২০০৩ এর ১৫ই জুলাই আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল। আজ ১২ই জুলাই, ১৬ বছর চলে গেল কোন ফাঁকতালে!
চাকরি ব্যাপারটাকে ছোটবেলা থেকেই অপছন্দ করতাম। কৈশোরে এসে উপলব্ধি করি, অপছন্দ নয় চাকরিকে ভয় পাই আদতে। ভয়ের উৎস খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করি বইয়ের প্রভাব। সারাজীবনেই খুব পড়ুয়া মানুষ ছিলাম না, তবে প্রচুরসংখ্যক বই নেড়েচেড়ে দেখা হয়েছে। সেইসব বই সূত্রে জেনেছিলাম চাকরিতে প্রবেশের পর শখ আর ক্রিয়েটিভিটির চর্চা জলাঞ্জলি দিয়ে যন্ত্রের জীবন যাপন করতে হয়। তখনো উপার্জন ধারণা খুব সুস্পষ্ট না হওয়ায় এই চিন্তার গভীরে যাওয়ার মতো পরিপক্বতা অর্জন করিনি, বরং চাকরিতে ঢুকলে ক্রিকেট খেলতে বা টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখার সু্যোগ পাবো না, আর লেখালিখি বন্ধ হয়ে যাবে— এ দুটো দুর্ভাবনাই কাতর করে তুলেছিল।
তবে এসএসসি পাশের পর যখন সিদ্ধান্ত নিলাম নটরডেম কলেজে ভর্তি হবো, তখন অনেকটা আচমকাই বয়স ৬-৭ বছর বেড়ে গিয়েছিল। আম্মুর সারাজীবনের ইচ্ছা ছেলে বড়ো হয়ে চিকিৎসক হবে, ছেলের বায়োলজি পড়তে একটুও ভালো লাগে না, সে সংকল্পবদ্ধ ইন্টারে উঠে সবার প্রথমে বায়োলজি বাদ দিবে; এ নিয়ে মা-ছেলের মনোমালিন্য বিস্তর, সমঝোতাকারী হিসেবে বড়ো বোনের আবির্ভাব, যে কোনো যুক্তি-তর্ক নয়, ছোট ভাইয়ের ইচ্ছাকেই সমর্থন দিয়ে যায় সবসময়।
বায়োলজি বাদ দেয়ার আগে সিনিয়র ভাইদের কয়েকজনের কাছেই জেনেছিলাম বায়োলজি না থাকলে মেডিকেল সাইড পুরো বন্ধ হয়ে যাবে, পাবলিক ভার্সিটির অনেকগুলো সাবজেক্টেও পড়ার সুযোগ পাবো না, অপশন বলতে থাকবে শুধু বুয়েট বা টেকনিকাল ভার্সিটিগুলো, কিংবা পাবলিক ভার্সিটির সিলেক্টিভ কিছু বিষয়। বায়োলজি বাদ দেয়ার চিন্তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
আমার পরিচিত কোনো মানুষ বুয়েটে পড়েনি, অভিনেত্রী অপি করিম বুয়েটে পড়ে, এটাই জেনেছিলাম পত্রিকাসূত্রে।মেডিকেল নিয়ে সামান্যতম ফ্যাসিনেশনও নেই, অপি করিম নাটক, নাচ করে যদি বুয়েটে পড়তে পারে, আমি পাবো না কেন? বড়োরা ঝুঁকিপূর্ণ বললেও আমার কাছে অতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।
ক্রিকেট খেলাসূত্রে সমবয়সীদের চাইতে সিনিয়র ভাইদের সাথেই ঘনিষ্ঠতার প্রগাঢ়তা বেশি ছিল সবসময়। তাদের বেশিরভাগই স্থানীয় কলেজে পড়াশোনা করতো, তাদের মুখে শুনতাম বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির অবস্থা সুবিধার না, বিদেশে চলে যেতে হবে। ডাক্তার হলে চাকরি পাওয়া না গেলেও নিজস্ব চেম্বার করেই জীবন চালানো যাবে।
জীবনে বিয়ে করবো না সংকল্প থাকায় পরিণতি নিয়ে খুব ভাবিত ছিলাম না, তবে কলেজের সেই সময়টাতে চাকরি নিয়ে সকলে যেরকম ভয় দেখাচ্ছিল, তাতে চাকরি না করলে জীবন কীভাবে চালাবো সেই চিন্তাগুলো সিরিয়াসলি করতে হচ্ছিল তখন।
দুটো পরিকল্পনা করি। প্রথম পরিকল্পনাটা ৯-১০ বছরেই তৈরি করা; বয়স ৩০ এর আশপাশে গেলে সংসারের মায়া ত্যাগ করে আশ্রমে স্থায়ী হবো। দ্বিতীয় পরিকল্পনা, বড়ো আপা আর ছোট ভাই রুমেলের সংসারে পর্যায়ক্রমে থাকবো, ওরাই আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবে; আমি মানুষের ইন্টারভিউ নিবো আর বই লিখবো। দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত লাগে তখন, কারণ আমার এসএসসি রেজাল্টের ৩ দিন পর বড়ো আপার বিয়ে হয়, আমি নটরডেমে পড়ার ২ বছর ওর বাসাতেই ছিলাম।
চাকরি আর উপার্জনের মধ্যে তখন পার্থক্য বুঝতে শিখি। একজন সুস্থ্য-সবল মানুষ অবশ্যই উপার্জন করবে, এজন্য চাকরি করা পূর্বশর্ত হতে পারে না। সেসময় প্রথম আলোতে রবার্ট ফিস্ক নামে একজন কলাম লিখতো, তার পরিচিতি অংশে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক লেখা থাকতো। বড়ো আপার কাছে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক পেশাটার অর্থ বুঝে নিজের জন্য উপযুক্ত মনে হয়, সিদ্ধান্ত নিই বুয়েট বাদ, জার্নালিজমে পড়াশোনা করবো। বড়ো আপার কঠোর তিরস্কারে জার্নালিজম পড়ার চিন্তা পালিয়ে গেলেও রবার্ট ফিস্ক ঠিকই সক্রিয় ছিল। ওয়েটিং লিস্ট থেকে বুয়েটে চান্স পেলাম যখন তখনো মাথায় ছিল বুয়েটে এসেছি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেধাবী মানুষদের সংস্পর্শে নিজেকে শাণিত করার উদ্দেশ্যে, এখান থেকে বৈষয়িক প্রাপ্তিযোগ নেই।
পড়াশোনা পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেশ-বিদেশের মানুষকে ইমেইল লিখেই দিন কাটতো, faithwriters.com এ একাউন্ট খুলে সেখানে পোস্ট করতাম। নটরডেমের বন্ধু শাহরিয়ার রউফ নাফির সাথে বুয়েটের ফার্স্ট ইয়ার- সেকেন্ড ইয়ারেও যোগাযোগ ছিল, তাদের বাড়িতেও যাতায়াত অব্যাহত ছিল। কলেজ লাইফেই তার বড়ো ভাই মুশফিকুর রউফ নাসা ভাইয়ের সাথে পরিচয় গড়ে উঠেছিল। বুয়েটে পড়াকালে একদিন নাফিদের বাসায় নাসা ভাইয়ের সাথে আলাপ হয়। আমার ঔদাসীন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেন, তোমার প্ল্যান কী আসলে। আমি বলি ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট হওয়া; আমার কথা হজম করতে কষ্ট হয় তার।
বিভিন্ন ম্যাগাজিন, প্রথম আলো, যুগান্তর, আমার দেশ, সমকাল, ইত্তেফাক সহ অনেকগুলো পত্রিকায় কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করি, লেখা পাঠাই; কোথাও আমার লেখা পছন্দ করে না।( এখন বুঝতে পারি, ভুল তরিকা গ্রহণ করেছিলাম; আমি আলোচনামূলক নিবন্ধের পরিবর্তে গল্প পাঠাচ্ছিলাম, গল্পকারকে কন্ট্রিবিউটর হিসেবে নিবে কেন)
ওদিকে একাডেমিক লাইফে তলানী ভেদ করে পাতালে রওয়ানা হচ্ছিলাম। আমার এডভাইজার শ্রদ্ধেয় কার্নি স্যার অত্যন্ত সহমর্মী হয়ে বলেন, ‘তোমার পক্ষে বুয়েট পাশ করা অসম্ভবের মতো, ক্যাম্পাসে বহু আদু ভাইয়ের দেখা পাবে, ইন্টার পাশ হয়ে ঘুরে লাভ কী, পরিণত বয়সে এজন্য লজ্জায় পড়বে; তার চাইতে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে দাও; ২ বছর মানুষের জীবনে কিছুই না, যেখানে তোমার মেধা আছে সেই লাইনে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করো’। আমি স্যারকে হতাশ করে বলি- স্যার আমি যেখানেই পড়ি আমার পরিণতি একই থাকবে; একাডেমিক পড়াশোনা থেকেই মন উঠে গেছে।
স্যার ভাবলেন আমি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে জীবন যাপনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। মানিকগঞ্জ থেকে আম্মুকে ডেকে নিলেন, অনেক কিছু বোঝালেন। আম্মুর ধারণা জন্মালো, অতিরিক্ত বই পড়া থেকেই আমার এ অধঃপতন, তিনি আমার হলের আলমারিতে থাকা প্রায় ১৫০টি বই ২ বস্তায় ভরে মানিকগঞ্জে নিয়ে গেলেন।
তবু আমার অভ্যাস বদলালো না। কার্নি স্যার প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন, সরাসরি বলে বসলেন- বুয়েট কোনো ফাজলামির জায়গা না, জীবন নিয়ে আমার আসলে প্ল্যান কী; আমার ব্যাচের সবাই যখন গ্রাজুয়েশন শেষ করে দেশের বাইরে যাবে বা চাকরিতে ঢুকবে, আমার তখনো জুনিয়রদের সাথে ক্লাস করতে হবে, আমার উপার্জন সংক্রান্ত চিন্তাই বা কী। আমি কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি, স্যারের সাথে দেখা করাই বাদ দিয়ে দিই।
বুয়েটে গ্রাজুয়েশনের পর মাত্র ১টা অতিরিক্ত টার্ম বৈধভাবে হলে থাকা যায়; সিট বাতিল হলে কোথায় থাকবো তাও ভাবিনি। মাথায় তখনো ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক শব্দটাই জেঁকে বসে ছিল। ১৬টা সাবজেক্টে ফেল, তবু নির্বিকার, আরো অন্তত ২ বছরের আগে বুয়েট থেকে বের হতে পারবো না নিশ্চিত হয়ে গেছে। এরই মধ্যে প্রফেশনাল সেট আপ এ নাটক বানাই একটা। ব্লগিংসূত্রে বেশ কিছু টিভি সাংবাদিকের সাথে পরিচয় ছিল, অনেকগুলো চ্যানেলে নাটক জমা দিই। প্রত্যেকেই বলে আপনার নাটকে পরিচিত কোনো আর্টিস্ট আছে? এই প্রশ্নেই সব জায়গা থেকে খারিজ হয়ে যাই। তবে একুশে টেলিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিল, যা আমার চিন্তাকে পরিপক্ব হতে সহায়তা করেছিল। তিনি বলেছিলেন- ‘ ভাই টেলিভিশন চ্যানেল তো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। আপনার নাটকে যদি অন্তত ২-৩ জন পরিচিত আর্টিস্ট থাকে তাহলে দর্শক দেখবে, স্পন্সর পাওয়া যাবে। আপনি নিজে কি আনকোরা আর্টিস্টে ভরা নাটক দেখেন’?
সেই শিক্ষা সত্ত্বেও আবারো টেলিফিল্ম বানাই। সেটার স্পন্সর যোগাড় করতে গিয়ে পরিচয় হয় উদ্ভাস একাডেমিক এন্ড এডমিশন কেয়ারের পরিচালক সোহাগ ভাইয়ের সাথে। আমার ক্রেজি চিন্তাভাবনা হয়তোবা তার পছন্দ হয়, তিনি জানান উদ্ভাসের বাইরেও তার আরো কয়েকটা কোম্পানী আছে, সেগুলো অন্যরকম গ্রুপ নামে পরিচিত। কিছুদিন পর তিনি বলেন তার সাথে কাজ করবো কিনা। আমি চাকরি করবো না, কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং মডেলে কাজ তো করাই যেতে পারে। সেভাবেই কাজ চলতে থাকে। এর মধ্যে ভাষাচিত্র প্রকাশনীর সোহেল ভাই আমার অনুদিত মিলান কুন্ডেরার উপন্যাস আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং বইটি বই মেলায় প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েও করে না শেষতক। অনুবাদ যেহেতু প্রচণ্ড পরিশ্রমসাধ্য কাজ, বয়সও কম ছিল, বই না প্রকাশ পাওয়ার দুঃখে মর্মাহত হয়ে পড়ি। সোহাগ ভাই আমার লেখালিখিকে প্রমোট করতে মৌলিক গল্পের বই প্রকাশ করে দেন, ক্রমাণ্বয়ে আরো ২টি বইয়ের প্রকাশক হন। আমি তখনো তার বিভিন্ন কোম্পানীতে ফ্রিল্যান্সার মডেলেই কাজ করতে থাকি, যাকে তখন ভদ্রস্থ ভাষায় ক্রিয়েটিভ কনসালটেন্ট বলা হতো।
কিন্তু ফ্রিল্যান্সারদের কর্মপরিধি থাকে সীমিত, আমি বেড়ে উঠছিলাম মহীরূহের মতো, ফলে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বাঁধাটা অনিবার্য হয়ে উঠে। এই কনফ্লিক্ট নিয়েও দীর্ঘদিন চলে গেছে; এক পর্যায়ে কনফ্লিক্ট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, আমারও প্রায় ৯ বছরের ফ্রিল্যান্সিং জীবনের যবনিকাপাত ঘটে।
তবে বিয়ে করবো না সেই সংকল্পচ্যুতি ঘটেছিল আরো ৯ বছর আগেই, তা পরিণতি পায় ২০১৩ তে, এবং ২০১৭ তে আমাদের সাথে যুক্ত হয় উনিশ, তেইশ নামের দুই কন্যাশিশু, যারা আমার অস্তিত্বের অলংকার।
বয়স কম ছিল, চাকরি করবো না, উপার্জন যা-ই করি, জীবন কেটে যাবে এই ছিল ভাবনা। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শাখা-প্রশাখা যুক্ত হয়েছে, উপার্জনের একটি ন্যুনতম সীমা প্রতি মাসেই বজায় রাখতে হয়; সোহাগ ভাইদের থেকে আসা ৯ বছরের উপার্জন উৎসও বন্ধ হয়ে গেছে, এখনো কি চাকরি খুঁজবো না?
এ নিয়ে স্ত্রী আর মায়ের সাথে মনোমালিন্যের অন্ত নেই, ছোট ভাইও চিন্তিত। আবারো সমঝোতাকারী বড়ো আপা; তার কথা যা করতে মন চায় করো।
ভেবে দেখলাম কী করতে মন চায়। প্রতিবার উত্তর পাই, মানুষ নিয়ে গবেষণা করতে। কিন্তু এ দিয়ে কি প্রতি মাসে সংসার খরচ চলবে? জানি না।
বুয়েটের বড়ো ভাইদের দ্বারস্থ হলাম, ফেসবুকে লেখালিখিসূত্রে সখ্যতা গড়ে উঠা অনেকের সাথে কথা হলো।
ডিসটেন্ট মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করলাম, সেখানে ক্রিটিকাল থিংকিং, ডিসিসন মেকিং, এনালিটিকাল রাইটিং, পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে ওয়ান টু ওয়ান কোর্স করানো হয়। সেখানে ৩-৪ জন স্টুডেন্ট পেলাম।
কিন্তু এই ৩-৪ জন স্টুডেন্ট থেকে প্রতি মাসে যা উপার্জন তা দিয়ে তো উনিশ, তেইশের খরচই উঠে আসে না, আমাকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এপ্রোচ করতে হবে, যেখানে হিউম্যান সাইকোলজি, পটেনশিয়ালিটি, বিজনেস ইনসাইট নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে কিনা দেখতে হবে।
যাদের সাথেই কথা বলেছি প্রত্যেকে নিরুৎসাহিত করেছে, বাংলাদেশে এ ধরনের কাজ করে টিকে থাকা যাবে না। কেউ ভাবছে আমি কনসালটেন্সি ফার্ম খুলছি, কেউ ভাবছে রিক্রুটিং এজেন্সি, কেউ ভাবছে ডন সামদানীর মতো ট্রেনিং দিবো, কিংবা আমি যেহেতু লিখি, কারো ধারণা আমি কন্টেন্ট প্রোভাইডিংয়ের কাজে নামছি।
কেবলমাত্র মানুষ নিয়ে যে রিসার্চ-এনালাইসিসের কাজ করা যায় এই ধারণাটাই বোঝাতে পারছি না, এখান থেকে উপার্জন তো বহুদূরবর্তী গাঁজাখুরি চিন্তা।
তবে জীবনে হয়তোবা কিছু মেধাবী আর সুন্দর মনের মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম, যে কারণে প্রতি মাসেই কীভাবে যেন অদ্ভুত সব প্রজেক্ট পেয়ে যাই।
যেমন, আপনার কোম্পানীতে যারা কাজ করে তাদের পটেনশিয়ালিটি, ল্যাকিংস, সে কোম্পানীর এসেট নাকি লায়াবিলিটি এবং কীভাবে তাকে বেস্ট ইউটিলাইজ করা যায় সে সংক্রান্ত এক গবেষণা করে দিলাম।
কিংবা আপনার কোম্পানীর ইমপ্লোয়িরা আদতে কতটা খুশি এবং ম্যানেজমেন্টের সাথে কোন পয়েন্টে গ্যাপ তৈরি হওয়ার কারণে কোম্পানীর গ্রোথ থমকে সে সংক্রান্ত গবেষণা ও সুপারিশ।
কিংবা আপনার ইমপ্লোয়িদের মধ্যে টিম বন্ডিং কেন নেই এবং কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা ওয়ার্কশপের মাধ্যমে এক্সিকিউট করা, কিংবা ট্যালেন্ট ম্যাক্সিমাইজ করার জন্য ম্যানেজার তৈরি করা।
কিংবা আপনার কোম্পানীর বিভিন্ন সমস্যার রুট কজ কী, বা পলিসি তৈরি– সবকিছুই মানুষ নিয়ে কাজ।
এটা কি এইচ আর ফার্মের আওতাভুক্ত? হয়তোবা নয়। আমি বরং হিউম্যান রিসার্চ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো। জীবনে ১৪০০+ মানুষের চাকরির ইন্টারভিউ নেয়ার সুবাদে, এটাও আমার একটা উপার্জনের সক্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানীগুলোতে হায়ারিংয়ের ক্ষেত্রে খুব কঠোর ফিল্টারিং অনুসরণ করা হয় না, যে কারণে অদক্ষ আর অযোগ্য ওয়ার্কফোর্স নিয়ে অভিযোগ চলতেই থাকে। কিন্তু হায়ারিংয়ের ক্ষেত্রেও একজন মানুষকে রিসার্চ আর এনালাইসিস করা যায়, এই কনসেপ্টটা নিয়েই কাজ করছি, হায়ারিং কনসালটেন্ট হিসেবে এনজিও এবং কয়েকটা স্টার্ট আপ এ সাপোর্টও দিয়েছি।
যারা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ভয় পায় এবং ইন্টারভিউ থেকে রিজেক্টেড হয় এই গোষ্ঠীটিকে কর্মক্ষম করার জন্য ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছা। জানি না আমার বর্তমান উদ্ভট কাজ কর্ম দিয়ে ততদিন সারভাইভ করা হবে কিনা। এ নিয়ে ভাবনা আছে, ভয় নেই। উনিশ, তেইশ বড়ো হবে, খরচ আরো বাড়বে, কীভাবে চলবো তখন? ঘুমুতে গেলে মাঝেমধ্যে এগুলো বিরক্ত করে, পাত্তা না পেয়ে চুপসে যায়।
ছোটবেলায় নাহয় চাকরি না করা নিয়ে ফ্যান্টাসি ছিল, আমি তো বড়ো ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হওয়ার ম্যাটেরিয়াল নই, তবু উপার্জনের ক্ষেত্রে এই নিঃসীম ক্যাজুয়ালপনার উৎস কী?
আমার পর্যবেক্ষণ মতে, ফ্রিডম আর ফ্লেক্সিবিলিটি আমার প্রধান স্পর্শকাতর জায়গা। আমি যতটা স্বাধীনচেতা, তার চাইতে বেশি স্বেচ্ছাচারী। যা মন চাইছে তা করার জন্য আরেকজনের অনুমোদন নিতে হবে, এই মৌলিক শর্ত মানতে পারি না বলেই চাকরিকে এড়িয়ে চলেছি সবসময়। নিয়ন্ত্রিত হতে চরম অনীহা আর বৈকল্য কাজ করে।
তবে কি নিয়ন্ত্রণ করতে চাই? নিয়ন্ত্রণপ্রিয়তা আসে ক্ষমতালিপ্সা থেকে, সেটা নেই আমার, তবে ইমপ্যাক্টলিপ্সা প্রচণ্ড; কাউকে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারলে দারুণ লাগে। ইনফ্লুয়েন্সও কি এক প্রকারের নিয়ন্ত্রণ নয়? অবশ্যই না। ইনফ্লুয়েন্স মানে কিছু গ্রহণ, কিছু পরিমার্জন, কিছু বর্জন শেষে স্বকীয় অবস্থানে পৌঁছানো। নিয়ন্ত্রণ মানে স্বকীয়তাকে সমর্পণ করে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আচরণ করা।
আমি যখন কোনো কর্পোরেশনের জন্য কাজ করি সেখানেও তো প্রোটোকল মানা এবং তাদের ইচ্ছা-অনুমোদনের ব্যাপার থাকে। যে কারণে চাকরি থেকে দূরে থাকলাম, ইনডিপেনডেন্ট ক্যারিয়ারেও কি সেগুলো প্রখর আর প্রকট নয়?
প্রথমত, কর্পোরেশনের জন্য কাজ করা আর কর্পোরেশনের অধীনে কাজ করা, দুটো ১৮০ ডিগ্রি আলাদা ধারণা। দ্বিতীয়ত, আমি যে ফিল্ডগুলোতে কাজ করছি এগুলো নিয়ে খুব বেশি সংখ্যক মানুষ সময় আর ক্যারিয়ার বাজি ধরেনি, যে কারণে ফ্রিডম আর ফ্লেক্সিবিলিটির কলটা আমার প্রান্তেই থাকে।
কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে আর না চলতে পারলে ব্যাক আপ প্ল্যান কী?
জানি না। আমি জীবনে কখনোই প্ল্যান বি রাখি না। বায়োলজি বাদ দিলাম, ইন্টারে যা পড়াশোনা করেছি বুয়েটে চান্স পাবোই জোর দিয়ে বলার জো ছিল না, তবু জিদ করে বুয়েট বাদে কোনো ভার্সিটির ফরম তুলিনি। মেরিট পজিশন এলো ৯০৩, জিপিএ ৫ পাওয়া সত্ত্বেও এয়ার লস যাওয়ার বিরাট ঝুঁকির মুখে চলে গিয়েছিলাম কেবলমাত্র আর কোনো অপশন না রাখায়। শেষ পর্যন্ত বুয়েট ওয়েটিং থেকে ডাকায় মুখ রক্ষা হয়েছে। কার্নি স্যার জোর করা সত্ত্বেও অন্য ভার্সিটিতে চেষ্টা করিনি। বিয়ের জন্য মাত্র ১ জন পাত্রী পছন্দ করেছি, ক্যারিয়ারে কী করবো বা আদৌ করতে পারবো কিনা চিন্তা না করেই তার সাথে সংসারে ঢুকে পড়েছি; আচমকা সোহাগ ভাইয়ের সাথে হওয়া পরিচয়ের সূত্র ধরেই তার সাথে ৯ বছর কাজ করেছি, আবার নিশ্চিত উপার্জন বন্ধ হয়ে গেলে কীভাবে চলবো সেই ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সেখান থেকে বের হয়েও গেছি। বিগত ১ বছরে টিকে আছি বহু কষ্টে, তবু হার তো স্বীকার করিনি।
যেহেতু ইনটেন্টে ভেজাল নেই, এবং মানুষ নিয়ে গবেষণা করেই বাঁচতে চাই, হয়তোবা প্ল্যান বি এর প্রয়োজন পড়বে না। যদি পড়ে?
জানি না।
বিত্তশালী বা খ্যাতিমান হওয়ার সামান্যতম স্বপ্নও নেই আমার। আমি একজন চিন্তক আর পর্যবেক্ষক হিসেবে সময় ব্যাপন করতে চাই যা মানুষের জীবনে ভ্যালু আর ইমপ্যাক্ট তৈরি করবে; সেই পরিভ্রমণে যাতে অর্থকষ্টে না ভুগি সেজন্য চিন্তা আর পর্যবেক্ষণকে অর্থমূল্যে বিনিময় করতে চাই।
এজন্য কি চাকরি করা খুব জরুরী?
যেহেতু সেফটি, সিকিউরিটি, স্ট্যাটাসের চক্করে ধরা পড়িনি, ১০০ বারের মধ্যে ১০০ বারই আমার উত্তর “Why so boring”?