শুরুতে দুটো ডেটা উল্লেখ করতে চাই, যার প্রভাবে এই লেখার অবতারণা
১. বুয়েটছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে অন্তত ২০০ জন মানুষের অভিন্ন ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল- ‘ভাগ্যিস বুয়েটে পড়ি নাই’। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ৫০০০ মানুষ, সেখান থেকে আনুমানিক ২০০ জন মানে ৪%; স্যাম্পল সাইজ অনুসারে ৪% কে নগণ্য বলার সুযোগ নেই। আমি অনেকটাই নিশ্চিত, সেই ২০০ জনের মধ্যে বড়োজোর ২০ জন পাওয়া যাবে যাদের বুয়েটে পরীক্ষা দেয়ার যোগ্যতা হয়েছিল, এবং সেই ২০ জন থেকে হয়তোবা ২জনও পাওয়া যাবে না যারা ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।
একই ঘটনায় অগণিত মানুষের স্ট্যাটাস পড়েছি- ‘বুয়েট শুনলেই একসময় শ্রদ্ধা চলে আসতো’– তার মানে এখন আর শ্রদ্ধা আসে না। যে শ্রদ্ধা খুব দ্রুত চলে যায় তা আদতেই শ্রদ্ধা কিনা সেটা সংশয়যোগ্য রয়েই যায়।
খুনটা বুয়েটে হয়েছে বলে বুয়েটের নাম এসেছে, ঘটনা মেডিকেলে ঘটলে কেবল নামটা বদল হতো। অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানে খুন হলে তখন কেবলমাত্র খুনটা নিয়েই কথা হতো, প্রতিষ্ঠান নিয়ে শোরগোল হতো না সম্ভবত।
এই ঘটনার সরলতম এন্টারপ্রেটেশন হলো, হিংসা আর হীনম্মন্যতা থেকেই বিরোধীতার সূচনা। এই এন্টারপ্রেটেশনে চার্ম, স্পার্ক কিছুই পাচ্ছি না। পথ দিয়ে হেঁটে চলা যে কোনো মানুষই এরকম এন্টারপ্রেটেশন দিবে। বরং এন্টারপ্রেটেশনের বিকল্প কোনো ব্যাখ্যা বা পর্যবেক্ষণ তৈরিতে আনন্দ পাওয়া যেতে পারে।
২. যখন কোনো সিনিয়র বুয়েটিয়ান, যিনি দেশে সেটেল করেছেন এবং চাকরি করছেন, এর ইন্টারভিউ করি ৮০% ক্ষেত্রে একটি মতামত পাই- ‘অফিসের নন-বুয়েটিয়ান কলিগরা তার/তাদের প্রতি কিছুটা ঋণাত্মক মনোভাব দেখায়, মানসিকতায় বিশাল ব্যবধান, বুয়েটের ছেলেরা দেশে থাকলে কারো অধীনে চাকরি না করে নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার চ্যালেঞ্জ নেয়া উচিত’।
অন্যদিকে বুয়েটিয়ান যারা উদ্যোক্তা হয়েছেন এরকম ২০-২২ জনের সাথে ইন্টারভিউকালে নিজেদের কোম্পানীতে বুয়েট গ্রাজুয়েট রিক্রুট না করা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাই- ‘বুয়েটের ছেলেদের ভাব বেশি, কমিটমেন্টের ঠিক নাই। চাকরিতে ঢোকার কিছুদিন পর থেকেই বাইরে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে, তারপর বাইরে চলে যায়। যারা থেকে যায় তাদের বেশিরভাগই টিমওয়ার্কে দুর্বল। তাছাড়া ওদের ডিমান্ড অনেক বেশি, ওদের চাইতে কম বেতনে অন্য ভার্সিটির গ্রাজুয়েট রিক্রুট করেও একই কাজ ভালোমতো করিয়ে নেয়া যায়। বুয়েটিয়ানরা বরং মাল্টিন্যাশনাল আর বড়ো ব্রান্ডের পেছনে বেশি ছোটে।
নন-বুয়েটিয়ান চাকরিজীবী এবং উদ্যোক্তা মিলিয়ে প্রায় ১৫০ জন মানুষের ইন্টারভিউ নেয়ার সুযোগ ঘটেছে। ইন্টারভিউ যেহেতু দেড়-দুই ঘন্টা বা তারও বেশি সময় ধরে চলে, বিচিত্র প্রসঙ্গের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাকগ্রাউন্ডও চলে আসে অনেক সময়। সেইসব আলোচনায় যা পাই তার সারমর্ম- ‘বুয়েটের ছেলেদের সাথে এক্সপেরিয়েন্স সুখকর নয়, তারা নিজেদের বিশাল জ্ঞানী মনে করে, গুগল বা মাইক্রোসফট ছাড়া অন্য কোম্পানীকে গুনে দেখে না, অন্যদের তাচ্ছিল্য করে’।
‘বুয়েটের ছেলে’ শব্দটাতেই হোঁচট খাই। মেডিকেল বা অন্যান্য ভার্সিটির ক্ষেত্রে স্টুডেন্ট বা ছেলে-মেয়ে শব্দটি ব্যবহৃত হয়, বুয়েট বা টেকনিকাল ভার্সিটির ক্ষেত্রে ‘ছেলে’ই চলে আসে বারবার।কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট একসময় বিআইটি থাকায় এখনো অনেক সিনিয়র খুলনা বি আইটি বা রাজশাহী বি আইটি সম্বোধন করে থাকে। (এটাও একটা ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ হতে পারে)
মাত্র ১৫ বছর আগেও বুয়েটে ছেলে-মেয়ে অনুপাত যথেষ্ট একমুখী ছিল, তার আগের অনুপাতের অবস্থা বলা বাহুল্য। সাম্প্রতিককালে টেকনিকাল লাইনে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও অনুপাতের দিক থেকে এখনো ছেলেদেরই আধিপত্য। সম্ভবত একারণেই একটা সরল সামাজিক এন্টারপ্রেটেশন- ‘ছেলে রেজাল্ট ভালো করলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, মেয়ে করলে মেডিকেলে’।
২য় ডেটাকে এন্টারপ্রেট করলে- অতিসরলীকরণ প্রবণতার ব্যাপারটাই সর্বাগ্রে স্থান পাবে।
বুয়েটে প্রতি ব্যাচে গড়ে যদি আনুমানিক ৭০০ জন গ্রাজুয়েশন করে ( ল্যাগের কারণে প্রতি ব্যাচেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ব্যাচের সাথে গ্রাজুয়েশন করতে পারে না ধরে নিচ্ছি।), তাদের মধ্যে কতজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার্থে বাইরে যায়?
বুয়েটের সংখ্যাধিক্যের ডিপার্টমেন্ট ৪টি- ইলেকট্রিকাল, সিভিল, কম্পিউটার সায়েন্স এবং মেকানিকাল। কেমিকাল, ওয়াটার রিসোর্স, মেটালারজি, আরবান প্ল্যানিং, নেভাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল, আর্কিটেকচার। (আমরা বুয়েটে পড়াকালে বায়োমেডিকাল ডিপার্টমেন্ট ছিল না)
ডেটা দিয়ে চিন্তা করলে দেশের বাইরে যাওয়ার তালিকা করলে- সিএসই, ইইই, এমই, এমএমই, নেভাল— এই ৫টি ডিপার্টমেন্টে পারসেন্টেজের দিক থেকে এগিয়ে থাকবে। অন্য ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরাও দেশের বাইরে পড়তে যায়, পারসেন্টেজের দিক থেকে কিছুটা কম। আমাদের ক্লাসে ৩৮ জনের মধ্যে ১৭ জন বিদেশে গিয়েছিল, ২ জন ফিরে এসেছে, আরো ২ জনের ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, তবু প্রবাসী সংখ্যা ১৫জন ধরলে তারা সামষ্টিকের ৩৯.৪৭% ( তার মানে ৪০-৪৫% এর মধ্যেই থাকবে)। বৃহত্তম ডিপার্টমেন্টগুলোতে ৪০% তোলা মানে সংখ্যাতেও বিশালত্ব।
বর্তমানে সরকারি চাকরি যেহেতু লোভনীয়, এটা হয়তোবা পারসেন্টেজে প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে তথ্যের সহজলভ্যতা, টাকার অবমূল্যায়ন, এবং ইমিগ্রেশন বৃদ্ধি প্রভৃতি নিয়ামক মিলিয়ে সামগ্রীকভাবে বিদেশগামী বুয়েট শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হয়তোবা ৪০% এর আশপাশেই রাখবে। ৫০% অতিক্রম করার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
আমাদের পরিচিত ৫-৭ জন দেশের বাইরে গেলেই ধরে নিই অধিকাংশই বোধহয় বাইরে চলে যাচ্ছে।বিশেষত সিএসই আর ইইই এর বাইরে যাওয়ার হার বেশি হওয়ায় (তবুও ৫০% হওয়ার সম্ভবনা কম। ইইই এর এক ব্যাচে ৯০ জন, সিএসই এর ৬০ জন গেলে ৫০% বলা যাবে। যেহেতু ২টা বা ৩টা সেকশন থাকে বৃহত্তর ডিপার্টমেন্টগুলোতে, একই ডিপার্টমেন্টের সবাইকে চেনা দুরূহ। তাই ৫০% বা ৬০% হিসাব করাটাও কঠিন। তবু এক ডিপার্টমেন্টের একটা ব্যাচ থেকে ৯০ জন বাইরে গেছে, এটা হওয়ার সম্ভাবনা কম)
বুয়েটের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী বাইরে যায় এটা কি তবে মিথ? যদি হয় তার ভিত্তি কী? সম্ভবত বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বাইরে যাওয়ার হার বেশি হওয়াতেই ‘অধিকাংশ’ বিশেষণটা জুড়ে বসেছে। ৬০% শিক্ষার্থী যদি দেশে থেকে যায়, তাদের জীবনযাপন কেমন সেটা একটা ইন্টারেস্টিং গবেষণা হতে পারে।
তবু বুয়েট-বিরোধীতা বিষয়ে এখনো কংক্রিট কোনো বক্তব্য দিতে পারিনি। চেষ্টা করা যাক।
***
আবরার হত্যাপরবর্তী আন্দোলনকালে নাট্যজন এবং প্রাক্তন বুয়েটিয়ান আবুল হায়াতের বক্তব্যের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। তার বক্তব্যে আবেগ এবং অনুভূতি দুটোই ছিল। তবে বক্তব্যে খুবই সাংঘাতিক একটি লাইন ছিল যা অন্য অনেক লাইনের ভিড়ে বোঝা যায়নি হয়তো।
তিনি বলেন- ‘আমরা বলতাম বুয়েট একটি দ্বীপ। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, এখানে পড়াশোনা, সাংস্কৃতিক চর্চা সবকিছু চলেছে, আমরা আন্দোলন করতাম পরীক্ষা পেছানো নিয়ে, ভিসি আমাদের দেখে হাসতেন, কারণ আমরা তার সন্তান। অথচ বর্তমান ভিসি……’
এই লাইনের দুটো সমস্যা
১. সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আবুল হায়াতের আদলেই চিন্তা করে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি ক্রমাগত অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের। এর কারণ হিসেবে মানুষজন রোহিঙ্গাদের দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন অপকর্ম এবং তাদের ঘিরে একটি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক অভিসন্ধি পূরণকেই প্রধান করলেও এগুলো পার্শ্বকারণ, মূল কারণ কখনোই নয়। মূল কারণ they don’t belong to this land— এই অনুভূতি সামষ্টিক মনোভাবের প্রতিনিধি হয়ে উঠে। আপনার বাড়িতে একজন অতিথি কতদিন থাকতে পারে; ১০-১২ দিন পার হয়ে গেলেই আতিথ্য যন্ত্রণায় পরিণত হয়। কিংবা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের ক্লাসিকাল কেইসটাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। পাহাড়ি আর সমতলের মানুষের মধ্যকার যে কনফ্লিক্ট, সেটাও সামনে আসতে পারে। সকল কনফ্লিক্টের রুটকজ ‘দ্বীপ থিওরি’। যখনই আপনি দ্বীপবাসী ভাববেন, আপনার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠই বিমুখ হবে। তারা ভাববে, তাদের প্রাপ্য জায়গা, হক আপনার সাথে শেয়ার করছে, আপনি না থাকলে সে আরো বেশি ভোগ করতে পারতো। আপনি কতটা যোগ্য, সে নিজে কীরকম অযোগ্য সেই ভাবনা তার মাথায় কাজ করে না।
গতকাল হিউম্যান ল্যাব এর পারসোনাল এসেসমেন্ট সার্ভিস নিতে আসে এক তরুণ। দীর্ঘ আলাপচারিতায় জানতে পারি স্কুলে পড়াকালে সে দলীয় রাজনীতি করতো; মারামারি, কোপাকুপি প্রায় নিত্যদিনকার কার্যক্রম ছিল। নিজে বহুবার কুপিয়েছে, নিজেও কোপ খেয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করি, কোপালে মরে যাবে জানা সত্ত্বেও কোপাতেন কেন, খুন করার আগে কোনো ভাবনা কাজ করেনি? সে বলে- আসলে ভাইয়া মারামারির সময় অতকিছু খেয়াল থাকে না। ওই ছেলে আমার বন্ধু অথবা সিনিয়র ভাইয়ের সাথে বেয়াদবি করেছে, ওরে আঘাত করতে হবে। হাতের কাছে যা পাই তা দিয়েই আঘাত করবো এটাই মাথায় থাকে, রাম দা নাকি বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করছি খেয়াল থাকে না, এমনকি মারলে যে মরে যেতে পারে সেটাও মনে থাকে না। একটাই জেদ কাজ করে– আঘাত করতে হবে’।
উদাহরণটি দিলাম, দ্বীপ থিওরি সংক্রান্ত কনফ্লিক্টের মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে সহায়িকা হিসেবে।
২. বুয়েটের ছেলেরা আন্দোলন করে পরীক্ষা পেছানোর উদ্দেশ্যে, এটা অত্যন্ত বাজে এক নির্দেশক। ২০০৬ এবং ২০১০ সালের দুটো ফুটবল বিশ্বকাপ পেয়েছি আমরা। পরীক্ষা পেছানো আন্দোলন দমাতে প্রথমবার হলে পুলিশ এসেছিল, ছাত্রদের সাথে সংঘর্ষ বেঁধেছিল, যার ফলশ্রুতে হল ভ্যাকেন্ট।পরীক্ষা পেছানো নিয়ে আরো একবার সিনিয়র-জুনিয়র মারামারি বেঁধেছিল, হল ভ্যাকেন্ট। পরীক্ষা পেছানো বিষয়ে বহুজন বহুভাবে লিখেছে, কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে এরকম মিনিংলেস এক কাজে বুয়েটের ছেলেপুলে আন্দোলন করতে পারে, হল ভ্যাকেন্ট হতে পারে— ব্যাপারগুলো কেমন হাস্যকর লাগে।
***
আমাদের দেশ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য কখনোই অবকাঠামোগতভাবে সমৃদ্ধ ছিল না। কয়েকজন ইন্ডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্টের জন্ম হয়েছে হয়তো, কিন্তু সামগ্রীকভাবে চিন্তা করলে ইঞ্জিনিয়ারিং ইকোসিস্টেম এবং কালচার কখনোই সেভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না।
তবু নির্বিচারে আমরা ছোটবেলায় যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, সেই চাওয়াটা তৈরি হলো কীভাবে?
ডাক্তার হতে চাওয়ার তবু একটা সামাজিক কারণ থাকতে পারে। ডাক্তারি মহান পেশা, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা করতে পারবে, চাকরি না পেলেও প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করা যাবে — এরকম বাতাবরণে বহু শিশুকেই আকৃষ্ট করা যেতে পারে ডাক্তার হতে। আমি ইন্টারে কেন বায়োলজি বাদ দিলাম, সেই অভিযোগ এবং অনুতাপ এখনো পর্যন্ত আমার মা বহন করে চলেছেন, যখনই আর্থিক সংকটে পড়ি কলেজজীবনে বাদ পড়া বায়োলজি সামনে চলে আসে।
ডাক্তার হতে চাওয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড তবু বোধগম্য খানিকটা, ইঞ্জিনিয়ারিং কেন? বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং পটেনশিয়ালিটি তো বড়জোর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পর্যায়ের। বুদ্ধিমান ছেলেরা কেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঝুঁকে?
মৌলিক অধিকারের মধ্যে দুটো শ্রেণি করলে এর একটা আপাত অনুমান মডেল তৈরি করা যেতে পারে। এক শ্রেণিতে থাকবে- অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা; অন্যটাতে- বাসস্থান এবং চিকিৎসা। শ্রেণি দুটোকে পর্যালোচনা করলে কৃষিপ্রধান অর্থনীতি ( অন্ন), গার্মেন্টস সেক্টর (বস্ত্র) এবং শিক্ষা ব্যবসা ( কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি) এর সম্প্রসারের ব্যাখ্যা যেমন পাওয়া যায়, অনুরূপ চিকিৎসা ( ডাক্তার) আর বাসস্থান ( ইঞ্জিনিয়ার) দিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ফ্যান্টাসির উৎস সম্বন্ধেও অনুমান করা যায়।
তবে বাসস্থানের সাথে ইঞ্জিনিয়ারকে মেলানো আপনার কাছে যতোই হাস্যকর লাগুক, আমাদের পূর্ব প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং মানে এখনো বিল্ডিং বানানো। আপনি বুয়েটে পড়েছেন মানেই বিল্ডিং বা বাসা-বাড়ি তৈরির জ্ঞান রাখেন আপনি। অবিশ্বাস হলে পূর্বপ্রজন্মের ২৫ জন মানুষের ওপর স্যাম্পলিং করতে পারেন।
প্রশ্ন হলো, অন্যান্য দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার কি তবে আলাদা, তাদের শিশুরাও কি একইরকম ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ফ্যাসিনেশনে ভুগে?
না ভুগলে, কেন নয়?
এ ব্যাপারে নৃতাত্ত্বিকরা ভালো বলতে পারবেন। বাঙালি জাতিসত্তাতেই গোলযোগ আছে সম্ভবত।
এ সংক্রান্ত একটি ক্লাসিকাল উদাহরণ হতে পারে অনলাইন কমেন্টজীবীরা। যে কোনো ওয়েবপোর্টালের কমেন্ট সেকশন নিয়ে ৩ সপ্তাহ গবেষণা করলেই বাংলাদেশীদের গড় মানসিক গঠন/গড়ন সম্বন্ধে ধারণা তৈরি হয়ে যাবে। ক্রিকইনফোর কমেন্ট সেকশনে ভারতীয় আর পাকিস্তানী কমেন্টবাজদের কমেন্টও একইরকম ইন্টারেস্টিং; তার মানে ভারতীয় উপমহাদেশের নৃতাত্ত্বিক মনস্তত্ত্ব নিয়েই গভীর পর্যবেক্ষণ-নিরীক্ষণ-পর্যালোচনার দাবি রাখে। তবু কমেন্ট প্যাটার্ন লক্ষ্য করলে বাংলাদেশী আর পাকিস্তানীদের মধ্যে দূরবর্তী অথবা নিকটবর্তী সাযুজ্য পাওয়া যায়। এই দুই অঞ্চলের গড় মানুষের মনস্তত্ত্ব এমন কেন এটা সমাজবিজ্ঞানীদের রমরমা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে।
***
ইঞ্জিনিয়ারিং একটি এপ্লাইড ফিল্ড, সাধারণত মধ্যমেধার মানুষেরা এপ্লাইড ফিল্ডে কাজ করে। উচ্চমেধাবী হিসেবে যাদের গণ্য করা হয় তারা পড়বে পিউর সাবজেক্টে; যেমন ফিজিক্স, ইকোনমিক্স, সোস্যাল সাইন্স, ম্যাথমেটিক্স, ফিলোসফি প্রভৃতি।
এটা হলো আইডিয়াল সিনারিও কেমন হওয়া উচিত সেই নিরিখে মন্তব্য করা। শুনতে তেতো হলেও পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য জীবিকার সনদ যোগাড় করা। অনগ্রসর অর্থনীতির দেশে একটা ছেলে বা মেয়ে সাধারণত ফিজিক্স তখনই পড়ে যখন ভর্তি পরীক্ষায় উপরের দিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। অন্যান্য সাবজেক্টের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগে পরিস্থিতি কেমন ছিল জানি না, তবে অনুমান করতে পারি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের প্রচুর চাকরি ছিল, বেতন যেমনই হোক। তাছাড়া প্রতিটি জেলায় এলজিআরইডি এর অফিস থাকা, চিফ ইঞ্জিয়ারদের ফ্যাসিলিটি-সম্মান দেখে অভিভাবকদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফ্যাসিনেশন তৈরি হয়ে থাকতে পারে।
অন্যদিকে দেশ চালায় মূলত আমলারা, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষা করলে খুব কম ক্ষেত্রেই হয়তোবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাউকে পাওয়া যাবে। আমলারাই যেহেতু প্রশাসনযন্ত্র, অভিভাবকেরা কেন আমলার চাইতে ইঞ্জিনিয়ারিংকে বড়ো করে দেখেছে এটা একটা জটিল জিজ্ঞাসা। একটা অনুষ্ঠানে জেলাপ্রশাসক আর ইঞ্জিনিয়ার যদি আমন্ত্রিত হয়, প্রোটোকল অনুসারে ডিসিরই উপরে থাকার কথা।
আমার অনুমান, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাধারণ মানুষ খুব একটা পছন্দ করে না, তাদের শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করে। সময় বদলাচ্ছে, সমাজ বদলাচ্ছে, এখন বুয়েটের যেসব ছেলে-মেয়ে দেশে থাকছে তাদের অনেকেই টেকনিকাল ক্যাডারের চাইতে সাধারণ ক্যাডা পছন্দ করছে প্রশাসনে ঢোকার অভিপ্রায়ে। ভূগোলে পড়া কেউ যদি এডমিন ক্যাডারে সুপারিশকৃত হয় সেটা অর্জন হিসেবে দেখা হয়, সিএসই গ্রাজুয়েট এডমিন ক্যাডারে ঢুকলে গণমানুষ বলতো- ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে শেষ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট হইলা! তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে গণমানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আসছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে বুয়েট সংক্রান্ত ফ্যাসিনেশনে আরো পরিবর্তন আসতে পারে।
***
অনেক স্কুলেই সাইন্স পাওয়ার জন্য ন্যূনতম নম্বর অর্জন করতে হয় পরীক্ষাতে। আর্টস বা কমার্সের ক্ষেত্রে সেই বিধিনিষেধ থাকে না। তাতে মনে হতে পারে, এদেশের মানুষ বিজ্ঞানপ্রিয় এবং বিজ্ঞানমনস্ক। অথচ বাস্তব চিত্র বলে, এদেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই বিজ্ঞানভীতি কাজ করে। তার অসংখ্য আলামত পাওয়া যায় মাজার ব্যবসা, ওঝা-তান্ত্রিকদের প্রাদুর্ভাব, জ্যোতিষরাজদের তেলেসমাতি পাথরের নমুনায়।
তবু সাইন্সকে প্রমোট করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ বেশি পাওয়া। তাছাড়া ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে সাইন্সে পড়াটা অনিবার্য শর্ত। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ বিজ্ঞানভীত, অজ্ঞ এবং কিছুক্ষেত্রে বিজ্ঞানবিদ্বেষী, তাদের বিদ্বেষ প্রকাশের একটি মাধ্যম বা প্রতীক প্রয়োজন। বুয়েটবিরোধীতা আদতে বিজ্ঞানবিমুখীতারই একটি আবহমান প্রতীকায়ন। খুব সহজ একটি এক্সপেরিমেন্ট থেকেই এ ব্যাপারে অনুসিদ্ধান্ত পাবেন। ১০ জন বুয়েটবিরোধী মানুষের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করে তার বিজ্ঞানচিন্তা সম্বন্ধে জানতে চান, এবং উত্তরগুলো পর্যালোচনা করলে নিশ্চিত অবাক হবেন। এটা কি নিতান্তই কাকতালীয়?
***
কয়েকজন বুয়েটিয়ানের জন্য বুয়েটের সবাই খারাপ নয়, এটি অতিসরলীকৃত বক্তব্য। ইতিপূর্বে বুয়েটছাত্রদের মনস্তত্ত্ব বিষয়ে দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছি, এখানে পুনরাবৃত্তি করতে চাইছি না। সেই পর্যালোচনানুযায়ী গড় বুয়েটিয়ানদের মানসিকতা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ।
কিছুদিন পূর্বে হিউম্যানল্যাব থেকে একটি সাইকোলজিকাল প্রোডাক্ট তৈরি করেছিলাম ‘Job fitness indicator’, মূলত একজন ব্যক্তির প্রেফারেন্স, এম্বিশন আর সোস্যাল ওরিয়েন্টেশনকে প্রাধান্য দিয়ে আরো কয়েকটি প্রবণতাকে সমন্বিত করে ৮৯টি প্রশ্নের এই এসেসমেন্টটি ৩০ জন মানুষের উপর স্যাম্পলিং করেছি, তন্মধ্যে বুয়েটিয়ান ৭জন। প্রোডাক্টটি গ্লোবাল নয়, লোকাল কনটেক্সট এ বানানো। আশ্চর্যজনক হলো, ৭ জনের মধ্যে ২ রকম indicator এসেছে
১. নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হতে চায় না। এক্সটারনাল প্রেসার না থাকলে কাজ করতে চায় না।
২. অত্যন্ত ডায়নামিক এবং উচ্চাকাংখী, retention এর সম্ভাবনা খুবই কম।
ইন্টারেস্টিং হলো, একটা ন্যুনতম মান আছে যার নিচে পেলে indicate করে হয় প্রশ্নগুলো তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, অথবা সে অনেক প্রশ্ন থাকার কারণে মনোযোগ সহকারে উত্তর দেয়নি। সেই শ্রেণিতেও পাওয়া গেছে ২ জন!
একটি পরিবারে ৩টি সন্তান থাকলে যে বুয়েটে পড়ে বাকি ২ জনের তুলনায় তার কদর বেশি। মা-বাবা যতোই বলুক সব সন্তানকে সমান দৃষ্টিতে দেখি, মনে যা-ই থাকুক, আচরণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও একই প্রবণতা। ফলে বাকি ২ সন্তান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বুয়েট পড়ুয়াটির প্রতি কিছুটা হলেও মনোঃক্ষুন্ন থাকে। সমস্যাটা বুয়েট বা মেডিকেলের নয়, সমস্যাটা সাফল্য পূজার। সফলতার উদ্ভট সংজ্ঞানীতির কারণে, একজন তরুণ/তরুণী বুয়েটে বা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ামাত্রই অনেক ক্ষেত্রে তার মাঝে জীবন ধন্য হওয়া অনুভূতি জাগে। আমাদের গণজীবনে সাফল্য বলতে মূলত বিত্তশালীতা বোঝায়, যেহেতু বুয়েটে বা মেডিকেলে পড়লে ভালো উপার্জনের নিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়, তারা সফলতার সংজ্ঞানীতিতে প্রমোশন পায়।
অথচ ভার্সিটি পাশের পরে কর্মজীবনে কে কতটা কন্ট্রিবিউট করতে পারলো সেটাই মূল প্রতিযোগিতা এবং আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত। প্রতিষ্ঠান বা পেশাকেন্দ্রিক অনুরাগ কিংবা বিরোধীতা, দুটোই কিন্ডারগার্টেনের শিশুতোষ বৈশিষ্ট্য। অবাক এবং হতবাক হয়ে ভাবি, একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজীবন চিন্তায় কিন্ডারগার্টেনে আচরণে পিএইচডি লেভেলে বসবাস করে। ফলে সুনির্দিষ্ট কোনো চরিত্র গড়ে উঠলো না আজও।
তবে বুয়েট ফ্যাসিনেশনের সাথে ঢাকাকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থারও সুবিশাল দায় রয়েছে। ঢাকা ভার্সিটি বা ঢাকা মেডিকেলকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অথবা রাজশাহী মেডিকেল সেরকম আলোচনায় থাকে না কেন? অনুরূপভাবে বুয়েট যদি ঢাকার বাইরে সিরাজগঞ্জে কিংবা পটুয়াখালিতে অবস্থিত হত, নিশ্চিতভাবেই সেটা হতো এক ভিন্নধর্মী বুয়েট।
সকল দৃষ্টিকোণ সংযুক্ত করে বুয়েটবিরোধীতার যে উপপাদ্য তৈরি হয় তার সাধারণ নির্বচনে কবির সুমনের গানের দুটো লাইন লিখতে চাই-
‘কালকেউটের ফণায় নাচছে লখীন্দরের স্মৃতি
বেহুলা কখনো বিধবা হয় না, এটা বাংলার রীতি’