যদি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অপারেশন করে লিওনেল মেসির পা কেটে বাদ দিতে হয়, কিংবা প্লাস্টিক সার্জারিতে পালটে যায় আমির খানের চেহারা, সেই মেসি বা আমির খান কি মার্কেটে টিকে থাকবে? তাদের এরপরের জার্নিটা কেমন হবে?
পারফর্মিং আর্ট এর একজন ব্যক্তির থেকে যদি তার পারফর্মিং টুলটাই বিচ্ছিন্ন হয় চিরতরে, শরীরসর্বস্ব প্রাণী হয়ে বেঁচে থাকার গ্লানি সে কীভাবে সয়ে নেয়, বা আদৌ কি নিতে পারবে? তার মোরাল এবং এক্সিসটেনসিয়াল ক্রাইসিসিগুলো বাইরে থেকে কতটা অনুভব করা যায়?
— এরকম এক গভীর দার্শনিক সংকট নিয়ে ডিল করার স্কোপ ছিল শিবুপ্রসাদ-নন্দিতা গ্রুপের ফিল্ম কণ্ঠ তে। কিন্তু সকল স্কোপ মাঠে মারা খেল মার্কেট ডিমান্ড এর কাছে; শেষ পর্যন্ত এটি হয়ে উঠলো অনেকটা এনজিও এর টাকায় নির্মিত শিক্ষণীয় ডকুমেন্টারি গোত্রীয় কিছু একটা৷
মার্কেট ফাইট ব্যাক এর গল্প শুনতে চায়, প্রতি মুহূর্তে ইনস্পাইরিং মুহূর্ত দাবি করে। অনগ্রসর এই মার্কেটে রোমান্স অথবা ফাইট ব্যাক না থাকলে সেই গল্প মার্কেটে বিকোয় না।
গল্পের মূল প্রোটাগনিস্ট একজন জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী তথা রেডিও জোকি, কণ্ঠনালীর ক্যান্সারে যখন কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে প্রথম ২০-২২ মিনিটের মধ্যেই, আমরা শতভাগ নিশ্চিত থাকি প্রোটাগনিস্ট এখান থেকেও ঘুরে দাঁড়াবে, কথা বলবে এবং পূর্বের পেশায় ফিরে যাবে। সবচাইতে পশ্চাৎপদ দর্শকটিরও এই ফর্মুলাবদ্ধ পরিণতি নিয়ে সামান্যতম সংশয় থাকার কথা নয়। সকলেই যা জানি আড়াই ঘন্টা ধরে সেই প্রেডিক্টেবিলিটির অনুশীলনে সৃজনশীলতার মাহাত্ম্যটা কি থাকে আদৌ?
বেশ কিছু প্রোডাকশন দেখার পর শিবুপ্রসাদ-নন্দিতা গ্রুপকে কিছুটা পরিমার্জিত অঞ্জন চৌধুরি, প্রভাত রায় ঘরানার পরিচালক মনে হচ্ছে। অঞ্জন চৌধুরি এর ছিল বড় বউ, মেজ বউ, ছোট বউ ঘরানার ফিল্ম আর ছিল রঞ্জিত মল্লিক নামের রেসিপি মাসালা অভিনেতা। আজ ৩০-৩৫ বছর পরে শিবুপ্রসাদদের স্টোরিতেও বড় বউ-মেজ বউ প্রাসঙ্গিক থাকে, এবং রঞ্জিত মল্লিককে রিপ্লেস করেছে অনুপম রায় নামের ট্যালেন্টেড মিউজিশিয়ানের মাধ্যমে। অনুপমের লিরিক আর কম্পোজিশন বাদ দিলে শিবুপ্রসাদের ফিল্মের বড় অংশই মেজ বউ হয়ে যায়।
সময় বদলালেও মার্কেটের চাহিদা কেন বদলায় না, এর সঙ্গে সম্ভবত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শিক্ষার মান, লাইফস্টাইল প্রভৃতি ফ্যাক্টর অপরিবর্তিত থাকার যোগসূত্র রয়েছে। আগে প্রসেনজিত-চিরঞ্জিতরা উদ্ভট কম্পোজিশনের পোশাক-নাচ-গান আর সংলাপ দিত, শেষের দিকে ঢিশুম-ঢুশুম ফাইট হত, সেই আবহের স্থলে আমরা দেখি মেন্টাল স্ট্রাগল, কনফ্লিক্ট প্রভৃতি কেতাবি গ্রামার; কিন্তু গল্পের ফ্ল্যাটনেস এ কোনো মোচড় পাই না।
কণ্ঠ ফিল্মটা আমরা কার চোখে দেখব; পাওলি দাম এর চোখ দিয়ে দেখলে তো খালি খালি লাগে সব৷ এসব পরিস্থিতিতে প্রচুর আশাভঙ্গের ঘটনা ঘটে, অনেকে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চায়। অথচ পাওলি দাম এর জন্য সবকিছু কত স্মুথ। সবাই তার প্রতি কো অপারেটিভ, এমনকি ডাক্তার পর্যন্ত তার ফেভারে। স্বামীর সাথে বারদুয়েক কনফ্লিক্ট এর বাইরে তেমন কোনো সংকট নেই। এতটা একরৈখিক ক্যারেক্টারাইজেশন কীভাবে সম্ভব!
বরং পাওলি দাম যখন শিবু প্রসাদ আর জয়া আহসানের মধ্যে প্যাশেন্ট-চিকিৎসক এর বাইরে ভিন্ন এক সম্পর্ক খুঁজতে চায়, রোমান্টিক এঙ্গেল আবিষ্কার করে সেই জায়গাটা অনেক বেশি জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করে। ক্যান্সারে একজন ব্যক্তি চিরতরে বাকহীন হয়ে জীবন কাটাবে, নাকি যার নিবিড় প্রশিক্ষণে হতাশ-বিষন্ন-বিধ্বস্ত মৃতবৎ অবস্থা থেকে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলো তার সাথে সম্পর্কের সামাজিক সীমা কিছুটা লাইন অতিক্রম করে গেলেও সেটাকে মানবিক পয়েন্ট থেকেই দেখবে, ইথিকাল গ্রাউন্ডের ডিজাইনটা কেমন হওয়া উচিত এক্ষেত্রে— এসব ন্যারেটিভ নিয়ে ডিল করতে না পারলে এসব ফিল্ম শেষ পর্যন্ত টিনেজার আর মিডিওকর চিন্তার মানুষদেরই সাময়িক স্টিমুলেশনের উপলক্ষ হয় মাত্র৷ প্রোটাগনিস্ট এর পতিব্রতা স্ত্রী এর বাইরে পাওলি দাম এর কি আদৌ স্বাধীন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়?
যদি আমরা শিবুর চোখ দিয়ে দেখতে চাই, এমন কিছু কি পাই যেখানে স্পার্ক আছে? শিশিপুত্র গাছের ডালে লটকে যাওয়া ঘুড়ি ছাড়াতে গিয়ে বিপজ্জনকভাবে দেয়ালে উঠে গেছে, পড়ে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে, সে পুত্রকে ডাকছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না; এর বাইরে তার কার্যকলাপ তো টিপিকাল বিষন্ন এবং ঘুরে দাঁড়ানোই। এই ধরনের মানুষ অনেক বেশি হন্টেড থাকে, প্রচুর হিউমিলিয়েশনের স্বীকার হয়, অথচ তার চেনা জগতে একটিও ক্রিটিকাল ক্যারেক্টার নেই। মানুষের জীবন আসলেই কি এতটা ব্লেজিংপ্রাপ্ত হয়?
আমরা বরং জয়া আহসান এর চোখ দিয়ে দেখলে কিছুটা স্পাইসি এলিমেন্ট পেতে পারি। প্রাক্তন স্বামীর সাথে ট্রমাটিক সম্পর্কের স্মৃতি, কর্মব্যস্ততা, এর মধ্যে একজন ক্যান্সার সারভাইভার প্যাশেন্টকে পুনর্বাসিত করা, তার সঙ্গ উপভোগ করা এবং তার দেয়া ছোট্ট বনসাইটি স্যুভেনির হিসেবে সাথে রাখা সবটার মধ্যে এক ধরনের প্লেটোনিকতা লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু সোস্যাল মব এর অনুশাসনে প্লেটোনিকতার স্থান নেই। তাই গল্পের সেটিংটাই এমন ছিল, প্রথম দৃশ্য থেকেই আমরা জানি জয়াকে অবশ্যই কলকাতা থেকে ফিরে আসতে হবে ঢাকায়, পরিচালক কোনোভাবেই শিবু-জয়াকে একই শহরে বা দেশে এফোর্ড করতে পারলো না। এটা দেখে মনে আসছিল বাংলা সিনেমার গান- চিরদিন তোমাকে ভালোবেসে যাব, কখনো দেব না বুঝতে, কখনো দেব না হারাতে…
অথচ মানুষের সাথে মানুষের কত বিচিত্র ক্যাপাসিটিতে সম্পর্ক হতে পারে। ডিসেন্সি বজায় রেখে সেসব সম্পর্ক চালিয়ে নেয়া যায় দীর্ঘকাল ধরেই, কোনোরকম উপদ্রব ব্যতিরেকেই৷ কিন্তু পাওলি দাম এর মতো আমরাও প্রতিটি সম্পর্কের নাম খুঁজি, নইলে সিঙ্গুলারিটি ক্ষুন্ন হয়। অতি পজেসিভনেস শেষ পর্যন্ত কি সম্পর্ককে সমুজ্জ্বল রাখতে পারে আদৌ? নামকরণের মধ্য দিয়ে সম্পর্ককে বৈধতা দেয়ার যে ডিপ্লোম্যাসি এখান থেকেই মানুষ আদতে নিজের উৎকর্ষকে খর্বিত করে। সেটাই সবচেয়ে দুর্বল গুণ যেটার কোনো চ্যালেঞ্জ বা পরীক্ষা নেই। ব্র্যাকেটবন্দী সম্পর্ক আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং পরিমিতি বোধকে বোতলবন্দী করে দেয়।
এইসমস্ত ক্রিটিকাল দৃষ্টিকোণ এড়িয়ে কেবল খুচরো মোটিভেশন আর কিছু সুন্দর সিনেটোগ্রাফির সমন্বয়েই যদি তৈরি হয় ফিল্ম, রার চেয়ে বরং ওয়েডিং ফটোশ্যুট করা অধিক ক্রিয়েটিভ এবং প্রফিটেবল আর্টওয়ার্ক। কন্ঠ ফিল্মটাও সেই শ্রেণিভুক্তই রাখবো৷ অনুপম রায় এর ‘আলোতে আলোতে ঢাকা’ গানটি মনে ধরেছে, এই ঘরানার লিরিকের প্রতি ব্যক্তিগত আগ্রহ রয়েছে, নিযে যখন লিরিক লিখি এই ধারাটা প্রায়োরিটি পায়। এর বাইরে পুরো ফিল্মটাই মীনা কার্টুনের মতো শিক্ষামূলক গল্প, যা দেখবার বা শুনবার বুদ্ধিবৃত্তিক স্তর ২৫ বছর আগেই পেরিয়ে এসেছি বিশ্বাস করি জোরালোভাবে!