিত হই জীবন বলতে কিছুই নেই, সবটাই মায়া। এবং অশ্বত্থ গাছের নিচে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তার দিব্যজ্ঞান লাভের কাহিনী পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি অশ্বত্থ গাছ খুঁজে বের করতে হবে, এবং ধ্যান করে দিব্যজ্ঞান পেতেই হবে, যদিও দিব্যজ্ঞান বলতে কী বোঝায় সেটার বিন্দুবিসর্গও বুঝিনি তখন। শিশু একদিন যুবক হয়, তারপর বার্ধক্যের কাছে হার মানে- জীবনের এই চক্র ভেদ করা যেহেতু সম্ভব নয়, এই মিছে মায়ায় জড়িয়ে কী হবে।

আমার জীবনে কখনো জীবন-মরণ পার করা বন্ধু ছিলো না কেউ। স্কুলে থাকাকালে শুভাশিস, সুমন, ২ আসিফ; বুয়েটে ব্রতী, আরমান- এদের সাথে আন্তরিকতা অমলিন, কিন্তু একদম জড়তাহীন সম্পর্ক বলতে যা বোঝায় তেমনটি কারো সাথেই গড়ে উঠেনি, একটা আবরণ কাজ করেছে সর্বক্ষণ। শৈশব থেকেই আমার বন্ধু বলতে গৌতম বুদ্ধ, রামানুজন. মাইকেল মধুসূদন, গ্যালিলিও, ম্যাক্সিম গোর্কী- এই ৫ জন মানুষ। আমার আচরণ এবং জীবনযাপন প্রায় পুরোটাই এদের অদৃশ্য প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে দীর্ঘদিন, কিন্তু এরা কেউই জীবিত মানুষ ছিলেন না; ফলে মৃত্যুর প্রতি তীব্র অভিমান জমে, এরা যদি আরও ২০০০ বছর বাঁচতো তাতে কার কী ক্ষতি হতো, যেসব লোকজন সারাদিন টাকা-পয়সা, গয়নাগাটির গল্প করে এদের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার দরকার কী, এদের আয়ু মাইনাস করে ওইসব মানুষের আয়ুতে দিয়ে দিতো; প্রচণ্ড বিরক্তিতে মনে হতো, আজই কেন মরে যাই না!

পরিণত বয়সে হুমায়ূন আহমেদের একটা টেলিভিশন ইন্টারভিউ দেখে আমার শৈশবের সেই আক্ষেপ নতুন করে ফিরে আসে। তিনি বলেছিলেন, মানুষ বাঁচে মাত্র ৬০-৭০ বছর, অথচ কচ্ছপ বাঁচে ৫০০ বছর। একটা কচ্ছপ কেন এতোদিন বাঁচবে!
ছেলেবেলায় ধর্মশিক্ষা বইতে পড়েছিলাম, হযরত নূহ (আঃ) একনাগাড়ে ৯২৯ বছর তার সম্প্রদায়ের মানুষদের দীনের দাওয়াত দিয়েছেন। অর্থাৎ দীর্ঘ এক জীবন। যার শুরু আছে, আজ হোক কালো হোক সেটার শেষও আছে, কিন্তু এখন যা পেলাম সেটা ৫০ বছর পর দেখার জন্য বেঁচে থাকবো না, এই বোধ আসবার পর মনে হয়েছে, কেন বৃথা আস্ফালন! এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে পরবর্তী চুমুক দেয়ার মধ্যবর্তী যে সময়ের ব্যবধান, জীবন তো তার চাইতেও ছোট। জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ পার হলেই চোখের পলকে বছর শেষ হয়ে যায়। জীবন তো এরকম কয়েকটা বছরেরই সমণ্বয় মাত্র। একজন মানুষ যদি ৬৭ বছর বাঁচে তার আয়ুষ্কাল মাত্র ৫৮৬৯২০ ঘণ্টা, অর্থাৎ ১০ লাখ ঘণ্টাও টেকা হয় না। একটা করে দিন শেষ হয় আর ৮৭৬০ ঘণ্টা খরচের খাতায় চলে যায়, কত দ্রুত ফুরিয়ে আসে সব। যদি নিশ্চয়তা থাকতো ৫০০০ বছর বেঁচে থাকা যাবে, তাহলে ১০০-২০০ বছর আরাম আয়েশ করে কাটিয়ে দেয়া যেতো; ৬০-৭০ বছর তো আমলেই আসতো না। টাকার প্রেম, খ্যাতির প্রেম, দেহজ প্রেম, সংসার প্রেম – এইসব বিবিধ প্রেমের বিষে নীল হয়ে স্বল্পস্থায়ীত্বের এই আয়ুকে ব্যবহার করার মধ্যে বৃহত্তর কোনো ভিশন খুঁজে পাই না। তবু অভ্যাসবশতই প্রেমের ফাঁদে প্রফুল্লচিত্তে ধরা দিই।

মৃত্যুকে উপলব্ধির ক্ষেত্রে অনেকটা সহায়তা করেছে পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য গিলগামেশ। সক্রেটিস, প্লেটোদেরও বহু হাজার বছর আগে রচিত এই মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র গিলগামেশ নামের এক রাজা, যার দেহের দুই তৃতীয়াংশ দেবতার, বাকিটুকু মানুষের। তাকে নিউট্রালাইজ করার জন্য তারই মতো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি চরিত্র সৃষ্টি করা হয় যার নাম এনকিদু। সে যেহেতু মানুষ, সঙ্গত কারণেই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু গিলগামেশ এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারে না, বন্ধুকে জীবিত করতে রাজ্য-টাজ্য ছেড়ে সে রওয়ানা হয় পৃথিবীর শেষপ্রান্তের উদ্দেশে, যেখানে আছে উৎনাপ্রিশতম নামের একমাত্র অমর মানুষ, যে জানে জীবনের রহস্য। বহু সংগ্রামের পর উৎনা প্রিশতমের দেখা পেলে উৎনা প্রিশতম প্রথমেই তাকে বলে অমরত্ব মানে তো নিঃসঙ্গতা, যিনি এই জগতটা সৃষ্টি করেছেন তিনি নিজে কত বড় নিঃসঙ্গ, ভেবে দেখ একবার। তবু গিলগামেশের অনুরোধে সে তাকে রহস্য জানায়- মৃ্ত্যু সায়রের তলদেশে আছে এক পদ্ম, সেটা যার শরীরে স্পর্শ করানো হবে সে অমরত্ব পেয়ে যাবে। গিলগামেশ সেই পদ্ম তুলে আনে, কিন্তু সামান্য অসতর্কতার কারণে এক বুনো সাপ সেটা নিয়ে নেয়, ফেলে রেখে যায় তার পুরনো খোলস। এনকিদুর আর জীবন পাওয়া হয় না। বহুবছর বাদে রাজ্যে ফেরার পরে দেখা গেলো, এনকিদু বলতে কেউ ছিলো এটাই মনে নেই কারো।

দেহ মানেই রোগ-শোক, রিপুর আঁধার। যত বয়স বাড়ে চেনা-পরিচিত মানুষের সংখ্যা কমে আসতে থাকে, দেহে রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে, এবং শোকের সংখ্যা বাড়ে। একসময় হঠাৎ আবিষ্কার করা হয়, ঘনিষ্ঠজনদের বেশিরভাগই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে, এবং এই হারানোর লিস্টে একদিন নিজেও ঢুকে পড়ে মানুষ। তাহলে এতো বর্ণালী স্মৃতি, কার্যক্রম এগুলোর ভবিষ্যৎ কী? আজ যে একটা কোম্পানীর সাথে ডিল সাইন করলাম, এটার ভবিষ্যৎ কী; বাহুবলী ড্রেস কিনলাম, এটারই বা গতি কী? দেহ তো পচে-গলে যায়, কিন্তু এই স্মৃতিগুলো তো দেখা যায় না, সেগুলো কোথায় যাবে! বাস্তবতা বলতে আদৌ কি কিছু আছে, নাকি সমস্তটাই বিভ্রম? মহাজীবনের ভিশন কী তাহলে? সতত এক্সপেরিমেন্টের শিকার হওয়া? ‘আমি কে’ এবং ‘কোনটা আমি’ এই দুটো নিরীহ প্রশ্নের উত্তরই বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস কেউ নিরঙ্কুশভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি যেখানে, সেখানে এই উদ্ভট এক্সপেরিমেন্টের যৌক্তিকতা কী? বিলিয়ন বিলিয়ন ডাটার এক্সপেরিমেন্টে নিজেকে তুচ্ছ একটা রেন্ডম স্যাম্পল মনে হয়; এই মনে হওয়ার তেজ

আমি যে প্রতিষ্ঠা, সামাজিক স্ট্যাটাস প্রভৃতি বিষয়াদির প্রতি চূড়ান্ত উদাসীন হয়ে সমগ্র আয়ুষ্কালটা জীবন নিয়ে, মানুষ নিয়ে, সম্পর্ক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে ছন্নছাড়ার মতো পার করে দিলাম, এটার প্রধানতম কারণ কিন্তু ওই নিজেকে গিনিপিগ মনে হওয়া বোধ থেকেই। একটা হাইয়ার ইন্টেলিজেন্ট সুপারন্যাচারাল সিস্টেম আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে আনন্দ পাচ্ছে, তার মানে জীবনের মূল আনন্দ তো এক্সপেরিমেন্টেই, আমিই বা বসে থাকি কেন! ধরা যাক, আমার পরিচিত কেউ পুলিশি ঝামেলায় পড়লো, আমি তাকে ছাড়াতে পারলাম না, কেউ হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইছে, আমি সেটাও করতে পারলাম না, কিংবা আমাকে দেখে ১৩ জন মানুষ সালাম দিলো না- তাতে কি বেঁচে থাকার সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেলো? কার কত ইনকাম, কে কয়টা ফ্ল্যাট কিনেছে- এইসব চিন্তায় বিভোর মানুষের সমাজে কে দাম দিলো এটা নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। একটা জংলি নেকড়ের সাথে রুম শেয়ার করা যেমন অনুভূতি, এই সমস্ত ভিশনবিহীন মানুষের সাথে পৃথিবী শেয়ার করার অনুভূতি তার চাইতে আলাদা কিছু নয়। সুতরাং নির্বিঘ্নে স্ট্যাটাস-প্রতিপত্তিকে জাহান্নামের রাস্তা দেখিয়ে দেয়া যায়।

আত্মা বা রুহ আসলে কী? ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়, তারে ধরতে পারলে মনো বেড়ি দিতাম পাখির পায়’- লালনের একগানেই রুহ সংক্রান্ত মানুষের গহীনতম ভাবনাটি বোঝা যায়।

কীভাবে মৃত্যু হয়? আকস্মিক মৃত্যু (স্ট্রোক, হার্ট এটাক), দুর্ঘটনা বা রোগে ভুগে মৃত্যু। আর বড় প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে একযোগে বহু মানুষের মৃত্যু। প্রাণ তৈরি হচ্ছে, প্রাণ বিনষ্ট হচ্ছে- এর মধ্যে কবে, কোথায় কোন্ মানুষ এলো, কে গেলো সেই হিসাব রাখে কে! তবু মানুষ বাঁচতে চায়। কোনো একটা বইয়ে একটা লাইন পড়েছিলাম এমন, সব মানুষ বেহেশতে যেতে চায়, কিন্তু কেউ মরতে চায় না। আসলে পৃথিবীর ৯০% মানুষই নিজে নিজে চিন্তা করতে পারে না, তাদের ইনফ্লুয়েন্সিং ফ্যাক্টর লাগে, রেফারেন্স ডাটা লাগে, ফলে পৃথিবীব্যাপী যখন যে ট্রেন্ড সেট হয় বৃহত্তর অংশের মানুষ সেটার পেছনেই ছোটে পিলপিল করে, এবং একদিন আয়ু ফুরিয়ে হারিয়ে যায়। আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথও মারা গেছেন, আমাদের পাশের গ্রামের তজু ব্যাপারিও তাই; তাহলে যে যেই খেয়ালে সময় পার করতে চায় করুক। কিন্তু এই বিপুল বৈষয়িকতা, লোভ, নীচতা এসবে কিছু মানুষ বিরক্ত হয়, এবং সেই বিরক্তি লেখা, গান বা ফিল্মের মাধ্যমে তারা প্রকাশ করে। মানিক বন্দোপাধ্যায় হোসেন মিঞার মাধ্যমে ময়না দ্বীপের আড়ালে নতুন এক সমাজ ব্যবস্থা চেয়েছেন, মিলান কুন্ডেরা বলেছেন জীবন অন্য কোনোখানে; যারাই ভেবেছেন, তারাই এই বৈষয়িক প্রতিবন্ধী জীবনকে অস্বীকার করেছেন, এবং তার চাইতে মৃত্যুকে বেটার অপশন ভেবেছেন।

আহমদ ছফা তার কোনো এক বইতে লিখেছেন, আমাদের জীবনের বড় অংশই তো খাওয়া, ঘুম আর সঙ্গমে অপচয় হয়ে যায়। প্রাণী হিসেবে মানুষের দায় আসলে কী? শুধুই কি বংশবৃদ্ধি? এর একটা অলটারনেটিভ ডিসকোর্স আছে আমার লেখা ‘প্রযত্নে-হন্তা’ গল্পে। ‘ একজন মানুষ চিন্তায় মারা যায়, স্বপ্ন, দর্শনে মারা যায়, একজন মানুষ তাড়িত-বিতাড়িত হয়েও মারা যায়— মানুষ আসলে প্রতিমুহূর্তেই নিজের কাছে নিজে মরে যায়; অথচ মানুষটি বেঁচে থাকে, বংশবৃদ্ধিও করে। বেঁচে থাকা বংশবৃদ্ধির সমার্থক হলে তো মানুষ না হয়ে ঘাসফুল হওয়াও ঢের ভালো’।

প্রবল বস্তুবাদীতা আর ইন্দ্রিয়পরণতায় বিরক্ত হয়ে সেই শৈশবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সংসার ত্যাগ করবো ৩০ বছর বয়সে। সেই বয়সে পৌঁছে গেছি, এখন সংসারে আছি বোনাস জীবন নিয়ে; যে কোনো দিন যে কোনো সময়ই চলে যেতে পারি ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কিংবা নীলফামারীর দুর্গম কোনো এলাকায় স্থায়ীভাবে। এ নিয়ে আমার আফসোস কাজ করে না, কারণ রেসপনসিবিলিটির প্রেমে পড়ে আয়ু ফুরানোর চাইতে ভালো লাগা নিয়ে অবশিষ্ট ঘণ্টাগুলো কাটানো অধিক যৌক্তিক। বস্তুবাদীতাকে অপছন্দ করা মানেই ভাববাদী, মরমীবাদী বা বাউলিয়ানা নয়; একটা সিম্পল জীবন, যেখানে চাহিদা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। ২ দিন আগে রাত জেগে হিউম্যান বিহেভিয়ার প্রজেক্টের ডকুড্রামার জন্য একটা পুঁথি লিখেছিলাম, তাতে কয়েকটা লাইন ছিলো এমন:

“সাধক হিমালয় কয় এ কিছু নয়, সবই ভাবের ভুল
চিন্তাছাড়া মানুষ যেন রঙিন ধূতরার ফুল
ফূর্তি বহুত হইছে/

ফূর্তি বহুত হইছে, সময় গ্যাছে, মাথার ভিতর ফাঁকা
সেলফির নেশায় বেহুশ মানুষ, পিঁপড়ার পিঠে টাকা
মানুষ মহিষ নাকি!!”

আমি ৩১ বছরের জীবনে একটা ব্যাপারে পুরো নিশ্চিত হয়েছি, দুর্ভিক্ষ আর বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া মানুষ কখনো না খেয়ে মারা যায় না। অথচ অদৃশ্য ভয় ক্রমাগত আমাদের দমিয়ে রাখে, ভাবে ওটা না করলে খাবো কী, সমাজে মুখ দেখাবো কী করে, এবং এটাই হওয়ার কথা।

একুশে টেলিভিশনে একসময় ‘আকবর দ্য গ্রেট’ সিরিয়াল প্রচারিত হতো, তার শুরুতে কয়েকটা লাইন ছিলো, ‘সূর্য আমি ওই দিগন্তে হারাবো, অস্তমিত হবো, তবু ধরনীর পরে চিহ্ন রেখে যাবো’। এই লাইনের মানে কী বুঝতাম না তখন, তবে শুনতে ভালো লাগতো, এবং বড় হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি, ধরনীর পরে চিহ্ন রেখে যাওয়ার স্বপ্ন কত বিপজ্জনক। কথাটা এতো বেশি চলতি হয়ে গেছে যে, এর বাড়তি কোনো তাৎপর্য নেই আর। আমি পুঁথির সুরে বলি কথাটা এভাবে,

‘মুখে হাতি-ঘোড়া মারতে তোমার হয় না মোটে কসুর
কুড়ের বাদশা ভাল্লুক তোমার ছোট মামার শ্বশুর
চিহ্ন কেমনে রাখবা’!

আমি ভাবি, ফেরদৌসি যখন শাহনামা লিখেছিলো, সেইসময় লেখার জন্য নিশ্চয়ই কম্পিউটার ছিলো না, কিংবা ২০ বছর আগেও যখন মোবাইলের এমন উৎকট অত্যাচার ছিলো না, এনালগ টেলিফোন থাকতো কদাচিত ২-১টা বাসায়, জীবন কি থেমে ছিলো? মিনিটে মিনিটে কথা বলা, খোঁজ নেয়া, এইসব আরোপিত আহলাদের অত্যাচার ছাড়াও সম্পর্কগুলোয় গভীরতা ছিলো। জীবন সহজ হওয়ার চাইতে আরও বেশি ডিভাইসবন্দী হয়ে গেল কি!

হাত-পা ছেড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে তো সময়ক্ষেপণ করার মানে হয় না, তবে প্রলোভনের পেছনে আত্মা বিনিয়োগ করাটাও মানবিক লাগে না। গ্যেটের ফাউস্ট শয়তানের কাছে আত্মা বেচে দিয়েছিলো; আমরা মানুষগুলো ফাউস্ট হয়েই জীবন কাটিয়ে দিই, যাদের আত্মা শয়তানের কাছে বন্ধক রেখে মহোৎসাহে জীবনের অর্থ খুঁজি। আমি বরং আত্মার জার্নিটা বোঝার চেষ্টা করি, সেই মহাজগতের ইমাজিনেশনে মেধা শাণিত করি। সময় বলতে কিছু নেই, বাস্তব বলতেও কিছু নেই, রেনে দেকার্তের মতো করে বলতে হয় ‘আমি ভাবছি, তাই আমি আছি’। কে এই ভাবাভাবির কাজটা করে দেয় বা করিয়ে নেয়, সেটাই প্রশ্ন।

একটি প্রবল আত্মকেন্দ্রিক জীবনের পেছনে ৫ লাখ ঘন্টা ব্যয় করার চাইতে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর চিন্তাচর্চা, ইনসাইট আর জীবনাচরণ বুঝে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের আপেক্ষিক হিসাবগুলো মিলিয়ে নিতে চাই। মৃত্যুকে ভয় পাই, অন্তত ৬৭ বছর বাঁচতেও চাই, কিন্তু বস্তুবাদীতায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে একটি ন্যানো সেকেন্ডও নয়। উৎনা প্রিশতম এর দুঃখটা বুঝি বলেই অমরত্ব প্রত্যাশা করি না, তবু একজন আদ্যন্ত সুখী মানুষ হিসেবেই শত আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্রহের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে চাই একদিন, যাকে অন্যরা বলবে মৃত্যু। মৃত্যু কি সমাপ্তি, নাকি সম্ভাবনা? যেটাই হোক, পৃথিবী পরিভ্রমণকালীন কোনো ক্ষুদ্রতার মোহে মহাজীবনের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি না ঘটে।

সময় সাহেব, চলো দাবা খেলি; আমি জিতলে তোমাকে কিছু দিতে হবে না, তবে আমাকে হারাতে পারলে আমার বাসার যে বই পছন্দ হয়, সেটাই তোমার। ঘোড়ার চাল দিয়ে দিয়েছি, এবার তোমার পালা……….