‘তুমি কী চাও বলো আমার কাছে/ আমার দেবার মতো সবই আছে/ টাকার পাহাড় দিমু উপহার, দিয়ে হবো তোমার স্বামী/ মানো কি বা মানো তুমি, ঘরে তুলে নেবোই আমি’- এটা একটা বাংলা সিনেমার বৈশিষ্ট্যহীন গান, যে সিনেমায় একজন নবাগত নায়ক অভিনয় করেছিলেন, রেডিও বিজ্ঞাপনসূত্রে তার নাম জানি- দিপু। সুপারফ্লপ এই সিনেমার নায়ক নিয়ে বাসায় কথা হতো মূলত তার ব্যক্তিগত জীবনের কারণে। এডভোকেট বাবার মুখে তার বিশাল ধনী এক ক্লায়েন্টের গল্প শুনি যে সম্প্রতি সিনেমার নায়ক হয়েছে। সিনেমার নামটাও তার বিত্তশালীতারই প্রতিচ্ছবি- ‘টাকার পাহাড়’!
হিট সিনেমার নাম কম-বেশি সবাই জানি, ফ্লপ সিনেমার নাম তো এর পরিচালক-প্রযোজকেরও মনে থাকে না। তবু টাকার পাহাড় সম্ভবত সেই সমস্ত ফ্লপ সিনেমার অন্যতম যার নাম বহু মানুষেরই জানা। এটাও হতো না, যদি ‘সানডে মানডে ক্লোজ কইরা দিমু’ সংলাপ দিয়ে এক ভিলেন পরিচিত হতেন। তেজি সিনেমার বিষু ওরফে ডিপজলই সেদিনেরই সেই ফ্লপ নায়ক দিপু, এই তথ্য জেনেছিলাম বহু বছর পরে।
হিউমারকে ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত করি আমি। উইটি হিউমার, ননসেন্স হিউমার, ডার্ক হিউমার। একটি করে উদাহরণ দিই। উইটি হিউমার- ‘মহামতি জাফরউল্লাহ শারাফতের দরাজ কণ্ঠের মাধূর্যে দুটো দাঁড়কাক মুগ্ধতাবশত নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো’। ননসেন্স হিউমার- ‘কিছু ভুল ছিলো তোমার, কিছু আমার/নবীনগরে গেলেই পাবে গরুর বিশাল খামার’। ডার্ক হিউমার- ‘হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে পাছায় আলপিন ঢুকে পড়েছে’।
হিউমারকে সংজ্ঞায়িত করি এভাবে- ‘যা টেনশন তৈরিতে বাধা দেয়, নেগেটিভ চিন্তাকে দমিয়ে রাখে এবং ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। হাসানো কমেডিয়ানের বৈশিষ্ট্য, কিন্তু মনের মধ্যে হাসির ভাব তৈরি হয় হিউমারচর্চা থেকে। ডার্ক হিউমার হজম করতে সংবেদনশীলতা অত্যাবশ্যক; প্রচলিত বোধ অনেক সময়ই ডার্ক হিউমারকে মেনে নিতে হিমশিম খায়। উইটি হিউমার বেশিরভাগ মানুষ ধরতেই পারে না; আমাদের হিউমারচর্চার ধারায় ননসেন্স ঘরানাই জনপ্রিয় বেশি, যদিও জানি না ননসেন্স হিউমারকে পর্যাপ্ত ননসেন্স বানানোর যোগ্যতা কতজনের থাকে!
অনন্ত জলিল, মাহফুজুর রহমান এবং হিরো আলমের ব্রান্ডিং বা সেলিং পয়েন্ট আদতে সমাজের সামষ্টিক হতাশাবোধ আর অর্থহীনতার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের জীবনের বেশিরভাগ কাজেরই কোনো অর্থ খুঁজে পাই না আমরা, অর্থ খোঁজার চেষ্টাটাই বাদ দিয়ে দিই একসময়। তখন ট্রল করা, পরনিন্দা, ঘৃণা প্রভৃতির চর্চা বাড়িয়ে দিই। হিরো আলমকে বাদ দিলে অবশিষ্ট ২ জনের প্রধান অন্ত্যমিল, এরা উভয়েই বিত্তশালী, সাংস্কৃতিক প্রতিভাযোগ নেই, কিন্তু বিত্ত দিয়ে প্রতিভাহীনতাকে ঢেকে দিতে চান। আপনি গায়ক নন, কিন্তু নিজের যদি একটি টেলিভিশন চ্যানেল থাকে, গান গাইলে নিষেধ করবে সাধ্য কার। আপনি এমন সুন্দরী একজনকে বিয়ে করতে চাইছেন যার সেলুলয়েডে মুখ দেখানোর বাসনা প্রবল, কিন্তু আপনি চান না সেই সুন্দরী অন্যকোনো নায়কের কণ্ঠলগ্না হোক; করণীয় কী তবে? নিজেই প্রযোজক বনে যান; নায়ক হওয়া আটকাবে কে?
৯০ এর দশকে যদি ইউটিউব আর ফেসবুকের চল থাকতো, তবে ডিপজল হতেন অনন্ত জলিল আর মাহফুজুর রহমানের সফল ও সার্থক পূর্বপুরুষ। তার সিনেমাকে অশ্লীলতার চাইতে বিনোদনের উৎস হিসেবেই দেখতো প্রজন্মমুখেরা। এর প্রমাণ অবশ্য পাওয়া যায় ডিপজলের ফানি ডায়ালোগ ক্যাপশনের ভিডিওতে ইউটিউব সয়লাব হওয়া দেখে এবং সেগুলোর ভিউ আর মন্তব্যসংখ্যায়। ‘আহো ভাতিজা আহো’, ‘বোজো না, দুদু খাও?’, ‘পাটক্ষেতে যামু’, ‘সিল মাইরা দিমু’, ‘সাবান মাখামু’, ‘পুত কইরা দিমু’, ‘সানডে মানডে কোলোজ কইরা দিমু’, ‘আমার হোগা মারা শ্যাষ’, ‘বড়ো ভাই ইলেকশন তো আইয়া পড়চে’ প্রভৃতি ডায়ালগ নিয়ে হরহামেশা মজা করে তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশ। অনন্ত জলিল যখন ‘বুঝলি না তুই, হোয়াট ইজ লাভ’ গায় কিংবা মাহফুজুর রহমান অদ্ভুত স্টাইলে প্যান্ট পরিধান করে গান গায় তখন দর্শকের মধ্যে যে উত্তেজনা কাজ করে তা কি ডিপজলের ওই সমস্ত ডায়ালোগে পাওয়া উদ্দীপনাকে ছাপিয়ে যেতে পারে?
তবে মাহফুজুর বা জলিলের চাইতে ডিপজলের লড়াইটা ব্যতিক্রমী, যদিও শুরুতে তারা একই লাইনেই ছিলেন। তাদের একজন নায়ক হয়েছেন, অন্যজন গায়ক। দুটো দিয়েই জনপ্রিয়তা পাওয়া তুলনামূলক সহজ। বিত্তবানদের খ্যাতিরোগের প্রধান কারণ তো সেই জনপ্রিয়তা, ব্র্যাকেটে পরিচিতি পাওয়া। হাসির পাত্র হয়েও যদি পরিচিতি পাওয়া যায় তার জন্য আত্মসম্মান কিছুটা স্যাক্রিফাইস করতেও রাজি অনেকে। ডিপজলের শুরুটাও তাদেরই মতো, যেটা তার সিনেমার নাম দেখলে বোঝা যায়। টাকার পাহাড় সিনেমার প্রযোজক ছিলেন তার ভাই; প্রশ্ন উঠতেই পারে সিনেমার নাম নিয়ে। কলকাতার শতাব্দী রায়ের সাথেও কাজ করেছেন নায়ক দিপু, কিন্তু দর্শক তাকে গ্রহণ করেনি। তবে ৯০ এর দশকে সারাপৃথিবীতেই কালচারাল প্যারাডাইম শিফটিং চলছিলো। বাংলা সিনেমাতেও সেসময় নায়কের প্রাচুর্য চলছিলো। ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, রুবেলের সাথে নতুন আবির্ভূত সালমান শাহ, আমিন খান, ওমর সানী, নাঈমরা ক্রেজ তৈরি করছিলেন। সিনিয়র আলমগীর, সোহেল রানা, জসিম- এরাও নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন তখনো। ফলে সেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ জায়গায় নায়ক হিসেবে দিপুর অবস্থান অর্জন অসম্ভব ছিলো। তাই বলে কি সিনেমাপ্রীতি থেমে থাকবে?
দিপু থেকে ডিপজল হওয়ার নেপথ্যে মান্না এবং কাজী হায়াতের ভূমিকাটুকুও উল্লেখ করা প্রয়োজন। সালমান শাহ বা ওমরসানী এর ফ্যানগোষ্ঠী কাছাকাছি রুচির হলেও মান্নার ফ্যানগোষ্ঠীর সাথে তাদের রুচিগত ব্যবধান ছিলো। রুচির দিক থেকে রুবেল আর মান্নার ফ্যানগোষ্ঠী সমগোত্রীয় বলা যায়।
মান্নার অভিনয় এক্সপ্রেসন এবং ডায়ালোগ থ্রোয়িংয়ে নিজস্বতা ছিলো। সেটা অপছন্দের হতেই পারে, কিন্তু তাকে এটার গুণে আলাদা করা যেতো। আপনি বলতে পারেন, মান্না অভিনয় পারতো না বলে সব সিনেমায় এভাবে এক্টিং করতো। কিন্তু তেজি সিনেমা যতদিনে করেছে ততদিনে তার ক্যারিয়ারের বয়স এক দশক পেরিয়ে গেছে। সেই দশ বছরে তো তার এক্টিং এমন ছিলো না, হঠাৎ এমন হলো কীভাবে? তার মানে এই নিজস্বতা তাকে সচেতনভাবে রপ্ত করতে হয়েছে।
নিজস্বতা ছিলো ডিপজলেরও। সে যখন ভিলেন চরিত্র করতো তখন প্রতিটি সিনেমায় যেভাবে কথা বলতো, ভিলেন ছেড়ে পজিটিভ চরিত্র করার সময়েও মুখের ভাষায় পরিবর্তন আসেনি বিশেষ। সে দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী হলে যে ভঙ্গিমায় কথা বলে, অসৎ পুলিশ অফিসার চরিত্রেও ভাষা একই থাকে, খুনী-মাস্তানেও ভাষায় পরিবর্তন নেই। তার মানে সে কথাই বলে এভাবে, যাপিত জীবনেও একইরকম। সে অভিনয় করে না, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে এক্টিভিটি চালায় মাত্র। যেখানে রপ্ত করার কিছু নেই, সেটাকে অভিনয় বলাটাও অনুচিত মনে করি।
তাহলে কি অনুসিদ্ধান্তে আসা যায় ডিপজল কোনো অভিনেতা নয়? যুক্তি-তর্ক দিয়ে এটা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে, কিন্তু যদি বলি ডিপজল একটি ইউনিক ক্যারেক্টার সিনেমা কনটেক্সট এ (হোক সেটা বাংলা, হিন্দি, তেলেগু, মারাঠি বা ইংরেজি), এই বক্তব্যকে খণ্ডন করা যথেষ্ট দুঃসাধ্য হবে। আমার অস্তিত্ব পরিভ্রমণ কাটে ইউনিকনেস ইলিউশনে, যা কিছু ইউনিক, সেটা পছন্দ করছি কি করছি না তা মূখ্য থাকে না। সে স্ক্রিপ্টের মতো হয় না, স্ক্রিপ্ট তার মতো হয়ে যায়। অভিনেতা হিসেবে তাকে বাতিল করে দিলেও ক্যারেক্টার হিসেবে সে গভীর গবেষণার স্পেস দাবি করে।
কেন সে এমন?
ব্যক্তিজীবনেও সে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী মানুষ; ট্রাফিক পুলিশকে মারার অভিযোগে শিরোনামে আসে, অস্ত্র উচিয়ে ধরার জন্য সমালোচিত হয়, মামলায় জেলে যায়, টিভি ক্যামেরার সামনে প্রচণ্ড এটিচুড দেখিয়ে বলতে পারে- ‘আমি কোন্ দলের সেটা ব্যাপার না, আমি ডিপজল এটাই আমার পরিচয়’। যখন প্রতিটি রাজনৈতিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত মানুষেরা সরকারের ক্ষমতা অপব্যবহারের কথা বলে, তখন তার ‘আমি ডিপজল’ বলার মধ্যে সেলফ-রেসপেক্ট এবং পৌরুষের প্রখর প্রগাঢ় নিদর্শন পাই।
এই মানুষ সিনেমার প্রয়োজনে নিজেকে বদলাবে তা আশা করা যায় কি? কাল্লু মামা সিনেমার একটা সংলাপ মনে পড়লো- ‘এই কাল্লু মামা নিজেই একটা সিনেমা, ৭দিন গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে না খাইয়া আছিলাম, ক্ষিদার জ্বালায় প্যাটে পাত্থর বাইন্ধা রাখছিলাম’। সিনেমার দর্শক তার খুন করার বীভৎসতা দেখে, কিন্তু কাল্লু মামার সংলাপের অনিবার্যতা খোঁজে না।
পারস্পরিক নিজস্বতাই মান্নার সাথে ডিপজলের রসায়ন জমার প্রধান নিয়ামক বলবো। কিন্তু তেজি সিনেমাটা হিট কেন করেছিলো, কিংবা সুপারফ্লপ দিপু নিজের ইমেজ বিসর্জন দিয়ে ভিলেন ডিপজল হিসেবে ফেরত এলেন কেন? মাহফুজুর বা জলিলের মতো শখের বশে বা টাকার জোরেই কি যুক্ত হয়েছিলেন এমেচারের মতো? তেজি সিনেমাটা যারা দেখেছেন, তারা বুঝবেন ঐ সিনেমার বিষু চরিত্রটি মোটেই এমেচারিতার নয়, ওখানে ব্যক্তিইমেজ ক্ষুন্ন হওয়ার সবরকম সম্ভাবনা তৈরি হয়েই ছিলো। তবু জেনেবুঝে ওই চরিত্রটিতে সে কেন অভিনয় করেছিলো? পরিচিতি পাওয়াটাই কি টার্গেট ছিলো কেবলমাত্র?
নায়ক-ভিলেন জুটির ইতিপূর্বে দৃষ্টান্ত ছিলো জসিম-আহমেদ শরীফ। কিন্তু সেটা জসিম ডমিনেন্ট ছিলো সবসময়। হুমায়ূন ফরিদীর সাথে ইলিয়াস কাঞ্চনের একটা জুটি গড়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু ফরিদী সম্ভবত ভিলেনগিররি মুখস্থ ফরমুলায় বিশ্বাস করতেন না, কাঞ্চনকে বাড়তি ফোকাস দেয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি ছিলো। তাছাড়া, ফরিদী ভিলেন থাকাকালে নায়কের চাইতে বেশি জনপ্রিয়তা আদায় করে নিতেন। এটা নায়কের জন্য কিঞ্চিৎ বিব্রতকর বলতে হবে।
মান্না-ডিপজলের ক্ষেত্রে ডমিনেন্সটা এককভাবে ছিলো না কারো। মান্না বাদে অন্য সকল নায়কদের সাথে সিনেমায় তো রীতিমতো ডিপজল ডমিনেটিং ফোর্স হিসেবে কাজ করতো। নায়কগিরির চাইতে সেইসব সিনেমায় ভিলেনগিরি বেশি প্রাধান্য পেতো। যে কোনো সিনেমায় ভিলেনের শেষ পরিণতি জেলে যাওয়া। কিন্তু এমন সিনেমা খুব কম পাওয়া যাবে যেখানে ডিপজল সিনেমার অন্তিম দৃশ্যে জেলে গিয়েছে। নায়কের হাতে খুন হওয়া এবং পার্শ্বনায়ককে হত্যা করা, এ দুটো পরিণতি প্রায় সব সিনেমাতেই অবধারিত ছিলো।
তার হত্যার ধরনেও নৃশংসতা ছিলো। পিস্তল দিয়ে হত্যা করতো খুব কম ক্ষেত্রেই; ধারালো অস্ত্র বা অন্য কোনো পাশবিক উপায়ই ছিলো তার হত্যা করার কৌশল। এক সিনেমায় সে কোলাকুলি করে হত্যাকৌশল হিসেবে, অন্য এক সিনেমায় রাইফেলের উল্টোপ্রান্ত দিয়ে মাথায় আঘাত করে।
প্রায়ই চিন্তা করতাম, ডিপজলকে পুলিশে ধরে না কেন, সে মরে কেন, বা পার্শ্বনায়ক না মরলে সমস্যা কী? কিংবা অনেক সিনেমায় ভিলেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়, ক্ষমা চায় শেষ দৃশ্যে, তারপর সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। পরে ব্যাখ্যা পেয়েছি, ভাঙবো তবু মচকাবো না নীতি এর। পুলিশে ধরা পড়া মানে নৈতিক পরাজয় মেনে আত্মসমর্পণ করা। কিন্তু খুন হওয়ার মধ্যে শেষ পর্যন্ত নিজের ইগোকে স্যাটিসফাইড রাখা, প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দেয়ার মেসেজ রয়েছে। পার্শ্বনায়ককে হত্যাও সেই ইগোর দৃষ্টান্ত। নিজের ভিলেনশিপকে শ্রদ্ধা জানানো বা আদর্শকে সঠিক মেনে সেই অবস্থানে অনড় থাকা।
ভিলেনের একটা পরিবার থাকে। বখাটে ছেলে, বা বাবা, স্ত্রী। কিন্তু ডিপজলের বেশিরভাগ সিনেমাতেই সে ইনডিভিজুয়াল। তার কোনো পারিবারিক প্লট থাকে না, এমনকি তার ছবিতে অন্য কোনো ভিলেন থাকে, যে মেইন ভিলেন, কিন্তু সে তার বাজির ঘোড়া হিসেবে নায়কের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। অনেকটা মাফিয়া চরিত্রের মতো। সে না নায়ক, না মূল ভিলেন, সে একজন মাফিয়া যার কাছে নায়ক-ভিলেন দুজনই বান্ধা। এই ইউনিকনেসটা কি কাকতালীয়, নাকি তৈরিকৃত? অতিঅবশ্যই আত্মপ্রেমের পরাকাষ্ঠা থেকে হয়েছে এটা।
সে যদি প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক না হতো, আত্মপ্রেম প্রদর্শনের সুযোগটা কি মিলতো? আমি মনে করি, তেজি সিনেমাটা এই প্রশ্নের একটা উত্তর হতে পারে। সেই সিনেমার একটা সংলাপই এখনো জনশ্রুত আছে- সানডে মানডে কোলোজ কইরা দিমু। কাজেই ডিপজলকে নিজের যোগ্যতায় আত্মপ্রেমের স্পেস অর্জন করে নিতে হয়েছে, বিত্ত খুব বেশি রোল প্লে করার সুযোগ পায়নি।
ভিলেনের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে স্টেরিওটাইপ আছে কয়েকটা: খুন-খারাবি, মদ খাওয়া, ধর্ষণ দৃশ্য। যেহেতু ডিপজলময় সিনেমা, তাই নায়কের চাইতে ভিলেনের নৃশংসতাই প্রাধান্য পেতো বেশি। সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে তার গালিবাজি। ইতিপূর্বে সিনেমায় গালাগালিগুলো সুনির্দিষ্ট কিছু শব্দেই সীমাবদ্ধ থাকতো। শুওরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, হারামির বাচ্চা, অমানুষ, পশু, হারামজাদা- এগুলোর বাইরে অশালীন শব্দের প্রয়োগ ছিলোই না বলতে গেলে। কিন্তু ডিপজল আর মান্না মিলে গালির ক্ষেত্রে বিপ্লব নিয়ে আসে বলা যায়। নাটকির পো, মান্দার পো, খানকির পোলা, গুয়া, হোগা জাতীয় শব্দগুলো সিনেমায় ঢুকে পড়ে অবলীলায়।
যেহেতু ডিপজলের অভিনয় দক্ষতা শূন্যপ্রায়, চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে তাকে সবচাইতে নির্ভর করতে হয়েছে চোখ এবং চুলের ব্যবহারের উপর। প্রায় প্রতিটি দৃশ্যেই সে চোখ পাকিয়ে সংলাপ বলতো, এবং এযাবৎকালে সবচাইতে বেশিরকমের উইগ ব্যবহার করা ভিলেন সে। উইগের সাপেক্ষে পরিবর্তন এসেছে পোশাকেও। নায়কের সাথে যেমন ১জন খাস চ্যালা থাকে, ডিপজল ভিলেন হয়েও একজন খাস চ্যালা এফোর্ড করেছে অধিকাংশ সিনেমায়। তাকে ভিলেনের চাইতে এন্টিহিরো বললেই সেটা মানানসই হয় বেশি।
আমি এই, আমি সেই প্রভৃতি হম্বিতম্বি সবচাইতে বেশি দেখা যায় মিঠুন চক্রবর্তীর সিনেমাগুলোতে, তার সংলাপগুলোও হতো নিজস্বধাঁচের। ভিলেন হয়েও নিজের পরিচয় জাহির করার প্রতিযোগিতায় ডিপজল যে কোনো নায়ককেই হার মানিয়েছে। কেন জাহিরের প্রয়োজন পড়তো? কারণ, পাবলিক ডিমান্ড। নায়ক-নায়িকার ‘আমার প্রেম যদি সত্যি হয় তোমাকে ফিরে আসতেই হবে’ জাতীয় নিরামিষ সংলাপের চাইতে ‘তর মরণের চুলকানি উঠছে, আমি তরে মলম লাগাইয়া দিমু’, কিংবা ‘আপনের মতোন ফকুন্নির পুতের নাম যদি হয় বাদশা, তাইলে দ্যাশের অবস্থা তো এমন হইবোই’ জাতীয় সংলাপগুলো দর্শকের হাততালি পায় বেশি। বানর নাচ দেখলেও হাততালি দেয় মানুষ, তাই তালিকে কোয়ালিটি বা মেরিটের প্রতিবিম্ব ভাবা যাবে না। কিন্তু সিনেমার প্রেক্ষিতে তালি দেয়া, শিটি বাজানো ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে; তার মানে দর্শক তখন এনগেজড হতে পেরেছে।
দর্শক কেন এনগেজড হলো? এটা রুচির প্রশ্ন। রুচি একদিনে তৈরি হয় না। এর সাথে তার আর্লি শৈশব, লাইফস্টাইল, সঙ্গ-সংঘ, প্রতিবেশের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সবকিছুর সমণ্বয়ে তৈরি হয় রুচিবোধ, এবং এটা চিরস্থায়ী কিছু নয়, ঘূর্ণায়মান লাটিমের মতো করে রুচিও সতত ঘূর্ণনশীল। রুচির পূর্বে অনেকে সস্তা, উচ্চমার্গীয়,উন্নতমানের, গড়পড়তা প্রভৃতি ট্যাগ যুক্ত করে আনন্দ পান। আমি এইসব ট্যাগিংয়ের পক্ষে না। কেউ যদি তার রুচিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে সেটাকেই প্রকৃত রুচি বলতে পারি। কেউ মেহেদী-ঝুমকার সিনেমা দেখলে নিম্নরুচি আর ফরেস্ট গাম্প বা শশাংক রিডাম্পশন দেখলে পরিশীলিত রুচি- এটা অতিসরলীকরণ। মেহেদী-ঝুমকার নর্তন-কুর্দন দেখে কেউ যদি বলতে পারে এখান থেকে তার প্রাপ্তি কী এবং সে কীভাবে নিশ্চিত প্রাপ্তির ব্যাপারে, সেই রুচির প্রতি পূর্ণসমর্থন রয়েছে আমার। অন্যদিকে ফরেস্ট গাম্প তাকে কীভাবে ফ্যাসিনেট করে এটা বলতে না পারলে সেই রুচিকে অন্তঃসারশূন্য বলতে ২য় বার ভাববো না।
দর্শক ডিপজলের ডায়ালোগবাজিতে এনগেজড হয়েছে এটার দায় ডিপজলের নয়, দর্শকের রুচির। কেন তাদের রুচি এমন এ নিয়ে বরং গবেষণা হতে পারে, এবং তখন আবিষ্কৃত হবে ডিপজল দূরবর্তী কেউ নয়, আমাদেরই অর্থহীনতা আর ভিশনহীনতার প্রতিনিধিমাত্র।
আমরা কীভাবে এরকম হলাম?
আমাদের আশপাশে আইডল ফিগারের নিদারুণ অভাব। কাউকে দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা জাগে না; প্রায় প্রত্যেকেই শুধু বক্তৃতাবাজি করে, সে তুলনায় কর্ম নেই তেমন। শিশু বয়স থেকেই আমরা হিপোক্রেসির চর্চা দেখে দেখে বড়ো হই। এবং বয়সকালে বুঝতে পারি, আমরা এতোকাল ধরে কেবল ভণ্ড হওয়ার চেষ্টায় রত আছি। আমরা তখন ক্রমাগত জাজমেন্টাল আচরণ করি, তার বাইরে রাখতে পারি না স্বয়ং নিজেদেরও। ভণ্ডের রুচি থাকতে নেই, রুচি আর ভণ্ডামি বরশি আর মাছের সমীকরণে মেনে চলছে অনাদিকাল থেকে।
রুচি তৈরি না হওয়ার লক্ষণগুলো আরো ভালোভাবে প্রতীয়মান হয় ফেসবুক এক্টিভিটিতে। সেফুদাকে নিয়ে মাতামাতি হয়, নায়লা নাঈমকে নিয়ে নির্বিচারে মত- পাল্টা মত কিংবা ফেসবুকে শেয়ার হওয়া পোস্টগুলোর কনটেন্ট মেরিট এবং লেন্থ, না থাকে সেখানে বিশ্লেষণ, না পর্যালোচনা, তবু সেসব পোস্টের টাইটেল দেখে কারো স্যালুট চলে আসে, কেউ সহমত ভাই হয়ে যায়, কেউ থাম্বস আপ দেয়, কারো চোখ ছলছল করে উঠে- এই যে নকল ইমোশন, এসবের চর্চা বাড়তে বাড়তে একটা বয়সে মানুষের উপলব্ধি হয় তার হাত-পা-চোখ থাকলেও রুচি নেই; সে একটি অতীত-ভবিষ্যৎবিহীন আরশোলামাত্র। এই উপলব্ধির সংক্রমণ এড়াতে সে আরো বেশি রুচিহীন আচরণেল লুপে আটকে পড়ে। রুচিহীনতা আকার ধারণ করে অক্টোপাসের।
অতি ডিপজলময় হওয়াতে সিনেমা বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। অনেকেই একবাক্যে তাকে বাংলা সিনেমার অশ্লীলতার পুরোধা বলে থাকেন। আমি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করি। অফিসিয়ালি বাংলাদেশের প্রথম অশ্লীল সিনেমা ‘রাঙা বউ’, যেখানে ভিলেন ছিলেন হুমায়ূন ফরিদী। ফায়ার সিনেমায় নায়িকা পলির উন্মুক্ত ঊর্ধ্বাঙ্গের দৃশ্য আছে এরকম সংবাদ পত্রিকায় এসেছিলো কীভাবে; সেটা কি ডিপজলের কীর্তি?
সিনেমায় অশ্লীলতার কয়েকটা সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট থাকে-
. গানের দৃশ্য যেখানে নায়িকার শরীরের বিশেষ জায়গায় ক্যামেরা ধরা হয় যাতে স্বাভাবিক নাচকেও অশ্লীল লাগে।
. গানের দৃশ্যায়নে বৃষ্টি, বিছানা, গোসলখানা, নদী, সাগর প্রভৃতির ব্যবহার, যেখানে নায়ক-নায়িকা শারীরিক সংসর্গ করে।
. ভিলেনের আইটেম গান।
. ধর্ষণদৃশ্য। পোশাক ছেড়া, শরীরের স্পর্শকাতর অংশ প্রদর্শন, এবং সুযোগ বুঝে কাটপিস জুড়ে দেয়া। ধর্ষণদৃশ্যের অভিনেত্রীদেরও ক্যাটেগরি থাকে- নায়িকার বান্ধবী, নায়কের ছোট বা বড়ো বোন, পার্শ্বনায়িকা।
ডিপজল যতগুলো ধর্ষণদৃশ্যে অভিনয় করেছে তার অন্তত ৩গুণ দৃশ্য খুনোখুনির। রক্তারক্তিকে ভায়োলেন্স বলা হয়, অশ্লীলতা নয়। বরং আমি ডিপজলের দায় দেখি ভায়োলেন্স আর ভালগার স্ল্যাং প্রমোট করার ক্ষেত্রে, যদি স্ল্যাং এর প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে আমার। তবু কৃত্রিম শালীনতা-মৈত্রী বজায় রাখার জন্য হলেও স্ল্যাংকে নিরুৎসাহিত করা উচিত।
তবে বাংলা সিনেমার অশ্লীলতা দেখলে বরাবরই হাসি আসতো, কমেডি মনে হতো/হয়। বাংলা সিনেমার তথাকথিত অশ্লীল দৃশ্যগুলোর বেশিরভাগই হাসির খোরাক যোগায়, যদিও পেইড কমেডিয়ান থাকে সিনেমায়; সেগুলোকে বরং ভাঁড়ামো মনে হয়। ক্যামেরার শাটার অন করতে শিখেই পরিচালক হয়ে গেলে তাদের প্রোডাকশন এর চাইতে উন্নত কিছু হবেই বা কীভাবে। এরা সার্কাসে বামুনের পাছায় আগুন জ্বালানো দেখে হেসে খুন হওয়া মানুষ; এদের কমেডি সেন্স এমনটাই হবে তাতে আর বিস্ময়ের কী হলো!
একবার ভাবুন, আশিক বানায়া আপনে তে তনুশ্রী দত্ত- ইমরান হাশমি বা মার্ডার সিনেমায় মল্লিকা শেরওয়াত-ইমরান হাশমির গানের মধ্যে যে অশ্লীলতা, বাংলা সিনেমায় সেই চেষ্টা কোথায়? যৌন অবদমনকে উস্কে দিতে নায়িকার দ্যোদুল্যমান বুক, আটসাট পোশাক, কিংবা ভেজা শাড়ি আর ক্যামেরার পজিশন এদিক-ওদিক করলেই অশ্লীলতা হয় নাকি! ওটা তো বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরদের জন্য রেসিপি হতে পারে বড়োজোর। কাটপিসের হিসাব-কিতাব আলাদা অবশ্য; একে সিনেমার মূল ধারার কার্যক্রমের সাথে মেলানো যাবে না।
ডিপজলের সংলাপগুলো কি সে নিজেই লিখতো? জানি না, তবে তার সংলাপ নিয়ে স্ক্রিপ্ট রাইটারকে যে আলাদাভাবে খাটতে হতো একথা নির্দ্বিধায় বললে অত্যুক্তি হবে না বোধকরি। অশ্লীলতার পয়েন্টগুলো উপেক্ষা করতে পারলে তার সংলাপের মেরিট এবং এক্সপ্রেসন দুটোই ডার্ক হিউমারের দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত। সে ক্ষুব্ধ, কিন্তু সেখানে ভয়ের চাইতে হিউমার বেশি। ‘ওই, অস্ত্র বাইর কর’- কথাটা সে যেভাবে বলবে, অন্য কেউ সেভাবে বলতে পারে না। একটা সিনেমার কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে; ডিপজলের বাবা মারা গেছে, সে রাজাকার ছিলো, তবু বাবাকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছে। মান্না তার লাশ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেয়। বেশ কয়েক দৃশ্য পর ডিপজল যখন প্রতিশোধের পরিকল্পনা করছে তখন তার প্রথম কথাই ছিলো ‘আমি ওই ময়লার গাড়িডা খুঁইজা বাইর করছি, আমার বাপরে ও ময়লার গাড়িতে কইরা পাঠাইছে, আমিও অর বাপরে ময়লার গাড়িতে উঠামু’; এটা কি প্রতিশোধের লাইন, নাকি উৎকৃষ্ট ডার্ক হিউমার?
হিউমারপ্রিয় যে কোনো মানুষের উচিত ডিপজলের প্রতিটি সিনেমা অত্যন্ত মনোযোগসহকারে দেখা, সংলাপগুলো খাতায় টুকে রাখা, এক্সপ্রেসনগুলো মনে রাখা; তার আর আলাদা করে মিস্টার বিন দেখার প্রয়োজন পড়বে না। মিস্টার বিনে হিউমার বলতে কিছুই নেই, পুরোটাই এক্সপ্রেসননির্ভর কমেডি। কিন্তু ডিপজলের পরতে পরতে হিউমার। এটিএম শামসুজ্জামান ভিলেনের চরিত্রে কমেডি টোন নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু হিউমার আনার ক্ষেত্রে ডিপজলের সমকক্ষ কোনো ক্যারেক্টার বাংলা বা হিন্দি সিনেমায় পাওয়া যাবে না। তামিল-তেলেগু সিনেমায় নৃশংস খুনী ভিলেনও ক্ষণে ক্ষণে হিউমার করে; সেখানে বিশুদ্ধ ভালো বা খারাপ কোনো ক্যারেক্টার থাকে না। তারা কমেডি আর হিউমার রাখে প্রায় প্রতিটি ক্যারেক্টারের বৈশিষ্ট্যে। তাদের পেইড কমেডিয়ান ক্যারেক্টার থাকে আলাদা, তবু হিউমার তাদের স্টোরিলাইনের প্রাণ।
কিন্তু সে তো হিউমারের উদ্দেশ্যে সংলাপ দিচ্ছে না, সে আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছে। মানুষ তাতে যদি হিউমার খুঁজে পায় সেটা তো তার জন্য অসফলতা। সেটাই কি ন্যায্য প্রাপ্য নয় তার? কিন্তু আমরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের সম্বন্ধে ১০৭টা ভুল ধারণা বা মিথ নিয়ে জীবন পার করে দিই। কেউ হয়তোবা ইন্টারটেইনার সে নিজেকে ভাবছে বুদ্ধিজীবী, কেউ ভালো ম্যানেজার সে ভাবছে কর্মী, কেউ ভালো বক্তা কিন্তু লেখক হওয়ার সাধনায় মেতেছে। ফলে ভ্রান্ত ধারণা আর মিথের করিডোর পেরিয়ে প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাওয়া হয় না আমাদের। ডিপজলও তো সেই আমাদেরই লোক।
যে কারণে ইমেজ সংকটে ভুগে সেটা পুনরুদ্ধারের আশায়-নেশায় সে ক্যারেক্টার ডিপজল হওয়ার পরিবর্তে অভিনেতা প্রবীর মিত্র আর আলিরাজের সংমিশ্রণে কখনো চাচ্চু, কখনোবা দুলাভাই জিন্দাবাদ সিনেমা বানিয়ে নিজের হিরোইজম দেখাতে চায়। এই ডিপজলকে কি চেয়েছিলাম আমরা? চাচ্চু সিনেমার কথা উঠলে মানুষ শিশুশিল্পী দীঘির কথা বলবে, দুলাভাই জিন্দাবাদের প্রসঙ্গ উঠবেই না আলোচনায়। তবু ডিপজল যে বহমান এর প্রধান কারণ সেই ‘আহো ভাতিজা আহো’ কিংবা ‘পুত কইরা দিমু’ জাতীয় সংলাপগুলোর কারণে। নায়ক হওয়ার কাঁচা বয়সের ফ্যান্টাসিতে নায়িকা রেসির সাথে স্ক্যান্ডাল ছড়ানো ব্যতীত তার প্রাপ্তি কী?
সিনেমার গান মানে সেখানে নায়ক-নায়িকা থাকবে, অথবা ভিলেনের ডেরায় নাচ আর মদের আসর। কিন্তু হুমায়ূন ফরিদী এই ধারায় পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তিনি বেশিরভাগ সিনেমাতেই নিজের স্কিল প্রদর্শনের জন্য গান রাখতেন, যেটা এমনকি মূল গানগুলোর চাইতেও জনপ্রিয়তা পেতো। ‘তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া’, ‘তোমরা কাউকে বলো না, কাউকে বলো না, এই তো প্রথম একটি মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে, পাগল করেছে, আমায় জাদু করেছে’ গানগুলো শুনলে বোঝাও যায় না এগুলো ভিলেনের লিপে দেয়া গান।
একই ধারা অনুসরণ করেছে ডিপজলও। তবে তার গানগুলো শুনতে হিউমারসেন্সের সর্বোচ্চ পরীক্ষা দিতে হয়। ‘খাইছে আমায় খাইছে রে, মদের নেশা পাইছে রে’, ‘বিষু দেওয়ান যা-ই কয়, এই শহরে তাই হয়, তেরো পাণ্ডা এক গুণ্ডা করবে সারা দেশটা জয়’, ‘কী বাত্তি লাগাইলি ওরে ও মাইনকা, কী আগুন জ্বালাইলি ওরে ও মাইনকা, হায় হায় কইজা আমার টানাটানি রে, থামাইয়া দে না আমার চুলকানি রে’, ‘বিছনাপাতি বিছাইয়া রঙের বাত্তি জ্বালাইয়া, শুটিং করুম তোর লগে মাইয়া’- এগুলো শুনলেই অনুমান করা যায় এগুলো ডিপজলের গান।
সালমান শাহ এর ঠোঁটের অধিকাংশ গানের গায়ক আগুন, অনুরূপভাবে ডিপজলের প্রায় সবগুলো গানেই আগুনের কণ্ঠ। এতে গায়ক আগুন নিন্দিত হলেও ডার্ক হিউমার গ্রাউন্ডে আমি নিন্দা-প্রশংসা কোনোটাই করবো না। জীবনের আলোকোজ্জ্বল দিকগুলো নিয়েই সময় পার করলাম, কাউকে ‘চুতমারানীর মেজো কাকা’ ডাকতে পারলাম না তাহলে কোথায় যেন অসম্পূর্ণতা লাগে। ‘হাইফেন’ নামে একটা বিকল্প আইডি খুলেছিলাম কেবলমাত্র ডার্ক হিউমারের অদম্য ইচ্ছায়। বলা যায়, হিমালয়ের চাইতেও হাইফেন নিকে লিখে বেশি হিউমার চর্চা করেছি জীবনে। আলো যতো বড়ো হয়, তাকে ঢাকতে এর চাইতেও বড়ো অন্ধকারের প্রয়োজন।
বাংলা সিনেমার দর্শক তাকে কোন্ কারণে মনে রাখবে; আদৌ কি মনে রাখবে? ভিলেন বললে মানুষ হুমায়ূন ফরিদী আর এটিএম শামসুজ্জামানের নাম বলে, কেন ডিপজল বা মিশা সওদাগরের কথা বলে না?
সিনেমার বাইরেও ডিপজলের ডায়ালগগুলো উপভোগ করি। যেমন, নাটকের লোকজন সিনেমা বানালে সেগুলো সম্বন্ধে তার পর্যবেক্ষণ বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে। তার কথা হলো, ওইগুলা ব্যবসা করছে এইগুলা তো সাংবাদিকরা লিখছে, কিন্তু যার টাকা গ্যাছে সেই প্রযোজক কত টাকা ফেরত পাইছে সেই হিসাব তো দেয় না কেউ। কিংবা জায়েদ খানকে চলচ্চিত্র সমিতির নেতা হিসেবে আলোচনার যোগ্যই মনে না করে টিভি অনুষ্ঠানে বলে দেয়, জায়েদের বয়স হয় নাই।
ডিপজলকে নিয়ে ছেলেবেলায় কমন যে দুষ্টুমিটা করতাম তা হলো ডিপজলের পরিবর্তে বলতাম ডিপকল। গভীর নলকূপকে ডিপকল বলা হয়। বাগধারাসূত্রে গভীর জলের মাছ শব্দবন্ধটার সাথেও পরিচিত ছিলাম। সেকারণে, ডিপজলকে দেখলে বেশিরভাগ সময়ই চিতল মাছের ইমেজ মাথায় আসতো; এখনো সেই ইমেজ বিচ্যুত হয়নি বলা চলে। চিতল মাছের পেটি, রাঁধে কাজের বেটি’। এমনকি আমার নামহীন বইতেও ডিপজলকে নিয়ে আলোচনা আছে, যার শেষ কথা হলো- সময়ের আরেক নাম ডিপজল। সময় কী, সময় দেখতে কেমন এসব গভীর দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর আসে নির্দোষ হিউমারে- সময় মানে ডিপজল! সময়ে বাঁচি, সময়ে আগাই, সময়ে পিছাই মানে তাহলে ডিপজলে আবর্তিত হই? এ আবার কেমনতর ডিপজল!
পুত কইরা দিমু আমি, পুত কইরা দিমু
পুত কইরা দিলে তোরা ধ্বংস হইয়া যাবি
কব্বরে গিয়া কোর্মা পোলাও রাইন্ধা খাবি…….