তারায় তারায় খচিত বইটি নিয়েছিলাম যাবতীয় প্রত্যাশাহীন মানসিকতায়, এবং পড়াশেষে প্রত্যাশিতভাবেই প্রত্যাশাহীনতার ব্যাপারটি নির্ভুল প্রতীয়মান হয়েছে৷ তবু জেনেশুনে বইটি পড়ার একটাই কারণ- সাক্ষাৎকারের প্রতি ঐকান্তিক কৌতূহল।
কীভাবে নিশ্চিত ছিলাম এই বই থেকে চিন্তার রসদ পাব না?
উত্তর নিহিত আছে বইয়ের নামের মধ্যেই। নামটা শোনামাত্রই মনে আসছিল জেমস এর গাওয়া গানের লাইন- ‘সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে, খুঁজে দেখ পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে, রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস, কোথায় আছে কেমন আছে মা’
বিখ্যাত মানুষের আগে ‘তারকা’ বিশেষণ কে কবে প্রথম বসিয়েছিল জানি না, তবে এই বিশেষণটা তীব্র বৈষম্যসূচক। তারকা আখ্যা দেয়ার মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হয়ে যায় কিছু মানুষ ধরা ও ছোঁঁয়ার বহু উর্ধ্বে, তাদের দেখতে হয় দূরবীনযোগে। কেউ যখন প্রতিষ্ঠিত বা তারকা হয়ে উঠে, আদতে সে পরিণত হয় মৃত মানুষে, সেও তখন দূর নক্ষত্ররূপে বিচরণ করে একাকী নিঃসঙ্গ।
এইসব কথিত তারকার টার্গেট মার্কেট সেইসব মানুষ যারা অনুভব করে বামুন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো যায় না। যে কোনো ক্রিটিকাল পরিস্থিতিতে উল্লিখিত বামুনেরা ঠিকই সারভাইভ করে যায়, তারকারা ক্রমাগত নিজেদের চারধারে সুরক্ষিত বেষ্টনী নির্মাণ করতে থাকে।
সাক্ষাৎকার দেয়াটা খ্যাতিমানদের রুটিনওয়ার্কের মতো। যে কোনো প্রশ্ন তাদের করা যায় না, অনেক সময় প্রশ্ন আগেই পাঠিয়ে তাদের অনুমোদন নিতে হয়, কিংবা না নিলেও তারা সেসব প্রশ্নই শুনতে চান যেগুলোর উত্তর থাকে তাদের ঠোঁটের অগ্রভাগে।
ফলে খ্যাতিমানদের সাক্ষাৎকারের চাইতে বোরিং এবং প্রেডিক্টেবল কনটেন্ট পৃথিবীতে পাওয়া যায় অতি কদাচিৎ!
তবু মানুষ উদগ্রভরে খ্যাতিমানদের কথাই শুনতে চায়। হয়ত সে ভাবে সেসব কথার সূত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কোনো সহজ সমীকরণ বা ফরমুলার দেখা মিলবে।
প্রতিষ্ঠিত মানুষ সে যে অঙ্গনেরই হোক, সে অতি অবশ্যই এনার্জেটিক, কৌশলী, কনসিসটেন্ট, জড়তাহীন এবং ফ্লেক্সিবল নৈতিকতার মানুষ হবে। অর্থাৎ সে কম্প্রোমাইজ করতে জানে।
কিন্তু
নিম্ন মধ্যবিত্তের সামাজিক নৈতিকতার ধারণায় কম্প্রোমাইজ এক ধরনের স্খলন, সুযোগের অভাবে সৎ ধারণা জেকে বসে। ফলে প্রতিষ্ঠিত মানুষের ফ্লেক্সিবল নৈতিকতা ধারণার সাথে আমাদের কখনোই পরিচয় ঘটে না, তারা বরং বর্ণচোরা নীতিতে নিম্নবর্গীয় মানুষের নৈতিকতায় নিজেদের স্থাপনের হাস্যকর প্রয়াস চালিয়ে যান। কতিপয় প্রতিষ্ঠাকামী বামুন বুভুক্ষের ন্যায় তাদের মুখ নিঃসৃত বাণী শোনার অপেক্ষায় থাকে, যদিও জানে না এখান থেকে তার প্রাপ্তি কী। যার সাথে আলাপ-পরিচয় নেই, যার জীবনে নেই আমার জন্য স্পেস বরাদ্দ তার সাথে ছবি তুলে বা তার একটা অটোগ্রাফ সংগ্রহে রেখে কোন মিনিংফুলনেস তৈরি হয় সেই প্রশ্ন জাগে না এবং কোনোদিন যাতে না জাগে সে লক্ষ্যেই দুনিয়াজুড়ে প্রতিষ্ঠার পূজা অর্চনা চলে।
তাই আপনি যদি খুব করে চান বিকাশের প্রতিষ্ঠাতাকে জিজ্ঞেস করবেন ‘ফ্লেক্সিবল নৈতিকতার ধারণায় কম্প্রোমাইজ কোন লেভেল পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য এবং জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কম্প্রোমাইজ করে আপনার উললব্ধি কী’, আপনি সেই সুযোগ পাবেন না, কারণ এটাকে দেখা হবে অসম্মান প্রদর্শন হিসেবে।
প্রতিষ্ঠিতদের সাক্ষাৎকার তাই সামান্য এদিক-সেদিক করে প্রচারিত তার বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনই। প্রতিষ্ঠিতদের সাথে আলাপ থেকে বের করে আনতে হবে কীভাবে সে কৌশলী মানুষ হয়ে উঠলো, কেন কোইনসিডেন্সগুলো তার সাথেই ঘটলো। তার কাছে একেবারেই চাওয়া উচিত না পরামর্শ, কারণ সেটা কোনোরকম মূল্য বহন করে না। যে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হবে সে গাইডেন্সের অপেক্ষায় নেই, নিজের পথ নির্মাণ করে নেবে। যে হবে কেরানি সে ওসব পরামর্শ প্রয়োগেরই যোগ্যতা রাখে না। বরং আগে হতে পারত সুখী কেরানি, পরামর্শের পর ভাববে হওয়ার কথা এলন মাস্ক হইয়া গেলাম চায়ের ফ্লাস্ক; কেরানি হিসেবেও সে তখন হবে নিম্নশ্রেণির।
প্রতিষ্ঠিত মানুষের ফরমুলাবন্দী সাক্ষাৎকার গণমানুষের মধ্যে তৈরি করে ডিলিউশন, তাতে পোর্টফোলিও ভারি হয় কারো কারো, কিন্তু সিগনিফিক্যান্ট কোনো পরিবর্তন আসে না চিন্তাচেতনায়।
তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত মানুষকে নিজ গরজেই তার জীবনের জার্নি শেয়ার করতে হবে। তার সময় পাওয়া নিয়েই যদি পানিপথের ৩য় যুদ্ধ ঘটে যায়, তার মানে সে তার গল্প বা অভিজ্ঞতাকে শেয়ারযোগ্য ভাবছে না, অথবা গল্প করাটা যথেষ্ট মূল্যবান মনে করছে না যা তার জীবনে ভ্যালু যুক্তকরণে সমর্থ হবে। এরকম সেমি-ইচ্ছুক মানুষকে এত তোয়াজ করে সাক্ষাৎকার নেয়ারই বা আবশ্যকতা কী!
এতসব চিন্তা প্রতিচিন্তার মধ্যেই তারায় তারায় খচিত বইটি পড়তে বসে যাই। বিভিন্ন অঙ্গনের ৯ জন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে মুনির হাসান এবং তার পুত্র ফারদীম মুনির তাদের যৌথ পডকাস্ট প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অতিথিদের নিয়ে পর্যাপ্ত পড়াশোনা করেছেন, কাউকে কাউকে অনুষ্ঠানে আনবার পূর্বে নিজেরা ইন্টারভিউ দিয়েছেন সেইসব অতিথির মনোনীত ব্যক্তির কাছে। নিজেদের কাজের জায়গায় তারা স্বচ্ছতা এবং সুশৃংখলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
কিন্তু যেহেতু তারকা নীতির সাথেই সাংঘর্ষিকতা বোধ করি, বইয়ের কনসেপ্টের সাথেই ফিলোসফিকালি মিসএলাইনমেন্ট তৈরি হয়ে যায়।
আমি বরং সেইসব প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির আলাপ শুনতে উৎসাহী যারা অকপট এবং আনসেন্সরড কথা বলতে পারদর্শী। হয়তবা প্রতিষ্ঠার মূল শর্তের সঙ্গেই এই দুটো বৈশিষ্ট্য মিলে না, তাই সেই চাওয়াও রয়ে যাবে অপূর্ণই।
৯ জন ব্যক্তির ইন্টারভিউয়ে নামগুলো উহ্য রেখে দিলে মনে হবে একই মানুষের গল্প শুনছি ৯ টি পৃথক সেটিংস এ, খুব বেশি আলাদা করা যায় না একের থেকে অন্যকে৷ এবং আলাপচারিতায় মনে হয় ইতোপূর্বে আরো অসংখ্যবার এই একই রেকর্ড বাজাতে বাজাতে তারা নির্বিকার হয়ে পড়েছেন৷ এর মধ্যেও ডাক্তার টি.এ চৌধুরী এবং স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম এর গল্প শুনে মনে হয়েছে তারা হয়তবা আরো কিছু বলতে চান যা বলা হলো না। কেবলমাত্র এই দুজনের আলাপকেই মানবিক এবং ক্লোজ টু অরিজিনালিটি মনে হয়েছে, এবং হয়তবা তাদের চিন্তা বোঝার আরো অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষা বোধ করছিলাম। অন্যদের আলাপ পড়ামাত্রই ভুলে গেছি, অথবা এমনও হতে পারে চোখ দিয়ে অক্ষর পড়েছি ঠিকই, সেগুলো আটকে গেছে সদর দরজায়!
তবু আমি প্রোএক্টিভলিই দেখব বিষয়টাকে। অন্তত ২ জন মানুষের চিন্তার ধরনে তো চিন্তার রসদ পেলাম। এক বই থেকে এর বেশি কী ই বা চাওয়ার থাকতে পারে!