বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও পেশায় বায়োপিক এনালিস্ট Mahfuz Siddique Himalay বাবু আমাকে সম্মানিত করেছিলেন, তার আগামী প্রকাশিতব্য বই, ‘চিন্তা এক্সপ্রেস’-এর একজন বিটা রিডার হিসেবে মনোনীত করে। বইটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া তুলে দিলাম এইখানে।
চিন্তা এক্সপ্রেস রিভিউ
স্বর্ণেন্দু সাহা
এই বইটিকে ঠিক কোন জঁ-রে ফেলা উচিত, তা নিয়ে একটু ভাবনা-চিন্তা করতে হবে তাকেই, যে মনোযোগ সহকারে পড়বে। ফিকশনের আদলে নন-ফিকশন জাতীয় এ-রম বই পূর্বে কখনও পড়েছি, এমন কিছু স্মরণ করতে পারছি না। এই বইকে টুকরো আত্মজীবনী বলে অভিহিত করা যাবে কিনা তা-ও মনে হয়।
এটি নির্দিষ্ট কোনও বিষয়মুখী বই নয়। আত্ম-উন্নয়ন জাতীয় বইয়ের মতো সহজ-সরল নির্দেশ দিয়েও পরিপূর্ণ নয়। অথচ ‘চিন্তা এক্সপ্রেসকে অনায়াসে ‘আত্ম-উন্নয়ন’ জাতীয় বইয়ের শ্রেণীতে যোগ করতে আমার আপত্তি নেই। এই বই সমাজের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে প্রথাগত চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে নতুন মাত্রা তুলে ধরেছে, যা হয়ত সকল পাঠক ভাবতে সক্ষম নন। লেখার গদ্য আকর্ষণীয় নয়, বক্তব্য আকর্ষণীয়। অন্তত প্রথম কূড়ি-পাতা কষ্ট করে হলেও লাইন-বাই-লাইন পড়লে এবং উপলব্ধি করতে পারলে, পাঠক বইয়ের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যাবেন, এ প্রায় হলফ করেই বলা যায়। একটানা পড়ে ফেলবার মতো নয় কদাপি। বদহজম ঘটবে। যারা কখনও না কখনও জার্মান দার্শনিক নিটশে-র বই পড়েছেন, তাঁরা আমার কথা বুঝতে পারবেন। এই বই ধীরেসুস্থে অল্প অল্প করে পড়া বাধ্যতামূলক, ভাববার মতো বহু বিষয়ে সমৃদ্ধ যা পড়া শেষ হলেও আপনার সঙ্গী হয়ে থাকবে। একাধিকবার পড়বার উপযুক্ত এই বই। কন্টেন্ট এনরিচড যে-কোনও নন-ফিকশন বইয়ের ক্ষেত্রেই এই বহু-পাঠ জরুরী। আমি নিজেই এই প্রতিক্রিয়া লিখতে বসে বুঝতে পারছি অনেক জায়গা নিখুঁতভাবে মনে করতে পারছি না, অবিলম্বে আবার পড়া দরকার। পড়তে-পড়তেই টের পাবেন, মনোজগতে একটা আলোড়ন উঠছে। এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া একটা জার্নির মতো। কারণ, এগোতে হয় বইতে পাতার পর পাতায় এসে হাজির হওয়া বক্তব্য ও বিশ্লেষণগুলি ভাবতে-ভাবতে, উপলব্ধি করতে-করতে। এতে দীর্ঘ সময় লাগে। এতে জনপ্রিয়তার বা পাঠকপ্রিয়তার জন্য দরকারি কৌশল বা বস্তুগুলি অনুপস্থিত, তা অস্বাভাবিক নয়। সব বই সবার জন্য নয়, এ তো জানা কথাই!
“চানাচুর বিক্রেতার চেয়ে ব্যাট বিক্রেতাকে বেশি আকর্ষণীয় মানি; চানাচুর শ্রেণী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কেনে, ব্যাট সে-ই কিনবে যে ক্রিকেট খেলতে চায়।” বইটিতে পাবেন এই ধরণের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের এরম বিভিন্ন মৌলিক ভাবনা। কিংবা উদাহরণ হিসেবে আরেকটা আইডিয়া তুলে ধরি, “নৈকট্য থাকবে কর্মফল সূত্রে, নইলে একটা কুকুরও তো ৪-৫-টা শাবকের জন্ম দেয়, না থাকে ওদের ঘনিষ্ঠতা, না থাকে মিলানো নাম।“
এখানে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে, দীর্ঘ কথোপকথন ও লম্বা চিঠি-সমূহের মাধ্যমে উঠে এসেছে লেখকের নিজস্ব কর্মজগতের নানান প্রসঙ্গ, কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষদের সঙ্গে মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি আদান-প্রদানের টু দ্য পয়েন্ট বর্ণনা। নানান এই কাজের অন্যতম জরুরি উপাদান হল তথ্য, প্রয়োজনীয় দক্ষতা হল পর্যবেক্ষণ। এই দুয়ের সাহায্যে লেখক নির্দিষ্ট মানুষ বা কোম্পানির ভবিষ্যৎ কার্যপ্রণালী কী হওয়া উচিত তা বোঝার চেষ্টা করেন, উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। এই বইয়ে গল্পের ছলে লেখা হয়েছে প্রচুর সত্য ঘটনা, যা যে-কোনও ব্যক্তির কাছে শিক্ষণীয় হিসেবে পরিগণিত হবে।
কেন এই বইটি পড়বেন বা কাদের জন্য এই বই?
১) যারা নিজেদের মুক্তমনা বলে মনে করেন বা ঘোষণা করেন। তারা এই পড়লে প্রচুর মৌলিক চিন্তার খোরাক পাবেন যা ইতিপূর্বে মনের মধ্যে ঢুকে থাকা বিভিন্ন বায়াসড মতামত পালটে দেবে।
২) যারা নিজেদেরকে সমাজের অধিকাংশ মানুষের তুলনায় সফল করতে চান। এই বই পড়লে জানতে পারবেন, সমাজের ৭০ শতাংশ মানুষের তুলনায় যারা অধিক সফল এরকম ব্যক্তিদের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য।
৩) যারা মৌলিক চিন্তাকে এপ্রিশিয়েট করেন। যারা দর্শনের বই পড়তে ভালবাসেন। এটা কোনও সহজপাঠ্য টাইমপাস করানোর সামর্থ্যযুক্ত বই নয় একেবারেই। যারা নিজস্ব ভাবনা-জগতকে সমৃদ্ধ করতে শক্ত, একঘেয়ে গদ্যের দেওয়াল টপকাতে পিছপা হন না, তাদের এই বই অবশ্যপাঠ্য।
৪) যারা চায়ের আড্ডা গুলজার করতে চান, তাদেরও এই বইতে উল্লিখিত বিভিন্ন ঘটনা, তথ্য ইত্যাদি যথেষ্টই উপকারে আসবে, তর্কে নামা প্রতিপক্ষকে ধসিয়ে দিতে। কিন্তু সেই মানসিকতার মানুষ এই-রকম বই হজম করার ধৈর্য রাখেন কিনা সেটাই বড় সন্দেহ।