নীল কোর্তায় নীল বংশীয়গণ
সর্বশেষ ৮ বছরে আমার ১টি চিন্তা বা অভিমতের সাথেও কি নৈকট্য বোধ করেছিল সাফির আবদুল্লাহ ? স্মরণে আসে না৷
ধরা যাক, তার সাথে কাটানো কোয়ালিটি সময়ের পরিমাণ আনুমানিক ১০৩ ঘন্টা, ক্রিকেট হলে উদযাপন করতাম সেঞ্চুরি পূরণের আনন্দ, কিন্তু সাফির আবদুল্লাহ এমন এক ব্যক্তি যার কাছে ক্রিকেট উগ্র জাতীয়তাবাদ আর কলোনিয়ালিজমের বাইরে ভিন্নার্থ বহন করে সামান্যই এবং গুগল ব্যতিরেকে ৭ জন ক্রিকেটারের নাম বলাটাও দুঃসাধ্য হওয়া যৌক্তিক বাস্তবতা৷
সুতরাং সেঞ্চুরি নিছকই সংখ্যা এক!
পুরপুরি বিপরীত অভিমুখী দুজন মানুষ ১০৩ ঘন্টা সময় পাড়ি দেয় কিসের প্রত্যাশায়, বা কোন মন্ত্রে? কমিউনিকেটিভ জগতে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে বক্তা এবং বক্তব্য থরে থরে থাকলেও উপাসনার ধ্যানমগ্নতায় কথা শোনা এবং প্রশ্নের প্রবহতায় কথা বলিয়ে নেয়া মানুষেরা সংখ্যালঘুতে রূপান্তরিত হয়েছে৷ সংখ্যালঘু হওয়াটাই বোধকরি ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের নিকট মধ্যমমানের চাহিদা তৈরি করেছে আমার।
সাফির আবদুল্লাহ কে আদতে কোন ইমেজে দেখি? অস্বাভাবিক বড়ো গ্লাসের চশমা আর নীল কোর্তায় মোড়ানো এক মানবগাছের কাণ্ড যে গাছটি হতে চায় ফার্নিচারে ব্যবহার্য, কিন্তু সামাজিক পীড়নে ধারণ করে ঔষধি বৃক্ষের চেহারা। আমাদের বাংলাদেশে সংস্কৃতমনা এবং গবেষণা মননের মানুষদের ভাষাভঙ্গি, আলোচনার কনটেন্ট এবং মিথস্ক্রিয়াগুলো প্যাটার্নবন্দী, সর্বসাধারণ তার সাথে বেমানান। সাফির আবদুল্লাহ প্যাটার্নবন্দী জীবনে নিত্য চলাচলে যখন ক্লান্ত বোধ করে প্যাটার্নমুক্ত হওয়ার অভিলাষ দেখায় সাময়িক, বন্দী এবং মুক্ত হওয়ার নিরন্তর খেলায় সদরগেটে দেখা হয় আমার সাথে, অথর্বচিত্তে শুনি তার গল্প; এরপর গেট থেকে বিতাড়িত হই, কারণ এলিট শ্রেণিতে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত এবং আমার জন্য নিষিদ্ধ৷
আপাত এনলাইটেনমেন্টের গল্প শোনাকালীন সাফির আবদুল্লাহ আমাকে শব্দ তৈরির কাঁচামাল যোগান দেয়। তার বহুদিনের ইচ্ছা সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতা যাবে শুধুমাত্র ট্রামের নিচে শরীর পাততে, পরমুহূর্তেই শুনি সে নর্থ আমেরিকায় যাবে উচ্চশিক্ষা নিতে, একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে নিজেকে একজন উচ্চমার্গীয় সাব-অলটার্নিস্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত করবে, দেশ থেকে হাতিল ফার্নিচারের সবচাইতে বড়ো শো-কেসটি নিয়ে যাবে পদক সাজিয়ে রাখতে। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমি তৈরি করি প্রমিজিং হতাশা, নোওয়ান্স মাইন্ড, কৃত্রিম চিন্তা, গ্ল্যামারাস কী-ওয়ার্ড প্রভৃতি শব্দমালা।
ইত্যবসরে সাফির আবদুল্লাহ প্রচ্ছদ করে আমার কুখ্যাত নামহীন বইয়ের, কৌণিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দু-চার বাক্য দান করে রঙপ্যাথি বইতে, এবং স্মরণ করিয়ে দেয় তার নেটওয়ার্কের কেউ আমার বইতে আস্থা পায় না, পড়বার মতোন যথেষ্ট মানসম্পন্ন গণ্য করে না। না দমে উলটো তাকে পরামর্শ দিই লেখালিখি শুরু করতে, তাতে শারীরিক ও মানসিকভাবে থাকবে সতেজ। পরামর্শ শুনলো কিনা বুঝবার পূর্বেই সে মিলিয়ে যায় সাব-অলটার্নিস্টদের গহবরে।
এভাবেই খরচ হয়ে গেল ৮টি বছর, জানাই হলো না নীল রক্তের সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের সাহচর্যে সাফির আবদুল্লাহ এর পূর্ণতা বনাম রিক্ততার সমীকরণের সর্বশেষ স্ট্যাটাসটা কী। গেল সপ্তাহে শুনি সে ইংল্যান্ডে আস্তানা গড়ছে, ভর্তি প্রক্রিয়াতে ৩ জন ব্যক্তির রেকমেন্ডেশন পত্র পাঠাতে হয়; অজ্ঞাত কারণে আমার থেকেও নিয়েছিল একখানা, পাঠিয়েছে কিনা জানা হয়নি। সম্ভবত রিজার্ভ বেঞ্চ গরম করাই ছিল পত্রের গুরুদায়িত্ব।
ইংল্যান্ড শুনবার পরে কিঞ্চিৎ আনন্দ ধারা টের পেলাম যেন। নর্থ আমেরিকা জুটেনি কপালে, অর্থাৎ এলিট শ্রেণিতে আপাতত সে বিজনেস ক্লাস নয় ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী হবে। পশ গ্রুপ তাকে স্বীকৃতি দিবে না সহসা। সেই দুঃখবোধে সে হয়তবা লেখক শাহাদুজ্জামানের সাথে গড়ে তুলবে সখ্য, এবং নর্থ আমেরিকার চাইতে ইংল্যান্ডই যে সাব-অলটার্নদের আতুর ঘর, তত্ত্বের উদ্ভাবন এবং সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করবে পরম নিষ্ঠায়।
বাংলাদেশ থেকে অন্তত তিন কোটি মানুষ রপ্তানি হওয়া উচিত ভারসাম্যের স্বার্থে। একজন করে মানুষ বিমানে উঠে, আর অস্থিরতায় ভুগি- এভাবে২-১ জন দিয়ে কি পূরণ হবে ৩ কোটির ঘাটতি? যেতে হবে পাইকারি দরে, তবু প্রসেস শুরু হোক।
নীল কোর্তার সাফির আবদুল্লাহ এর সঙ্গে মিল পাচ্ছি গলদা ও বাগদা চিংড়ির, কারণ চিংড়ির ন্যায় আগামী সপ্তাহ নাগাদ রপ্তানী হয়ে যাবে সেও! গত ১০ বছরে ঘনিষ্ঠ-অঘনিষ্ঠ কত শত মানুষ রপ্তানি হলো ইউরোপ-আমেরিকায়, শূন্যতা বোধ প্রগাঢ় হতে হতে পার করেছে থ্রেশোল্ড লিমিট, এখন ইউরোপে যাওয়া মানে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা আসার মতোই নৈমিত্তিক লাগে৷ তাছাড়া স্ট্রিমইয়ার্ড আর জুম জীবনে যতখানি প্রবেশাধিকার নিয়েছে তাতে পাশের রুমে থাকার সাথে তফাত সামান্য কানাডায় অবস্থানের। শেষ পর্যন্ত যোগাযোগটাই মূখ্য।
রপ্তানিযোগ্য আইটেম হিসেবে সাফির আবদুল্লাহ জাহাজে চাপতে যাচ্ছে অচিরেই, তবু জানি হয়তবা ইংল্যান্ডের টেমস নদীতে সলোমন ফিশের সাঁতার দেখতে দেখতে মনে আসবে কলকাতা এবং ট্রাম, কাউকে না পেয়ে সে স্মরণ করবে আমায়, আমি আবারো ধ্যানে বসবো শব্দ উদ্ভাবনের আকাঙ্ক্ষায়।
রপ্তানি সার্থকতা পাক হে নীল কোর্তার নওজোয়ান, দেখা হবে স্ট্রিমইয়ার্ডের স্ক্রিনে!