বারী সিদ্দিকীর একটা গান শুনছিলাম গতকাল-
আমার অনেক বাঁশের বাঁশি আছে, মিছে কেন কিনবি চাটাই বাঁশ/আমি বারী বাঁশরিয়া বাঁশি যে মোর প্রাণপ্রিয়া/ তা না হলে বাঁশির ভেলায় ভাসাইয়া দে লাশ
গানটা শোনার পর থেকেই মৃত্যু সংক্রান্ত পুরনো রোমান্টিসিজম ফিরে এসেছে আবার। বেঁচে থাকা যদি উপভোগ্য হয়, মৃত্যু তবে কেন হবে বিষাদময়। ম্যারাথন দৌড়ের শুরুতে যাদের দেখেছিলাম ক্রোশ এগুবো আর চেনা মুখগুলো কমতে থাকবে, যুক্ত হতে থাকবে নতুন মুখ, এবং তাদের সাপেক্ষে একদিন আমিও ছিটকে যাব ট্র্যাক থেকে— ব্যাপারটার মধ্যে পিলো পাসিং গেম ভাইব পাওয়া যায়।
কাঙ্ক্ষিত জীবন যদি থাকতে পারে ড্রিম ডেথ কেন থাকবে না। এরূপ ভাবনা তাড়িত হয়ে মৃত্যুকে চিঠি লিখি, নিজেই রচনা করি নিজস্ব মৃত্যুর প্রেস রিলিজ, কল্পনায় দেখি শোকগ্রস্ত শুভাকাংখীদের চেহারা, এবং পরদিনই যে যার প্রাত্যহিকতায় করেছে প্রত্যাবর্তন৷
মৃত্যু যেখানে এতখানি ইমপ্যাক্টশূন্য ঘটনা, জীবদ্দশায় অনুতাপ-অনুশোচনা বা আফসোসের টালি বাড়িয়ে ধ্বজভঙ্গতায় আক্রান্ত হওয়াটাও বিষাদময় নিরর্থকতা।
মানুষে মানুষে সম্পর্ক ম্যাক্রো স্কেলে ২ ধরনের- ভোক্তা, উৎপাদক। এদের মধ্যে ৩য় একটি পক্ষ সংযোগ স্থাপন করে, তাদের আইডেন্টিটি ‘সরবরাহকারী’।
প্রত্যেক উৎপাদক কোনো না কোনো স্তরের ভোক্তা, কিন্তু বেশিরভাগ ভোক্তাই উৎপাদক নয়। ভোক্তার রুচি, চাহিদা এবং লাইফস্টাইলের সাথে মিলবে না উৎপাদকেরটা।
ফলে উৎপাদকের আনন্দ-বেদনা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সমীকরণ কখনোই নিখাদ ভোক্তার নিক্তিতে পরিমাপ করা উচিত নয়।
একারণেই ভোক্তার মৃত্যুতে আমি ব্যথিত হই, কারণ একজন ভোক্তা কমে যাওয়া মানে কোনো না কোনো উৎপাদকের বঞ্চিত হওয়া।
কিন্তু উৎপাদকের মৃত্যুতে প্রথমেই চিন্তা আসে শেষ ৫ বছরে তার উৎপাদন ট্রেন্ড কোনদিকে- উর্ধ্বমুখী, স্থবির, নাকি নিম্নমুখী। উর্ধ্বমুখী হলে চিন্তা করি কীভাবে মৃত্যু হলো, এবং তার ভোক্তারা নতুন কোন উৎপাদকের মাধ্যমে তার শূন্যতা পূরণ করবে। স্থবির বা নিম্নমুখীর ক্ষেত্রে অবশ্য আলাদা; আনমনেই বলি- ‘অবশেষে হাড় জুড়ালো, যান ঘুরে আসুন’
শেন ওয়ার্ন, সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায়, আজম খান বা আইয়ুব বাচ্চুর যখন মৃত্যু হলো প্রতিক্ষেত্রেই মনে হয়েছে- আরো আগে কেন নয়, জীবন থেকে নতুন আর কী পাওয়ার ছিল আপনাদের।
কিন্তু যখন শুনি কোনো পেশাজীবীর প্রয়াণ ঘটেছে সে আমার চেনা হোক বা অচেনা তার প্রতি গভীর সহমর্মিতা বোধ করি। মনে হয়, বেঁচে থাকলে লোকটি আরো কতগুলো নতুন জায়গায় যেতে পারত, কত রকম কেনাকাটা করত, সিনেমা দেখত, ছবি তুলতো, নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হত— একটা সাপ্লাই চেইন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। তার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম আমিও।
কিন্তু শেন ওয়ার্ন বা আজম খান এর কাছ থেকে পাওয়ার অবশিষ্ট কিছু কি ছিল, কিংবা হুমায়ূন আহমেদ?
আইয়ুব বাচ্চুকে শেষের দিকে গান গাইতে দেখলে প্রচণ্ড মন খারাপ হত৷ একজন উৎপাদক শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছে, তবু টিকে থাকবার প্রয়োজনে প্রচণ্ড ঠাঁ ঠাঁ রোদে পুরনো পণ্য নিয়ে বসে আছে মার্কেটে। উৎপাদকের রিটায়ারমেন্টের বয়স থাকে না, সে মূলত ভোক্তা হারায় অন্য উৎপাদকের দাপটে। অনেকটা সন্ত্রাসী বা ডনগিরির নিয়তি। এক ডন নিহত হয় অন্য ডনের গুলিতে, শুরু হয় নতুনের রাজত্ব। উৎপাদক নিজের ভাণ্ডার ফুরিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা স্বীকার করে না৷ জমিদারি শেষ কবেই, কিন্তু রয়ে গেছে এটিচুড। কখন এবং কোথায় থামতে হয় সেই সিদ্ধান্ত এমনকি উৎপাদকের হাতেও থাকে না, মার্কেট হয়ে উঠে তার নেশা এবং আসক্তি উভয়ই। ফলে তার জন্য একটাই এসকেপ রুট- আকস্মিক মৃত্যু।
ভোক্তাকুল তাকে ঘিরে শোক উৎসবে মাতে, হারানোর হাহাকার বিরাজ করে, জীবিত উৎপাদকের চাইতে তার লাশ হয়ে উঠে অধিক মূল্যবান এবং আকর্ষণীয়৷
এই এনালজিতে দুটো প্রশ্ন আসতে পারে। প্রথমত, উৎপাদকেরও থাকে পরিবার-স্বজন, তাদের কষ্টটা কি উপেক্ষা করা যায়? দ্বিতীয়ত, কেবলমাত্র উৎপাদনই যদি বেঁচে থাকার প্রধান নিয়ামক হয় উৎপাদকদের ক্ষেত্রে কি মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে না, কিংবা কেউ উৎপাদন ক্ষমতা ফুরিয়ে ফেললে কি আত্মহত্যার পথ বেছে নিবে? যেমন শেন ওয়ার্নের কি উচিত ছিল খেলা ছাড়ার পরেই একটা সুন্দর দিন দেখে মরে যাওয়া, বা আইয়ুব বাচ্চু যখন আর পারছিল না গাইতে, সেও কি সুযোগ বুঝে ঝাঁপ দেয়া উচিত ছিল ১৯ তলা বিল্ডিং থেকে?
কিন্তু স্মরণে রাখা দরকার, প্রশ্ন দুটো আসছে কোন পারসপেক্টিভ থেকে৷ দুটোই ভোক্তা পারসপেক্টিভ থেকে। অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্ন বা চট্টগ্রামের আইয়ুব বাচ্চু মারা গেলে বরিশাল হিজলা উপজেলার তরুণ শিহাবের কী আসে-যায়। অথচ সে বিষন্ন, কারণ সে তাদের ভোক্তা৷ আইয়ুব বাচ্চুর সহপাঠী বা আত্মীয় অনেকেই মারা গেছে, আগামীতেও যাবে; শিহাব জানবেই না। জানলেও থাকবে নির্বিকার।
তাই ভোক্তার লেন্স দিয়ে উৎপাদকের ছবি তুললে সেটাও আদতে ভোক্তারই প্রতিচ্ছবি হবে।
কিছুদিন পূর্বে কে কে নাম এর এক ভারতীয় গায়কের মৃত্যু হলো ৫৪ বয়সে, কনসার্ট শেষ করে। কে কে এর নাম শুনেছি, গান শুনিনি, তাই উৎপাদক হিসেবে তার ট্রেন্ড সম্বন্ধে অবগত ছিলাম না। কিন্তু যখনই জেনেছি মৃত্যুর আগে সে কনসার্ট করেছে ২০-২৫ হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে, আমার প্রথম অভিব্যক্তিই ছিল- what a magnificent departure!
ছাত্রজীবনে যখন টেলিফিল্ম নির্মাণ করেছিলাম দুটো, তখন প্রায়ই ভাবতাম ফিল্মের প্রিমিয়ার চলছে বড় পর্দায়, দর্শক দেখছে, সেই সময়ে যদি মৃত্যু হত!
বই প্রকাশ পাওয়া শুরুর পর থেকেই স্বপ্ন দেখি জাহাজে হচ্ছে লেখক ইন্টারভিউ, জাহাজ গেল ডুবে, লাশ ভেসে হারিয়ে গেল, খুঁজেই পাওয়া গেল না। এর চাইতে সিম্বলিক মৃত্যু কি ২য়টি সম্ভব একজন উৎপাদকের পক্ষে! ৭৯ বয়সে কি পৃথিবীতে কন্ট্রিবিউট করার মতো ভাবনা বা ফিল্ম উৎপাদন সম্ভব? যদি হয় বাঁচা খারাপ না, নইলে অনাবশ্যক শরীর বহনের আবশ্যকতা কী! দেহেরও তো বিশ্রাম কিংবা পুনর্সজ্জা প্রয়োজন!
বারী সিদ্দিকীর যে গানটার রেফারেন্স দিলাম শুরুতে ওটা চ্যানেল আইয়ের একটা অনুষ্ঠানের ক্লিপিং, গান পরিবেশনের পূর্বে বারী সিদ্দিকীর ছোট্ট আলাপ আছে। সেসূত্রে জানি বারী সিদ্দিকী গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে বলছেন জীবনভর বাঁশি বাজিয়েছেন, ঘরে প্রচুর বাঁশি বিকল পড়ে আছে; মৃত্যুর পরে বাঁশিগুলো দিয়ে চাটাই বানানো যায় না?
তার চিন্তাটা প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে আমায়৷ উৎপাদনে লাগে সাধনা-অধ্যবসায়, সেটা করতে গিয়ে জীবনের বহু জায়গা থেকে সময় স্যাক্রিফাইস করতে হয়, আর্থিক স্বচ্ছলতাও আসে কদাচিৎ; কিন্তু মৃত্যু ঘাপটি মেরে বসে থাকে, যে কোনো মুহূর্তে ছো মেরে তুলে নিবে— এই বাস্তবতার সাথে বোঝাপড়া হয়ে গেলে বেদনাবিধুরতা তৈরি হয় মনের ভেতর৷ মূলত সেখান থেকেই তৈরি হয় মহাযাত্রার রোমান্টিকতা।
ক্যাপিটালিজম, সোস্যালিজম, কমিউনিজিম, ইনডিভিজুয়ালিজমসহ যতরকম ইজম আছে এবং আগামীর পৃথিবীতে আসবে তাতে ভোক্তার ধর্ম বদলালেও উৎপাদকের ধর্ম ইজমভেদে বদলায় না তেমন। ভোক্তার ভালোবাসা বা ভক্তি পাওয়াটা যেমন অপ্রত্যাশিত বা অব্যাখ্যনীয়, অনুরূপ সময়মত প্রস্থান নেয়াটাও এক ধরনের ডিভাইন ব্যালেন্সিং—- আর উৎপাদক এর লাইসেন্স যে একবার পেয়েছে সেই আনন্দময়তা থেকে সরে এসে নিছক ভোক্তা হয়ে বেঁচে থাকাটা তার জন্য যাবজ্জীবন কারাভোগেরই নামান্তর।
বারী সিদ্দিকীও চলে গেছেন প্রাকৃতিকতার সূত্রে, কিন্তু তার পণ্যের ভোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে কোথাও বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। কিন্তু হৃৎপিণ্ড সচল থাকলে এই একই গান হয়তবা টিভিতে লাইভ গাইতেন আরো কয়েকবার; দমে ঘাটতি, স্কেল মিলছে না অথচ গাইতে হচ্ছে৷
এই যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ কি ভোক্তাহৃদয় ধারণে সক্ষম কোনোদিন?
হে ঈশ্বর, আমার জীবনে অদ্যাবধি আনন্দই ধর্ম পরিব্রাজনই রিচুয়াল; মৃত্যুটাও সিম্বলিক হোক।