আমাদের শৈশব-কৈশোরে বাংলাদেশের ক্রিকেট খুব বেশি বিকশিত হয়নি, জনপ্রিয়তায়ও ছিলো অনেকটাই পিছিয়ে। সেই সময়টাতে জনপ্রিয় হওয়া লাকী আখন্দের গাওয়া ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ’ গানটার কিছু লাইন উদ্ধৃত করতে চাই-
“ওয়েস্ট ইন্ডিজ নাকি অস্ট্রেলিয়া পেল লংকা দুখের ঝাপটা
শচীন না হলেও ওয়াসিম আকরাম জয় করে নেবে কাপটা,
বলতে পারি না আজ কার হবে সেই মালা স্বপনের সুবাস মাখা,
আমাদের হৃদয়ে সবুজের মাঝখানে বিজয়ের সূর্য আঁকা
হঠাৎ করে বাংলাদেশ, চারিদিকে বাংলাদেশ
……………………………………….
দূরের আকাশে আজ অবিরাম উড়ছে, উচ্ছ্বাসে কিছু পতাকা
বিশ্বকাপে দেখো আমাদেরও নাম লেখা, ডানা মেলে থাকা বলাকা”
ক্রিকেট সংক্রান্ত লেখায় ক্রিকেটিয় গানের রেফারেন্স টানা মূলত তৎকালীন সোশ্যাল আসপেক্টটা বুঝানোর উদ্দেশ্যে। গানটা যখন রিলিজ হয় ততদিনে বাংলাদেশ একটা বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছে, টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি (যদিও ইউটিউব ইনফরমেশনে লেখা গানটা ২০০৩ এ রিলিজ পাওয়া, কিন্তু গানের প্রথম দুই লাইন- “বিশ্বকাপে দেখো হিমশীতলের দেশে জমেছে ক্রিকেট পুরোটা, সাউথ আফ্রিকা নিয়ে যাবে কাপটা, ভাবছে সবাই এ কথা” থেকে ধরে নেয়া যায় এটা আসলে ১৯৯৯বিশ্বকাপের প্রেক্ষাপটে লেখা, যেহেতু ৯৯ বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো এবং সাউথ আফ্রিকাকে হট ফেবারিট ধরেছিলো বোদ্ধারা)। এই গানে ২জন মাত্র ক্রিকেটারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, এবং তারা পাকিস্তান আর ভারতের প্রতিনিধি। যদিও ফেবারিট হিসেবে সাউথ আফ্রিকার কথা এসেছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা অস্ট্রেলিয়ার নাম আছে, কিন্তু শন পোলক, জন্টি রোডস, লারা বা শেন ওয়ার্নের বদলে টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরামকে স্যাম্পল হিসেবে নিয়ে আসা, এটা কি নিতান্তই কাকতালীয়, নাকি পাবলিক ডিমান্ড? ফেসবুকভিত্তিক জাতিসত্তা ও চেতনা বিশেষজ্ঞদের ভয়ে অনেকেই এখন সত্যিটা লুকিয়ে ফেলতে চাইবেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো ২০০১ এ আশরাফুল বা মাশরাফি আসার আগ পর্যন্ত আমাদের ক্রিকেট কমিউনিটিতে স্টার ক্রেজের পুরোটাই পাকিস্তান এবং ভারতের ক্রিকেটাররা দখল করে রেখেছিল। (এমনকি সাকিব আল হাসান, তামীম ইকবালও তাদের বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে বলেছেন তাদের ছেলেবেলার হিরো ছিলো পাকিস্তানের ওপেনার সাঈদ আনোয়ার। সাকিব-তামীম আমার সমবয়সীই হবেন, তাই শৈশব-কৈশোরটা আমরা একই জেনারেশন দেখে পার করেছি বলা যায়)
পাকিস্তান-ভারতের ক্রিকেটারদের এই ক্রেজ শুরু হয় ৯২ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি কন্ডিশনে রঙিন পোশাক, সাদা বলের বিশ্বকাপে উপমহাদেশের একটা দল চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল (যারা গ্রুপ পর্বে ৭৪ রানে অলআউট হয়েছিল), এটা এদেশের ক্রীড়ামনস্ক মানুষদের আকর্ষণ করেছিলো বোধকরি। তখন সত্যিকারের ক্রীড়ামনস্ক মানুষ বাদে কারোরই ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি ছিলো না বিশেষ, সেটা ফুটবলের জন্য বরাদ্দ রাখা ছিলো। তবু ইমরান খান সাময়িক ক্রেজ তৈরি করেছিলেন, তবে বেশি নজর কেড়েছিলেন তরুণ পেসার ওয়াসিম আকরাম। অদ্ভুত সুইং, আকর্ষণীয় চেহারা আর উইকেট উদযাপনের উচ্ছ্বাস খুব অল্প সময়েই তাকে এদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ঢাকার লীগে খেলতে আসার দরুণ তাকে নিয়ে কৌতূহলটা আরও বাড়ে। সে হিসেবে বলতে গেলে, বাংলাদেশে বড় ক্রেজ তৈরি করা প্রথম পাকিস্তানী ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরাম। তার বোলিং পার্টনার ওয়াকার ইউনুসও জোরে বল করার কারণে এদেশে জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।
৯৬ বিশ্বকাপের আগে থেকেই ভারতের আজহারউদ্দিন দর্শকপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। ভারতের মতো হিন্দুপ্রধান দেশের অধিনায়ক একজন মুসলমান, এরকম একটি সাম্প্রদায়িক অনুভূতি তাকে ক্রিকেটের বাইরের জনগোষ্ঠীর কাছেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। তার কলার উচু করে রাখা, সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটার স্টাইল অনেক বাংলাদেশী তরুণ ক্রিকেটারের জন্যই আদর্শ হয়ে উঠেছিল; গোঁফ রাখা-গোঁফ কাটা নিয়ে তার সংস্কারটাও অনেকে অনুসরণ করতে শুরু করে।
বুস্ট ইজ দ্য সিক্রেট অব মাই এনার্জি- বুস্টের বিজ্ঞাপনসূত্রে শচীন টেন্ডুলকার এমনিতেই এদেশে পরিচিত ছিলেন, ক্রেজ তৈরি করেন মূলত ৯৬ বিশ্বকাপ আসরে সর্বোচ্চ ৫২৭ রান সংগ্রহ করে। সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বেই তাকে নিয়ে ক্রেজ বাড়তে থাকে ইন্ডিয়ার ম্যাসিভ মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি এবং ৯৮ সালে ৮/১০টি সেঞ্চুরি করার বদৌলতে। ভারতের যে কোনো স্ট্র্যাটেজিরই সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই পড়ে, টেন্ডুলকার ক্রেজ এর ব্যতিক্রম হবে কেন!
সেঞ্চুরি দিয়ে টেস্টে অভিষিক্ত সৌরভ গাঙ্গুলী (ওয়ানডে অভিষেক অবশ্য ৯২ সালে, কিন্তু কিছুই করতে না পেরে মাঝের ৪ বছর হারিয়ে গিয়েছিলেন) এর ক্রেজ পুরোটাই মিডিয়ার সৃষ্টি করা আরোপিত। আজহারের জন্য যেটা ছিলো মুসলিম পরিচয়, গাঙ্গুলীর জন্য এডভান্টেজ হয়ে এসেছে কলকাতার বাঙালি হওয়াটা। বাঙালি আর বাংলাদেশী যে একইসূত্রে গাঁথা, এরকম অদ্ভুত একটা এঙ্গেল এদেশের স্পোর্টস জার্নালিস্টরা আবিষ্কার করে ফেলেন, ৯৮ এ ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের ৩১৪ চেজ করতে গিয়ে খেলা ১২৪ রানের ইনিংসের বদৌলতে এরপর তো তাকে টেন্ডুলকারের সাথেও তুলনা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। বাঙালি=বাংলাদেশী উদ্ভট তত্ত্বের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে আজও সৌরভ গাঙ্গুলীর সমার্থক হয়ে আছে ‘দাদা’ সম্বোধনটি।
যখন ক্রেজ বাড়ে সাথে একজন ভিকটিম বা আনসাং হিরো ক্যারেক্টারেও প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটদর্শকদের কাছে এই রোলটা প্লে করেছেন রাহুল দ্রাবিড়। বিশুদ্ধ ব্যাটিং টেকনিক, দেয়াল প্রভৃতি বিশেষণের ব্যবহারে দ্রাবিড় কখন যে আনসাং হিরোকে গ্ল্যামার দিয়েছেন সেটা টেরই পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানের আরও কয়েকজন ক্রিকেটারকে ঘিরে ক্রেজ তৈরি হয়েছিল। সাঈদ আনোয়ারের কারণে যেমন বেশ কয়েকজন কিশোর ডানহাতি হওয়া সত্ত্বেও বামহাতি ব্যাটসম্যানে বদলে গেছে। ৯৮ সালে শচীনের ব্যাপক উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত সাঈদ আনোয়ারের সাথে সেঞ্চুরি নিয়ে তার একটা ঠাণ্ডা লড়াই ছিলো। পাকিস্তানের মতো ভঙ্গুর দলে খেলা আর ২০০১ এ মেয়ের মৃত্যুর পর ক্রিকেটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণেই বোধহয় সেই লড়াইটা জমেনি।
৯৯ এর এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পরপর ২ বলে দ্রাবিড়-টেন্ডুলকারকে বোল্ড করে লাইমলাইটে চলে আসা শোয়েব আখতার বিশাল রান আপ এ প্রচন্ড এথলেটিক ভঙ্গিতে বোলিং ডেলিভারি আর গতির ঝড় তোলার কারণে খুব দ্রুতই ক্রেজ তৈরি করেন। তার বোলিং দেখাটা চোখের জন্য তৃপ্তিদায়ক হয়ে উঠে। বিশ্বের দ্রুততম বোলার হওয়া নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লি এর সাথেকার দ্বৈরথটাও দারুণ উপভোগ্য ছিলো।
ভারত-পাকিস্তানের বাইরে শ্রীলংকার দুজন ক্রিকেটার, সনাথ জয়াসুরিয়া এবং আরবিন্দ ডি সিলভা, স্বল্পসংখ্যক ভক্ত তৈরিতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর ভিত্তি ৯৬ বিশ্বকাপে অতর্কিত শ্রীলংকার চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়া। জয়াসুরিয়ার হার্ড হিটিং ব্যাটিং ক্রিকেট মানেই চার-ছক্কা বোঝা দর্শকের কাছে এবং সেমিফাইনাল আর ফাইনালে ডি সিলভার অনবদ্য ব্যাটিং প্রতিটি বল মনোযোগ দিয়ে ফলো করো দর্শকের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার কারণ হয়ে উঠে।
এডভান্সড লেভেলের দর্শক ব্রায়ান লারাকে নিয়ে ফ্যাসিনেটেড থাকতো, বিশেষ করে ৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আসরের দুর্দান্ত দল সাউথ আফ্রিকাকে বিদায় করে দেয়ার ক্ষেত্রে তার সেঞ্চুরিটি বিশেষ অবদান রাখে। টেস্টে ৩৭৫ বা ফার্স্ট ক্লাসে ৫০১ রানের ইনিংস থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে তিনি জনপ্রিয় হন মূলত ওই ইনিংসের পর থেকে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট মিডিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশী মিডিয়াতেও প্রজন্মের সেরা ব্যাটসম্যান স্বীকৃতির জন্য টেন্ডুলকারের সাথে তার একটা কম্পিটিশন সৃষ্টি করে দেয়, যা সবখানের মতো বাংলাদেশের দর্শকও গোগ্রাসে গিলতে থাকে, এবং অদ্যাবধি গিলেই চলেছে।
শুধুমাত্র ফিল্ডিং দিয়েই ক্রেজ তৈরি করেছিলেন সাউথ আফ্রিকার জন্টি রোডস। ৯৬ বিশ্বকাপের পর ফ্যাশনসচেতন শেন ওয়ার্ন আর রিস্ট প্লেয়ার সুদর্শন মার্ক ওয়াহ এদেশের ক্রিকেট কমিউনিটিতে ঢুকে পড়েন।
ক্রিকেটারদের সিনেমা নায়কদের মতো বাংলাদেশী তরুণীদের কাছে ক্রেজ বানানোর যাত্রাও পুরনো নয়। এক্ষেত্রেও ওয়াসিম আকরামই পায়োনিয়ার। তার সময়কার আরেকজন পেসার আকিব জাভেদ নিয়মিত সুযোগ না পেলেও চেহারার কারণে তরুণীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পান। শ্রীলংকার রোশান মাহানামা খেলোয়াড় হিসেবে তেমন আকর্ষণীয় না হলেও তরুণীদের মধ্যে ক্রেজ ছিলো।
তবে তরুণী-ক্রেজ প্রশ্নে সকল ভব্যতা বা ক্রিকেটিয় যুক্তিবোধ হার মানবে যে লোকটির কাছে, তিনি এখনো খেলে যাচ্ছেন; বুমবুম আফ্রিদি। ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’ লিখে লজ্জায় ডোবানোর ইতিহাস আজ থেকে ১৮ বছর আগে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে, তবু মনে হয় যেন এখনো সেই ঘটনা জীবন্ত। ২০ বছরের ক্যারিয়ারে ক্রিকেটিয় অর্জন তেমন কিছু নেই, তবু তাকে নিয়ে মিডিয়া হাইপ; এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপারই বটে।
আফ্রিদিকে নিয়ে আরও কিছু কথা না বললে আলোচনা আংশিক থেকে যায়। আরেকটু বিস্তারিত লিখি। ৩৯৮ ওয়ানডে খেলে আফ্রিদ ৮ হাজারের কিছু বেশি রান করেছেন, ৩৯৫টি উইকেট পেয়েছেন, ৩২ বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন। টি-টোয়েন্টি পারফরম্যান্স খুবই বাজে। ৯৮টি ম্যাচ খেলে গড় মাত্র ১৮ এবং উইকেট ৯৭টি। তুলনায় টেস্ট পারফরম্যান্স বরং ভালো। ২৭ টেস্টে ৫টি সেঞ্চুরি, ৮টি হাফ সেঞ্চুরি, গড় ৩৬.৫১, উইকেট ৪৮টি। কিন্তু টেস্টের জন্য তাকে সেভাবে বিবেচনাতেই নেয়া হয়নি, পরিসংখ্যান একজন কিংবদন্তী পর্যায়ের ওয়ানডে অলরাউন্ডার বললেও মাতামাতি সবকিছুই তার ব্যাটিং নিয়ে; এটা নিয়েই যত আপত্তি। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ছক্কা (৩৫১টি) হাঁকানোর রেকর্ড এখনো তার (২৩৮টি নিয়ে গেইল আছেন ৩য় স্থানে), দীর্ঘতম ছক্কাটিও তার হাঁকানো। ক্রিকেট বলতেই মেজরিটি দর্শক যেহেতু চার-ছক্কা বুঝে, সেই হিসেবে ছক্কা একটা ফ্যাক্টর হতে পারে, কিন্তু ২ বলে ২টা ছক্কা মেরে ৩য় বলে আউট হয়ে যাওয়াটা যে মূর্খতা এবং অক্রিকেটিয় এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শকরা বুঝতে পারে না, এমনকি এভাবে যে জেতার চাইতে হারা ম্যাচের সংখ্যাই বাড়ে সেটাও বুঝে না।
শো-অফ টেন্ডেন্সিই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মৌলিক এবং মজ্জাগত স্বভাব, আফ্রিদির বিপুল জনপ্রিয়তা সেটাই প্রমাণ করে। সে কখনো টিম প্লেয়ার ছিলো বলে মনে হয়নি, গ্যালারির হাততালি পাওয়া, নিজের সামর্থ্য জাহির করা বা দেখিয়ে দেয়া এসবই ছিলো তার ব্যাটিংয়ের দর্শন। ক্রিকেট কিংবা ক্রিকেটের বাইরের অধিকাংশ গড়পড়তা বাংলাদেশীর মনে-মননে একজন আফ্রিদি বসবাস করে। আফ্রিদির জনপ্রিয়তা সেই দায়মুক্তির প্রাতিষ্ঠানিকতামাত্র।
আফ্রিদি ক্যারিয়ারের প্রথম দশকে একজন মারকুটে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন, ৩৭ বল এ সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েছিলেন, বোলিং করতেন টুকটাক। সাকলাইন মুশতাক, সাঈদ আজমলদের কারণে বোলিং নিয়ে সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। কিন্তু ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় দশকে তিনি পুরোপুরি বোলার হয়ে যান, এবং ৮ বা ৯ নম্বরে ব্যাট করা স্লগারে পরিণত হন। অবশ্য যখন টপ অর্ডারে ব্যাটিং করতেন তখনও তিনি স্লগারই ছিলেন। ড্রাইভ, পুল, কাট, ফ্লিক কোনোধরনের শটেই তিনি পারদর্শী ছিলেন না, হ্যান্ড-আই কোঅরডিনেশনের বালাই ছিলো না, রিফ্লেক্স ছিলো না, তবু তার নিক হয়ে গেল বুমবুম। জয়াসুরিয়া, গিলক্রিস্টদের তাণ্ডব দেখেছেন, ক্রিস গেইল, ডেভিড মিলার, ব্রেন্ডন ম্যাককালামের পাওয়ার হিটিং দেখেছেন, কিংবা শেওয়াগের এগ্রেসিভ ব্যাটিং দেখেছেন; তাদের সাথে মেলালেই বুঝতে পারবেন আফ্রিদির ব্যাটিং সেই কাতারে ফেলা যায় কিনা। পক্ষান্তরে, ৩৯৫টি ওয়ানডে উইকেট পেয়েছেন। তিনি যে গতিতে বল করেন ভারতের রবিন সিং বা বাংলাদেশের খালেদ মাহমুদরা বড় রানআপ নিয়েও তত জোরে বল ডেলিভারি দিতে পারতেন না; আবার শেন ওয়ার্ন বা স্টুয়ার্ট ম্যাকনিল না হোক, অন্তত ভারতের অমিত মিশ্র মানের লেগস্পিনারও তাকে বলা যায় না। তবু উইকেট যেহেতু পেয়েছেন, বোলার হিসেবে বেনিফিট অব ডাউট পেতেই পারেন। সাকিব আল হাসানেরও তো আর্মার ছাড়া স্টক ডেলিভারি নেই, তাকে স্লো-লেফট আর্ম অর্থোডক্স বললে, আফ্রিদিকেও স্পিনার বলা যেতেই পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো আর্টিকেল পাইনি যেখানে আফ্রিদির বোলিং নিয়ে কথা হয়েছে, আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের বিজ্ঞাপন মানেই আফ্রিদি এই যে মিথ (মিথ্যা) বাংলাদেশের স্পোর্টস মিডিয়া সেলেবল করছে, এই দায়টা ভাঙার দায়িত্ব কারা নেবে? তারাই যারা ক্রিকেট নিয়ে চিন্তা করে, লিখে, আফ্রিদিকে নিয়ে ট্রল করে বরং তাকে ঘিরে হওয়া মাতামাতির মার্কেটিং করা হয়। ওয়ানডে ক্রিকেটের দীর্ঘ জার্নিতে ক্যালিস, ফ্লিন্টফ বা নিদেনপক্ষে শেন ওয়াটসন, সনাথ জয়াসুরিয়ার সাথে তুলনা করলেও আফ্রিদি অনেক পিছিয়ে থাকবেন, কিন্তু ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’ আর ‘ভারত-পাকিস্তান ইফেক্টের’ কারণে তিনি পরিণত হয়েছেন লিজেন্ডে। আমরা যারা ৯০ এর দশক থেকে ক্রিকেট ফলো করি, স্পোর্টস মিডিয়ার এই ক্ষতিকর স্ট্র্যাটেজিকে সাপোর্ট করা তাদের জন্য স্রেফ বিরক্তিকর। আফ্রিদির যে স্টাইল তাতে টি২০ তে তার সবচাইতে সফল হওয়ার কথা, অথচ এখানেই তিনি চরম ফ্লপ। কারণটা খুব সিম্পল; টি২০ শুধু পাওয়ার দিয়ে চলে না, এর সঙ্গে প্রচণ্ড স্কিল আর ইন্টেলিজেন্স থাকতে হয়, যে দুটোরই ভয়ানক অভাব রয়েছে এই ভদ্রলোকের।
ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের নিয়ে এই ক্রেজের কারণ কী আসলে? প্রথম কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক ও ভৌগলিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দুটো দেশের প্রভাব এত স্পষ্ট যে তাদের নিয়ে জনমনে কৌতূহল এমনিতেই থাকে। মিডিয়া তার ফায়দা নিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই যুদ্ধংদেহী আবহ ক্রিয়েট করতো। তখন শারজাহতে নিয়মিত টুর্নামেন্ট হতো যেখানে ভারত-পাকিস্তানের থাকাটা অবশ্যম্ভাবী ছিলো, কানাডায় শাহারা কাপ নামে দুই দেশের মধ্যে একটা দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হতো। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে লেখার মতো চটকদার কিছু না থাকায় ‘প্রতিবেশী’ আর ‘মুসিলম’ এই দুই তত্ত্ব হাজির করে ভারত-পাকিস্তান নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ ঢুকিয়ে দেয়া হতো। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেট নিয়ে সেভাবে কোনো লেখাই আসতো না। তারাও বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে খুব একটা কানেক্টেড ছিলো না, ভারত-পাকিস্তানের সাথে তবু এশিয়া কাপ, সার্ক ক্রিকেট সূত্রে হলেও খেলা পড়তো। শ্রীলংকা প্রমিজিং হওয়া সত্ত্বেও তাদের পরিচিতি থেকেছে দ্বীপ দেশ হিসেবে, যে কারণে ঘুরে ফিরে সেই ভারত-পাকিস্তান বলয়েই আবদ্ধ।
এবং খেলার মধ্যে ন্যাশনালিজম সেন্স ঢুকিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াটাও এভাবেই শুরু হয় এদেশে। ৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানকে হারিয়ে দিলো, তখন রিপ্রেজেন্টেশনটা হলো এরকম ৭১ সালের পর এতো বড় আনন্দের উপলক্ষ্য আর আসেনি, অথচ ৩ কোটি মানুষও এদেশে একটিভলি ক্রিকেট ফলো করে না। সেই খেলাটা হয়ে গেল দেশপ্রেমের অংশ, ক্রিকেটাররা হয়ে গেল টাইগার। এই অদ্ভুত মিডিয়া স্ট্যান্স মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়ানো ছাড়া কী করেছে? যে মানুষটি ছোটবেলায় ভারত বা পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের ক্রেজ দেখে বড় হওয়া সূত্রে খেলার সময় তাদের জিততে দেখলে আনন্দিত হয়, বা খেলাকে সমর্থন করে সে হয়ে গেল ভারত বা পাকিস্তানের সমর্থক। অর্থাৎ তারা রাজাকার, ভারতের দালাল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, এরকম যারা ট্যাগিং করেন বা দেশ, রাজনীতি, জাতিসত্তা নিয়ে রেফারেন্স দাঁড় করান, তারা কি ভেবেছেন পাকিস্তানের হকি খেলার সময় ক্রিকেট সাপোর্ট করা লোকটি পাকিস্তানকে সমর্থন করে কিনা, কিংবা পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গুনগুন করে গায় কিনা, পাকিস্তানের নির্বাচন বা সেনা হস্তক্ষেপ বিষয়ে চিন্তিত কিনা। এর কোনোটাই যদি না করে তাহলে স্রেফ ওয়াসিম আকরাম কিংবা টেন্ডুলকারকে ভালো লাগাসূত্রে তাদের দলকে সমর্থন জানানো মানেই কি সে পাকিস্তান বা ভারতের সমর্থক হয়ে গেল? যেমন, এদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থন করা ৮০% মানুষ ম্যারাডোনার কারণে তাদের সমর্থন করে, তাদের বাবা-চাচারা হয়তোবা ম্যারাডোনার খেলা দেখেছিল ৮৬ ফুটবল বিশ্বকাপে, সেই গল্প শুনে তারাও বংশ পরম্পরায় আর্জেন্টিনা সমর্থন করে। এখন মেসির খেলা দেখে অনেকে আর্জেন্টিনার সমর্থক হচ্ছে, যার প্রভাবে আরও ২০-২৫ বছর পরেও আর্জেন্টিনার নতুন সমর্থক আসবে। সেটা যদি সমস্যা না হয়, ফুটবল বিশ্বকাপের সময় সারা দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানীর পতাকায় ছেঁয়ে ফেলা যদি স্পোর্টস ক্রেজ হিসেবে মেনে নেয়া যায়, ক্রিকেটের বেলায় দৃশ্যপট বদলে যায় কেন? ফেসবুক আসার পর বোধহয় এই বিদ্বেষ সংস্কৃতি আরও বেড়েছে।
আমাদের ক্রিকেট উন্নতি করছে। এখনকার বাচ্চাদের আইডল খুঁজতে ভারত-পাকিস্তানের দিকে তাকাতে হয় না। আমাদের সাকিব আছে। মাশরাফির চাইতে জনপ্রিয় ক্রিকেটার বর্তমান বাংলাদেশে একজনও নেই। বিরাট কোহলি, উমর আকমলরা যতই পারফরম করুক, ক্রেজ তৈরির মতো অবস্থায় কখনোই আর পৌঁছাতে পারবে না। যে কিশোরী বা তরুণীরা ম্যারি মি আফ্রিদি লিখতো তাদের মেয়েরা এখন তাসকীনকে নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগি, সাব্বিরের চোখ দেখে বলে ‘বন্ধুর দুইটা চোখ, যেন দুই নালা বন্দুক’। এমনকি গানেও কত পরিবর্তন এসেছে। ৯৮ সালে বাংলাদেশে যখন মিনি বিশ্বকাপ হলো, শুভ্র দেব থিম সঙ করেছিলেন ‘সব জাতি এক হয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়বো, সোনার বাংলাদেশে ক্রিকেটের জয়গান গাইবো’। আর এখন বাংলাদেশের জয় মানেই আসিফের গাওয়া ‘বেশ বেশ সাবাশ বাংলাদেশ, যাও এগিয়ে আমার বাংলাদেশ’ গানটি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়া। যেটা খুবই অকল্পনীয় ছিল, ২০১৫ এর পর সেটাও হচ্ছে। চমক হাসান ইউটিউবে বাংলাদেশের বীরত্বগাঁথা নিয়ে ক্রিকেট ফানি সংগীত করছেন, অর্থাৎ আমরা উঠে আসছি। সামনের দিনগুলোতে গানের কথা আরও বিবর্তিত হবে। কাজেই ভারত-পাকিস্তানের ক্রেজ এমনিতেই স্তিমিত হয়ে আসছে। এর মধ্যেও যারা পাকিস্তান দলকে নিয়ে পোস্ট লিখে, বা ভারতের সমর্থন জানিয়ে লিখে, নিশ্চিত থাকুন তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশ জিতলে আপনার মতোই খুশি হয়, কিন্তু ছোট বেলার প্রভাব এড়াতে পারে না; ওয়াসিম আকরাম বা টেন্ডুলকারের ইনফ্লয়েন্স তারা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। এর সঙ্গে জাতিসত্তার লেশমাত্র সম্পর্ক নেই। আপনি হাই ইন্টেলিজেন্সের মানুষ, আপনি বোঝেন দেশ একটি রাজনৈতিক কনসেপ্ট, খেলাধুলাকে এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে দেখানো হলেও এর মূল উদ্দেশ্য ন্যাশনালিজম প্রোমোট করা, তাই খেলা প্রচণ্ড পলিটিকাল। কিন্তু ভাইয়া/আপু, এটাও তো বুঝতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এসব কঠিন তত্ত্ব-উপাত্ত নিয়ে ভাবে না, তারা জাস্ট এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালু নিয়েই ভাবিত, আপনি অহেতুক তার মধ্যে কমপ্লেক্সিটি ঢুকিয়ে নিজের বিদ্যাটুকু জাহির নাইবা করলেন নাহয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্রিকেটের আরও বেশি কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ আছে। এদেশের মানুষ সময় নিয়ে সচেতন নয়, এরা পরিশ্রমী কম, তাই ক্রিকেট একটা বড় অপরটুনিটিও। সেটা নিয়ে কাজ করুন, তাতে দেশের উপকার হতে পারে। পাকিস্তানের ক্রিকেট নিয়ে পোস্ট লিখলে রাজাকার, ভারতের ক্রিকেট নিয়ে বললে দালাল- এগুলো তো অসুস্থ ও নিম্ন চিন্তাধারার লক্ষণ। আপনি না নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে তৃপ্তি পান!
দেশ আপনার আমার কল্পনার চাইতেও অনেক বড়, আর ক্রিকেট আমাদের ভাবনার চাইতেও ক্ষুদ্র। কোনো একদিন বাস্কেট বল বা রাগবি দেশের জনপ্রিয়তম খেলা হতেই পারে, তখন কি এগুলোও দেশ হয়ে যাবে? মাত্র ২টা দেশ (ভারত, অস্ট্রেলিয়া) আছে যেখানে ক্রিকেটের ক্রেজ পাবেন; বিশ্বের প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে সংখ্যাটা তুচ্ছ নয়? জনপ্রিয়তাই যদি দেশ হয়ে যায়, তাহলে কোনো একদিন সিক্স প্যাক, ভ্রু প্লাক এগুলোও দেশ হয়ে যাবে কিন্তু। কাজেই দেশকে দেশের মতো থাকতে দিন, জনপ্রিয়তা একটা ট্রেন্ড বা সময়কেন্দ্রিক ধারণা, যা আজ আছে, কাল থাকবে না। কিন্তু দেশ দেশই থাকবে যতদিন পর্যন্ত বড় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটে।
ক্রিকেট কালচার নিয়ে কাজ করতে হলে সংখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যত বেশি সংখ্যক মানুষ ক্রিকেটে ফ্যাসিনেটেড হবে, ক্রিকেট নিয়ে ভাববে, কালচার বিল্ড আপ ততো স্মুথ হবে। বানের জলের সাথে শুধু মাছই আসে না, সাপ-কাঁকড়াসহ বহু ক্ষতিকর প্রাণীও আসবে। সংখ্যাবৃদ্ধির ঝক্কিটাও এখানেই। সেই ফিল্টারিংটা নিয়ে কাজ করা যেতে পারে, ফালতু লেখার বিপরীতে ৩টা ভালো লেখা তৈরি করা যেতে পারে যাতে অন্যরা বিভ্রান্ত না হয়। তার পরিবর্তে দোষারোপ, ট্রলিং বড্ড বেশি প্রতিক্রিয়াশীল এবং চিন্তাশূন্য আচরণ।
ক্রেজের বাংলা পরিভাষা উন্মাদনা। এটাকে পজিটিভলি দেখা যেতে পারে, থ্রেটও ভাবা যেতে পারে। আমাদের গড় মানসিকতাই নির্ধারণ করে দেবে ক্রিকেট ক্রেজের চূড়ান্ত ভবিষ্যত। আমাদের ক্রেজ কি ভারতের মতো হবে যারা স্টেডিয়ামে আগুন দেয়, খেলোয়াড়দের বাড়িতে হামলা করে, নাকি অস্ট্রেলিয়ার মতো যারা সুন্দরভাবে গ্যালারিতে বসে টেস্ট, ওয়ানডে, টি২০ সব ফরম্যাটই সমান আগ্রহে উপভোগ করে? ক্রিকেট তো জীবন নয় যে প্রত্যেকটা বলই দেখতে হবে, তাই সময়ের প্রশ্নটি অবান্তর। যদি ২ ওভার খেলাও দেখা হয় সেটাতে যেন ভালো লাগা থাকে।
ভারত-পাকিস্তান ক্রেজ চলে গেছে, এখন বিদ্বেষটা চলে গেলেই আমরা absolute ক্রিকেট ক্রেজের আস্বাদন অনুভব করতে পারবো। বিদ্বেষমুক্ত ক্রিকেট প্লাটফরম গড়ে উঠুক আমাদের হাত ধরেই।