গণমহলে শব্দটা পরিচিত ‘ব্রেইন ড্রেইন’ নামে, গুগলে এটাকে আরেকটু ভদ্রস্থ ভাষায় প্রেজেন্ট করা হয়েছে ‘হিউম্যান ক্যাপিটাল ফ্লাইট’ হিসেবে। প্রেজেন্টেশনে তো আর পারসেপশন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে না, ব্রেইন ড্রেইন কথাটা নিয়েই ডিল করি বরঞ্চ।
সংজ্ঞায় বলা হয়, একটি দেশের স্কিলড প্রফেশনালরা যখন ভিন্ন দেশে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে) পাড়ি জমায়, তার মানে সেই দেশ কিছু ব্রেইন লস করে। এই প্রক্রিয়াটিই হলো ব্রেইন ড্রেইন। মোটাদাগের এই সংজ্ঞা নিয়ে শব্দ খরচ করা আসলে সময়ের অপব্যবহার। তার চাইতে একটা রিয়েল লাইফ প্রশ্ন নিয়ে ভাবি, যার ক্ষমতা আছে রকেট বানানোর, সে যদি সাইকেলের ব্রেক বানিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়ার স্যাক্রিফাইস না করে যে কোনোভাবে রকেট বানানোটাকেই প্রায়োরিটি দেয়, তার এই সিদ্ধান্তের জন্য তাকে কি কোনোভাবে সেলফিশ বা দোষী বলা যায়?
যদি বলা হয়, সাইকেলের ব্রেক পর্যন্তই তোমার দেশের সামর্থ্য, সুতরাং রকেট বানানোর ইচ্ছা করলে সেটা দেশপ্রেম হবে না, তখন একটা ব্যাপার অবধারিতভাবেই চলে আসে, সেটা হলো, একতরফা অনুভূতিকে প্রেম বলে না, একে বলে মোহ। প্রেম সবসময় পারস্পরিক, সেখানে দুই পক্ষেরই সমান দায়িত্ববোধ থাকে। যে মানুষটি রকেট বানানোর স্কিলকে স্যাক্রিফাইস করে সাইকেলের ব্রেক নিয়ে খুশি থাকলো, এর বিপরীতে তার মূল্যায়ন কোথায়? ধরলাম, টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করার সামর্থ্য নেই, কিন্তু এপ্রিশিয়েট করা, রেসপেক্ট করা এগুলোর জন্য তো টাকার বাধ্যকতা নেই, সেই চর্চাটা কি আদৌ আছে? একজন সামান্য সার্ভেয়ার এদেশে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনে, একজন কেরানি কোটি টাকার এফডিআর করে, সেই সোসাইটির প্রতি দায়বোধ উপেক্ষা করে কেউ যদি তার স্কিল প্রয়োগের ক্ষেত্র খুঁজে নিতে চায়, আরেকটু ভালোভাবে বাঁচতে চায়, একে ঠিক কোন্ গ্রাউন্ডে বক্রচোখে দেখা যায়? দেশ মানে আমি একা না শুধু, অনেকেই মানুষ বুঝে, পৌরনীতির সংজ্ঞা অনুসারে অবশ্য স্বাধীন ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব, সরকার প্রভৃতি অনুষঙ্গ বোঝায়। আমি পৌরনীতি জানি না, দেশ মানে যদি একই সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক সীমারেখার মানুষ হয়, সেই মানুষের কাছ থেকে একজন এক্সট্রা মেধাবী মানুষ কতটুকু সম্মান বা মূল্যায়ন পাচ্ছে। বাকপটু, সুযোগসন্ধানী, লঘু আর তেলবাজ প্রকৃতির মানুষ যখন বিভব-বিলাসে ঠাট-বাট দেখায়, সকল কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় পেছনের দিকে থাকা বেশিরভাগ মানুষ যখন অধিকাংশ ক্ষমতাশালী পোস্ট অধিকার করে থাকে, সেইখানে অসাধারণ মেধাবী মানুষেরা যদি নিতান্তই ব্যক্তিগত চিন্তা করে, নিজেদের এম্বিশনকে ফুলফিল করতে তৎপর হয়, সেজন্য তাকে নিন্দা করা উচিত, নাকি নিজের পথ নিজে করে নিচ্ছে বলে তার এফোর্টের প্রতি পজিটিভ থাকা উচিত।
মূলত ব্রেইন ড্রেইনের যে ইস্যু নিয়ে আমাদের সমাজে হাহাকার কাজ করে সেটা হচ্ছে দেশের টাকায় পড়ে বাইরের দেশে সার্ভ করছে কেন, দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এই হাহাকারটা কিছুটা অজ্ঞতা বা বোঝার ভুল এবং অনেকাংশেই হীনম্মতা বোধ থেকে উদ্ভূত। ব্রেইন ড্রেইন একটা গ্লোবাল ইস্যু, শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের প্রত্যেক দেশেই এই ঘটনা ঘটে। বিশেষত, অনুন্নত দেশের মেধাবী মানুষেরা উন্নত দেশে সেটেল হয় এই পারসেন্টেজটা অনেক বেশি। কিন্তু অজ্ঞতার কারণেই বোধহয় অনেকে মনে করে, এটা বুঝি শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রে ডিভি লটারীর মাধ্যমে যখন মানুষ যায়, বা কানাডা-অস্ট্রেলিয়াতে ইমিগ্র্যান্ট হয়, তখন সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
কিন্তু একজন মেধাবী শিক্ষার্থী যখন গ্রাজুয়েশন শেষ করে বাইরের দেশে যায় উচ্চশিক্ষার্থে এবং পড়াশোনা শেষে সেখানেই সেটেলড হয়, সেটা নিয়েই যত কথা চালাচালি। কিন্তু একবার ভেবে দেখা যাক, এই উচ্চশিক্ষার ব্যাপারটা এক পাশে রেখে, আমাদের দেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোনো পেশাজীবী তার নিজের ফিল্ড এ চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন এই সংখ্যাটা কি অনেক বেশি? কখনোই নয়, বরং এদের চাইতে বেশি হলো নরমাল ইমিগ্র্যান্ট এর সংখ্যা। কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে যখন আমরা শ্রমিক পাঠাই বা অবৈধভাবে শ্রমিক যায়, তখন তো আমরা বরং শ্রম বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে বলে খুশি হই। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে এটা বলে স্বস্তি বোধ করি। তখন তো বরং এটাই দেশপ্রেম হিসেবে দেখা হয়, তাদের প্রবাসজীবনের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র টিভি বা খবরের কাগজসূত্রে সবার সামনে তুলে ধরি। পক্ষান্তরে, দেশের বাইরে যারা পড়তে যায় তারা সবাই তো খুব ভালো পজিশনে থাকে না, বা পড়াশোনা শেষেও সেখানে ভালো চাকরি পায় না। দেশের জন্য তাদের ফিলিং কি কম? তাদের স্ট্রাগল নিয়ে তো খুব বেশি শোরগোল চোখে পড়ে না। বরং টকশো গুলোতে তারা ‘মেধা পাচার’ কোটায় তত্ত্বকথার অবলম্বন হয়ে উঠে। যারা দেশের বাইরে পড়তে যায়, তাদের ফ্যামিলি তো দেশেই থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তারা কি ফ্যামিলিকে টাকা পাঠায় না? ফাইনান্সিয়াল কন্ট্রিবিউশনই যদি মাপকাঠি হয়, তাদের সেই কন্ট্রিবিউশনটা ওভারলুক করা হয় কেন? রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হওয়ার পর প্রবাসী স্টুডেন্টদের পাঠানো টাকার পরিমাণ কি নিতান্তই নগণ্য? কানেক্টেড থাকাই যদি মূখ্য হয় সেটার জন্য তো আজকের বিশ্বে কে কোথায় আছে সেটা কোনো বিষয়ই নয়, আমেরিকায় বসেও স্কাইপ, হোয়াটস আপ, ভাইবার এ কানেক্টেড থেকে কাজ করে দিচ্ছে অনেকেই। ফিজিকাল প্রেজেন্স তো খুব জরুরী নয় ইন্টেলেকচুয়াল সাপোর্ট এর ক্ষেত্রে। তবু আমাদের সমাজে দোষারোপ কালচার এস্টাব্লিশড হয়ে পড়েছে।
এটার বড় কারণ আমার মনে হয় হীনম্মন্যতা বা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স। যে লোক থার্ড ডিভিশনে ইন্টার পাশ করেছে সে যদি বলে ঢাকা ভার্সিটি-বুয়েটে পড়ার ইচ্ছা নেই বা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়বো না, সেটা হাস্যকর শোনায়। একই কারণে, সৎ কর্মচারী শব্দটা আমার কাছে বিশেষ অর্থবহ করে না, কিন্তু সৎ কাস্টমস অফিসার বা সৎ পুলিশ অফিসার আমার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং এবং রেসপেক্ট ডিজার্ভিং মনে হয়। কারণ, একজন কর্মচারীর অসৎ হওয়া না হওয়া খুব বড় স্কেলের কিছু নয়, কিন্তু প্রতিনিয়ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন পুলিশ অফিসার সততা ধরে রেখেছেন এর চাইতে কঠিন সংগ্রাম কিছু হতে পারে না। সেই ঈমানই সবচেয়ে দুর্বল ঈমান যার পরীক্ষা নেই। সুযোগের অভাবে ভালো আর খারাপ হওয়ার সবরকম সুযোগ পেয়েও ভালো- দুইয়ের মূল্যায়ন এক হয় না কখনো। তাই ব্রেইন ড্রেইন নিয়ে যারা উচ্চকিত, অধিকাংশই মেধার দিক থেকে বিলো এভারেজ, বাইরে পড়তে যাওয়ার বা দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগই হয়নি সেভাবে হয়তো, তারা যদি বলে দেশকে ভালোবেসে রয়ে গেছি, দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় পড়ে ওই ছেলেমেয়েগুলো বাইরের দেশের সেবা করছে, এই কথাগুলো অবুঝ শিশুর নাবুঝ বুলির মতো শোনায়। সে যতটুকু পড়েছে সেখানেও তো দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা আছে, তার কন্ট্রিবিউশন কী; টিভিতে টকশো দেখা, পেপার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেবে কিনা, আমেরিকা এই সুযোগে এই কন্টিনেন্ট বেল্ট এ ঘাঁটি গড়বে কিনা, ট্রাম্প হিলারির চাইতে বেশি ভালো হবে কিনা, এইসব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে চায়ের দোকানের বিল বাড়ানো?
হ্যাঁ, আবার অনেকেই আছেন যাদের দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশে থেকে গেছেন, বা আমার নিজের পরিচিত কয়েক বন্ধুও পড়তে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। এই যে বিশাল স্যাক্রিফাইস, সোশ্যাল প্রেসারকে উপেক্ষা করা, নিজে কিছু করতে চাওয়া এই রিস্ক নেয়ার দম বেশিরভাগ মেধাবীরই থাকবে না।
আমাদের দেশে মেধাবী বলে যারা পরিচিত হয় তাদের এভারেজ লাইফ সাইকেলটা কেমন হয়। তারা ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো, সবসময় বাসা থেকে বলা হয় ফার্স্ট-সেকেন্ড হতে হবে, খেলাধুলা করা মানে সময় নষ্ট, পরীক্ষায় খারাপ করা- এই ধরাবাঁধা রুটিনে বড় হতে হতে তাদের বেশিরভাগই আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে ভাবতে পারে না, তাদের সোশ্যালাইজেশন স্কিল সেভাবে ডেভেলপ করে না, তারা সাধারণত ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির, বলে কম, পড়ে বেশি, চিন্তা করে বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের সোশ্যাল স্ট্রাকচারে সেই মানুষগুলোই টিকে থাকে যারা সাত-পাঁচ চৌদ্দ বুঝ দিতে পারে, আরেকজনকে ওভারটেক করে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয় সেই কূটবুদ্ধি নিয়ে ডিল করতে পারে, এই ধরনের মানুষকে হ্যান্ডল করার জন্য যে পরিমাণ মেন্টাল স্মার্টনেস থাকা উচিত তা অধিকাংশ মেধাবীরই থাকে না, অথচ তাদের আত্মসম্মান বোধ প্রবল। এরা ব্যক্তিস্বাধীনতা, ফ্রিডম, মূল্যায়ন, এপ্রিশিয়েশন এসবে বিশ্বাসী, এবং সেই বিশ্বাসটা আঘাতপ্রাপ্ত হলে এরা ভেঙ্গে পড়ে মনের দিক থেকে। তবু যারা চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশে কিছু করার, বা সিস্টেমের সাথে খাপ খাওয়াতে প্রতিনিয়ত স্ট্রাগল করে যাচ্ছে, সেই মানুষগুলোকে আমি বলি আয়রনম্যান। এরকম আয়রনম্যানদের অপদস্থতা, নিঃশব্দ কান্না আপনি শুনতে পাবেন না, আপনি তার উপর ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দেন, তার অফিস উচ্ছেদ করবেন, পদে পদে হয়রানি করবেন, তবু তাদের দমিয়ে রাখতে পারবেন না। এরা সংখ্যায় বরাবরই অল্প, এবং এই অল্প মানুষেরাই ধীরে ধীরে ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে যার সুফল নিতে ড্রেইনে যাওয়া ব্রেইনগুলো আবার ফিরে আসবে দুধের মাছির মতো। এটাই ট্রু ফ্যাক্ট। পৃথিবীতে চেঞ্জ মেকারের সংখ্যা চিরকালই অল্প ছিলো, কিন্তু সেই চেঞ্জ এর সুফল নেয় লাখ লাখ মানুষ।
ব্রেইন ড্রেইনের ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে একটা সাইকোলজিকাল বিহেভিয়ার চলে এলো ভাবনায়। আমরা যারা ঢাকায় থাকি তাদের প্রায় ৯০%ই বোধহয় ঢাকার লোকাল নই, আমাদের প্রায় সবারই শেকড় মফঃস্বল বা গ্রামের দিকে। পড়াশোনা বা চাকরিসূত্রে আমরা ঢাকায় চলে আসি, এখানে দীর্ঘদিন থাকার দরুণ এখানকার লাইফস্টাইলের সাথে অভ্যস্ততা গড়ে উঠে, পরে ছুটি বা অন্য কোনো উপলক্ষ্যে গ্রামে গেলে সেখানকার সবকিছু কেমন অপরিচিত মনে হয়। যদি বলা হয় তুমি ঢাকায় যে বেতন পাচ্ছো, পঞ্চগড়ে গেলেও একই বেতন দেয়া হবে, ওখানেই সেটেলড হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই রাজি হবে না সম্ভবত। এর কারণ ঢাকার লাইফস্টাইলের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। বাইরে যারা পড়তে যায় তাদের ক্ষেত্রেও কাছাকাছি ধরনের অভিজ্ঞতা ঘটে। সেখানকার প্রিভিলেজড লাইফস্টাইল, এনভায়রনমেন্ট সবকিছুর সঙ্গে একধরনের এডজাস্টমেন্ট তৈরি হয়ে যায়। সেই কমফোর্ট জোন ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার স্পৃহা সহসা কাজ করে না। একে যদি দোষ বলা হয়, তাহলে ঢাকা থেকে যে পঞ্চগড়ে যেতে রাজি হচ্ছে না, টেকনিকালি সেও দোষী। কিন্তু পঞ্চগড়ের মানুষ তো বলতেই পারে আমরা পেলে-পুষে বড় করলাম, এখন ঢাকায় গিয়ে থাকে। এই যে ইজম, স্বজাত্যবোধ এগুলো ন্যাচারাল,এর থেকে সহসা রেহাইও মিলবে না।
স্থানান্তর এটা গ্লোবাল ব্যাপার। ইউরোপ থেকে দলে দলে লোক আমেরিকা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে এসে এখানেই বিয়ে-থা করে স্থায়ী হয়ে গেছে, কালচারাল এক্সচেঞ্জ এবং সংমিশ্রণ এভাবেই ঘটে, এভাবেই মানুষের সংকরায়ণ ঘটে। কাজেই এই ন্যাচারাল ফ্লো নিয়ে হাপিত্যেশ করা একধরনের দুঃখবিলাস।
দুঃখবিলাস না করে রাষ্ট্রীয়ভাবে সোশ্যাল এবং স্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট খাতে বিপুল বিনিয়োগ করা উচিত, টেকনোলজি খাতে আরও বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত। ভারতবিদ্বেষীতা যতই রিসেন্ট ট্রেন্ড থাকুক, অন্তত এই একটা জায়গায় তাদের কাছ থেকে জাতিগতভাবে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় রয়েছে। তাদের দেশেও ব্রেইন ড্রেইনের সংখ্যা প্রচুর ছিলো, কিন্তু আইটি খাতে উন্নয়নের কারণে সর্বশেষ ২০-২৫ বছরে তাদের অনেক মেধাবী আবার দেশে ফেরত আসতে শুরু করেছে, ফলে ব্রেইন গেইন হচ্ছে বা হয়েছে। আমাদের সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি এখনো। আমাদের দেশে যে লেভেলের ইঞ্জিনিয়ারিং হয় সেটার জন্য ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারই যথেষ্ট, সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে যে লেভেলের কাজ হচ্ছে সেটা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। ফলে যার মেধার মূল্যমান ২ লাখ টাকা, তাকে যদি ১৫-২০ হাজার টাকা দিয়ে রিপ্লেস করতে চাওয়া হয়, সেজন্য যেমন কোম্পানীকে দোষ দেয়া চলে না, অনুরূপভাবে সে তার মেধার বাজারমূল্য যাচাইয়ের জন্য যদি আরও স্ট্রং মার্কেটপ্লেস এ নিজেকে প্রেজেন্ট করে সেটাও প্রফেশনাল দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা উচিত। জীবনে ইমোশন বা আবেগের প্রয়োজন আছে, কিন্তু আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে চাওয়াটা দুর্বলচিত্তের লক্ষণ।
বন্ধু চমক হাসানের একটা গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ফেসবুক আর ইউটিউবসূত্রে। গানের টাইটেল ছিল ‘সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে’ – এই গান শুনে কত অসংখ্য প্রবাসী তরুণ-তরুণী যে চোখের জল বিসর্জন দিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। কী ছিলো সেই গানে? জাস্ট একজন প্রবাসী তরুণ দেশের কথা মনে করে নিজের অনুভূতি শেয়ার করছে, লক্ষ মানুষ সেই অনুভূতির সাথে নিজেদের রিলেট করতে পেরেছে। কারণ বিদেশ বিভুইয়ে সে ফিজিকালি পড়ে আছে ঠিকই, কিন্তু তার ঘনিষ্ঠজন, পরিবার সবাই তো এদেশে। তাদের ছেড়ে এই যে নিঃসঙ্গ জীবন এটা কি খুব আনন্দের? তবু তারা দেশে আসার সাহস পায় না কেন? কারণ, এখানে এসে কী করবে? পিএইচডি শেষ করে এদেশে এসে কোথায় চাকরি করবে? তার ডিগ্রির মূল্যায়ন হবে কি? ওখানে যদি সংসার পাতে, সন্তান হয়, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে এদেশে? এইসব নানান ইনসিকিউরিটি ফিলিং, সোশ্যাল স্ট্যাটাসের ভয় এই দ্বন্দ্ব থেকে বের হবে কীভাবে! আমাদের এখানে তো বরং বিদেশে থাকা মানে খুবই প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার, প্রবাসী পাত্র মানে মা-বাবার প্রথম পছন্দ (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, ঢালাওভাবে নয়), আমেরিকান গ্রীন কার্ড হোল্ডার পাত্রী মানে ছেলের ফকফকা ভবিষ্যৎ- এরকম মাইন্ডসেট যখন সমাজের মেজরিটি পিপলের, সেখানে বাইরের দেশে শত স্ট্রাগল করেও একজন মানুষ দেশে ফিরতে চাইবে না, কারণ ওখানে অড জব করলেও দেশের মানুষ তো জানে ছেলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। তার স্ট্রাগলের গল্প তো কোথাও ছাপা হবে না, সে তো শ্রমিক হিসেবে রপ্তানী হয়নি। সিমপ্যাথিও যে একটা প্রিভিলেজ, এটা এই ‘বিদেশ গমন’ ব্যাপারটা ব্যবচ্ছেদ না করলে বুঝতাম না।
অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর দেশে সাইন্সে পড়া একটা বিশাল রিস্কের ব্যাপার আসলে। অন্যদিকে সাইন্স না এগুলে দেশ এগুবে না। এই উভমুখী সংকটের বাস্তব সমাধান কী আমার তা জানা নেই। আমার ভাগ্নেকে নিয়ে আমার বড় বোনের অনেক আশা, সে চায় ছেলে ডাক্তার হোক। আমি বলি একটাই ছেলে, যদি চাও ছেলে নিজের কাছে থাকবে, তাহলে বরং কমার্স পড়াও। সাইন্সে পড়ে ভালো ফলাফল মানেই ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেষ্টা, যে কয়দিন ছাত্রজীবন সে কয়দিন ভাব, তারপর পাশ করে বের হলেই পাশার দান উল্টে যাবে। ডাক্তার তবু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে চলে খেতে পারে, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারের গতি কী? অথবা পিওর সাইন্সের সাবজেক্ট এ যারা পড়ে তাদের ক্যারিয়ার গোল কী; ব্যাংকিং অথবা বিসিএস, নাকি গার্মেন্টস এ চাকরি? পক্ষান্তরে, ভার্সিটিতে পেছনের দিকের সাবজেক্ট এ চান্স পেয়ে ফার্স্ট ইয়ার থেকেই বিভিন্ন ইনফরমেটিভ বই পড়ে, জব সল্যুশন পড়ে সে হয়ে উঠছে আগামী দিনের আমলা। এই যে অদ্ভুত নীতি আর পদ্ধতি, এর থেকে বের হয়ে যারা নিজের মতো বাঁচতে চাইছে তাদের স্বার্থপর বলছেন কোন্ যুক্তিতে? আপনার গলায় জোর আছে, আপনি সংখ্যায় ভারি, স্রেফ এটাই কারণ? অতকিছু করতে হবে না, স্রেফ ছোট্ট একটা কাজ করা যেতে পারে। শুধুমাত্র একটা শহরকে কেন্দ্র করে একটা দেশ গড়ে উঠতে পারে, বাংলাদেশ ছাড়া এমন নজির বোধহয় খুব বেশি পাওয়া যাবে না। ঢাকার সাথে নিকটবর্তী শহর মানিকগঞ্জ বা টাঙ্গাইলের লাইফস্টাইল, মার্কেট, অফিস সবকিছুর যে পার্থক্য, আরও দূরবর্তী শহরগুলোর দিকে তাকান। পার্থক্যটা আরও বেশি। আপনি বা আপনারা যেহেতু সংখ্যায় ভারি, গলায় জোর আছে, ঢাকাভিত্তক বাংলাদেশ কনসেপ্ট চেঞ্জ করার জন্য আন্দোলন করুন, আওয়াজ তুলুন। বিশ্বাস করুন, এটা দেশের জন্য অনেক বড় কন্ট্রিবিউশন হবে। তখন কিন্তু মিন মিন করবেন না, বলবেন না, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত, প্রচুর সময়, জনবলের দরকার, আমার একার কথায় কি এতোবড় ঘটবে। এটার জন্য তো সময় দিতে হবে’। – দেখলেন, আপনি পিছিয়ে এসেছেন! অনুরূপভাবে মেধাবী ছেলে-পেলে কোথায় গেল, কোথায় থাকলো, এটা নিয়ে মচমচে, কুড়মুড়ে সংলাপ না আউড়িয়ে ১ কেজি শসা খান, এতে চর্বি কমবে, হার্ট ভালো থাকবে, কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, মানুষের মেধা একটি ভৌগলিক সীমারেখা নিরপেক্ষ ব্যাপার। কেউ তার মেধা দিয়ে যদি বৃহত্তর মানব কল্যাণে কন্ট্রিবিউট করে আমি মনে করি সেটাই বড় এচিভমেন্ট; ভূখণ্ডটা ফিলিপাইন নাকি ফিনল্যান্ড সেটা কোনো মেজর ইস্যুই নয়। কারণ, ফিনল্যান্ডের মানুষও আনন্দে হাসে, ফিলিপাইনেও তাই, সর্বত্রই বেদনায় একই রকম নীল হয়। ভূখণ্ড যা-ই হোক, মানুষই মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। সেই মানুষের মধ্যে বিভাজন বাড়ায় এমন কোনো আক্ষেপের গল্প বা তত্ত্ব আমরা নিশ্চিন্তে সেফটিক ট্যাংকে বিসর্জন দিয়ে দিই। মেধাবী, অমেধাবী বড় কথা নয়, যে কোনো সুন্দর মনের মানুষকেই সম্মান করি। ব্রেইন তখন ড্রেইনে নয়, আপনার মস্তিষ্কেই থাকবে। ড্রেইন একটি নেগেটিভ এপ্রোচ; যতটুকু সময়ের জন্য নিঃশ্বাস সচল আছে, আগের চাইতে একটু বেটার ওয়েতে চিন্তা করতে চেষ্টা করি।