আলিফ লায়লা ( এরাবিয়ান নাইটস) এর প্রসঙ্গ মনে পড়লো আসলে সাম্প্রতিককালে দীপ্ত টিভিতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া সুলতান সোলেমান সিরিয়ালটি নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে। এবং এই চিন্তার ফলাফল হলো, ব্যাপারটা আলিফ লায়লা বা সুলতান সোলেমানের ক্রেজ নয়, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে প্রচারিত হতে থাকা বিদেশী সিরিয়াল বা কার্টুন(বাংলায় ডাবিংকৃত, বা ইংরেজি) এর একটা পরম্পরাভেদ আছে। সেগুলো নিয়ে কথা না বললে শুধুমাত্র আলিফ লায়লা বা সুলতান সোলেমান কোনো অর্থ বহন করবে না, গোষ্ঠী মনস্তত্ত্ব এবং রুচির গভীর যোগসাজশ রয়েছে এক্ষেত্রে।

আমি ছোটবেলায় টেলিভিশন একদমই দেখতাম না (এখনো দেখা হয় না)। ক্রিকেট খেলা আর বাংলা সিনেমা এই দুটো ব্যাপারে আগ্রহ ছিলো, টিভিতে দেখাও হতো এ দুটো প্রোগ্রামও। তবে চোখ-কান খোলা রাখার কারণেই হয়তোবা চলতি ট্রেন্ডগুলো সম্পর্কে জানা ছিলো, এবং বিচ্ছিন্নভাবে প্রোগ্রামগুলো দেখাও হয়েছে। এই সিরিয়ালগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, কয়েকটা পর্ব দেখলেই আগে-পরের সবকিছু সম্পর্কে জেনে নেয়া যায়।

বাংলায় ডাবকৃত সিরিয়ালগুলোর কথা বলি প্রথমে। শুরুতেই বলবো আলিফ লায়লার কথা। এর জিঙ্গেলটা আমাদের শৈশবে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘দেখো সব নতুন কাহিনী, মন ভরে দেখার বানী, কত যুগ পেরিয়ে গেছে, নতুন তবু রয়ে গেছে’- এই লাইনগুলো মুখস্থ হয়নি শুনতে শুনতে আমাদের বয়সী এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুরূহ। আলিফ লায়লা মানেই জ্বিন, পরী, জাদু-টোনা। কেয়ামত জিন, তাক জিন-তোবাক জিন আরও কত নাম না জানা জিন। তবে জিন-পরীর বাইরের গল্পের চরিত্রগুলোই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। যেমন, আলি বাবা চল্লিশ চোর, আলাদীন, সিন্দবাদ, কেহেরমান। বিশেষ করে, কেহেরমানের এক চোখে কাপড় বাঁধা, চুল ছিঁড়ে ফুঁ দেয়া এসব তৎকালীন সময়ে খুবই মুখরোচক হয়ে উঠেছিল। সিন্দাবাদের সোলেমানী তলোয়ার নিয়েও গল্প তৈরি হয়েছিল প্রচুর। তবে আলিফ লায়লার সিন্দাবাদ নয়, আরও ড্যাশিং সিন্দবাদকে আমরা পাই দ্য নিউ এডভেঞ্চার অব সিন্দবাদ নামের সিরিয়ালটিতে। ডুবার, রঙ্গার, ফিরোজ, জাদুকর ডিমডিম চরিত্রগুলো খুব দ্রুতই পরিচিতি পায়। এছাড়া নায়িকা মিভ এর ডারমট নামের বাজপাখিটিও দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। আমাদের এলাকার এক বড় ভাই তো রীতিমত বাজপাখি পোষা শুরু করে দিয়েছিলেন মিভ এর প্রতি ফ্যাসিনেশন থেকে।

তবে আলিফ লায়লারও আগে একটি ঐতিহাসিক সিরিয়ালে এদেশে আলোড়ন তুলেছিল। সেটা হলো মহীশূরের শাসক টিপু সুলতানকে নিয়ে নির্মিত দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান (সম্প্রতি মাছরাঙা টিভিতে সেটা আবারো প্রচারিত হচ্ছে শুনেছি)। হায়দার আলী, গাজী বাবা চরিত্রগুলোর বলিষ্ঠতা, টিপু সুলতান চরিত্রে সঞ্জয় খানের (ঋত্বিক রোশানের সাবেক স্ত্রী সুজানা খানের বাবা অথবা চাচা) দৃঢ়তা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাঙালির ঘরে ঘরে সিরিয়ালটিকে ব্যতিক্রমী আসনে বসিয়ে দেয়। ‘…তখন একটি তলোয়ার ঝলসে উঠলো, সেই তলোয়ার শেরে মহীশূর টিপু সুলতানের তলোয়ার’- শুরুর এই অভিভাষণটি দীর্ঘদিন মুখস্থ ছিলো আমার (অনভ্যাসে ভুলে গেছি)।

আরেকটি ঐতিহাসিক সিরিয়াল ছিলো আকবর দ্য গ্রেট। ‘সূর্য আমি ঐ দিগন্তে হারাবো, অস্তমিত হব, তবু ধরনীর পরে চিহ্ন রেখে যাব’- সিরিয়াল শুরুর এই লাইনগুলো খুবই পছন্দ হয়েছিলো সে বয়সে। বৈরাম খান, এবং মাহিম আনাগারের মধ্যকার বৈরিতা দেখতে ভালো লাগতো। মাহিম আনাগারের কুপুত্র আজম খান তাকে ‘আম্মি হজরত’ সম্বোধন করতো, এই সম্বোধনটাতে এতোই মজা পাই যে এখনো দুষ্টুমি করে আমার আম্মুকে বেশিরভাগ সময় আম্মি হযরতই বলি (মানুষের সামনে শুধু আম্মু বলা হয়। আমার আম্মুর সাথে আমি জীবনভর দুষ্টুমিই করে গেলাম)একুশে টিভিতে মুঘল সম্রাজ্ঞী নুরজাহানকে নিয়েও একটি সিরিয়াল চলেছিল কিছুদিন। অন্যগুলোর মতো এটাও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। নুরজাহান চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী ড্যানিস কনডেন্সড মিল্কের বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছিল এটা নিয়েও সে কি বিস্তর গবেষণা।

ইংরেজি বা অন্য ভাষারও বেশ কিছু সিরিয়াল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যেমন, রবিনহুড। লিটল জন, ফায়ারট্যাক, মেরিয়েন আর রবিন হুডের লক্ষ্যভেদী তীর গল্পের টপিক হয়ে উঠেছিল। কিছুদিন পর মেরিয়েনের একট্রেস চেঞ্জ হওয়ায় অনেকেই মন খারাপ করে, এক পর্যায়ে রবিন হুড নিজেই চেঞ্জ হয়ে যায়। সিরিয়ালটি মাঝপথে কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
একজন মৃত পুলিশ অফিসারকে রোবটে ট্রান্সফর্ম করে অপরাধ দমনে ব্যবহার করার গল্প নিয়ে নির্মিত ‘রোবোকপ’ সিরিয়ালটাও আমাদের কৈশোরে আরেকটা সংযোজন। রোবোকপের যান্ত্রিক হাঁটার স্টাইল তখন স্কুলে অনেক ছেলেকেই অনুকরণ করতে দেখেছি।
একুশে টেলিভিশন আসার পর থিফ অব বাগদাদ নামে একটা সিরিয়াল প্রচারিত হতো। সেটাও এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। বিটিভিতে আরেকটা সিরিয়াল হতো মিস্ট্রিয়াস আইল্যান্ড। জুল ভার্নের গল্পের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত এই সিরিয়ালের রহস্যময় চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমোকে এখনো মনে পড়ে।

বাংলায় ডাবকৃত সিরিয়ালের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার বেশ কিছু সিরিয়ালও বিটিভ আর ইটিভিতে প্রচারিত হতো। ম্যাকগাইভারের নাম আসবে প্রথমেই। এতো ছোট ছিলাম যে ম্যাকগাইভারের বেশিরভাগ কার্যক্রমই মনে নেই। শুধু মনে পড়ে, ম্যাকগাইভারের অনেক বুদ্ধি ছিলো, সে অনেক কিছু বানাতে পারতো।

দ্য সাইমন এবং দ্য র‌্যাভেন নামের দুটো সিরিয়াল দেখাতো। সাইমন সম্ভবত বামুন টাইপ ছিলো, আর র‌্যাভেন ছিলো একশনধর্মী। কিছুটা প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট থাকায় র‌্যাভেনও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়।
টারজান সিরিয়ালটাও মাঝে কিছুদিন বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো। টারজানে নিয়ে তো জলঘোলা কম হয়নি। আরও কয়েকটা সিরিয়াল দেখাতো রাতের বেলায়, The Fall Guy, The Equalizer এবং The A Team; শেষোক্ত সিরিয়ালটিতে মূল চরিত্রের হেয়ারস্টাইলটা খুব শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল। অনেক ফুটবলারই সেই হেয়ারস্টাইল অনুসরণ করে এখনো।

কিছুটা ভৌতিক কনটেন্ট এর দ্য এক্সফাইলস হতো লেট নাইটে। স্টার মুভিজেও সেটা দেখানো হতো, বিটিভিতে সেন্সর করলেও স্টার মুভিজের ভারসনে নায়ক-নায়িকার দু-একটা অন্তরঙ্গ দৃশ্য থাকতো বলে গল্প শুনেছি স্কুলের বন্ধুদের মুখে (আমাদের বাসায় ডিশ ছিলো না যতদিন মানিকগঞ্জে ছিলাম)। নায়িকার হেয়ার স্টাইল টিনএজারদের ব্যাপক ফ্যাসিনেশন ক্রিয়েট করতে সমর্থ হয়েছিলো।

গ্রীক পুরাণের হারকিউলিস এবং এর অভিনেতা কেভিন সার্বো দুজনই ক্রেজ তৈরি করতে পেরেছিলেন। আমাদের মতো টিনএজারদের পছন্দের তালিকায় ঢুকে পড়ে সুপারম্যান সিরিয়ালটি। বাংলাদেশে ড্যানি সিডাককে দিয়ে হাস্যকর এক সুপারম্যান সিনেমা নির্মিত হয়েছিলো; পুরোটা দেখা হয়নি। Thunder in Paradise, Ocean Girl এই দুটো সিরিয়ালের নাম পরিচিতদের মুখে শুনেছি, তবে আমি নিজে একটা পর্বও দেখে উঠতে পারিনি।
একুশে টিভির কল্যাণে আরেকটা সিরিয়াল খুব ভালো লাগতো। সেটা হলো স্পেলবাইন্ডার। প্যারালেল ইউনিভার্স কী তখন কিছুই জানতাম না, বুয়েটে পড়ার সময় আবারো যখন নতুন করে দেখি সবগুলো সিজন ততদিনে প্যারালেল ইউনিভার্স সম্পর্কে পড়া হয়েছে একটু আধটু।

শুধু সিরিয়াল নয় বাংলায় ডাবিং করা এবং ইংরেজি ভাষায় অনেকগুলো কার্টুন দেখানো হতো বিটিভিতে। এক্ষেত্রে পায়োনিয়ার বলতে হবে মীনা কার্টুনকে। ইউনিসেফ এর চাইল্ড এবং ওমেন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের অধীনে এই কার্টুনটি পরিণত হয়েছিল কিংবদন্তীতে। আজকের দিনে মীনা সেই অবস্থান এখনো ধরে রাখতে পেরেছে কিনা জানি না, তবে আমাদের ছোটবেলায় প্রায় সববয়সী মানুষকেই দেখেছি মীনা কার্টুনে মজা পেতে। আমাদের জন্য আরেকটা কার্টুন ছিলো, যেটা শুক্রবার দুপুরের আগে প্রচারিত হতো। মোগলি। শেরখান, বাঘিরা এই ক্যারেক্টারগুলো যেমন ভালো লাগতো, তেমনি মোগলির ব্যবহার করা বুমেরাং অস্ত্রটিও বেশ পরিচিতি পেয়েছিলো।
তবে কার্টুনের মূল ফ্লেভারটা আসলে ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত কার্টুনে। খুব ভালো লাগতো ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট কার্টুনটি। এর জিঙ্গেলটাও খুব পছন্দের ছিলো। ৫টা আংটির পাওয়ার কম্বাইন করে ক্যাপ্টেন প্ল্যানেটকে নিয়ে আসা এবং সমস্যার সমাধান করা, বুধবার বিকেলের ওই আধাঘণ্টা সময় যেন চোখের পলকে চলে যেত। তারও আগে নিনজা টার্টলস নামে একটা কার্টুন ছিলো; সেটাও দারুণ পপুলার হয়েছিলো, কিন্তু দেখা হয়নি খুব বেশি।
উডি উড প্যাকারের দুষ্টুমি এবং হাসি তো আমাদের সমগ্র কৈশোরকেই আচ্ছন্ন রেখেছিল। একুশে টিভির কল্যাণে পাপাই দ্য সেইলরও দেখার সুযোগ হয়েছে। আর টম এন্ড জেরি তো এখনো আগের মতোই জনপ্রিয়। খুবই অদ্ভুত লাগে যখন দেখি জেনারেশন চেঞ্জ হয়, কিন্তু টম এন্ড জেরি একইরকম জনপ্রিয়তা ধরে রাখে।

কার্টুন এবং সিরিয়ালের বাইরে মিস্টার বিন এর কথা বলবো। কিন্তু কী-ই বা বলার আছে। মনে পড়লেই হাসি পায়। এরকম পরিমিতিবোধের কমেডি সিরিজ আমি অদ্যাবধি দেখিনি।

স্মৃতিচারণ তো অনেক হলো। এবার মূল পয়েন্টে আসি। সুলতান সোলেমান। জি-বাংলা, স্টার জলসাকে পেছনে ফেলে দীপ্ত টিভির এই সিরিজটি জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছে। সাড়ে সাতটা মানেই ঘরে ঘরে হুররম সুলতান আর ঈব্রাহীম পাশার দ্বন্দ্ব। ফলে যেটা হয়েছে অন্যান্য চ্যানেলও বিদেশী সিরিয়ালগুলো বাংলায় ডাবিং করে সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু কোনোটাই সোলেমানের মতো ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ইসলামের ইতিহাসের স্টুডেন্ট এবং ইতিহাস সচেতন মানুষ বাদে বোধহয় খুব মানুষই সুলতান সোলেমানে নাম শুনেছিলো এই সিরিয়ালের আগে, এমনকি এখনো এসব দর্শককে জিজ্ঞেস করলে বড় অংশই হয়তো বলতে পারবেন না সুলতান সোলেমান আসলে কে ছিলেন, বা তার বিশেষত্ব কিসে? বরং তারা সুলতান সোলেমান মানে বুঝে হুররম, ঈব্রাহীম পাশা, মাহী দেভরান। বিশেষ করে হুররমের গ্ল্যামার এবং ফ্যাশন সচেতনতা এই সিরিয়ালের সেলিং প্রোপোজিশন মনে হয়েছে আমার। সেই মনে হওয়াটা ক্রস চেক করতে গিয়ে গুগলিং করে পেলাম, সত্যিকার অর্থেই এই সিরিয়ালে ঐতিহাসিক ভুল-ভ্রান্তি প্রচুর, এবং সোলেমানের রাজনৈতিক দূরদর্শীতা বা শাসক হিসেবে প্রজ্ঞা নয়, বরং হেরেমের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রই মূখ্য হয়ে উঠেছে, যেখানে সোলেমান নিজেও ইনভলভ। এই কাজটা সম্ভবত পরিচালক ইচ্ছা করেই করেছেন, কারণ দর্শক ইতিহাস নয়, কনফ্লিক্ট দেখতে চায়, গ্ল্যামার চায়। একজন রাজ শাসকের লাইফ স্টোরিতে সেসব উপকরণ বেশি করে আনতে হবে, তাহলেই হিট হবে। নইলে ৪৬ বছর যে সুলতান ঘোড়ার পিঠে বসে এপ্রান্ত সেপ্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন, কোনো একজন পত্নীর প্রতি বিশেষ অনুরাগ সেটাই হয়ে গেল সিরিয়ালের মূল ফোকাল পয়েন্ট; শাসকের বেশিরভাগ সময় কাটে হেরেমের বিচার করে। নইলে যে সিরিয়াল চলে না!

এই আলোচনা থেকে এমনটা মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই এই কথাগুলো বোধহয় এই উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে বলা। মোটেও নয়, ইউনিভার্সালই দর্শকচরিত্রের একটা কমন প্যাটার্ন আছে। সেটা যে যত ভালোভাবে ফলো করতে পারবে, তার প্রোডাক্ট তত জনপ্রিয়তা পাবে। মনে হতে পারে, হিন্দি সিরিয়ালগুলোতে উদ্ভট মেকআপ, ক্যামেরার আজগুবি ডিরেকশন, আরোপিত অভিনয়, চুইংগামের মতো ছোবড়া হয়ে যাওয়া কাহিনী- এসবের মধ্যে দেখার কী আছে। দেখার কিছু নেই, কিন্তু এডিক্টিভ এলিমেন্ট আছে; ধৈর্য ধরে এক সপ্তাহ হজম করতে হবে, যদি অষ্টম দিনে অটোমেটিকালি ওই সিরিয়াল দেখার জন্য মন আকুপাকু না করে তখন কিছু একটা বলে দিয়েন। এই যে এডিক্টিভ এলিমেন্ট, এটা অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর ডিপেন্ড করে। সেগুলো আপনি বুঝবেন, তবু এডিকশন থেকে বের হতে পারবেন না।
সাংস্কৃতিক অবক্ষয় নিয়ে অনেক কথা উঠছে, বলা হচ্ছে এইসব বিদেশী সিরিয়ালের জন্য আমাদের দেশীয় অনুষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ছে, এদের প্রতিহত করা হোক। আমি এটাকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব গণ্য করি। আজকের বিশ্বে বাউন্ডারি দিয়ে কি আপনি ইনফরমেশন ফ্লো আটকে রাখতে পারবেন?
আপনি ভালোমানের অনুষ্ঠান বানালে মানুষ এমনিতেই দেখবে। আপনি গাদাগাদা বিজ্ঞাপন দিয়ে নাটক বানাবেন, টকশো তে সয়লাব করে ফেলবেন, মানুষ তো চ্যানেল ঘুরাবেই। মনে রাখবেন, এখন হাতে রিমোট থাকে, অপশনও অনেক বেশি; সুতরাং রিমোটের এক বাটনে চাপ দেয়া সেকেন্ডের ব্যাপার। চয়েজ যেখানে অনেক বেশি সেখানে কম্পিটিশন করেই পজিশন আদায় করে নিতে হয়, করুণা দিয়ে বা কণ্ঠরোধ করে যা-ই হোক দর্শককে ফেরাতে পারবেন না।
বাংলাদেশেও সিরিয়াল তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো এডিকশন তৈরি করতে পারছে না। যেখানে চ্যানেল ঘুরালেই স্টার প্লাসে অরিজিনাল স্টোরি দেখা যাচ্ছে, সেখানে নকল স্টোরি দেখার প্রয়োজন কী!

আমি বলছি না বাংলাদেশেও সিরিয়াল বানানো হোক, কিন্তু প্রোগ্রামে অবশ্যই নতুনত্ব নিয়ে আসতে হবে। মিডিয়া লাইনে ক্রিয়েটিভিটির চাইতে সম্ভবত চাপাবাজি আর সিন্ডিকেটবাজীকে বেশি প্রায়োরিটি দেয়া হয়, নইলে এইসব ব্রেইনলেস প্রোগ্রাম প্রোডিউস করার কোনো লজিকাল গ্রাউন্ড দেখি না, আর বাংলাদেশে ক্রিয়েটিভ মানুষের অভাব এটা বিশ্বাস করার মতো হতাশাবাদী কোনোকালেই ছিলাম না। সমস্যাটা সম্ভবত এখানেই যে, ক্রিয়েটিভ মানুষগুলোর জায়গা কিছু অমেধাবী দালালশ্রেণীর মানুষ কুক্ষিগত করে রেখেছে। কাজেই আন্দোলন যদি করতে হয়, এসব রিয়েলিস্টিক ইস্যুতে করুন। বিদেশী সিরিয়ালের অনুপ্রবেশ তো নতুন নয়, সেই ৯০ এর দশকের আগে থেকেই তা ছিলো, বিপুল জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। সেই সময়ে যদি ইত্যাদি, শুভেচ্ছার মতো অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হতে পারে, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, বারো রকমের মানুষ নাটক হতে পারে, এখন এতোদিন পরে এসে বিদেশী সিরিয়াল হুমকি হয়ে উঠলো? কথাটা বেশি হাস্যকর হয়ে গেলো না আংকেল?

আঙুলটা এদিক সেদিক না ঘুরিয়ে নিজের মাথার দিকে তুলুন, কারণ ওখান থেকেই যত দুষ্টবুদ্ধি বের হচ্ছে।