পপুলিস্ট সাহিত্যের দায়-অনাদায়: কেইস স্টাডি রাসয়াত রহমান জিকো
বর্ষার অনাকাঙ্ক্ষিত গরমে কাহিল, ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে কর্কশ বাড়িওয়ালারূপী রোদের উপদ্রব থেকে বাঁচতে চাইছি সেই মুহূর্তে কন্যা উনিশ এনড্রোয়েড ফোন ধরিয়ে দিল হাতে। শুনতে পাই স্পষ্ট কণ্ঠে বলছে- ‘আব্বা জিক্কু জ্যাঠার বইয়ের পিডিএফ পাইছি। জ্যাঠায় বইয়ের নামখান রাখছে জব্বর- “সন্ধ্যা নামার ক্ষণে”। বিড়ালের মতো শুইয়া না থাইকা বইডা পইড়া আমারে সামারি শুনাও’।
পড়িমড়ি করে ফ্লোর থেকে উঠি প্রবল অবিশ্বাসে- ‘ওই তুই কেডা? ৫ মিনিট আগেও তো তরে ৩ বছরের গেন্দা দেখলাম, এখনো বাক্য ফুটে নাই মুখে। আঁৎকা যেমনে বাইড়া উঠছোস বয়স ১২-১৩ এর কম হইবো না, কিন্তু আমার বয়স বাড়ছে বইলা তো মনে হইতেছে না। সে যাই হোক, উনার নাম রাসয়াত রহমান জিকো; তুই জিক্কু ডাকলি ক্যান’।
‌‌
‘হিমালয় সাহেব ভনিতা না করে বইটা পড়ুন। আপনার জন্য গ্রিন টি নিয়ে আসি’- বলে উনিশ আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে রান্নাঘরের দিকে এগোয়।
মোবাইলের স্ক্রিনে পিডিএফ ফাইলটাতে চোখ লেলিয়েছি, ঠিক তখনই পাশে উনিশকে শুয়ে থাকতে দেখি। বয়স ৩-ই রয়ে গেছে!
বই পড়তে থাকি, সমান্তরালে রান্না হতে থাকে প্রশ্ন আর উত্তরের চচ্চরি। প্রথমেই প্রশ্ন আসে বাংলাদেশে বইয়ের ক্রিটিক হয় না কেন? রিভিউ লিখে অনেকে, সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুগ্ধতা অথবা মোহভঙ্গতার চেনা রেসিপিতে আটকে থাকে।
পরের প্রশ্ন জীবনে সাহিত্যের উপযোগিতা কী? প্রশ্নটা বিপদে ফেলে দেয়। একজন ব্যক্তি ক্রাইম থ্রিলার যে কারণে পড়ে, নীটশে বা কাফকা পড়ার উপযোগিতা নিঃসন্দেহে আলাদা। কিংবা কমেডির উপযোগিতা দিয়ে রোমান্টিক বা স্যাটায়ারের উপযোগিতা পরিমাপ করা যাবে না।
দ্বান্দ্বিকতার শুরু হয় যখন উপযোগিতাকে ছাপিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণটাই মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠে। কাফকা বা নীটশে পড়লে উৎকৃষ্ট সাহিত্য পড়া হচ্ছে, ড্যান ব্রাউন বা জে.কে, রাউলিং পড়া নিম্নরুচি বা স্থূলরুচি— এই যে ওভার-সিম্পলিফিকেশন এটা সামাজিক শ্রেণি সংঘাতের মতোই মারাত্মক ক্ষতিকর।
বইয়ের উপযোগিতাকে আমি খুবই সরল এক প্যারামিটারে পরিমাপ করি। একটা বই পড়ে পাঠক যদি তার উপলব্ধি যথার্থভাবে নিজেকে বোঝাতে পারে, এবং ৮-১০ বছর পরেও আচমকা সেই উপলব্ধি স্মরণে আনতে পারে সেটাই বই পড়ার সার্থকতা। যদি পড়ার কিছুদিনের মধ্যেই কেবল কনটেন্টের খণ্ডিত অংশ মনে থাকে, উপলব্ধিটুকু হারিয়ে যায় সেই বই পড়া আর না পড়া একই কথা। আপনি মাসে ৩৫টা বই পড়েছেন; ক্যামু-বোর্হেস-ফুয়ান্তেস-চেখভ-বিভূতিভূষণ-মানিক-রবীন্দ্রনাথ কাউকে বাদ রাখেননি, কিন্তু উপলব্ধি কী জিজ্ঞেস করলে বলতে বা লিখে প্রকাশ করতে পারবেন না, উটকো ধনীরা যেরকম টাকার গরম দেখায় আপনার ব্যাপারটাও পড়ার গরম দেখানো বৈ কিছু নয়।
যারা ক্রিটিক করেন তারা সাধারণত পপুলিস্ট সাহিত্যকে এড়িয়ে চলেন, ক্রিটিক করবার যথেষ্ট যোগ্য মনে করেন না। এটা একটা বড়ো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি। পপুলিস্ট সাহিত্য সারা পৃথিবীর পাঠকদের বৃহত্তম অংশের মানুষদের কেন আকৃষ্ট করে এটা তো চিন্তার জন্য দুর্দান্ত এক উপকরণ হতে পারে। উপলব্ধি প্রশ্নে পপুলিস্ট সাহিত্য আটকে পড়বে হয়তো, এক কাপ চা পান করা বা সালমান খানের একটা মুভি দেখার সময়টুকুতে যে হাসি-আনন্দের মধ্যে থাকা হয়, পান করা বা সিনেমা দেখা শেষে যদি কিছু মনে নাও থাকে আনন্দ কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয় না।
কেউ যদি কেবলমাত্র সালমান খানের সিনেমাই দেখে সেটা তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের সীমাবদ্ধতা, সিনেমার কনটেন্ট-কনসেপ্টের নয়। আমরা হয়ত এভাবে দেখতে পারি যে কোনো ভারি খাওয়া-দাওয়া শেষে ডেজার্ট দেয়া হয়। ডেজার্টই একমাত্র মেনু বানিয়ে ফেললে ডেজার্টের উপযোগিতাকে কি প্রশ্ন করা যায়?
পপুলিস্ট সাহিত্য কি ডেজার্টতুল্য? হতে পারে নাও পারে।
রাসয়াত রহমানের বই ৭০-৮০ পৃষ্ঠা পড়েছি, সেই সময়ে আচমকা প্রশ্ন আসে যে কোনো ফিকশনধর্মী সাহিত্য কি থিয়েটার দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত? কিংবা বহু আগে থেকেই রাজ দরবারে সভাকবি পদ ছিল, রঙ্গশালা বসতো, সেই প্রভাব কি চিরতরে বহন করছে কথা সাহিত্য? একটি ক্যারেক্টারকে উপস্থাপন করতে গিয়ে যেভাবে তার পোশাক, চেহারা, বা বাড়ি-ঘর-রুম-দরজার পুঙ্খানুপুংখ বর্ণনা দেয় তাতে প্রত্যেক কথাসাহিত্য বায়োস্কোপের মতো লাগে। দেখার সময় সঙ্গত কারণেই চিন্তা কম করতে হয়, কেবল দর্শনেন্দ্রিয় সক্রিয় থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিনের পরম্পরায় প্রায় সকল দেশের কথা-সাহিত্যকগণ ফিকশেনর যে ফর্ম তৈরি করেছেন, প্রশ্ন আসা অবধারিত এমনটা কেন হলো? তখনই থিয়েটার এবং তারও পূর্বে গল্প বলার আসরের যে প্রাগৈতিহাসিক রীতি সেসব মনে পড়ে।
রাসয়াত রহমান জিকোর সন্ধ্যা নামের ক্ষণে বইটিকে কোন শ্রেণিতে ফেলা যেতে পারে?
প্রতিষ্ঠিত ক্রিটিকদের অভিমত যা-ই হোক আমি একে রোমান্টিক থ্রিলার হিসেবে পেয়েছি। ব্যক্তিজীবনে এবং চিন্তার দিক থেকে তিনি হিউমারপ্রিয়, যে কারণে রোমান্টিক থ্রিলারের বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে কিঞ্চিৎ হিউমার উপস্থিত বিভিন্ন জায়গায়।
২২৮ পৃষ্ঠা কলেবরের এই বইটি তিনি কেন লিখেছেন, না লিখলে কোন্ অপূর্ণতা রয়ে যেত? পড়া শেষে প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না। দস্তয়ভস্কি যদি নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড না লিখতেন তাতে কি তার অতৃপ্তি কাজ করতো? শেষ পর্যন্ত মীমাংসায় আসি তিনি লিখেছেন কারণ লিখতে ইচ্ছা করেছে। ইচ্ছার উর্ধ্বে কিছু নয়।
প্রায় প্রত্যেক দেশের পপুলিস্ট সাহিত্যের স্টোরিটেলিংয়ের একটি প্রতিষ্ঠিত রেসিপি রয়েছে। এই রেসিপি যে যত নিবিড়ভাবে অনুসরণ ও প্রয়োগ করতে পারে স্টোরিটেলিংয়ে তিনি তত বেশি দক্ষ। সেই রেসিপি বা ফরমুলাতে আমরা কী কী শর্ত বা উপকরণের উপস্থিতি পাবো?
১. গল্পটা শুরু হবে মাঝের বা শেষের কোনো একটি টার্নিং পয়েন্ট থেকে। গল্পের জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন ঘটনার ইঙ্গিত থাকবে, কিন্তু খোলাসা করা হবে না। বলা হবে আজ না, অন্য কোনো সময় বলবো— এরকম কিছু। সেটার উত্তর জানার আকর্ষণে পড়ে যেতে হবে।
২. গল্পের শুরুর দিকে যাদের ভালো এবং মন্দ মনে হবে, একটা পর্যায়ে গিয়ে তাদের অবস্থান বদল হবে। ভালো আসলে ভান, এবং মন্দের ভিন্ন এক ব্যাখ্যা আছে। গল্পে এক বা একাধিক সিক্রেট থাকবে, সেই সিক্রেট কে কত স্মার্টলি আড়ালে রাখতে পারছে তার উপরই জনপ্রিয়তা নির্ভর করে।
৩. কাহিনী যখনই প্রেডিক্টেবল হয়ে উঠছে সেই মুহূর্তে গতির বিপরীতে আচমকা এমন এক টুইস্ট আসবে যার জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। টুইস্টের ব্যাকগ্রাউন্ড এমন সূক্ষভাবে প্রস্তুত করা থাকে যে টুইস্টটাকে আরোপিত লাগে না।
তবে বাংলাদেশের পপুলিস্ট সাহিত্যে আরো একটি গুরুতর শর্ত থাকে, তা হলো বিভিন্ন উক্তিকে বাণী-প্রবচনের মতো করে উপস্থাপন করা যেটা দিয়ে মুগ্ধতা তৈরি করা যায়। যেমন, ‘প্রতিটি মানুষই মুরগির নিয়তি নিয়ে জন্মায়, পৃথিবী তাকে শেখায় হয় ডিম পাড়ো অথবা মাংস হিসেবে খাবারের থালায় শোভা পাও; তোমার বিষ্ঠার ভার কেউ নেবে না’—এই উক্তি এমনভাবে বলা হবে যেন এটা ‘আমরা করবো জয়’ এর মতো অতি প্রচলিত বাণী। প্রতি ৩-৪ পৃষ্ঠা ব্যবধানেই এরকম লাইনের উপস্থিতি থাকবে, যেগুলো বইয়ের ট্রিজার হিসেবে ব্যবহাযোগ্য।
উল্লিখিত রেসিপির প্রতিটি উপকরণই রাসায়াত রহমান জিকো তার সন্ধ্যা নামের ক্ষণে বইতে ব্যবহার করেছেন। সুতরাং স্টোরিটেলিং গ্রাউন্ডে তিনি শতভাগ গতিশীল। কিন্তু কেবলমাত্র স্টোরিটেলিংগুণেই কি একটি বইকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে? টার্গেট অডিয়েন্স অবশ্যই ম্যাটার করে এক্ষেত্রে। পৃথিবীব্যাপীই স্টোরিটেলিংয়ের এই ফরম্যাট চলছে। যতরকম টিভি সিরিজ, তেলুগু-তামিল-কোরিয়ান সিনেমা, প্রতিটির স্টোরিটেলিং ব্যাকরণ এটাই। একটা সিনেমা দেখে বা বই পড়ে স্থায়ী উপলব্ধি তৈরি হওয়াটা কেন জরুরী হতেই হবে, সাময়িক এবং স্বল্পস্থায়ী উদ্দীপনা তৈরি হলে সমস্যাটা কোথায়— এই প্রশ্নকে ইনভ্যালিড বলার শক্ত কারণ আপাতত জানা নেই।
তবু পপুলিস্ট সীমানায় থেকে পপুলিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখকের বইটি ঘিরে কিছু পর্যবেক্ষণ বা কনফিউশনকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাক।
১. আমাদের মা-খালা বা ভাবীদের একটা বৃহত্তম অংশ কেন স্টার জলসা আর জি-বাংলার সিরিয়াল দেখে এ নিয়ে দীর্ঘদিন আগ্রহ ছিল। সাথে হিন্দি সিনেমাগুলো কেন জনপ্রিয় সেই প্রশ্ন রয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় মাঝে ৭-৮ মাস জি-বাংলা আর স্টার জলসার বেশ কিছু সিরিয়ালের ব্যাপারে আপডেট রাখতাম ইউটিউব সূত্রে। জি-বাংলায় একটি সিরিয়াল পাই নকশি-কাঁথা। সেখানে নায়ক প্রথমে অন্য একজনকে ভালোবাসে, পরে মুসলমান এক মেয়ে তথা মুল নায়িকার প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়, তাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিয়ে করে, কিন্তু সামাজিক কারণে গোপন রাখে। ইতোমধ্যে পুরনো প্রেমিকাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। তার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পরে পুনরায় সেই মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে। কিছুদিন পরে ছাড়াছাড়ি হওয়া প্রাক্তন স্ত্রী খুনী ভাড়া করে মূল নায়িকা (যার সাথে নায়কের ২ বার বিয়ে হয়েছে ইতোমধ্যে) তার প্রাণনাশের চেষ্টা করে, ঘটনাক্রমে সে বেঁচে যায়, এবং স্মৃতিভ্রষ্ট হয়। এরই মধ্যে নায়কের সাথে সেই প্রাক্তন স্ত্রীর ২য় বারের মতো বিয়ে হয়, এবং নায়িকাকে যে বাঁচায় সেই ব্যক্তির সাথে নায়িকার বিয়ে হয়। কিছুদিন পরে মূল নায়কের ফুসফুসের ক্যান্সার হয়, নায়িকার বর্তমান স্বামী যে প্রবাসী ডাক্তার তার চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে, নিজে অপারেশন করে, এবং নায়ককে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। ফলে নায়িকা প্রাক্তন এবং বর্তমান স্বামী নিয়ে একই বাড়িতে বসবাস করতে থাকে।—-এর সাথে কয়েকটা রোমান্টিক হিন্দি সিনেমা, তেলুগু থ্রিলার আর নেটফিক্সের ১-২টা সিরিজ যোগ করলে যা পাওয়া যায় সেটাই এই বইয়ের মূখ্য চরিত্র নিহাদ, রামিসা আর শাফিনের মিথস্ক্রিয়া অথবা পরিণতি। এ ধরনের চরিত্র নির্মাণ ক্রাউডকে অনেক বেশি এনগেইজ করে, কারণ সে ব্যক্তিজীবনেও এ ধরনের অবদমন দ্বারা তাড়িত হয়।
২. চরিত্রের লিঙ্গভিত্তিক ব্যবচ্ছেদে গেলে লেখক অতিমাত্রায় একপেশে নির্মাণ করেছেন এ কথা একদম নির্দ্বিধায় বলা যায়। বইয়ের নারী চরিত্রগুলোর কাজ কী? তারা অনবরত প্রেমে পড়বে, প্রেম যৌনতায় গড়াবে। অন্যদিকে পুরুষ চরিত্রগুলো পাগলা প্রেমিক, অন্ধভাবে ভালোবেসে যাবে এবং ভালোবাসার মানুষটির যৌনতার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া বা ভালোবাসার মানুষটি একাধিক পুরুষের সাথে যৌনতায় লিপ্ত জানা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার টানে সবকিছু মেনে নেবে। এবং অসংখ্যবার রুম ডেট করা বয়ফ্রেন্ডকে ছেড়ে বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবে—এখানেও মূল স্খলনটা নারী চরিত্রেরই। ৮০ এর দশকে জন্ম নেয়া নিহাদের মাও আরেকজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল, ফিরে এসেছিল গর্ভবতী হয়ে। তার জন্য দিওয়ানা ছিল নিহাদের পালিত বাবা, সেই রক্ষণশীল সময়েও সে তাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়, এবং তার গর্ভজাত সন্তানকে নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়। লায়লা নামের এক ক্যামিও চরিত্র পাওয়া যায় যে নিহাদের চাইতে এক বছরের বড়ো, তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়, যৌনতার প্রস্তুতি নেয়,এবং এক সময় বিদেশ চলে যায়। অন্যদিকে পুরুষ যৌনকাতর চরিত্র বলতে আমরা এক আবৃত্তিশিল্পীকে পাই যে নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ভিডিও করে। টিনএজ কিশোর পাই যে মনে করে মেয়েদের বাইকের পেছনে ঘুরালেই পটে যায়। আর সারাজীবন মানুষের উপকার করা, অত্যন্ত সলিড মনের অধিকারী ছেলেদের মেয়েরা পাত্তা দেয় না বিশেষ। চরিত্র নির্মাণের এই যে স্টেরিওটাইপ কম্পোজিশন এগুলোর ভিত্তি বিভিন্ন আড্ডায় মেয়েদের নিয়ে যেসব জল্পনা হয় তারই বহিঃপ্রকাশ। শুধুমাত্র যদি রামিসা চরিত্রটাই দেখি মনে হতে বাধ্য হয় পুরুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হবে, অথবা সে নিজে আকৃষ্ট হবে। তার জীবনে আকর্ষণের বাইরে তেমন কোনো করণীয় নেই। অন্যদিকে শাফিন চরিত্রটিকে মনে হবে দেবদূত। এই যে উপস্থাপন এটা লেখকের সমাজ পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন সংক্রান্ত অগভীর পর্যবেক্ষণেরই প্রতিফল মনে হবে।
৩. পুরো স্টোরিলাইন দাঁড়িয়ে আছে অজস্র কাকতালের উপর ভিত্তি করে, যেগুলোকে আমরা সিনেমায় দেখে দেখে ক্লিশে বানিয়ে ফেলেছি। নিহাদের সাথে রামিসার যোগাযোগের সূত্রপাত, কোচিং সেন্টারে রুমা নামের কৈশোরের প্রেমের সাথে শাফিনের পুনরায় দেখা হওয়া, রামিসার সাথে দেখা হলেই তার বই আর ওড়না পড়ে যাওয়া, ক্লাস টু তে পড়াকালে রাশা নামের যে শিশুকে ভালোলেগেছিল বহুবছর বাদে দেশে ফেরার কালে এয়ারপোর্টে তাকে দেখা এবং তারই শাফিনকে চিনতে পারা, নিহাদের দেশে ফেরার কালে রামিসার সেই বান্ধবীর সাথে প্লেনে দেখা হওয়া যার যৌনতার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছিল, শাফিন ক্রিমিনোলজি নিয়ে পড়তে নিহাদের দেশে তার ইউনিভার্সিটিতেই যাওয়া, রামিসার এনজিওতে চাকরি পাওয়া এবং সেসূত্রে নিহাদের কাছাকাছি দেশে যাওয়া, শাফিনের ভাই সিয়াম রামিসার গায়ে বাইক তুলে দেয়া মিরপুরের রাস্তায় এবং তাকে ভাবী সম্বোধন করা, শাফিনের জন্য ঠিক করা পাত্রীকে সিয়ামের বিয়ে করা, শাফিনের ফোন সিয়ামের কাছে থাকা এবং শাফিনের হয়ে সিয়ামের উত্তর দেয়া ‘আই অ্যাম গেটিং ম্যারিড’——–ব্যাপারগুলো শাহরুখ খানের মেলোড্রামাটিক সিনেমা লাগে।
৪. গল্পের প্রধান সিক্রেট আরোপিত এবং বেমানান। এটা ঠিক সেই অর্থে টুইস্টই বলা চলে না, যেন টুইস্টের প্রয়োজনে টুইস্ট আনা। পুরো স্টোরিলাইন যে কম্পোজিশনে এগিয়েছে তাতে জিসান নামের চরিত্রটিকে শিশু ধর্ষণকারী সমকামী হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না। তার আগ পর্যন্ত জিসানকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে তার এই পরিণতি লেখকের জবরদস্তি। একই সাথে লুৎফুল্লাহ ক্যারেক্টারটা যেভাবে এগিয়ে গেছে সমগ্র স্টোরিলাইনে তাতে সে নিহাদের কুমারী মাতার ভাই এবং সে কারণে নিহাদকে সহ্য করতে পারে না এই ব্যাখ্যা গায়ের জোরে দেয়া। তার আগ পর্যন্ত লুৎফুল্লাহ ছিলেন এলাকার টিপিক্যাল মুরব্বি ধরনের কমেডি ক্যারেক্টার যারা সবকিছুতে খুঁত খুঁজে পায় সমালোচনা করে। নিহাদকে পুরুষত্বহীন দেখানোর জন্য জিসানকে ধর্ষক বানানোর প্রয়োজন ছিল না। এবং এই টুইস্ট না থাকলেও স্টোরিলাইনের কোনো শ্রীহানি ঘটতো না। এবং পরবর্তীতে নিহাদের সাথে একই গাড়িতে বসে থাকা অবস্থায় শাফিন আর রামিসার চুম্বন দৃশ্যায়নটা বা এস্তোনিয়াতে তিনজন নৌকায় ঘোরা সমগ্র ব্যাপারটার মধ্যে এক ধরনের থ্রিসাম দৃশ্যায়ন রয়েছে, যেখানে একজন যৌনতায় অক্ষম পুরুষ তার স্থানে অন্য এক পুরুষকে বসিয়ে পছন্দের নারীর সাথে যৌন সম্ভোগের ফ্যান্টাসিতে ভুগছে। এই মিথস্ক্রিয়ার সাথে বহুবছর পূর্বে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী নির্মিত থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার সিনেমার সমাপ্তির অন্তমিল পাওয়া যায়, যেখানে নায়িকা তিশা তার লিভিং পার্টনার (প্রচলিত নিয়মে বিয়ে করেনি) মোশাররফ করিম আর কলেজের বন্ধু বর্তমানের প্রেমিক (যার সাথে সে একই ফ্ল্যাটে থাকছে) গায়ক তপুকে নিয়ে একত্রে বেড়াতে যায়। নিহাদের আরো বেটার কোনো সিক্রেট বা দুঃখ থাকতে পারতো। এবং শুরু আর শেষে যে বাচ্চাটা রাখা হয়েছে এটা পুরোটাই ইলিউশন তৈরির জন্য। শুরুতে মনে হবে বাচ্চাটা বোধহয় রামিসার, কিন্তু একদম শেষ পৃষ্ঠায় জানা যাবে এক গণিকা যার সাথে নিহাদ কিছুটা সময় কাটিয়েছিল কিন্তু যৌন অক্ষমতাহেতু সেবা নিতে পারেনি সে এইচআইভি পজিটিভ হয়ে মৃত্যুর পূর্বে তার সন্তানের দায়িত্ব নেয়ার জন্য তাকে ইমেইল করতে বলেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। তার মানে সমগ্র স্টোরিলাইনে এই বাচ্চার সিগনিফিক্যান্ট কোনো কন্ট্রিবিউশনই নেই। স্টোরিটেলিংয়ের এই সুনির্দিষ্ট টেকনিকটাকে অনৈতিক গণ্য করি।
৫. লেখক বর্তমান প্রজন্মের প্রতি খুব বেশিমাত্রায় জাজমেন্টাল। এদের জীবনে হ্যাং আউট, প্রতারণা, ছবি তোলা, একাধিক সম্পর্কে জড়ানো, কমিটমেন্ট না থাকা এসবের বাইরে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু তিনি খুঁজে পাননি। এটাই যদি তার প্রজন্ম পাঠ হয় সেক্ষেত্রে এগুলোর কারণ অনুসন্ধান করা নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেই পথে তিনি আগাননি। প্রচলিত চর্বিত চর্বন আর ঢালাওভাবে দোষারোপ দিয়ে সহমত ভাইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর পায়তারা। এখানে লেখকের সততা কিছুটা কনফারমেশন বায়াস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
৬. সমগ্র স্টোরিলাইনে হিউমারের অন্তর্ভুক্তি খুবই সামান্য, তবু যেটুকু আছে শুধুমাত্র এই হিউমারটুকুর কারণেই এই বইটিকে অনেকদিন স্মরণে রাখতে বাধ্য হবে। সুনির্দিষ্ট কয়েকটা শক্তিশালী হিউমারের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে
-লুৎফুল্লাহ তার কন্যাকে নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গেছেন। নিহাদ আর বন্ধুরা গ্যালারিতে তাকে দেখে একযোগে লুৎফুল্লাহ বলে ডেকে উঠে। একযোগে এতজনকে লুৎফুল্লাহ বলতে শুনে গ্যালারির অন্যরা বলে ভাই লুৎফুল্লাহ কে। শ্রীলংকা-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ চলছে, রানাতুঙ্গা ব্যাট করছে। তারা জবাব দেয় রানাতুঙ্গার আরেক নাম লুৎফুল্লাহ। রানাতুঙ্গা রান নেয় সারা গ্যালারি লুৎফুল্লাহ বলে চিয়ার করে উঠে, বাউন্ডারি মারলেও তা-ই। এটা এক দুর্দান্ত হিউমার কম্পোজিশন।
-শাফিনের বাপ-চাচারা আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। ৮৬ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবার পর তারা গরু জবাই দিয়ে এলাকার বিখ্যাত মনা বাবুর্চিকে দিয়ে তেহারি রান্না করিয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর বিশ্বকাপ হয় আর তারা গরু কিনে, কিন্তু আর্জেন্টিনা আর চ্যাম্পিয়ন হয় না। ২০১২ এর এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ফাইনালে উঠা উপলক্ষ্যে ২টা গরু কিনে, বাংলাদেশ ২ রানে হেরে যাওয়ায় রেগে গিয়ে তারা বাবা নিজেই গরু জবাই দিতে যায়, গরুর লাথি খেয়ে পা ভেঙ্গে একমাস ঘরে পড়ে থাকে। এছাড়া কোপা আমেরিকা ফাইনালে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ফাইনাল হওয়ায় আবারো গরু কিনে তারা। অর্থাৎ যে কোনো আনন্দের উপলক্ষ্য হলেই তার পরিবার গরু জবাই দেয়।
-শাফিনের দাদা ৩ বার হার্ট অ্যাটাক করেছে। তাকে দেখলেই তার বাংলা সিনেমার আনোয়ার হোসেন মনে হয়।
রাত পৌনে ৯টা নাগাদ বই পড়া শেষ করে উঠতে যাবো, দেখি অপর কন্যা তেইশ খুব প্রজ্ঞাময় চেহারায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, হুট করে ওর বয়স ২০ হয়ে গেছে, যদিও কয়েকদিন আগে আমরা ওদের ২ বোনের ৩য় জন্মদিন পালন করলাম। বুঝলাম জেরার মুখে পড়তে যাচ্ছি।
‘বাবা কেমন লাগলো বইটা? পড়ার সময়ে বেশ কয়েকবার হো হো হাসছিলে শুনতে পেলাম’
উনিশের সাথে এমন অভিজ্ঞতা ৪ ঘণ্টা আগে হওয়াতে অবাক হইনি এবার আর। খুব স্বাভাবিকভাবেই বলি, ‘যদিও তুমি আমার দৃষ্টিভ্রম মাত্র তবু বলি, একটা বই পড়ার পরে যতরকম প্রশ্ন হতে পারে সবচাইতে নিম্নমানের হলো কেমন লাগলো বইটা পড়ে। বাকি জীবনে কখনো এই প্রশ্ন করবে না কাউকে। কেবল ভালো লাগা আর না লাগা দিয়ে একটা বইকে বিচার করতে হয় না। বইটা তোমার মাথায় কতদিন বেঁচে থাকবে এটাই উপযুক্ততম শব্দ। হিউমারের বিচ্ছিন্ন প্রয়োগগুলো বাদে এই বইয়ের সমস্তটাই চিরঅভ্যস্ততার গল্প। বাংলা সাহিত্যে এমনিতেই ব্যাকগ্রাউন্ড এনালাইসিস থাকে না, কেবল ধারাবর্ণনা। পপুলিস্ট সাহিত্যে এগুলো তেমন ডিমান্ডও নয়, তবু পপুলিস্ট পয়েন্ট অব ভিউ থেকেও তো এটা মাথায় রাখা যাচ্ছে না। মেকিং অতি দুর্বল আর প্রেডিক্টেবল। দেখ শাফিনের দাদা বইয়ের মাঝেই পূর্বাভাস দিয়েছে রামিসার সাথে তার বিয়ে হবে, এবং সমস্ত স্টোরিটাই তৈরি করা হয়েছে সেই বিয়ের গন্তব্যেই আমাদের নিয়ে যেতে। আরেকটু লেজে খেলানো যেত না’?
তেইশ কিছু বলার পূর্বেই উনিশ এসে বাগড়া দিল- ‘বাবা জিক্কু জ্যাঠারে বইলো তো পুরাপুরি কমেডি আর হিউমারের একখান বই লেখতে। আমি তার ফেসবুকের খুচরা স্ট্যাটাসগুলা পড়ছি, তার তো শরীর ভরা হিউমার’।
আমি সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ি। ‘ওই তর মতলব কী’?
তেইশ র্ভৎসনা করে আমায়। ‘ছিঃ বাবা,এভাবে কেউ নিজের বাচ্চাদের সাথে কথা বলে। তুমি বড্ড বোরিং’!