ছোটবেলায় চিত্রটা কেমন ছিলো মনে নেই, কিন্তু বয়স ২০ ছাড়ানোর পর এ জীবনে যে কথাটা সবচেয়ে বেশি শুনেছি মানুষের মুখে সেটা হলো, সময় নেই খুব ব্যস্ত আছি। এবং বিভিন্ন নাটক, সিনেমা, ব্লগ আর্টিকেল পড়াসূত্রে এটাও দেখি, মানুষ নাকি ভীষণ ব্যস্ত সবাই। ব্যস্ত, ব্যস্ত, আর ব্যস্ত। স্কুলের বন্ধুর সাথে দেখা হয় না, কারণ ব্যস্ততা; ঘনিষ্ঠজনের সাথে দেখা করার সময় হয় না, সেই ব্যস্ততাই কারণ। যেহেতু প্রচুরসংখ্যক মানুষের ইন্টারভিউ নিই, একটু সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কারো ইন্টারভিউ নেয়ার ক্ষেত্রে সবসময় যে বাধাটি ফেস করি, তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ত, কথা বলার সময় নেই। বিগত ১ বছরে ব্যস্ততা বিষয়ে ভাবলাম প্রচুর।

ব্যস্ততা বলতে আসলে কিছু নেই, কোনো মানুষই ব্যস্ত নয়, পুরোটাই প্রায়োরিটি। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের জীবনে একটা অদৃশ্য প্রায়োরিটি লিস্ট মেইনটেইন করি। সেই লিস্টে একজন মানুষ বা একটা কাজ কত নম্বরে অবস্থান করে তার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় একজন মানুষ কতটা ব্যস্ত বা ফ্রি। ধরা যাক, একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করতে যাবেন, কিন্তু সে এতোই ব্যস্ত যে ৭মিনিটি সময় দিতে পারবে না। এই মানুষটিই নিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একজন মন্ত্রীর জন্য বসে থাকবে হয়তো, তখন তার ব্যস্ততা কোথায় যায়? কারণ, প্রায়োরিটি লিস্টে মন্ত্রীর সাথে দেখা করাটা অনেক উপরের দিকে আছে। কিংবা আপনাকে আপনার ঘনিষ্ঠ কেউ দাওয়াত করলো, আপনি যেতে পারলেন না ব্যস্ততার কারণে। মূল ব্যাপারটা হলো, দাওয়াতের চাইতে ওই সময়ের কাজটির প্রায়োরিটি আপনার বেশি ছিলো। কারো প্রায়োরিটি লিস্ট অনেক দীর্ঘ, কারোটা ছোট, লিস্ট সবারই আছে।

প্রায়োরিটাইজ করাটা কি আসলেই জরুরী, কিংবা কিসের ভিত্তেতে প্রায়োরিটি নির্ধারিত হবে? এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই প্রায়োরিটাইজ করতে হবে, নইলে জীবন এলোমেলো বিশৃঙ্খলতার খোয়াড়ে পরিণত হবে। আমাদের অধিকাংশের জীবনেই যে ‘ভাল্লাগে না, লাইফ sucks’ টাইপ অনুভূতি কাজ করে, এর প্রধানতম কারণ আমাদের কাজ-কর্মের অর্গানাইজড প্রায়োরিটি ঠিক করা নেই, যখন যেটা মনে হয় করার চেষ্টা করি, ফলে খুব দ্রুতই ফ্যাটিগ বা প্যানিক হয়ে পড়ি। আপনাকে ২২৩ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো সারাদিন ঘুরে বেড়াও; আবোল-তাবোল কোথায় কতক্ষণ ঘুরবেন! আমাদের বেশিরভাগ মানুষই ওই ২২৩ টাকা হাতে নিয়ে এলোমেলো ঘোরাফেরা করা টাইপের। প্রায়োরিটি বিষয়ে তাই তর্কের কিছুই নেই।

কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, প্রায়োরিটি কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। যারা প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকেন বলে শোনা যায় বা নিজেরা গুঞ্জন ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের প্রায়োরিটির ভিত্তি হলো গেইন বা বেনিফিট। ধরা যাক, অফিসের ব্যস্ততার জন্য আপনার বন্ধুটি দাওয়াতে আসতে পারলো না, এক্ষেত্রে অফিস প্রায়োরিটি পেয়েছে, যেহেতু সেখান থেকেই তার জীবিকার সাপোর্ট আসে। বা অমুক গ্রুপের জিএম এর এপোয়েন্ট পাচ্ছেন না, কারণ আপনার সাথে কথা বলে জিএম এর তেমন কোনো গেইন বা বেনিফিট নেই। যদি থাকতো, তাহলে তার প্রায়োরিটি লিস্টের অন্য কাজগুলোকে ওভারটেক করে আপনি ঢুকে যেতে পারতেন।

গেইন বা বেনিফিট কি সবসময় অর্থনৈতিক? হয়তো, হয়তো নয়। তবে অতিরিক্ত ব্যস্ত হিসেবে যাদের চিনি বা জানি আমরা, তাদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই অর্থনৈতিক মানদণ্ডে হয়ে থাকে। কাজটা করলে মনে তৃপ্তি পাবো, একারণে সেটা প্রায়োরিটি লিস্টে উপরে, এই এনালজি দাঁড় করানোটা তথাকথিত প্র্যাকটিকাল লাইফে লুজার বা আনফিট সিম্পটম।

তবে তথাকথিত প্র্যাকটিক্যাল লাইফের নিয়ন্তাদের জন্য দুঃসংবাদ হলো, এই এপ্রোচ আর খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না তারা। পৃথিবীজুড়ে মোটিভেশনাল স্পিকার পেশাটা এখন প্রেস্টিজিয়াস হয়ে উঠছে, মেন্টাল হেলথ বিষয়ে কথা হচ্ছে, সেমিনার হচ্ছে। এসব দেখে অনুমান করা যায়, ফরমাল-প্রফেশনাল-অপরটুনিস্ট-অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ার-ডেকোরাম প্রভৃতি চটকদার শব্দগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে শীঘ্রই, কারণ এসব আর চলছে না, চলবেও না; অনেকেই সেটা বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু মানতে পারছেন না কমফোর্ট জোন ভেঙ্গে যাবার ভয়ে। ‘be casual, live casual’- এই থিওরিই রাজ করবে আগামীতে, তারপর ৯৭ বছর রাজত্ব শেষে পুরোনো হয়ে যাবে, তখন দরকার পড়বে নতুন এপ্রোচের। এভাবেই প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলাতে হয়, নিয়ম বদলাতে হয়, এবং সিস্টেম বিবর্তিত হতে হয়। ১৩ বছর পরেও যদি একটা সিস্টেম একইরকম থাকে, তার মানে সেটা স্থবির হয়ে পড়েছে, থাকা না থাকা একই কথা।

ক্যাজুয়াল এপ্রোচ প্রসঙ্গে একটু লিখি। যারা প্রচণ্ড ব্যস্ততার ভান করে তারা আসলে সচরাচর স্থবির মানুষ, যাদের তেমন কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি, এবং প্রোডাক্টিভিটি শূন্যের কাছাকাছি। প্রোডাক্টিভ মানুষের প্রধান লক্ষণ সে অলয়েজ ফ্রি, যত কাজই থাকুক, কখনো সেটার দোহাই দিবে না। ব্যস্ত ব্যস্ত খেলায় মগ্ন থাকা মানুষেরা নিজেদের প্রকাশ করতে ভয় পায়, অন্যের সাথে ইন্টারেক্ট করতে অনীহা বোধ করে, কারণ তার/তাদের ব্যক্তিগত জীবনে শক্ত কোনো ফিলোসফি নেই, ট্রান্সমিট করার মতো ভিশন নেই; অন্যদিকে সমীহ পেতে, এটেনশন আদায় করতে ব্যস্ততাকে ঢাল হিসেবে উপস্থাপন করবে।
ব্যস্ততা আদতে একটি মানসিক ব্যাপার। যারা মনে করে প্রচণ্ড ব্যস্ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মেন্টাল ব্লক কাজ করে, ফলে বাড়তি কিছু নেয়ার ক্ষেত্রে বারডেন বা বোঝা মনে হয়। আশপাশে যত ব্যস্ত মানুষ দেখছেন তাদের শুধু একটা সিম্পল প্রশ্ন করুন- লাস্ট ৩ মাসে আপনি সিগনিফিক্যান্ট কোন্ কাজটা করেছেন? ১০ জনের মধ্যে ৭ জনই সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারবে না, অথচ তারা ব্যস্ত।

আমরা ব্যস্ত ভাবতে এবং ব্যস্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে গর্ব বোধ করি, মনের ভেতর কোথায় যেন ‘দেখিয়ে দেয়ার বা জাহির করার’ মনোভাব কাজ করে। এই আরোপিত ব্যস্ততাই আমাদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস। আমাদের কমন পারসেপশন বলে, বড় কোম্পানীর এমডি মানে যে সে লোক নয়, তার সাথে এক কাপ চা খাওয়া মানে বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার, যে ব্যস্ত মানুষ, একটু কথা বলেছেন- সবার সাথে কি বলে! একজন নামকরা ডাক্তার মানে তার ৫ জন এসিসটেন্ট থাকবে, তারাই সব হিস্টরি লিখবে, ডাক্তার সেগুলো দেখে টেস্ট দিবে অথবা ওষুধ লিখে দেবে, এবং অন্তত ৪৭ দিন আগে তার সিরিয়াল নিতে হবে, বছরের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থাকেন; এতোই ব্যস্ত একজন মানুষ সে। সুতরাং আমি অন্যের চোখে কতোটা বড় সেটা নির্ভর করছে আমি আসলে কোন্ স্ট্যাটাস বিলং করি এবং আমার ব্যস্ততার পাল্লা কতটা ভারি। এরকম মাইন্ডসেট যখন সমাজের মেজরিটি মানুষের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়, এবং এই তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে রিয়েল লাইফ এক্সপেরিয়েন্সগুলোই প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, তখন প্রোডাক্টিভ মানুষ তৈরি হওয়াটা যেমন অবাস্তব, সিস্টেম লসটাও অনিবার্য পরিণতি।

খোশগল্প বা আড্ডাকে আমরা বরাবর খারাপ দৃষ্টিতে দেখি; কারো সঙ্গে ১১ মিনিট কথা বললে ৯মিনিট ৫৩ সেকেন্ড যদি বৈষয়িক আলাপ না থাকে সেটাকে কনস্ট্রাকটিভ আলোচনা বলা যাবে না, সেটা হয়ে যাবে খেজুরে আলাপ। ফলে আমরা আরেকজনের সাথে কথা বলি তাকে জানা বা বোঝার উদ্দেশ্যে নয়, নিজেকে বেশি বেশি করে জানাতে, যে কারণে আমাদের সোসাইটিতে আড্ডা শব্দটাকে এতো নেগেটিভ সেন্সে দেখা হয়। ২ ঘণ্টা আড্ডার যে এনার্জি, সেটার প্রভাবে ৩ ঘণ্টার কাজ যে ১ ঘণ্টায় করে ফেলা যায়, এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটাই ধরার চেষ্টা করা হয় না। একটা কমন উদাহরণ বহু জায়গায় বহুবার দিই আমি। একটা বিল্ডিং নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ার কতটুকু কাজ করে, আর রাজমিস্ত্রি কতটুকু? এজন্য ইঞ্জিনিয়ারকে কত টাকা দেয়া হয়, আর রাজমিস্ত্রী কত পায়? অথচ রাজমিস্ত্রির মনোজগতে ইঞ্জিনিয়ার সারাজীবন আনপ্রোডাক্টিভ এবং অতিমূল্যায়িত একজন হয়ে থাকবে, কারণ দিনভর শ্রম তো রাজমিস্ত্রিই দিচ্ছে। আমরা ব্যস্ততা বলতে রাজমিস্ত্রী হওয়া বুঝতে চাই, ইঞ্জিনিয়ারের রোলটা উপলব্ধি করতে চাই না। ঠিক একারণেই আমাদের সবকিছুতে এফিশিয়েন্সি লস আর কোয়ালিটি ক্রাইসিস এতো বেশি। ব্যস্ততার সংজ্ঞা আগে পাল্টাতে হবে; এটা শেষপর্যন্ত থিওরিই থেকে যাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত ১ জন আপাত ব্যস্ত মানুষও এই রাজমিস্ত্রী প্রিভিলেজড মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে না আসবে।

বারট্রান্ড রাসেল এর ‘আলস্যের জয়গান’ আর রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’- একজন মানুষ জীবনে যদি মাত্র এই দুটো বই খুব গভীরভাবে চিন্তা করে অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পড়ে, তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য সেটাই যথেষ্ট। জীবনে ৪৩২৩টা বই পড়ে ক্রেডিট নেয়ার চাইতে মাত্র ৭টা বই ইনকিউজিটিভ মন থেকে পড়ুন, সেটার ইমপ্যাক্ট অনেক বেশি হবে। বিশেষত রাসেলের ‘আলস্যের জয়গান’ যতবার পড়বেন ততবারই মনে হবে কী সব ফালতু কাজে সময় নষ্ট করছি, এবং তুচ্ছ বিষয়কে এতো হাইলি প্রায়োরিটি সম্পন্ন মনে করছি। আমরা অলসতা শব্দটাকে বরাবরই ভুলভাবে ভাবি। কিছু মানুষ আছে যারা কাজ করতে পছন্দ করে না, কর্মস্পৃহা শূন্যের কোঠায়, শুধু শুয়ে-বসে আরাম করতে চায়, এবং ইন্দ্রিয়বিলাসের মধ্য দিয়ে সময় পার করে দেয়। এরকম অকর্মণ্য মানুষের সংখ্যা অজস্র, কিন্তু আমরা তাদের অলস বলি না সচরাচর; আমরা অলস বলি সেইসব মানুষকে যারা ভাবুক প্রকৃতির, কিংবা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। ফলে অলস সংক্রান্ত কনসেপ্টেই আমাদের বিরাট গ্যাপ রয়ে গেছে। ভাবুক প্রকৃতির মানুষ অনেক বেশি প্রোডাক্টিভ। একটা সিম্পল টেস্ট করতে পারেন। আপনি ২ ঘণ্টা বসে বসে চিন্তা করবেন, আর ২ ঘণ্টা দৌড়াদৌড়ি করবেন; দেখবেন ২ ঘণ্টা চিন্তা করে অনেক বেশি ক্লান্ত বোধ করছেন। তাই ভাবুক প্রকৃতির মানুষকে কাজে লাগানো গেলে তারা ফাটাফাটি আউটপুট দিতে পারে। অন্যদিকে চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া বা কেরম খেলে সময় কাটানো মানুষগুলোই দারুণ প্রোডাক্টিভ হতে পারে, কারণ তার মন ফ্রেশ। ফাইলের মধ্যে মুখ গুজে রাখা, কিংবা ক্রমাগত মিটিং চালিয়ে যাওয়া মন ফরমালিনমিশ্রিত, সেটার ইউটিলাইজেশন খুব বেশি বাকি নেই। এজন্যই টানা ৬ মাস কাজ করার পর অন্তত ২০-৩০ দিনের ছুটিতে থাকা উচিত। যে কোনো বিচ্যুতিই আবার নতুনভাবে শুরু করার অনুপ্রেরণা দেয়। ক্রিকেট খেলা দেখলে এটা আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। যে কোনো ড্রিংকস ব্রেকের পর সাধারণত উইকেট পড়ে, কিংবা ব্যাটসম্যান নতুন করে সেট হওয়া চেষ্টা করে। এখান থেকে জীবনের বড় একটা লারনিং পাওয়া যায়। ব্যস্ত বলতে কিছু নেই, সে শুধুই ঢঙের আরেক রঙ!

ব্যস্ত থেকে বাস্তব, সেখান থেকে বস্তু। আমরা ব্যস্ততার অজুহাতে কোন ক্ষণে মানুষ থেকে বস্তু হয়ে উঠি টেরই পাই না, বা আমাদের বোধ অনেক আগেই ভোঁতা হয়ে যায়। আমাদের এতো ব্যস্ততার টার্গেট বা পারপাস কী; বিত্তশালী হওয়া? আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে তা-ই, কিন্তু একথা সর্বাংশে ভুল। আমরা টাকার মোহে পড়ি মোটেই বেটার জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে নয়, অন্যের সালাম বা সমীহ পাওয়ার আশায়। দুর্ভিক্ষ বাদে অন্য কোনো সময় খাবারের অভাবে মারা গেছে এই সংখ্যাটা কতো? দেশে এতো বেকার বলে শুনি,টাকাই যদি কারণ হতো তাহলে তো এদের বড় অংশ না খেয়ে মরতো; কষ্টশিষ্টে সবাই বেঁচে থাকে কিন্তু।আমরা কষ্টে থাকতে ভয় পাই, এখান থেকে শুরু; তারপর একসময় বিলাসবহুলতার প্রতি আকর্ষণ জমে এবং একটা নেভার এন্ডিং গেম এ পরিণত হয়।আপনার একটা ফোনে কাজ হয়ে যায়, এরকম প্রভাবশালী একজন হওয়াই আলটিমেট টার্গেট, এবং আপনি মনে করেন প্রচুর টাকা হলেই কেবল সেরকমটা সম্ভব।অর্থাৎ, টাকা নয় পাওয়ার বা ক্ষমতাই মূল ফ্যাক্টর। এটা আরও বোঝা যাবে, আরেকটা উদাহরণ দেখলে। কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক,শিল্পী এরা কি প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক? তবু তাদের এতো ইনফ্লুয়েন্স কেন, কিংবা বাংলা লিংকের বিজ্ঞাপনে কবি নির্মলেন্দু গুণকে মডেল করা হয়েছে কেন? এখান থেকেই বুঝতে পারবেন, টাকার ফ্যাসিনেশনটা ভ্রান্ত, মূল বিষয় ইনফ্লুয়েন্স আর ইমপ্যাক্ট।এটা সব মানুষের মধ্যেই কাজ করে; কেউ সেই টার্গেট পূরণের জন্য টাকার দিকে ছোটে, কেউ প্রতিভা বা ট্যালেন্টের দিকে ছোটে। কিন্তু টাকা দিয়েই যেহেতু বাসার বাজার হয়, হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ, স্কুলের বেতন দিতে হয়, তাই প্রতিভাচর্চার চাইতে টাকাটাই নিরাপদ অপশন মনে হয়। এবং সেখান থেকেই ব্যস্ততার মিথের জন্ম হয়।

আপনি তো অনেক ব্যস্ত; ছোট্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে পারেন। ধরা যাক, আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ একজনকে কোনো কারণ ছাড়াই ২৩ হাজার টাকা দিলেন।এবং সেই একই মানুষকে নিয়ে আরেকটা কাজ করলেন। তার পরিচিত ২৩ জন মানুষকে বললেন তাকে জন্মদিনে ফোন করে উইশ করতে এবং প্রত্যেকে কুরিয়ার করে ১টা ৩ লাইনের চিঠি আর ১ পিস কামরাঙা পাঠাবে, এবং পুরো আয়োজনের পেছনে আপনি আছেন এই কথাটিও প্রত্যেকে জানাবে। সেই লোকটি চরম ব্যস্ত, বস্তুবাদী, ক্যারিয়ারিস্টিক যেমনই হোক, মাত্র ১ বছর পরে তাকে জিজ্ঞেস করুন তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কী, ১০০ ভাগ ক্ষেত্রে ফোন করা আর কুরিয়ারে গিফট-চিঠি পাঠানোটাই বলবে, আপনি ২৩ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সেটা বলবে না। কিন্তু ঘটনা ঘটার ১৭ দিন পরে জিজ্ঞেস করুন, তখন প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে ২৩ হাজার টাকার ঘটনাটাই বলবে, অথচ ১বছর পরে সেটা মনেও থাকবে না। ওই গিফট পাঠাতে আর ফোন করতে আপনার ১হাজার টাকাও খরচ হবে না কিন্তু। তাহলে স্মরণীয় ঘটনা হবে কেন? কারণ ২৩ জন মানুষ তাকে প্রায়োরিটি দিয়েছে, এটাই তার অবচেতন মন তাকে কনভিন্স করবে। অথচ, আমরা ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে জীবনের কী অদ্ভুত সরল ফিলোসফিটাই ভুলে যাই।

একটা কথা আমি প্রায়ই বলি- ‘তিলের পেছনে তিমি’। আমার কাছে এটাকে অত্যন্ত পাওয়াফুল একটা লাইন মনে হয়।আমরা ক্ষুদ্র পরিসর আর সাময়িক প্রাপ্তিকে বড় করে দেখতে গিয়ে বুঝতেও পারি না এর বাইরে কত প্রকাণ্ড এক জগত আর প্রাপ্তির সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, আমরা এক্সপ্লোর করতেই অনীহা বোধ করি। ফলে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবন তিলের ব্যবচ্ছেদ করেই নিঃশেষিত হয়ে যায়, তিমির দেখা আর মেলে না।

হারমান হেস এর ‘সিদ্ধার্থ’ বইটা এক্ষেত্রে আরেকটা চরম উদাহরণ। সিদ্ধার্থ বলেছিলো, ‘আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারি, আমি অপেক্ষা করতে পারি’।একজন মানুষের মোটিভেটেড হওয়ার জন্য সিদ্ধার্থের এই একটা লাইনই যথেষ্ট। কষ্টসহিষ্ণুতা আর ক্রাইসিস থেকেই একজন মানুষ বৃহৎ জীবনের সাথে কানেক্টেড হয়। যার জীবনে ২৯টা ব্যর্থতা নেই, সে জীবনের মানেই বোঝেনি। যে মানুষ ধৈর্য ধরতে পারে এবং না খেয়ে থাকার ভয় করে না,তাকে হয়তোবা ৭ বছর আটকে রাখা যাবে, কিন্তু ৮ম বছরে গিয়ে সে তার গন্তব্যে পৌঁছুবেই। আমাদের সবসময় তাড়া; যেন ট্রেন ধরতে হবে, বাস চলে যাচ্ছে। আসলে তো আমাদের কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করারও নেই। স্রেফ নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের তাগিদে ব্যস্ততার নিখুঁত অভিনয় আছে।

ব্যস্ততার এই জিঞ্জির ভাঙার একটাই উপায়, নিজেকে ভ্যালুয়েবল বানানো। সেটা করতে পারলে অন্যের প্রায়োরিটি লিস্টেও অবলীলায় ঢুকে পড়া যাবে, কেউ আর বলবে না অমুক স্যার খুব ব্যস্ত আছেন। নিজস্ব গাড়ি না থাকলে কিছুই হয় না,এপার্টমেন্ট থাকাও তেমন জরুরী নয়, কিন্তু অন্যের প্রায়োরিটি লিস্টে ঢোকাটা অতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায়োরিটি লিস্টে ঢুকতে হলে নিজেকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। নির্বিচারে সবার প্রায়োরিটি লিস্টে ঢোকার টার্গেট থাকলে এফডিসির গেটেও ঢোকা হবে না, আপনি নিজে যে ফিল্ডের মানুষ, যেখানে ইন্টারেস্ট আছে, সেই সংক্রান্ত মানুষগুলোর প্রায়োরিটি লিস্টে ঢুকতে হবে।তাই হাতি-ঘোড়া না মেরে,রাষ্ট্র-রাষ্ট্রক্ষমতার বংশোদ্ধার না করে নিজের প্রায়োরিটি লিস্ট ঠিক করুন। এবং অতি অবশ্যই ব্যস্ত মানুষ না হয়ে ক্যাজুয়াল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করুন।চলতে চলতে একদিন হয়তোবা সন্তুষ্টির আনন্দ পাবেন। ব্যস্ততার বস্তাপচা প্রলোভন থেকে জীবন মুক্তি পাক, বিকশিত হোক বোধ।

let your soul fly