“জব মার্কেটের যে খারাপ অবস্থা, একটা চাকরি পাওয়া সোনার হরিণের মতো হয়ে গেছে”- এই লাইনটি জীবনে একবারও শোনেনি, এমন শহুরে বাঙালি পাওয়া দুর্লভ ব্যাপার। বেকারত্বের হাহাকার ঘরের ছাদ বা চাল ফুটো করে আকাশে গ্যাসবেলুনের মতো উড়ে বেড়ায়, আমরা শ্বাসকষ্টে ভুগি; তবু হাহাকারের বিকার থামে না।
জব মার্কেট শব্দবন্ধটা দিয়ে আমি মূলত প্রাইভেট সেক্টর বোঝাতে চাইছি। সরকারি চাকরি দিয়ে জব মার্কেট বুঝতে চাওয়ার প্রবণতা খুব সুবিধাজনক কিছু নয়। প্রতি বছর দেশের ভার্সিটিগুলো মিলিয়ে যতজন গ্রাজুয়েট বের হয়, এবং সরকারি চাকরিতে যতগুলো পোস্ট ফাঁকা থাকে- এই দুই পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলালেই সিনারিওটা পরিষ্কার হবে, দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের চাহিদা পূরণে প্রাইভেট সেক্টরই শেষ পোতাশ্রয়।
কেন বেকারত্ব? প্রায় ১৫০ জন বেকার এবং ২০০ জন চাকরিপ্রত্যাশীর সাথে আলাপ করে ১৫-২০টা পয়েন্ট পেয়েছি, যেগুলো সবারই জানা, তবু সেখান থেকে টপ ফাইভ পয়েন্ট শেয়ার করি:
• নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি। মামা-চাচা না থাকলে চাকরি পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই।
• বেতন কম, বিপরীতে কাজের চাপ অস্বাভাবিক বেশি। ১০ হাজার টাকা বেতন দিয়ে ১০ লাখ টাকার কাজ করিয়ে নেয়।
• বন্ড সাইনিং করিয়ে নেয়া; এক জায়গায় ৫ বছর থাকতে হবে, এই ফাঁদে ফেলে আটকিয়ে রাখে, অন্যদিকে বছরের বছরের পর ইনক্রিমেন্ট বন্ধ থাকে।
• সিকিউরিটি মানি চায়, কিন্তু কিসের ভরসায় সেই টাকা দেয়া হবে সেই নিশ্চয়তা নেই। (ট্রাস্ট ইস্যু)
• ফ্রেশারদের জন্য কোথাও সুযোগ নেই, সবাই শুধু এক্সপেরিয়েন্স চায়।
এই পয়েন্টের প্রেক্ষিতে যে কেউ সিদ্ধান্তে চলে আসতে পারেন, কোম্পানী চালায় সব মুনাফালোভী ধুরন্ধর মানুষ যাদের মধ্যে সামান্যতম মানবিক গুণাবলী নেই, এবং ‘পুঁজিপতি’, ‘অর্থপিশাচ’, ‘রক্তচোষা’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে এদের বংশোদ্ধার করার মাধ্যমে আমরা অপার শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি, এবং সকালে উঠে বিডিজবস এ নির্বিচারে সিভি ড্রপ করি। গত ৭ বছরে প্রায় ৬০০ মানুষের জব ইন্টারভিউ নেয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। একটা বিষয় আমি বরাবরই জানতে চাই, চাকরিতে এপ্লাই করার সময় আপনি কি জব রেসপনসিবিলিটি পড়েছিলেন? ৯৫% ক্ষেত্রে, না সূচক উত্তর পেয়েছি; মাউসের একটা ক্লিক দিয়েই যেহেতু এপ্লাই করা যায়, পড়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করে না, কোন্ পোস্টে এপ্লাই করছে, কেন এপ্লাই করছে। যে কারণে, বেকার জীবনের প্রধান সান্ত্বনা বিডিজবস বা চাকরির সাইটগুলোতে সিভি ড্রপ করা এবং মনে মনে নিশ্চিত হয়ে থাকা, আমাকে ডাকার কোনো কারণই নেই, আমার তো ইন্টারনাল লবিং নেই! এরা মনে মনে ভাবে- এদের বিশাল যোগ্যতা, শুধুমাত্র রেফারেন্স না থাকা বা দুর্ভাগ্যের কারণে তারা পেরে উঠছে না। পুরো দেশ তার বিরুদ্ধে; নিজেকে ভিকটিম ভাবার অদ্ভুত খেয়ালে অপরিমেয় ব্যক্তিগত সমবেদনায় তারা নিজেকে উদ্দীপ্ত রাখে এবং আরও বিক্রমে এপ্লাই করে; মনে মনে বলে- একদিন কোনো সুপারহিরো এসে তার মেধা আবিষ্কার করে তাকে সুযোগ দেবে; সেই সুপারহিরোকে কীভাবে ইমপ্রেস করবে সেই ফন্দি আঁটে। কিন্তু সুপারহিরো আর আসে না, বরং ‘সব শালা সিস্টেমবাজ। মামা-চাচা থাকলে তো এরকম হবেই’!
এবার ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে সবচাইতে মুখরোচক মন্তব্যটি লিখি, যেটা বোধহয় সবারই কমন পড়ে। ‘ব্যবসায়ীরা নিজেদের মা/ভাই-বোন/বউয়ের কাছে প্রোডাক্ট বেচলেও প্রফিট করে’। যখন ৭০% বা ৮০% ডিসকাউন্ট দেয়া হয়, তখনও প্রফিট করে, অর্থাৎ প্রফিট, প্রফিট এবং প্রফিট। সুতরাং, আমরা এই ব্যাপারে নিশ্চিত ব্যবসায়ীমাত্রই প্রফিটমেকিং মাইন্ড। প্রফিট বাড়বে কাদের মাধ্যমে? দক্ষ কর্মীর মাধ্যমে। আমাদের সন্দিদ্ধ মন বলতে পারে ঘুষ দিয়ে, লবিং করে বা মানুষ ঠকিয়ে বিজনেস ডিল করে; এজন্যই পলিটিক্যাল ব্যাকআপ থাকাই যথেষ্ট। দক্ষ কর্মী-টর্মী কিছু না। আপনাকে সুযোগ দেয়া হলো, একটা লবিং করেন বা লোক ঠকানো প্ল্যান বানান বা সেটাকে ইমপ্লিমেন্ট করেন। সবরকম চেষ্টা তদবির করেও বেশিরভাগ সময় পারবেন না। মানুষ ঠকানো এতো সহজ কোনো ব্যাপার নয়, এর জন্য প্রচুর বুদ্ধি লাগে এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। অনেকেই বলেন, টাকা কামানোর ইচ্ছা থাকলে কতভাবেই তো কামাতে পারি, কিন্তু আমার সেই ইচ্ছাই নেই। আজ পর্যন্ত যতজনের মুখে শুনেছি, প্রত্যেককে সাথে সাথে জিজ্ঞেস করেছি, আমার টাকা কামানোর খুব ইচ্ছা, আমাকে একটা বুদ্ধি দেন। কেউ বলতে পারেনি। ফলে, টাকা কামানোর ইচ্ছা নেই কথাটা মিথ্যা, আপনার আসলে সামর্থ্য নেই। মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে নিজেকে মহৎ ভাবার বিলাসিতায় আমাদের জীবনের ৩টা দশক বিলুপ্ত হয়ে যায়।
যেহেতু দক্ষ কর্মী মানে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজের সম্ভাবনাও বেশি, তাহলে ব্যবসায়ীরা নিজেদের অযোগ্য আত্মীয় স্বজনদের চাকরিতে নিচ্ছে কেন, এই প্রশ্ন আসেনি কখনো? নিজের মায়ের কাছেও যে বা যারা প্রফিট করে, আত্মীয়-স্বজন তো কোনো ছাড়! বা কোম্পানীর উচ্চপদস্থ কেউ নিজের পছন্দের লোককে ঘুষ খেয়ে চাকরিতে ঢোকালে কোম্পানীর লোকসানই যদি হয়, সে ঢোকায় কেন? নিশ্চয়ই কারণ আছে। খুব সিম্পল কারণ, আপনার ভাবনার চাইতেও সিম্পল। আপনার আর ইন্টারনাল রেফারেন্সের মধ্যে যোগ্যতার পার্থক্য ঊনিশ-বিশ লেভেলের; এইটুকু পার্থক্যের জন্য আউটসাইডার কাউকে নেয়ার বিশেষ তাগিদ বোধ করে না তারা; বরং নিজের পরিচিত একজনকে কাজে ঢুকিয়ে সমাজ কল্যাণ বা বেকারত্ব সমস্যা নিরসনে মহান ভূমিকা পালন করেছে ভেবে, অভাবনীয় পুলক বোধ করে নিজের ভেতর। কিন্তু এই সহজ অথচ শক্ত সত্য কথাটি মেনে নিতে মন সাঁয় দেয় না কিছুতেই; পৃথিবী দুভাগ হয়ে যেতে পারে, বায়ুর গতি থেমে যেতে পারে, কিন্তু আমার যোগ্যতার কমতি, এটা কোনোভাবেই সম্ভব না; ‘হু দ্য হেল আর ইউ? মাস্ট বি আ মাদারফাকার!!’ অর্থাৎ গালির মাধ্যমে প্রেসার রিলিজ, দারণ না ব্যাপারটা?
আপনি বলতে পারেন, যোগ্যতা একটা ওভাররেটেড টার্ম। চাকরি করার জন্য কোন্ যোগ্যতা লাগে? বসকে তেল দেয়া আর কলুর বলদের মতো খাটতে পারলেই হলো। আপনার নিজের কথাতেই কিন্তু স্ববিরোধীতা আছে। একজন মানুষকে খুশি করলে যদি নিজের উপকার হয়, পারলে করে দেখান। মানুষকে খুশি করাও বড় মাপের একটা আর্ট; চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হবেন। আপনি হয়তো ভাবছেন, বসের প্রশংসা করলে বা তার কথামতো চললেই সে খুশি হয়ে যাবে। এটা তো সবাই জানে, চেষ্টাও করে; তবু কারো কারো প্রতি বস বেশি থাকেন, সেটা কীভাবে সম্ভব হয়। সুতরাং এখানে অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর আছে, যা কাউকে অন্যদের চাইতে আলাদা করে। স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড টার্মটা বরং ওভাররেটেড। ধরা যাক, আপনি মনে মনে যা ভাবছেন সেটাই প্রকাশ করলেন, এবং এতে সে অসন্তুষ্ট হলো। তার মানে আপনার ভাবনাতেই সমস্যা; এমন জিনিস কেন ভাবেন যা শুনলে আরেকজনের খারাপ লাগবে, বরং তাকে আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন, দেখবেন তার মধ্যেও ভালো লাগার অনেক কিছু আছে। পৃথিবীতে এবসোলিউট খারাপ বলতে কোনো মানুষ নেই। একজন ধর্ষক, খুনী বা সন্ত্রাসীর মধ্যেও সুকোমল বৃত্তি আছে। আপনার বস নিশ্চয়ই সেই লেভেলের খারাপ মানুষ নয়। সুতরাং তাকে যে আবিষ্কার করেছে, তার সেই বৈশিষ্ট্যকে আপনি যোগ্যতা না বলে ‘তেল মারা’ বললে সেই দায় তো আপনার, তার না।
দ্বিতীয় অভিযোগ, কলুর বলদের মতো খাটা। আপনার কি মনে হয়, অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা না থাকলে পৃথিবীতে কোনো মানুষ চাকরি করতো? এই চাহিদা পূরণের জন্যই তো চাকরি করতে বাধ্য হয়। ভালোবেসে চাকরি করার সংখ্যাটা যেহেতু তুলনামূলক কম, আপনাকে প্রতিটি পয়সার দাম উসুল করে দিতে হবে। ‘উৎপাদনমুখী অর্থনীতি’তে এটাই বটমলাইন। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপকে মূল্যায়ন করা প্রোডাক্টিভিটি স্কেলে। নইলে দুনিয়ার অর্ধেক মানুষ কবিতা লিখতো, বাকি অর্ধেক গান-বাজনা করতো। যে বসকে ঘুমানোর আগে গালি দেন, ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করার সময় বসের মায়ের সাথে সঙ্গম করাসূচক হতাশার হুমকি দেন, প্রোডাকশনের প্রসঙ্গ না থাকলে সেও গাছের তলায় বসে নির্বিঘ্নে কবিতা লিখতো অথবা গিটার বাজিয়ে গান গাইতো। ক্ষুধা আর স্ট্যাটাসের তাড়নায়ই যেহেতু চাকরির জন্ম, সেটা মেনে নিয়ে কেউ যদি বাড়তি পরিশ্রম করতে পারে তাকে কলুর বলদ বলাটা কতখানি শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে? এটাও একধরনের পরশ্রীকাতরতা। ব্যাখ্যা করি, পরিশ্রম বলতেই মানুষ বুঝে কায়িক শ্রম, যে কারণে মেন্টাল শ্রম দেয়া মানুষদের প্রতি কায়িক শ্রম দেয়া মানুষদের একধরনের অস্ফূট ক্ষোভ কাজ করে, মনে হয় বসে বসে টাকা নিচ্ছে না, কোম্পানী কেন বোঝে না। এক্ষেত্রে পারফেক্ট উদাহরণ হলো, রাজমিস্ত্রী আর ইঞ্জিনিয়ারের। একটা কনস্ট্রাকশন সাইটে ইঞ্জিনিয়ারের কাজ কতটুকু? সবকিছু তো রাজমিস্ত্রী বা নির্মাণশ্রমিকই করে। অথচ, ওই কাজের জন্য ইঞ্জিনিয়ারের পারিশ্রমিক কত, আর রাজমিস্ত্রীকে দেয়া হয় কতো? জীবনভর তাই ইঞ্জিনিয়ারকে গালমন্দ আর শাপশাপান্ত করেই রাজমিস্ত্রী বিমল পরিতৃপ্তি লাভ করে। ভেবে দেখুন, আমাদের আশপাশেও রাজমিস্ত্রী-ইঞ্জিনিয়ারের দ্বৈরথ প্রতিনিয়ত চলমান বিবিধ চেহারায়।
আপনার যোগ্যতা নেই, সামর্থ্য নেই, যোগ্যতা তৈরির সামান্যতম ইচ্ছা নেই, দক্ষতাবৃদ্ধির অনুভূতি নেই; কিন্তু মনভরা পরশ্রীকাতরতা আছে; আপনার জন্যই বেকারত্বের শঙ্খনীল কারাগার।
ফ্রেশারদের নিয়োগ কেন দেয়া হয় না, এ নিয়ে একটা রিয়েল লাইফ স্টাডি করার চেষ্টা করেছিলাম। তাতে ২টি মূখ্য কারণ উঠে এসেছে। ১ নং কারণ, ফ্রেশারদের অস্থিতিশীলতা। একজন ফ্রেশার কখনোই নিজের ভ্যালু বুঝতে পারে না। তাকে আপনি যত টাকার চাকরিই দেন, বেশিরভাগ সময়ই সে মনে করবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন দেয়া হচ্ছে না, অন্য কোথাও তার জন্য বিশাল কিছু অপেক্ষা করে আছে। ফলে সে প্রতিনিয়ত চাকরি খুঁজতে থাকে, এবং অন্য কোথাও ২ হাজার টাকা বেশি বেতন পেলেই চাকরি বদল করে। কোম্পানী তার পেছনে ৫-৬ মাস ইনভেস্ট করলো আউটপুট পাওয়া ছাড়াই, যথন আউটপুট পাওয়ার কথা, তখনই চাকরি বদল। ফলে, ইনভেস্টমেন্ট পুরোটাই ভাগাড়ে। একবার ভাবুন, একটা কোম্পানী থেকে বছরে যদি ২ জন মাত্র ফ্রেশার চাকরি বদল করে, সেই কোম্পানীর ইনভেস্টমেন্ট কত টাকা গেলো? অন্যদিকে, অভিজ্ঞ কাউকে নিলে সে ১ মাসের মধ্যেই কাজ বুঝে নিয়ে আউটপুট দেয়া শুরু করতে পারে। তার চাকরি বদলের সম্ভাবনা তুলনামূলক কম; অন্য জায়গায় দ্বিগুণের কাছাকাছি অফার না পেলে সে মোটামুটি সেটেলড ধরে নেয়া যায়।
ফ্রেশারদের সুযোগ না দিলে অভিজ্ঞতা তৈরি হবে না, এই যুক্তিতে ফ্রেশাররা আবেদন জানাতেই পারে আমাদের সুযোগ দিন। কিন্তু ‘চঞ্চল মন আমার শোনে না বারণ’ গানটা প্রতিনিয়ত তাদের মনের মধ্যে বাজে। কমিটমেন্টের বালাই নেই, ‘বেটার অপরচুনিটি’ এর ড্রিম গার্ল তাদের মুখে আর মাথায় স্থায়ী আবাস গড়ে নেয়। ঘর পোড়া গরু সিদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়; ফলে ফ্রেশারদের নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতার কারণে কোম্পানীগুলোও স্ট্রিক্ট পলিসি নেয়, নো এন্ট্রি ফর ফ্রেশারস। জব মার্কেটে ফ্রেশারদের ইমেজ খারাপ করার পেছনে শতভাগ দোষ পূর্বসূরী ফ্রেশাররাই, যার কুফল ভোগ করতে হয় উত্তরসূরী ফ্রেশারদের। এই বলয়ে কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকে চাকরিচক্র।
২ নং কারণটি অর্থনৈতিক অতিসংবেনশীলতা। মাল্টিন্যাশনাল আর জায়ান্ট কোম্পানীগুলো বাদে বাংলাদেশের বেশিরভাগ কোম্পানীই হাইলি প্রফিটেবল নয়, তাদের বাজেট ক্রাইসিস প্রায় লেগেই থাকে। একজন লোক বাড়ানো মানে ফিক্সড খরচ বাড়িয়ে ফেলা, এমতাবস্থায় ফ্রেশার একজন কর্মী নিয়ে তাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ইচ্ছা বা সাহস তাদের মধ্যে কাজ করে না। জাতিগতভাবে আমাদের মধ্যে যেহেতু শর্টকাটে সাফল্য পাওয়ার গভীর স্বপ্ন কাজ করে, চাকরিদাতারাই বা ব্যতিক্রম হবে কোন্ প্রকারে? তারা কি জাতির বাইরের কেউ। একজন দক্ষ কর্মী যে প্রতিষ্ঠানের পটেনশিয়াল এসেট, তাকে সময় দিলে সে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারবে, সেটা বোঝার মতো মেন্টাল ফিটনেস খুব সীমিতসংখ্যক নীতিনির্ধারকদের মধ্যেই কাজ করে। অধিকাংশেরই প্রবণতা, ইনস্ট্যান্ট বেনিফিট। ৩ মাস পরে কী হবে সেটা কী হবে যদি ৩ দিন পরই সারভাইভ করতে পারি- এই হচ্ছে গড় মানসিকতা। যে কারণে, জাতিগতভাবেই আমাদের মধ্যে ‘ভিশন’ নেই; আমরা ৫ টাকা খরচ করে ৯ টাকা ইনকাম করতে পারলেই খুশি। জীবনভর যদি ৫ আর ৯ এর হিসাব মিলিয়েই মাথার চুল সাদা হয়ে যায়, হু কেয়ারস! যতই বলা হোক, ব্যবসা হলো রিওয়ার্ড আর রিস্ক এর কন্টিনিউয়াস কনফ্রন্টেশন; শেষ পর্যন্ত রিস্ক নেয়ার মতো স্মার্টনেস দেখাতে পারা মানুষ মাইক্রোস্কোপের আড়ালেই থেকে যায়। আমরা কেবল ‘মোটা দাগে’ দেখা দৃশ্যগুলো, অনুভূতিগুলোকেই বিগার পিকচার ভেবে ‘চিয়ার্স’ বলে উঠি।
শিক্ষার উদ্দেশ্য কী?
খাতায় উত্তর লিখবো, বোধসম্পন্ন ব্যালান্স মানুষ তৈরি করা। ব্যালান্স মানুষ দিয়ে কী হবে? তারা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করবে। এক লাইনে বললে, রাষ্ট্রের জন্য কর্মী তৈরি করা। বিজ্ঞ, দূরদর্শী বা প্রতিভাবান মানুষ তৈরির জন্য একাডেমিক সিলেবাস ডিজাইন করা হয় না। রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন দূরে থাক নিদেনপক্ষে পত্রিকার সম্পাদক বা উদ্যোক্তা পর্যায়ের মানুষ হয়েছেন যারা, খেয়াল করে দেখুন তারা কেউই একাডেমিক পড়াশোনা নিয়ে ফ্যাসিনেটেড নন। শিক্ষা ব্যবস্থা হলো, ছাঁচে ফেলা মানুষ তৈরির একটা প্রকল্প। ছাঁচে ফেলা মানুষ কর্মী হবে, দেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের এডুকেশনের কারিকুলাম প্রায় পুরোটাই ইন্ডাস্ট্রিয়ালি ডিটাচড। ভার্সিটিতে ৪ বছর অনার্স করে একজন গ্রাজুয়েটের কোন্ কোয়ালিটি তৈরি হয় যেটা তাকে চাকরিক্ষেত্রে কোন শার্প এজ দেয়? বরং ভার্সিটি লাইফে যারা বিভিন্ন অর্গানাইজিং, কালচারাল এক্টিভিটি, সোশ্যাল এক্টিভিটিতে জড়িত থাকে, দেখা যায় চাকরি ক্ষেত্রে তারাই তুলনামূলক সুবিধা করতে পেরেছে। টেকনিকাল ফিল্ড (যেমন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং) বাদে বাকি সব ধরনের ফ্যাকাল্টিতে এই কথার সত্যতা বহুলাংশে মিলবে। থার্ড এয়ার পর্যন্ত একটা ছেলে বা মেয়ে জানেই না তার আসলে কোন দিকে ক্যারিয়ার গড়া উচিত, এবং এজন্য কী করা উচিত। অতি উৎসাহীরা কেউ কেউ সেকেন্ড এয়ার থেকে জব সল্যুশন পড়া শুরু করে। কিন্তু সেকেন্ড এয়ারের একজন শিক্ষার্থী যদি জব সল্যুশন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তার মানে একাডেমিক পড়াশোনা তার উদ্দেশ্য পূরণে কী নিদারুণভাবে ব্যর্থ, সেটা কি আলাদা করে ব্যাখ্যা করার আবশ্যকতা আছে? স্বল্পোন্নত এবং অনুন্নত দেশগুলোতে বেশি করে ভোকেশনাল ট্রেনিং আর ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা উচিত; সেটা কি আদৌ হচ্ছে? বা যেসব কোর্স আছে, সেগুলো কতখানি রিয়েল লাইফ ওরিয়েন্টেড। বাইরের অনেক দেশেই, কোম্পানীগুলো ভার্সিটির থিসিস প্রোজেক্টগুলোতে ইনভেস্ট করে এবং সেখানে নিজেদের আরএনডি এর কাজগুলো করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে; কোম্পানী-ভার্সিটি উভয়ের জন্য উইন-উইন সিচুয়েশন। আমাদের দেশে গবেষণার সেক্টর খুব বেশি বিকশিত নয়, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং, ফিন্যান্স, এইচআর, সেলস প্রভৃতি ফাংশনাল ডিপার্টমেন্টগুলোতে নিয়মিত লোক তো লাগে। সেক্ষেত্রে, ভার্সিটিগুলোতে নিজেদের রিকোয়ারমেন্ট দিয়ে কোর্স ডিজাইনের জন্য কোম্পানীগুলো যদি ইনভেস্ট করে তাহলে তো ক্যাপাবল লোক পাওয়া সহজ। আমরা ইন্ডাস্ট্রির জন্য কর্মী প্রস্তুত করছি, অথচ ইন্ডাস্ট্রির সাথেই কানেকশন নেই। ব্রান্ডিং কনটেস্ট, আইডিয়া কনটেস্ট, ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট প্রভৃতি শর্ট টার্ম এক্টিভিটির মধ্যেই আমাদের যাবতীয় এফোর্ট এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
বেকারত্বের একমাত্র এবং কেবলমাত্র কারণ অলসতা আর স্কিল ডেভেলপমেন্ট অনীহা। একটা সহজ উদাহরণ দিই। আমরা বড় লেখা পড়ি না, আমরা বড় দৈর্ঘ্যের বিজ্ঞাপন দেখি না, কারো সাথে ১০ মিনিট আড্ডা দিই না; কারণ আমাদের সময় নেই। যদি প্রশ্ন করি, কিসে সময় আছে বা আপনার ২৪ ঘণ্টা সময় কীভাবে কাটে? কোনো সদুত্তর পাবেন না, কেবল সময় নেই আর সময় নেই। এত সময় যাচ্ছে কোথায়? চ্যাটিং, মোবাইল গুতাগুতি, অনির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুম, কম্পিউটার গেমস, রাষ্ট্রের সমালোচনা, সেলফি তোলা; এসবই তো; নাকি আরও কিছু আছে?
‘সময় নেই’ এটা আসলে চরম নেগেটিভ এক ফিডব্যাক নিজের প্রতি। সারাদিনে কয়টা কাজ করেন, কী কাজ করেন, ভেবে দেখুন হিসাব মেলাতে পারবেন না; কেবলই মনে হবে কীভাবে যে সময় চলে যায়! অর্থাৎ সময় সময়ের মতো খেলে যাচ্ছে, আপনি পেণ্ডুলামের মতো দুলছেন, আর কিছুই না। আপনি ইন্দ্রিয়বিলাস ছাড়া কিছুই করছেন না যা আপনি উল্লেখ করতে পারবেন। এতো ইন্দ্রিয়বিলাসের চূড়ান্ত গন্তব্য আসলে কোথায়; নেপচুন গ্রহে?
সময় নেই বলার মধ্য দিয়ে আপনি নিজেকেই প্রবঞ্চিত করছেন। আপনার মধ্যে স্পৃহা নেই, চ্যালেঞ্জ নেই, দেবদারু গাছের পাতা হয়ে সুখ খুঁজছেন, কিন্তু জানেনও না কী করলে সুখী হন। ১১ জন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কত টাকা স্যালারি হলে মনে হবে এর চাইতে বেটার অপরচুনিটি আর সম্ভব নয়। ১ জনও বলতে পারেনি। এতোটাই অদূরদর্শীতার নৈপুণ্যে চমৎকৃত হতে হচ্ছে আমাদের!
এনালিটিকাল এবিলিটি আপনার না-ই থাকতে পারে, দূরদর্শীতার অভাব থাকাও খুব স্বাভাবিক, কিন্তু ‘সময় নেই’ বলে এড়িয়ে যাওয়া, লেগে থাকার অনীহা, এই দায় কীভাবে এড়াবেন? সময় নেই মানে আপনার আগ্রহ নেই, কিন্তু কিসে আপনার আগ্রহ সেটাও জানেন না; আপনার আর কাওরানবাজার আন্ডারপাসের সামনে ঘুমিয়ে থাকা বাস্তুহীন মানুষের পার্থক্য কোন্ পয়েন্টে? ভাবছেন অনেক সিস্টেম জেনে গেছি, আপনার চাইতে চাল্লু মাল একটাও হয় না, কিন্তু এচিভমেন্ট কী আপনার? আমাদের সাম্প্রতিক হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে ১ জনকে এসাইনমেন্ট দিয়েছিলাম ‘ধান্ধা করলে অন্ধ হয়’- এই লাইনটা ১৬ পৃষ্ঠা লিখতে হবে, কোথাও ফাঁক রাখা চলবে না। ৫ ঘণ্টা একটানা পরিশ্রম করে কাজটা সে কমপ্লিট করেছে। আপনার জন্যও একই বাণী; নিজের শক্তিমত্তা, দুর্বলতা সম্পর্কে ততটাই জানুন, যতটা জানেন ৫ বা ৭ এর ঘরের নামতা।
বেকারত্বের জন্য রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজ, পুঁজিবাদ, আমেরিকা, ইসরাইল, ভারত, ফিলিপাইন, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ প্রভৃতি ৭৭৯ টা কারণকে দায়ি করতে পারেন, বুদ্ধি খাটিয়ে আরও কয়েক হাজার কারণ বের করে ফেলতে পারেন, কিন্তু যে কারণটি কখনোই আপনার বুদ্ধিতে আসবে না, সেটাই আবারো বলি; একটা আয়নার সামনে দাঁড়ান। যার প্রতিবিম্বটি দেখতে পাচ্ছেন, সেই মূল কালপ্রিট। পারলে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিন।
‘আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওহে দয়াময়, পাড়ে লয়ে যাও আমায়’