বাংলাদেশী ‘নায়িকা’ বললে অটোমেটিকালি যার ইমেজ আমার মাথায় চলে আসে তিনি হলেন ববিতা, দ্বিতীয় অপশন মৌসুমী। এরপরে আর কারো ইমেজ মাথায় আনতে পারি না। হতে পারে এটা আমার সীমাবদ্ধতা , তবে নায়িকা শব্দটাকে বন্ধনীযুক্ত করার কারণে এটা বলার অবকাশ রাখে না যে , আমি আলাদাভাবে নায়িকা শব্দটাতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছি । সেই গুরুত্বের তারতম্যের কারণেই বোধ করি ববিতা এবং মৌসুমী অন্যদের থেকে কম্পিটিটিভ এডভান্টেজ পেয়েছেন ।
গ্ল্যামার শব্দটাকে গুগলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে – ‘an attractive or exciting quality that makes certain people or things seem appealing’ ; আমার ধারণা কোয়ালিটি শব্দটাতে দুটো বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্ন এবং প্রকটভাবে আছে ; একটা হলো ফেসিয়াল লুক এবং ফিগার। এবং এপেলিং বলতে আসলে যৌন আবেদনকেই মোটাদাগে মীন করা হয়ে থাকতে পারে। এটা বললাম কমন এন্টারপ্রেটেশনের কথা। গভীর এন্টারপ্রেটেশন নিশ্চয়ই আরও চিন্তাশীল কিছু হবে । কিন্তু সিনেমা একটা এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালু বহন করে , এটা একটা কমার্শিয়াল ইন্ডাস্ট্রি , কাজেই এখানে কমন এন্টারপ্রেটেশনটাই শেষ কথা , চিন্তাশীলতা ঐচ্ছিক ব্যাপার ।
গ্ল্যামার নিয়ে একটা প্যারা খরচ করে ফেললাম , কারণ এই ভারতীয় উপমহাদেশেই ‘নায়িকা’ কনসেপ্টটা পুরোপুরি গ্ল্যামারকেন্দ্রিক । নায়িকা মানে হলো যাকে দেখলে মনে হবে এর সাথে প্রেম করি, একান্তে সময় কাটাই , তাকে ভেবে ফ্যান্টাসিতে ভুগি । তাই এই উপমহাদেশে অন-স্ক্রিনে নায়িকার পারসোনালিটি টাইপ খুবই প্যাথেটিক । তার রোল খুবই সীমাবদ্ধ । সে দেখতে আকর্ষণীয় , সে অশালীন ইঙ্গিতে শালীন পোশাক পরবে , খুবই স্টাইল করে প্রথম দৃশ্যে এন্ট্রি নিবে , নানারকম নখরামি করবে , শরীর দুলিয়ে হাঁটবে , নায়কের সাথে প্রেম করবে , ভিলেনের লালসার শিকার হবে , বাবার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ের জন্য চাপাচাপির শিকার হবে , ৪-৫টি গানে ক্যামেরায় বিভিন্ন এঙ্গেলে শরীরের ভাঁজ দেখাবে , এবং শেষ দৃশ্যে নায়কের সাথে মিলে যাবে – এখানে কোথাও তার অভিনয় দক্ষতা ডিমান্ড করা হয় না , সে কতোটা এপেলিংভাবে নিজেকে দর্শকের সামনে এক্সপ্রেস করতে পারছে সেটাই কমার্শিয়াল ডিমান্ড।
আমি প্রায়ই ভাবি নায়িকার রোলটা আসলে এমন কেন। এ নিয়ে নারীবাদী লেখকেরা ইতিমধ্যেই বিস্তর লিখে ফেলেছেন , তাই যা-ই লিখি সেটা চর্বিত চর্বন হয়ে যাবে। তবু আমার নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ আছে , সেটাও যদি চর্বিত মনে হয় এই প্যারাটা স্কিপ করতে পারেন। সিনেমা প্রদর্শনের প্রধান মাধ্যম আসলে বড় পর্দা বা হল এবং অধিকাংশ হলগুলোর যে এনভায়রনমেন্ট এবং অডিয়েন্স উপস্থিতি , তার মধ্যে পারসেন্টেজ করলে পুরুষরা অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। ফ্যামিলি নিয়ে বা প্রেমিক-প্রেমিকা ও সিনেমা দেখতে হলে যায় , কিন্তু সামগ্রীক প্রেজেন্টেশনটা যেরকম তাতে অধিকাংশ মহিলা দর্শকও সিনেমা দেখে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভিঙ্গি থেকে। তবে এই ফেনোমেনোনেরও একটা সোশিও এনালিটিকাল ব্যাখ্যা আছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন নাটক , যাত্রা বা সিনেমাগুলোতেও নারী চরিত্রে পুরুষেরাই অভিনয় করতো , এরপরে যখন নারী চরিত্রে নারীরাই অভিনয় করতে শুরু করলো সেই নারীরাও সামাজিকভাবে নিগৃহীত হয়েছে দীর্ঘদিন পর্যন্ত। ফলে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এমন , সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখছেন একজন পুরুষ , প্রযোজক-পরিচালক-ডিস্ট্রিবিউটর-দর্শক(ভোক্তা) সবই পুরুষ অথবা পৌরুষিক মানসিকতার । লেখকেরা তাদের উপন্যাসে নারীকে যেভাবে প্রেজেন্ট করেন , সেটা হয়তো সত্যিকারের নারীচরিত্র নয় , লেখকের কল্পিত নারীচরিত্রের ছায়া । কারণ , লেখক নিজে হয়তো পরিবারের গণ্ডির বাইরে খুব বেশি নারীর সাথে মিশেনি কখনো , ফলে পূর্ণাঙ্গ নারীচরিত্র দাঁড় করানো তার পক্ষে অসম্ভব । তাকে নির্ভর করতে হয় কল্পনাশক্তি আর কমনসেন্সের উপর । এরকম যখন প্রেক্ষাপট তখন সিনেমাতে নায়িকাকেও প্রেজেন্ট করা হয় ফ্যান্টাসির জায়গা থেকেই। এটা কি সোশ্যালাইজেশন প্রসেস এর সীমাবদ্ধতা , নাকি ইচ্ছার অভাব এই ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে ঢালাওভাবে পাবলিক ডিমান্ড ফুলফিল করতে চাওয়ার ফরমুলা অনুসরণ করার প্রবণতা থেকে এটা ধরে নেয়া যায় , নারী চরিত্র চিত্রায়ণে যথেষ্ট গবেষণার অভাব রয়েছে। নারীবাদী মনোভাব বা লেখালিখির কারণে কিছু নায়িকা প্রধান সিনেমা হয় , কিন্তু সেটা আবার ওভার-গ্লোরিফাইংয়ের ভারে ভারাক্রান্ত , সুষ্ঠু ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টরটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত । সোসাইটিতেই যেখানে ব্যালেন্সিং নেই , যে কোনো এককেন্দ্রিক ও একতান্ত্রিক ( হয় অতিমাত্রায় পিতৃতান্ত্রিক , অথবা মাতৃতান্ত্রিক ) ই মূখ্য হয়ে উঠে , সিনেমায় তার ব্যত্যয় ঘটবে কী প্রকারে। আলটিমেটলি সিনেমা তো কমবেশি সোশ্যাল ফ্যান্টাসিরই ম্যাক্রো লেভেলের ম্যাগনিফিকেশন!
ববিতা , মৌসুমী নিয়ে লিখতে গিয়ে সোশিওলজিকাল আলোচনা চলে এসেছে মূলত ‘নায়িকা’ শব্দটাতে বন্ধনী প্রয়োগ করায়। এক্ষেত্রে আমার ব্যতিক্রম মনে হয় শাবানা কে। বাংলাদেশে বোধ হয় তিনিই একমাত্র ফিল্মের মানুষ যিনি কল্পিত নায়িকা ইমেজ থেকে বেরিয়ে অভিনেত্রী হিসেবে আলাদা আবেদন অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর অভিনীত বেশিরভাগ সিনেমাতেই তিনি নায়কের সমান গুরুত্ব আদায় করে নিতে পেরেছেন , বিশেষত আশির শেষ আর নব্বইয়ের দশকের বেশিরভাগটা জুড়ে শাবানা যে কোনো প্রতিষ্ঠিত নায়কের সাথে পাল্লা দিয়ে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। শাবানার যে পারসোনালিটি ইমেজ তাকে বড় বোনের মতো শ্রদ্ধা বা বড় ভাবীর মতো মায়ের দৃষ্টিতে দেখা যায় , তার সাথে প্রেম করা , তাকে নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগা এই ব্যাপারটা অনেকটাই অনুপস্থিত। সিনেমায় তার হাতে চড় খায়নি এমন অভিনেতা বোধ হয় খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে হয়তোবা দেখা যাবে বাংলা চলচ্চিত্রেই তার মতো এতো চড় দেয়ার দৃশ্যে কেউ অভিনয় করেনি। তবে এই শাবানাও কিন্তু ষাটের দশকে গ্ল্যামারাস নায়িকাই ছিলেন , বিশেষত পাকিস্তানী নাদিমের সাথে তার কেমিস্ট্রিটা তো তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এমনকি মধ্যবয়সে ৯০ এর দশকেও সেই একই নাদিমের সাথে ‘ঝড় তুফান’ নামে একটা বেশ সময়ের বিচারে এগ্রেসিভ সিনেমা করেছেন। অন্য নায়কদের বেলায় এই গ্ল্যামারাস রোলটা তুলনামূলক কেন কম , এটা একটা রহস্য।
ববিতার পূর্বে আরেকজন নায়িকা ছিলেন যাকে গ্ল্যামারাস বলা যায় অনায়াসেই। তিনি ষাটের দশকের শবনম , ক্ষেত্রবিশেষে তাকে ববিতার চাইতেও এগিয়ে রাখবো । রহমানের সাথে তার কেমিস্ট্রিটা দারুণ জমে উঠেছিল। কিন্তু ৬৫ সালে পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় বাংলা সিনেমা তার গ্ল্যামার ব্যবহারের খুব বেশি সুযোগ পায়নি। প্রায় ৩০ বছর পরে পাকিস্তান থেকে যখন পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন ততদিনে তিনি মান্নার আম্মাজান চরিত্রে অভিনয় করা মানুষ , সেই গ্ল্যামারের কথা তো ভুলেই গেছে সবাই।
কবরীকে মিষ্টি মেয়ে বলা হয় , রাজ্জাকের সাথে তার জুটিটা খুব রোমান্টিকতা পেয়েছিল , তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন , কিন্তু কবরীকে সেই অর্থে আমার কখনো ব্র্যাকেটদেয়া নায়িকা মনে হয়নি , কারণ উপমহাদেশে নায়িকা কনসেপ্ট যা যা ডিমান্ড করে তার বেশিরভাগই আমি তার মধ্যে খুঁজে পাইনি। ববিতার বড়বোন সুচন্দাও নায়িকা হিসেবে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন , কিন্তু জহির রায়হানের স্ত্রী হয়ে যাওয়ায় নায়িকা হিসেবে বিকশিত হওয়াটা আর হয়ে উঠেনি।
‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় , সে কি মোর অপরাধ ’ – এই অসাধারণ রোমান্টিক গানটি যে নায়িকাকে উৎসর্গ করা যেতে পারে তিনি সত্তরের দশকের হার্টথ্রব অলিভিয়া। ওইরকম রক্ষশণীল সময়েও নিজের দেহবল্লবের প্রদর্শনে কার্পণ্য করেননি , সাক্ষাৎকারে অবলীলায় বলেছেন চরিত্রের প্রয়োজনে যে কোনো পোশাকে আপত্তি নেই। তার নাম হয়ে উঠেছিল সেক্সবম্ব। বাংলা ততোটা ভালো বলতে না পারায় অভিনয়ে আড়ষ্টতা ছিলো , কিন্তু শুধুমাত্র সৌন্দর্যের কারণেই বোধ হয় ৭৫ সালে কলকাতায় গিয়ে উত্তম কুমারের বিপরীতে বহ্নিশিখা সিনেমায় অভিনয় করে এসেছেন। বাংলাদেশে ওয়াসীমের সাথে তার একটা ক্রেজি জুটি গড়ে উঠেছিল, বিশেষত ফোক-ফ্যান্টাসি নির্ভর সিনেমাগুলোতে তার কদর যথেষ্টই ছিলো , কিন্তু ৮০ এর পর থেকেই মুটিয়ে যাওয়া শুরু করলে হাজারো তরুণ এবং বিবাহিত পুরুষের ফ্যান্টাসি অলিভিয়া হারিয়ে যান দৃশ্যপট থেকে। তবে অলিভিয়া এখনো প্রাণবন্ত , ইউটিউবে খুঁজলে তার যে ৪-৫টি গান খুঁজে পাওয়া যায় সেগুলো এনালাইজ করলেই বুঝতে পারা যায় সময়ের তুলনায় তিনি কতখানি এগ্রেসিভ ছিলেন। ২০০০ সালের পরে আমরা যেটাকে অশ্লীলতা বলি , সেই ৭৮-৭৯ তে তিনি সিনেমায় নিজের খোলা পিঠ দেখিয়েছেন ( যদিও অলিভিয়ার দাবি তার বদলে অন্য মেয়ের পিঠ ব্যবহার করা হয়েছে ) ; একবার ভাবুন , তখনকার আমলে কতখানি ডেসপারেট হলে এই দৃশ্য করা যায়।
নাচের কারণে দুজন নায়িকাকে উল্লেখ করা যায় ; একজন অঞ্জনা , অপরজন নূতন। অঞ্জনা অসংখ্য সিনেমা করলেও নিজেকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করতেন । নূতন বরং আরেকটু এগ্রেসিভ ; বাংলাদেশে নাগিনী নাচ জনপ্রিয়করণে , নায়িকার বুক কাঁপানো দৃশ্যের অশ্লীলতা প্রোমোটে তাকে পায়োনিয়ার বলা যেতেই পারে , এবং নায়িকা ক্যারিয়ারের শেষের দিকে ড্যানি সিডাকের সাথে উদ্ভট সিনেমা করা , দিলদার তার সমগ্র অভিনয় জীবনে ‘আব্দুল্লাহ ’ নামে একটা সিনেমা করেছিল নায়ক চরিত্রে সেখানে নায়িকা হওয়া – এরকম বেশকিছু ঘটনার কারণে নূতনকে আলাদা একটা অবস্থান দিতে হয়।
বেবি হেলেন নামে শিশু চরিত্র দিয়ে অভিনয় শুরু করা সুচরিতা দারুণ গ্ল্যামারাস ছিলেন এটা আমি গুগল পড়ে জেনেছি , কিন্তু আমার কেন যেন তাকে কখনোই সেরকম গ্ল্যামারাস মনে হয়নি। আরেক অভিনেত্রী রোজিনাকে নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত আছে , কিন্তু আমি সেসব গল্পের মধ্যে টুইস্ট পাইনি খুব একটা।
ববিতার ছোটবোন চম্পাও আশির দশকে যথেষ্ট নাম কুড়িয়েছেন। কাছাকাছি সময়ে চলচ্চিত্রে আসা দিতিও সম্ভাবনাময় ছিলেন । কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে কে বেশি মানানসই এটা নিয়ে বোধ হয় দিতি আর চম্পার মধ্যে অলিখিত একটা ইগোক্ল্যাশ ছিলো। দুই বোন মিলে জাফর ইকবালের সাথে একটা ট্রায়াঙ্গাল লাভ এর সিনেমাও করেছিলেন , কিন্তু বয়সে ছোট হয়েও চম্পা ববিতাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি লাবণ্যে। আমি অবশ্য এটার পেছনে জাফর ইকবাল-ববিতার অফ-স্ক্রিন কেমিস্ট্রির একটা জোরালো ভূমিকা দেখি।
অঞ্জু ঘোষ , অরুনা বিশ্বাস এই নায়িকাদের অসম্মান করতে চাই না , তবু তাদের এপ্রোচকে অনেকটাই যাত্রাশিল্পীর মতো মনে হয় আমার। জিনাত , দোয়েল ( দিঠির মা ) , রঞ্জিতা , রানী , শাহনাজ , নিপা মোনালিসা – এই নায়িকারা কেন-কীভাবে সিনেমায় এসেছিলেন এবং আবার কোথায় হারিয়ে গেলেন হুট করে , কোনোটারই কিনারা করে উঠতে পারি না। কুংফু নায়িকা হিসেবে রুবেলের সাথে মিশেলার একটা জুটি হয়েছিলো , কিন্তু নায়িকার সাথে কুংফু ব্যাপারটা দর্শক ঠিক সেভাবে নিতে পারে না।
মৌসুমী অধ্যায় শুরু করি।
ববিতা বা মৌসুমীকে নিয়ে আলাদা করে লিখবো না , দুজনের মধ্যে একটা কম্পারেটিভ চিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করবো। যেহেতু বলেই দিয়েছি নায়িকা বললে শুধু এই দুজনের ইমেজই মাথায় আসে , এবং অন্যদের ব্যাপারে লিখেও ফেলেছি অনেকটা , এক্সট্রা কমপ্লিমেন্ট না হলেও চলবে মনে হয়।
সালমান শাহ এর সাথে মৌসুমীর দ্বন্দ্বের সুযোগে সবচাইতে লাভবান হয়েছেন শাবনুর। তার জনপ্রিয়তা বিপুল , সালমানের প্রস্তুত করে দেয়া প্লাটফরম ব্যবহার করে পরবর্তী ১০-১২ বছর তিনি দাপটের সাথে অভিনয় করে গেছেন এবং সাফল্যও পেয়েছেন , কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে নায়িকা বললে শাবনুরকে পিছিয়ে রাখতে হবে গ্ল্যামার প্রশ্নে। অবশ্য গ্ল্যামারের এপ্লিকেশন পারসন টু পারসন ভ্যারি করে , তিনি যেহেতু অনেক বছর ইন্ডাস্ট্রি লিড করেছেন , ডেফিনিটলি তিনি গ্ল্যামারাস। কিন্তু মৌসুমীর পাশে তাকে দাঁড় করিয়ে দিলে তখন বোধ হয় পার্থক্যটা ধরা পড়বে।
শাবনাজকে বরং গ্ল্যামারের দিক থেকে এগিয়ে রাখা যায় , কিন্তু ক্যারিয়ার সচেতন না হওয়ায় অল্পতেই হারিয়ে যান দৃশ্যপট থেকে।
ফটোতারকা থেকে সিনেমায় আসা পপিকে গ্ল্যামারাস বলা যায় কিনা বুঝতে পারছি না। বরং প্রথম সিনেমা ‘কুলি ’তে তোয়ালে জড়িয়ে গান গেয়ে নিজেকে সেক্স সিম্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় , সেখান থেকে বোধ হয় আর বের হতে পারেননি। তবে অলিভিয়ার সাথে তাকে মেলানো যাবে না। হঠাৎ করে মুটিয়ে যাওয়ায় ক্যারিয়ারের বেশি সময় দর্শক তার মুখ নয় , বুকের দিকে তাকিয়ে সিনেমা উপভোগ করেছে বলে ধারণা করি। ( আমি হলে গিয়ে প্রচুর সস্তা টাইপ বাংলা সিনেমা দেখেছি জীবনে , সেখানকার দর্শক কমেন্টের প্রেক্ষাপটে এই স্টেটমেন্ট , এটাকে ঢালাওভাবে স্টেটমেন্ট না ধরার অনুরোধ )। তদুপরি শাকিল খানের সঙ্গে স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে ক্যারিয়ার গ্রাফটা যেরকম হওয়া উচিত ছিলো সেটা ধরে রাখতে পারেননি।
ক্লাশ নাইনে সিনেমায় আসা পূর্ণিমা ‘মনের মাঝে তুমি’ করে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন সত্যি , কিন্তু মৌসুমীর মতো ক্রেজ তৈরি করতে পেরেছিলেন কিনা জানা নেই। এর একটা প্রধান কারণ , তার কোনো শক্ত জুটি গড়ে উঠেনি। তিনি ছিলেন শাবনুর , মৌসুমীর ছায়ায় ঢাকা তারকা। তার সাথে জুটি ছিলো রিয়াজের , কিন্তু রিয়াজ বললে প্রথমেই আসে শাবনুরের কথা । ফলে পূর্ণিমা অনেকটাই সাপোর্টিভ ক্যারেক্টার , একক নায়িকা হিসেবে স্ট্রং ফ্যানবেইজ গড়ে তোলা তার পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।
ম্যাডামফুলি নামের ব্যতিক্রমী সিনেমা দিয়ে অভিষিক্ত সিমলা আরও কিছু সিনেমা করেছিলেন বা এখনো করেন। কিন্তু তিনি আসলে নায়িকার চাইতে চরিত্রাভিনেত্রী বেশি।
ইত্যাদির গানে মডেল হওয়া এবং সালমান শাহ এর সাথে প্রিয়জন সিনেমা করা শিল্পীকে অবশ্যই গ্ল্যামারাস বলা যায় , কিন্তু এই নায়িকাগুলো সম্ভবত ফিল্ম পলিটিক্সটা শিখে উঠতে পারেনি , যে কারণে তাদের ঠাঁই হয়েছে বিস্মৃতির ইতিহাসে। লিমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একদমই অভিনয় না জানা , অতিরিক্ত মুটিয়ে যাওয়া সম্ভবত তার পতনকে ত্বরাণ্বিত করেছে। একসময় মিস বাংলাদেশ হওয়া রাকা এর মধ্যে গ্ল্যামার ছিলো , কিন্তু ওস্তাদ জাহাঙ্গীরের মতো নন-গ্ল্যামারাস হিরোর সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে কোনো আলোচনাতেই নেই আর তিনি। বৃষ্টি , শামা এরা এতো অল্প সিনেমা করেছেন যে এদের নিয়ে কথা বলারই কিছু নেই। নিশি , সোনিয়া , তৃষ্ণা এরা বরাবরই সি-গ্রেডের নায়িকা , ধর্ষণদৃশ্যে আন্তরিক অভিনয় ছাড়া সিনেমায় তাদের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই সম্ভবত। মুনমুন , ময়ুরী , পলি , ঝুমকা , নদী , শাপলা , শানু এই তথাকথিত নায়িকারা আসলেই পেশাদার অভিনেত্রী ছিলেন , নাকি এদের অন্য কোনো পেশার পসার বাড়ানোর লক্ষ্যে সিনেমায় মুখ দেখানোটা জরুরী মনে করেছিলেন সেই উত্তর জানা নেই আমার।
শাকিবা নামে একজন নায়িকা এসেছিলেন খুব অল্প সময়ের জন্য , তার পারিবারিক ও এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ডও সমৃদ্ধ ছিলো । ১-২টা সিনেমা করে প্রচণ্ড গ্ল্যামারাস এই নায়িকা কোথায় হারিয়ে গেছেন কেউ জানে না বোধ হয়। প্রবাসী তামান্না , দেশী রত্না , কেয়া এরা সম্ভবত শখের বসে নায়িকা হয়েছিলেন , কয়েকটা সিনেমা করেই শখ মিটে গেছে।
অপু বিশ্বাস কোন্ বিচারে নায়িকা আমি বুঝে উঠতে পারি না , এতো কাজের ভিড়ে নতুন করে আর বুঝার চেষ্টাও করি না। টেলিভিশন থেকে যাওয়া রোমানা আর নিপুণের মধ্যে নিপুণ ফার ফার বেটার , সেটা গ্ল্যামার এবং অভিনয় দুই কনটেক্সটেই। রোমানা বরং অপু বিশ্বাসের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারে কে বেশি উদ্ভট এটা নিয়ে। শাহারা , ডিপজলসূত্রে নায়িকা পরিচিতি পাওয়া রেসি , অনন্ত জলিলের ( ইভা রহমান ) বর্ষা – এদের ব্যাপারে শব্দ খরচের মানে দেখি না। বিদ্যা সিনহা মীম টিভি থেকে গিয়ে পুরোদস্তর নায়িকা হওয়ার চেষ্টা করছেন , হাইটের কারণে নায়ক পাওয়া একটু সমস্যা ; তবু তার মধ্যে প্রমিজ এবং গ্ল্যামার দুটোই আছে। লেগে থাকলে হয়তোবা বর্তমান সময়ের বন্ধ্যাত্ব ঘুঁচিয়ে দিতে পারবেন। মাহিয়া মাহী , পরী মনি এরা নায়িকা , নাকি বিতির্ক উস্কে দিতে উন্মুখ মানুষ – এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাই না। ৪৩ বছর বয়সে জয়া আহসান ২৩ বছরের তরুণী সাজার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন , তার চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই , কিন্তু আমি এখন চাইলেই কি ক্লাস ফোরের বাচ্চাদের মতো হতে পারবো ? জয়া আহসানের চেষ্টাটাও সেই পর্যায়ের। তার জন্য শুভ কামনা। তিষা , মম এরা সিনেমা করলেও টেলিভিশন ইমেজ থেকে বের হতে পেরেছেন মনে হয় না। এর বাইরেও অনেক নায়িকা থাকতে পারেন ( যেমন আঁচল , অন্তরা , নাসরিন ) যাদের নাম বাদ পড়ে গেছে। তাদের প্রতি সমবেদনা।
এবার আসা যাক আসল পয়েন্ট এ। ববিতা আর মৌসুমী পুরোপুরি দুটো ভিন্ন জেনারেশন বিলং করেন। তাই দুজনের মধ্যে তুলনা চলে না। বিশেষ করে ববিতা যেখানে জহির রায়হান , আলমগীর কবির এর মতো পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন , সত্যিজিত রায়ের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের সাথে কাজ করেছেন , মৌসুমীর গণ্ডি সেখানে খুবই সীমাবদ্ধ। কিন্তু গ্ল্যামার প্রশ্নে ববিতা আর মৌসুমীকে পাশাপাশি দাঁড় করালে যে কোন একজনের পক্ষে ভোট দেয়াটা কঠিন হয়ে পড়বে। মৌসুমীর ক্যারিয়ারে দুটো ভুল ছিলো। প্রথম ভুল , অবশ্যই সালমান শাহ এর সাথে সিনেমা না করা। শাবনুরের সাথে যে ১৪টি সিনেমা করেছেন সালমান , সেগুলোর নায়িকা মৌসুমী হলে তিনি অন্য লেভেল এ পৌঁছে যেতেন। দ্বিতীয়ত , ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় বিয়ে করা মাত্রই মা হওয়া , যা পরবর্তীতে তার ড্রিম গার্ল ইমেজ কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অভিনয়ের জন্য তাকে কখনো রুবেল , কখনো ইলিয়াস কাঞ্চন , এক পর্যায়ে ফেরদৌস , মান্না এদের সাথে জুটি বাঁধতে হয়েছে , কিন্তু জুটিগুলো কোয়ালিটি কাজ উপহার দিতে পারেনি। সেদিক থেকে ববিতা অনেক লাকি। তিনি রাজ্জাকের সাথে কাজ করেছেন , বুলবুল আহমেদের সাথে অসংখ্য ভালো সিনেমা করেছেন , ফারুকের সাথে বিরাজ বৌ , আলোর মিছিলের মতো সিনেমা করেছেন , আর জাফর ইকবালের কথা তো বলাই বাহুল্য। ববিতা নিজেও বেশ কয়েকটা সাক্ষাৎকারে জাফর ইকবালের প্রতি তার বিশেষ মুগ্ধতার কথা স্বীকার করেছেন। ৮৫ সালে ৩৫ বছর বয়সেও পাকিস্তানী ফয়সালের সাথে মিস লংকা সিনেমায় ‘ চুরি করেছো আমার মনটা হায়রে হায় মিস লংকা ’ গানের সাথে যেভাবে নেচেছেন , দিস ইজ জাস্ট এমেজিং। মৌসুমীর সেরকম কোনো এচিভমেন্ট নেই। হিন্দি সিনেমার বাংলা ভার্সনে ‘ দেখেছি প্রথমবার দুচোখে প্রেমের জোয়ার ’ গানের সাথে রুবেলের সাথে নেচে বরং দর্শকের হাসির খোরাক যুগিয়েছেন। কিন্তু প্রতিভা বা উপমহাদেশীয় গ্ল্যামার থিওরি চিন্তা করলে , সবকিছুই মৌসুমীর ছিলো , কিন্তু সেটাকে বেস্ট ইউটিলাইজ করার মতো মেধাবী পরিচালক তার সেরা সময়ে ছিলো না , তারা তখন হিন্দি সিনেমার সিন বাই সিন টুকলিফাইংয়ে ব্যস্ত ছিলো। বাংলাদেশী সিনেমার ইতিহাসেই মৌলিক গল্পের সিনেমা সংখ্যা কম , সেই ষাট-সত্তরের দশকে যেসব সিনেমাকে আমরা গোল্ডেন এজ বলি সেগুলোর বেশিরভাগও কলকাতা বাংলা আর হিন্দি সিনেমার নকল। ববিতার স্বরলিপি সিনেমাটাও উত্তম কুমার-তনুজার একটি সিনেমার হুবুহু অনুসরণ। কাজেই নকল ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়াই বেটার। তবে এই লেখার এক জায়গায় বলেছি , অলিভিয়া সাহসী ছিলেন । কিন্তু সত্যি কথা হলো , ববিতার সাহসিকতার দৃষ্টান্ত আরও ব্যাপক । অনন্ত প্রেম সিনেমার শেষ দৃশ্যে রাজ্জাকের সাথে তার একটা গভীর চুম্বনের দৃশ্য ছিলো , যেটা সেন্সর বোর্ড কেটে বাতিল করে দেয় ; যে কারণে সেই দৃশ্যটা দর্শক দেখতে পারেনি । এরকম সাহসিকতা মৌসুমীও দেখিয়েছেন মাতৃত্ব সিনেমায় বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর দৃশ্যে অভিনয় করে। এই দৃশ্য নিয়েও ঝামেলা হয়েছিলো।
ববিতা-মৌসুমী দুইয়ের সাথে তুলনা করাটা অবান্তর , যেহেতু প্যারামিটার কিছুই মেলে না। তবু ব্র্যাকেটবন্দী করে নায়িকা শব্দটা বললে আমি নির্দ্বিধায় এই দুজনকেই বেছে নিয়ে অন্য কাজে মন দিব।
সেই অন্য কাজটা কী জানেন ? সেটা হলো শাবানার ইমেজ কল্পনা করা । কারণ , আমি বাংলাদেশে অভিনেত্রী বললে তার কথাই প্রথমে ভাবি। এমনকি কখনো কখনো ব্র্যাকেটবন্দী নায়িকা হিসেবেও। একটা গানের কথা বলি , ইউটিউব থেকে দেখে নিয়েন , তখন শাবানাকে নিয়েও নায়িকাসুলভ ফ্যান্টাসি তৈরি হতে পারে : ‘আমি কার জন্য পথ চেয়ে থাকি , আমার কী দায় পড়েছে…’