নটরডেম কলেজকে টার্মিনাল বলার বৃহৎ অথচ ভীষণ ব্যক্তিগত একটি কারণ রয়েছে। জীবনের প্রথম ১৭ বছর আমি হিমেল নামে পরিচিত ছিলাম, সেখান থেকে হিমালয় অধ্যায়ের সূচনা নটরডেম কলেজে এসেই। এখন ৩২ বছর বয়সে ফেলে আসা জীবনকে রিভিউ করতে গেলে স্পষ্ট দুটো ধারা পাই। বিভাজন রেখাটিই নটরডেম কলেজ বরাবরে এসে বিযুক্ত করেছে জীবনদর্শনকে।
নটরডেমে না পড়ে ঢাকার যে কোনো কলেজে পড়লেই কি একই পরিণতি বরণ করতে হতো?
নটরডেম নামটাতে প্রথম গুরুত্বারোপ করি তৌফিক জোয়ার্দার নামের এক বিতার্কিকের সৌজন্যে। বিটিভিতে বিতর্ক অনুষ্ঠান দেখতাম নিয়মিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাহমুদ বিন আলম এবং নটরডেম কলেজের তৌফিক জোয়ার্দার, এই দুজন প্রায় প্রতিটি বিতর্কতেই শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত হতো। তখন যেহেতু নির্বিচারে মানুষের ইন্টারভিউ নিতাম, সেই তালিকায় তৌফিক জোয়ার্দারকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রবল ইচ্ছা থেকেই নটরডেম নামটা নিনাদ সৃষ্টি করেছিলো বলা যায়।
তবে নটরডেম কলেজের নাম আরো আগে থেকেই জানতাম আমাদের এলাকার জিয়া আনসারী ভাইয়ের কল্যাণে। বয়সে সে আমার চাইতে ৮ বছরের বড়ো, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব ছিলো তুমুল পর্যায়ের। নটরডেম কলেজের গ্রুপ সেভেনে পড়তো সে, ইন্টার পরীক্ষা চলাকালে অর্বাচীনের মতো এক কাজ করে বসে, যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে সে কঠিন সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। সিজোফ্রেনিকদের আমাদের সমাজে পাগল আখ্যায়িত করা হয়; আমার বয়স বা পক্বতা এমন কিছু ছিলো না যার কারণে সিজোফ্রেনিয়ার মতো জটিল রোগ সম্বন্ধে বুঝতে পারবো। তবে পাগল, ভ্যানওয়ালা, চাওয়ালা, রিকশাওয়ালা প্রভৃতি শ্রেণির সাথে সহজাতভাবেই আমার জমে যায়/যেত। ফলে বন্ধু বা আত্মীয়রা জিয়া ভাইকে এড়িয়ে চললেও আমি তার নিবিড় সাহচর্য উপভোগ করতাম, আমার কল্পনাশক্তির বিকাশে তার সাথে কাটানো অগণন মুহূর্তগুলোর সুবিশাল প্রভাব রয়েছে।
মূলত জিয়া ভাইয়ের কাছেই গ্রুপ সেভেন, পরিসংখ্যান আর নটরডেম এর রোলনম্বর দেয়ার নিয়মটা সম্বন্ধে জানি। সবচাইতে ইন্টারেস্টিং লাগে স্যারদের এটেনডেন্স দেয়ার পেছনে সময় নষ্ট করতে হয় না, প্রত্যেকের সিট নির্দিষ্ট, যে কারণে কোন সিট খালি কেবলমাত্র সেটা দেখে নিলেই চলে। ৩ সপ্তাহ পরপর সিট পরিবর্তন হয়। এডেনডেন্স ব্যাপারটাকে বিরক্ত লাগতো স্কুল জীবনেই; এর পেছনেই ৫-১০ মিনিট চলে যায়। এর চাইতেও মজা পেয়েছিলাম ‘জেল ক্লাস’ এর গল্প শুনে। এটেনডেন্সের পরিমাণ কমে গেলে কিংবা ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করলে তাকে জেল ক্লাস করতে হয়। প্রথমে অবশ্য ভেবেছিলাম, কলেজের ভেতরেই জেল আছে।
কিন্তু জিয়া ভাই যেহেতু নটরডেমের ছাত্র থাকাকালেই সিজোফ্রেনিক হয়ে পড়েছিলো, ওই কলেজে পড়ার ব্যাপারে তখনো খুব বেশি কনভিন্সড ছিলাম না। বরং মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ বেশ বড়োসড়ো, কলেজের সামনের মাঠে প্রচুর ক্রিকেট খেলতাম, ঢাকায় গেলে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে যাবে, এটা ভেবে বিষন্ন হতাম কিছুটা। কিন্তু তৌফিক জোয়ার্দারকে টিভিতে দেখার পর সংকল্প নিই নটরডেমেই পড়বো ।
স্কুল পাশ পর্যন্ত আমার এক্টিভিটিকে ডায়নামিক বলা যায়। লেখালিখি, ইন্টারভিউ নেয়া, ক্রিকেট খেলা, উদ্যোগ নেয়ার মধ্যেই সময় ব্যয়িত হয়েছে বেশি। পড়তাম যতক্ষণ, চেয়ারের সাথে নিজেকে বেঁধে নিতাম। এক্সট্রিমিস্ট বা প্রচণ্ড ডমিনেটিং এটাই আমার জন্য উপযুক্ততম শব্দ হতে পারে। সিনিয়র, সমবয়সী বা জুনিয়র, যাদের সাথেই কাজ করি সেখানে আমিই সর্বেসর্বা থাকতাম, ফলে নিজের মধ্যে নকল আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়, ভঙ্গুর কিন্তু ভয়ঙ্কর রকম কমফোর্ট জোন তৈরি হয়। আপাদমস্তক এক কূপমণ্ডুক হিসেবে বেড়ে উঠি।
জিয়া ভাইয়ের মুখে আরেকটা যে গল্প শুনি, নটরডেমে সবকিছু ক্লাসেই পড়ানো হয়, কোনো প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন পড়ে না। এই ব্যাপারটা অবাক করে আমায়। ক্লাস ফোর থেকে প্রাইভেট পড়ি, বড়ো ভাই যারা কলেজে পড়তো তাদেরও দেখতাম প্রাইভেট পড়ার পেছনে প্রচুর সময় খরচ করাতে; দীর্ঘদিন পর্যন্ত ধারণা ছিলো প্রাইভেট পড়া স্কুল বা কলেজে ভর্তির অন্যতম শর্ত। নটরডেমে যেহেতু এটা নেই, তার মানে এখানে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা হবে।
আমাদের ওরিয়েন্টেশনের দিনও ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা একই কথা বলায় আমার বিশ্বাস জোরালো হয় প্রাইভেট আসলেই পড়তে হয় না। প্রায় দেড় মাস পর্যন্ত এই বিশ্বাস অটুট ছিলো আমার। কিন্তু ক্লাসের পড়া বলতে গেলে কিছুই বুঝতাম না, স্যাররাও ১টা, ২টা সমস্যা সমাধান করে দেয় ফিজিক্স বা ম্যাথের, বাকিগুলো বলে নিজে করে নিয়ো। ওদিকে কুইজ পরীক্ষায় আসে অন্য প্রশ্ন। আশপাশের ছেলেদের দেখতাম সবকিছু পারে, আমি কিছুই পারি না; বাধ্য হয়ে সব বিষয়ের গাইড কিনে নিই, গাইড দেখে সমাধানগুলো করার চেষ্টা করতাম। বেশিরভাগই বুঝতাম না, কিন্তু বারবার চর্চার কারণে মুখস্থের মতো হয়ে যেতো।
দেড় মাস পরে একজনের মুখে শুনি সে জওহরলাল স্যারের কাছে ম্যাথ প্রাইভেট পড়ে; এটা শুনে অবিশ্বাসের ধাক্কা খাই। তাকে সরাসরি বলে বসি- নটরডেমে না প্রাইভেট পড়তে হয় না, তুমি পড়ো কীভাবে? আমার নির্বুদ্ধিতায় সে খুবই মজা পেয়েছিলো, তার উত্তর ছিলো- আরে বোকা, ২-১ জন এক্সট্রা অর্ডিনারি জিনিয়াস ছাড়া এই কলেজে কয়টা স্টুডেন্ট আছে যারা কোনো প্রাইভেট পড়ে না? একটা কথার কথাকে কেউ সিরিয়াসলি নেয় নাকি! তার ৩-৪ মাস পরে প্রাইভেট পড়তে গিয়েছিলাম, কিন্তু ১ মাস পরই আলসেমি পেয়ে বসে, প্রাইভেট পড়া অধ্যায়েরও সমাপ্তি। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে ২ মাস প্রাইভেট পড়েছিলাম এবং ইন্টারের আগে ম্যাথের মডেল টেস্ট দিয়েছিলাম ৫টা, সেটাও সম্পন্ন করা হয়নি।
আমাদের স্কুলিং সিস্টেমে পরিবর্তনগুলো খুবই উচ্চমাত্রার, যে কারণে হাবুডুবু খাওয়া দশা হয়। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠলে সিলেবাসে বিশাল পরিবর্তন, এর সাথে কোনো পূর্বসূত্র থাকে না। এইট থেকে নাইনে উঠলে জগত বদলে যাওয়ার মতো অবস্থা। এসএসসির পর কলেজে উঠলে দীঘি থেকে সমুদ্রে পড়ার দশা হয়। ক্যালকুলাসের কোনো নামগন্ধও শুনিনি এসেএসিতে, কিন্তু নটরডেমে আমাদের প্রথম বা দ্বিতীয় ক্লাসেই ক্যালকুলাস শুরু করা হয়। কিংবা স্লোপ কী জিনিস, স্থানাংক কী এইসব প্রশ্ন মাথায় এসেছে, উত্তর পাইনি। ক্যালকুলাসে যখন লিমিট বোঝাতো আমার মাথায় প্রথমেই যেটা আঘাত করতো, সাইন কেন কজ হয়ে যাবে। কারিকুলাম ডিজাইনের এই অমার্জনীয় ত্রুটির দায় কি পলিসি মেকাররা এড়াতে পারবেন? কোনো ক্রোনোলজি কেন নেই? আপনি তো দীঘি থেকে সমুদ্রে ফেলতেই পারেন, কিন্তু যাকে ফেলছেন তার কী দশা হবে ভেবেছেন?
নটরডেমে আমি প্রথম সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। প্রথম ১৬ বছরে যখন যা করতে চেয়েছি করে ফেলেছি, অনুসারীর অভাব হয়নি। কিন্তু নটরডেমে আমি স্রেফ যদু-মধু টাইপের একজন ছিলাম। ঢাকার ছেলেরা এতো বেশি ঠাঁট-বাট আর জ্ঞানে এগিয়ে ছিলো সেখানে নিজের পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে উঠেছিলো। স্কুলে উদ্যোগ নিয়ে মানুষকে ইমপ্রেস করে ফেলতাম, কিন্তু এখানে আমার নিজের নেয়ার মতো কোনো উদ্যোগ বাকি ছিলো না। একগাদা ক্লাব, যা করতে চাই সেই ক্লাবের অধীনে করে ফেললেই তো হয়। সাইন্স ক্লাব, ডিবেট ক্লাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, চেস ক্লাব, ন্যাচার স্টাডি ক্লাব অনেকদিন ধরেই চলছে, কোনো একটাতে ঢুকে পড়লেই হয়। ২-১দিন ক্লাবগুলোর কার্যক্রমে উপস্থিত হই, কিন্তু সেখানে সিনিয়ররা দায়িত্বে, স্যাররা মডারেটর, প্লাটফরম তৈরি। রেডিমেড জিনিসের প্রতি বিকর্ষণ করি এটা যেমন সত্যি, অনুরূপভাবে আমি যে ওসব ক্লাবে বিশেষ পাত্তা পাইনি এটাও মিথ্যা নয়।
ক্লাস টু থেকে লেখালিখি শুরু করলেও প্রকাশিত লেখা অনেক দেরিতে। আমার লেখাগুলো প্রধানত ডায়েরি আর খাতায় জমিয়ে রাখতাম; সেগুলোর পাঠক ছোটভাই রুমেল, বন্ধু সুমন-আসিফ আরেফিন প্রমুখ। নটরডেমে এসে ব্লু এন্ড গোল্ড ম্যাগাজিনের নাম জানতে পারি। সেখানেই জীবনের প্রথম লেখা প্রকাশিত হতে দেখি। আমার চিন্তাধারা কখন কতটা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এটা বোঝার জন্য ইংরেজি আর্টিকেলটার শিরোনামটাই যথেষ্ট হবে- Life Mocks towards life! লেখার সময় ভাবি না জানি কত হৈ হুল্লোড় পড়ে যাবে, কিন্তু ম্যাগাজিন প্রকাশিত হওয়ার পর অন্যদের লেখা পড়ে বুঝতে পারি আমি একজন বালের লেখক; বিগত ১০ বছরে যতটুকু লিখেছি তার চাইতে ভনিতা করেছি অনেক বেশি, লেখক সাজার ভনিতা, আদতে আমি একটা নিম্নমানের চুতমারানি। এই উপলব্ধি আমার মধ্যে হীনম্মন্যতা বোধ বাড়াতে থাকে। মানুষের জীবনযাপন, আচরণ, দর্শন সবকিছুকেই মেকি আর মিনিংলেস মনে হতে থাকে। বাউলিয়ানা আরো প্রগাঢ় হতে আরম্ভ করে।
বাউলিয়ানার সূচনা অবশ্য কলেজে ক্লাস শুরুর কিছুদিন পর থেকেই। যেহেতু কোনো ক্লাবে যুক্ত হইনি, প্রাইভেট পড়তাম না, খুব বেশি বন্ধু-বান্ধবও ছিলো না, এবং ক্লাস সকাল আটটায় শুরু হয়ে ১টার মধ্যে শেষ হয়ে যেত; ফলে আমার হাতে অফুরন্ত অলস সময় থাকতো। সেই অবিশ্রান্ত সময়কে কীভাবে খরচ করা যায় সেই ভাবনা থেকে দুটো কাজ শুরু করি:
এক, প্রতিদিন নিয়ম করে ডায়েরি লিখতে থাকি। অনেকটা নিজেকে প্রশ্ন করা, নিজের ভুলত্রুটির জন্য নিজেকে প্রচণ্ড অপদস্থ করা আর দোষী সাব্যস্ত করা এবং উত্তরণের জন্য সমাধান খোঁজা। কে সমাধান দেবে জানি না, কিন্তু ডায়েরির পৃষ্ঠা ভরতি হতে থাকে গোঁজামিলযুক্ত ভাবনায়। তথাকথিত বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ভিন্ন এক জগতের সাথে পরিচয় ঘটে দ্রুতই। হয়তোবা কারো সাথে বাস্তবে কথা বলে সুবিধা হচ্ছে না, কল্পনায় তার সাথে আড্ডা মারছি।
দুই, পড়ার টেবিলে বসে অলটারনেটিভ রিয়েলিটিতে কানেক্টেড হয়ে যাওয়া। এবসেন্ট মাইন্ড প্রবণতা তীব্রতর হয় এই সময়টাতে। কলেজের বাইরে প্রায় সমস্ত সময় চেয়ার-টেবিলে বসে থাকতাম, মানুষের ধারণা জন্মে বইয়ের বাইরে আমার কোনো জগত নেই, পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বুঝি না। অথচ ১১ ঘণ্টা টেবিলে বসে থেকে ১১টি লাইনও পড়া হয়নি।
দিনের পর দিন এভাবে একনাগাড়ে বসে থাকার দরুণ মানুষ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ, জীবনভাবনা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, গভীরভাবে উপলব্ধি করি আমার হিমেলসত্তা মৃত্যুবরণ করেছে, একাডেমিক পড়াশোনার প্রতি ফ্যাসিনেশন পুরোপুরি হারিয়ে ফেলি, এবং অদ্ভুত এক ডিল করে ফেলি নিজের সাথে। বাকি জীবনে নিজের জন্য মাত্র ২ বার সৃষ্টিকর্তার কৃপা চাইবো- ইন্টারে জিপিএ ফাইভ পাওয়া, এবং যে কোনো সাবজেক্ট হলেও বুয়েটে চান্স পাওয়া।
বাকি জীবনে যখন যা-ই ঘটুক, আর কৃপা চাইবো না, এবং কখনোই যেন জীবিকার পেছনে ছুটতে না হয় সেই সাহসিকতাটুকু চাই। ১৫ বছর আগে করা ডিল এখনো দৈববাণীর মতো মেনে চলছি; এর মধ্যে বহুবার ভয়ানক বিপদের মুখে পড়েছি, কিন্তু কৃপা চাইনি, কারণ সেই লিমিট অনেকদিন আগেই ফুরিয়ে ফেলেছি।
বুয়েটে ভর্তি হতে চাওয়ার পেছনে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা কাজ করেনি। যেহেতু ১০ বছর বয়স থেকেই মানুষের সাক্ষাৎকার নিই, এবং নটরডেমে এসে বুঝতে পারি আমি মিডিওকর, এই ঘাটতি পূরণের একমাত্র উপায় মনে হয় প্রচুরসংখ্যক মেধাবী মানুষের সংস্পর্শে থেকে নিজের লেভেল আপগ্রেড করবো। মেধার ঘনত্ব সবচাইতে বেশি বুয়েট আর মেডিকেলে, যেহেতু আমরা সামাজিকভাবে যাদের মেধাবী হিসেবে চিনি তাদের বৃহত্তর অংশই ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিকেলে ভর্তি হয়।
কিন্তু মেডিকেলে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ অনেকদিন আগেই রহিত করে রেখেছিলাম। স্কুলে পড়াকালে বায়োলজি পড়তে লজ্জা বোধ করতাম, শরীরবৃত্তিক আলোচনা থাকায় সেগুলো পড়তে অস্বস্তি হতো। সেটা চরম আকার ধারণ করে এক পর্যায়ে, তবু সেটা বায়োলজি বাদ দেয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী কারণ ছিলো না। কিন্তু জিয়া ভাইয়ের মুখে গ্রুপ সেভেনের গল্প শুনতে শুনতে নিজেকে অনেক আগে থেকেই গ্রুভ সেভেনে কল্পনা করে ফেলি। ৭ সংখ্যাটার প্রতি শৈশব থেকেই ফ্যাসিনেশন কাজ করে। ইংরেজি সেভেন সংখ্যার আকৃতিটাও ইন্টারেস্টিং লাগতো, একারণে নামের শেষে সবসময়ই 777 কোডটা ব্যবহার করতাম। এটা ৭৭৭ নয়, ট্রিপল সেভেন, মানে তিনটি আলাদা সেভেন যার প্রতিটির আলাদা গল্প আছে, (এমনকি পরিণত বয়সে এখন যখন নিজের রিসার্স ফার্ম খুলেছি মানুষ বিষয়ক সেটারও নাম রেখেছি Humanlab777)। তাই জিয়া ভাই যখন গ্রুপ সেভেনের কথা বলে আমি অন্য কোনো গ্রুপের কথা চিন্তাই করতে পারিনি।
কিন্তু আমার সংকল্পে জল ঢেলে দেয় জিয়া ভাই স্বয়ং যখন জানতে পারি কে কোন্ গ্রুপে পড়বে এটা নিজে সিলেক্ট করার সুযোগ থাকে না, কলেজ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এটা শোনার পর নটরডেমে পড়ার উৎসাহ আবারো কমে যেতে থাকে, তৌফিক জোয়ার্দারের ইন্টারভিউ নেয়াটাও দূরতম কল্পনা মনে হতে থাকে। তবে অলৌকিকভাবে উৎসাহ পুনরুদ্ধার হয় জিয়া ভাইয়ের পরের কথায়- কেউ যদি স্ট্যাটিসটিক্স নেয় সে অটোমেটিকালি গ্রুপ সেভেনে চলে যায়। আমাকে গ্রুপ সেভেনেই ঢুকতে হবে, স্ট্যাটিসটিক্সই ফাইনাল। তাতে বায়োলজি বাদ দিতে হবে, মেডিকেলে পরীক্ষাই দিতে পারবো না, আম্মু অনেক কষ্ট পাবে। ধুরো, মেডিকেলে না পড়লে কী হবে, কিন্তু পড়লে গ্রুপ সেভেনেই পড়বো, এই সংকল্প থেকে ইন্টারে উঠামাত্র বায়োলজি বাদ দিয়ে দিই, এবং কাঙ্ক্ষিত গ্রুপ সেভেনেই ঠাঁই হয়। স্টুডেন্ট নম্বর ১০৫৭১২৯; খুবই ইন্টারেস্টিং লাগে রোল নম্বরের ব্যাখ্যা- ১ মানে সাইন্স, ০৫ ইন্টারের সাল, ৭ গ্রুপ নম্বর, ১২৯ রোল নং। এরকম ইউনিকনেসের মধ্যে আরো আরাম বোধ করি ক্লাস রুম দেখে। আমাদের ক্লাস হতো ৩১৭ নম্বর রুমে; এটা একটা প্রাইম নাম্বার।
কিন্তু নিজের রোল নম্বরে সন্তুষ্ট হতে পারিনি, শাহরিয়ার রউফ নাফি নামে এক ম্যাথ জিনিয়াসের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরির পর রোল নম্বরকে আরো বোরিং মনে হয়। নাফির রোল নম্বর ১২৭, সে জানায় এই নম্বরটা খুবই ইন্টারেস্টিং; প্রথমত এটা একটা প্রাইম, দ্বিতীয় ১২৭ এমন এক নাম্বার যাকে এর ডিজিটগুলো দিয়েই পুনর্নিমাণ করা যায়, অর্থাৎ 2^7-1=127; পক্ষান্তরে ১২৯ হলো ৩ আর ৪৩ এর গুণিতক, দুটো প্রাইমের গুণফলের বাইরে কিছুই নয়।
ক্লাস শুরুর পরে দেখি কুইজ পরীক্ষায় ২ ধরনের প্রশ্ন হয়; গ্রুপ ১,২,৩,৭ এক দিকে, ৪,৫,৬.৮ আরেকদিকে। শোনা যেতো, এই ৪টা গ্রুপে বেশি মেধাবী ছাত্রদের দেয়া হয়, বাকি ৪টাতে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের, ওই গ্রুপগুলো থেকে স্ট্যান্ড করার সংখ্যাও বেশি থাকতো। এই কথাটাকে আমার আজগুবি মনে হতো।
ক্লাস শুরুর পরে জিয়া ভাইকে মনে পড়ে। গ্রুপ সেভেনের আসলে বিশেষত্ব কী, অন্য গ্রুপের সাথে পার্থক্যই বা কী; সে এই গ্রুপে পড়েছে বলে এখানকার গুণকীর্তন করেছে মাত্র, নাথিং স্পেশাল। ক্লাসে বিশেষ মন নেই, কিন্তু রিতা জোসেফিন নামের এক ম্যাডামের ক্লাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। তিনি ইংরেজি ক্লাস নিতেন। তার ক্লাস নেয়ার ধরনে বা তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ছিলাম এমন নয় মোটেই, ম্যাডাম পড়া ধরতেন নিজের এক ইউনিক স্টাইলে। পড়াতে পড়াতে হঠাৎ ডাকতেন রোল নং ২৯ তুমি বলো তো, কিংবা রোল ৮৬। তিনি কী পড়াচ্ছেন কিছুই মনে প্রবেশ করতো না, কিন্তু কোন্ রোল নং ডাকতে পারেন সেটা প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করতাম। বিজোড় রোল নংই ডাকতেন বেশি, তবু কোনোদিনই প্রেডিকশন মিলতো না। এটা আমাকে আরো বেশি উজ্জীবিত করতো, ম্যাডাম ক্লাসে ঢোকামাত্রই প্রেডিকশন শুরু হয়ে যেতো।
নটরডেমই বোধহয় একমাত্র কলেজ যারা ফুলস্কেপ কাগজ ব্যবহার করতো সকল ধরনের কাজে। ডিমাই কাগজে লিখে অভ্যস্ত সব জায়গায়, ফুলস্কেপ বিরক্তিকর; তবু তারা ফুলস্কেপপ্রীতি থেকে সরেনি। সেখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা যতজন ছিলেন প্রায় প্রত্যেকেই বিরাট এটিচুডের অধিকারী ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানের ডি.কে স্যার (তার পূর্ণ নাম তখনো জানতাম না আজো জানি না, অথচ এই স্যারের শ্বশুরবাড়ি মানিকগঞ্জে। তার শ্বশুর আমার স্কুলের অত্যন্ত পছন্দের একজন শিক্ষক প্রয়াত সুরেশ রায়) এবং ম্যাথের স্ট্যানলি পিউস (তার আচরণ রোবটের মতো। ম্যাথ প্র্যাক্টিকালগুলোতে অকারণে রিপিট দিতেন প্রচুর)- এই দুজন ব্যতীত কোনো শিক্ষকের আচরণেই অসন্তুষ্টি ছিলো না, কিন্তু ওখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের গালিগালাজ করতে ইচ্ছে হতো। বেতন দিতে গেলে তাদের স্যার ডাকলে খুশি হতো, মাঝেমধ্যে ধমকও দিতো। প্রথম সাময়িক পরীক্ষার প্রোগ্রেস রিপোর্ট অভিভাবকের হাতেই দিবে, কোনোভাবেই ছাত্রের হাতে দিবে না। একটা প্রোগ্রেস রিপোর্ট আনার জন্য মানিকগঞ্জ থেকে আম্মুকে আসতে হবে এটা ভেবে আরো বিরক্তি বেড়েছিলো।
সিদ্ধান্ত নিই প্রোগ্রেস রিপোর্টই তুলবো না। কিন্তু ১ মাস পরে আমাকে ডেকে পাঠানো হয় এবং রিপোর্ট না তোলার জন্য যথেষ্ট দুর্ব্যবহারের শিকার হই, এবং হুমকি পাই ১ সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট না তুললে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। বাঁধন নামে সেন্ট জোসেফের এক স্মার্ট ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে ততদিনে। সে ক্লাসে বলতে গেলে আসতোই না, ক্লাস শুরুর ৩য় সপ্তাহ থেকে সেকেন্ড ইয়ারের শেষ পর্যন্ত আমরা একই বেঞ্চে বসে পার করেছি। তার রোল নং ১২২, ব্যান্ড করতো, বিভিন্ন অর্গানাইজিংয়ের সাথে যুক্ত থাকতো, ক্লাসের অন্যতম পরিচিত মুখ। (পরবর্তীতে সে বুয়েটে আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়েছিলো)। আমার দূরবস্থার কাহিনী শুনে সে হেসে বলে, ধুরো ব্যাটা এটা কোনো কাহিনী হলো নাকি, আমার ড্রাইভাররে নিয়ে যাবি, বলবি তোর মামা, প্রোগ্রেস রিপোর্ট দিয়ে দিবে; তোর কি ধারণা পোলাপান গার্ডিয়ান নিয়ে আসে কলেজে?। সত্যিই তার ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে যাই, এবং বিনাক্লেশে প্রোগ্রেস রিপোর্ট তুলি। এতে ক্ষিপ্ততার পরিমাণ আরো বাড়ে। রাস্তা থেকে একজনকে ধরে আনলেই যদি রিপোর্ট পাওয়া যায়, এই ঢঙের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তাহলে!
ল্যাব ব্রাদারদের আচরণেও সন্তোষের পরিমাণ কমই ছিলো বলবো। প্রথমদিকে ভাবতাম তারাও বোধহয় শিক্ষকস্থানীয়, পরে নাফি-বাঁধনদের মুখে জানি এরা আমাদের চাইতে বড়োজোর ২ বছরের সিনিয়র, ইন্টার পাশ করে ভার্সিটিতে ভর্তির অপেক্ষায় আছে বা ভর্তি হয়েছে। যেহেতু ল্যাবে কিছুই পারতাম না, ল্যাব ব্রাদারদের দ্বারস্থ হতাম, এবং কিছুদিনের মধ্যেই দুর্বল স্টুডেন্ট হিসেবে ল্যাব ব্রাদারদের নজরে পড়ে যাই। ফলে তারা খুব বেশি গুরুত্ব দিতো না। যেসব প্র্যাক্টিকাল গ্রুপে করতে হতো সেখানে আমাকে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতো, গ্রুপের কেউ আমাকে কিছুতে ইনভলভ করলে তারা বলতো- আরে এই ছেলে খুবই স্লো, ওকে দিলে রিপিট খাইতে পারো। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ল্যাবগুলো গুরুত্ব হারায় আমার কাছে। তখন ল্যাব ব্রাদারদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। খাতা সাইন করছে কিছুই না দেখে, ছেলে-পেলে ব্যাক ক্যালকুলেশন করে ডাটা বসিয়ে দিচ্ছে , কিংবা কেমিস্ট্রিতে লবণ মেলানোর সময় আগে থেকেই জেনে যাচ্ছে কী লবণ, তবুও লাইন ধরে খাতা জমা দেয়াটা তো হাস্যকর ব্যাপার। এই খাতা সাইন করলেই বা কী! পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকদিন নিজেই উল্টাপাল্টা সাইন দিয়ে তারিখ বসিয়ে দিই খাতায়, লাইন ধরে আর জমা দিই না। এবং অবাক হয়ে দেখি নিজের সাইন করাও রিপোর্টগুলোও একসেপ্টেড হচ্ছে। মানে খাতায় তারিখসহ সাইন থাকাই যথেষ্ট হছে উঠছে, কে সাইন করলো তা মূখ্য নয় মোটেও।
যেহেতু জীবিকার চিন্তা নেই, জীবনের কৃপাও বাকি আছে ৩টামাত্র, আমার মধ্যে অপরিমেয় রিল্যাক্স ভাব ভর করেছিলো। ক্যান্টিনে বসে ক্রমাগত চা খেতাম। সারা দেশের যেখানে যাই সেখানকার ২টা জিনিস খাওয়ার চেষ্টা করি- চা এবং ডাব। আমাদের কলেজজীবনে বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গাতেই প্রতি কাপ চায়ের দাম ছিলো ২টাকা মাত্র, সেই সময়েও কলেজ ক্যান্টিনের চায়ের দাম ছিলো ৫টাকা। আমার কাজ থাকতো এক কোণে বসে চা খাওয়া আর টেবিল টেনিস খেলারত ছেলেদের খেলা দেখতে দেখতে অলটারনেটিভ রিয়েলিটিতে ঢোকার চেষ্টা করা।
ক্লাস বাং দেয়ার মতো পর্যাপ্ত সাহস ছিলোই না বলতে গেলে। সিট যেহেতু নির্দিষ্ট, অনেক ছেলেই আরেক বন্ধুর প্রক্সি দিয়ে দিতো। যেমন, যার রোল ১৩৫ সে গিয়ে ১৪৪ এর সিটে বসে থাকতো, তাতে হয়তোবা সে এবসেন্ট হয়ে যেতো, কিন্তু পরে আবার ১৪৪ কোনো ক্লাসে তার প্রক্সি দিয়ে দিতো। এভাবে ভাগে-যোগে বাং মারার সুযোগ ছিলো। কিন্তু আমার সেই পরিমাণ সাহস ছিলো না, অন্যদিকে ক্লাসেও মন নেই। সময় কাটানোর উপায় হিসেবে ট্রাভেল চেস বোর্ড কিনে নিই। বেঞ্চগুলো যথেষ্ট উচা হওয়ায় বসার বেঞ্চে ছোট্ট দাবা বোর্ড বসালে স্যারদের পক্ষে অত দূর থেকে বোঝা সম্ভব হতো না পাশাপাশি বসে দুটো ছেলে মাথা নিচু করে দাবার চাল দিচ্ছে আর তার কথা শুনছে। নিয়মটা ছিলো কেউ দাবার দিকে তাকাবে না, নিজের চাল দিয়ে স্যারের দিকে তাকাবে, তার কিছুক্ষণ পরে আরেকজন চাল দিয়ে স্যারের দিকে তাকাবে।
কলেজ লাইফে যেরকম বাউলিয়ানা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একাডেমিক পড়াশোনার প্রতি সকল প্রকার আসক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম, কুইজ পরীক্ষাগুলো না থাকলে হয়তোবা ইন্টার পাশ করাটাই সম্ভব হতো না আমার পক্ষে। নটরডেমের গেট দিয়ে ঢোকার পরই কোত্থেকে যেন সঞ্জিবনী হাওয়া চলে আসতো। বহু মেধাবী ছেলে যেমন দেখেছি, তেমনি উশৃংখল, দুষ্টু, চিকনবুদ্ধি সম্পন্ন ছেলেও দেখা হয়েছে প্রচুর। কলেজে অবস্থানকাল দেড় বছরের কিছু বেশি, কিন্তু এইটুকু সময়ে কৈশোরোত্তীর্ণ একজন মানুষকে ট্র্যাকে রাখতে যেরকম প্রসেস এবং সিস্টেম ডিজাইন করা দরকার নটরডেম সেই পয়েন্টে অনেকটাই নিখুঁত বলবো।
কলেজ লাইফে যে পলিসিটা সবচাইতে বিষন্ন করতো, পরবর্তী জীবনে সেটাই হয়েছে আমার শিখন স্টাইল। বিদ্যুৎ ভদ্র স্যারকে মনে পড়ে। তিনি ম্যাথ পড়াতেন আমাদের। তিনি ২,৩টি ম্যাথ এর অর্ধেক করিয়ে বলে দিতেন বাকি প্রবলেমগুলোর কোনটার সাথে কোনটা মিলযুক্ত এবং একটা কথা সবসময়ই বলতেন ‘এসো নিজে করি বলে একা একা করে নিতে হবে’। আমি যখন প্রশিক্ষণ দিই বা কারো সাথে আলাপ করি কখনো তাকে কিছু শেখানোর চেষ্টা করি না, বরং তার মধ্যে যা আছে সেটাই তাকে দিয়ে আবিষ্কার করিয়ে নিতে চেষ্টা করি। আমি বুঝতে পেরেছি চামচ দিয়ে খাবার মুখে তুলে দিলে একজন মানুষকে পঙ্গু বানিয়ে দেয়া হয়, বরং চামচের ব্যবহার শেখালে এবং স্বাদ সম্বন্ধে ধারণা দিলে সে নিজেই বিভিন্ন স্বাদের খাবার পছন্দমাফিক পরিমাণে খেতে পারবে। এই শিক্ষাটা কখনোই পাওয়া হতো না যদি ক্লাসের সময়গুলো অমনোযোগী না হতাম এবং প্রশ্ন উঠতো- স্যার এমন কেন?
কলেজে কিছু ছেলের সাথে মা আসতো, বহু ছেলে মেসে থাকতো, ক্লাসে বসে অনেকেই চটি বই পড়তো, ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস হলেও গেটের বাইরে গিয়ে অনেকেই সিগারেট টানতো, আইডি কার্ড প্রদর্শন ব্যতীত কোনো ছাত্রকে কলেজে ঢুকতে দেয়া হতো না- এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও মানুষ পর্যবেক্ষণে এসবের সুতীব্র ইমপ্যাক্ট ছিলো। বিশেষত, কলেজে আমি এক নতুন উদ্যোগে শুরু করি। যাদের দেখলে ইন্টারেস্টিং মনে হতো তাদের একটা ডায়েরি দিয়ে বলতাম সেখানে নিজের সম্পর্কে কমপক্ষে ৫ পৃষ্ঠা লিখতে। প্রকল্পের নাম দিয়েছিলাম ‘আপনভুবন’।
এই উদ্যোগের বদৌলতে সমবয়সী অনেকের ভাবনাই জানা হয়ে যেতো। হিমেল নামেই আরেকজন ছেলে পড়তো গ্রুপ সেভেনে; তাকে লিখতে দিলে সে পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলো, যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছিলো, আমি চাই আমার প্রস্থানের পর আমার অস্তিত্বের সকল চিহ্ন পেন্সিলের লেখার মতোই মুছে যাক। ১৮ বছরের এক তরুণের কাছ থেকে এরকম চিন্তা মোটেই প্রত্যাশিত ছিলো না। তাই আমার ভেতর থেকে হিমেলসত্তা হারিয়ে গেলেও সেই হিমেলকে আজও মনে পড়ে!
নটরডেম কলেজকে টার্মিনাল বলছি কেন? মহাজীবনের অণ্বেষণে মহাকারণের সাথে যুক্ত হওয়ার যে যাত্রা তার শুরু হয়েছিলো নটরডেমের ক্যান্টিনে বসেই। তাই আজও যখন আরামবাগের আশপাশে যাই কিংবা মতিঝিল এলাকা যানযোগে অতিক্রম করি আনমনেই বলে উঠি- ‘এই পথে আমি হিমেল ছিলাম’!
এই পথ চলি একা
রাতের আঁধার সাথী করে
দূরাশার পৃথিবীতে, শূন্য হৃদয় যায় জ্বলে
শুধু তুমি কাছে নেই বলে।।।