গুলতেকিন খানের প্রতি আমার কৌতূহলের কারণ দুটো। প্রথমত, তার সাথে আমার নিজের মায়ের স্ট্রাগলপূর্ণ লাইফস্টাইলের সাদৃশ্য, দ্বিতীয়ত শচীন দেব বর্মণের স্ত্রী মীরা দেব বর্মণ। শচীন দেবের বিখ্যাত অনেকগুলো গানেরই গীতিকার তিনি, যদিও তা খুব বেশি জনে জানে না।
গুলতেকিন খান লেখালিখি করেন এই তথ্য জেনেছি হয়নি বেশিদিন। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে স্মরণ করে শীলা আহমেদ প্রথম আলোতে একটি ছোট্ট লেখা প্রকাশ করেছিলেন, মনে রেখাপাত করার মতো কিছু ছিলো না সেটা, তবু আলসেমি ঢঙে পড়া সেই নিবন্ধসূত্রে জেনে যাই তার মা গুলতেকিন খানের লেখার ব্যাপারে। মূলত তখনই ইচ্ছা পোষণ করি তার লেখা কোনো একটি বই পড়বো।
কিন্তু বইয়ের নাম জানা না থাকায় সংগ্রহ করা হয়নি আর। যাপিত জীবনের অন্যান্য জটিলতায় একসময় ভুলেও যাই।
এবছর বইমেলা বর্জন করেছিলাম। বই সংগ্রহের মাধ্যম একমাত্র রকমারি ডট কম বাদে ছিলো না তাই। দৈবচয়নের মতো করে বই খুঁজতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে গুলতেকিন খান এর নামটা চোখে পড়ে, এবং আগ-পিছ না ভেবেই বইটি কিনে ফেলি।
কেনার পর প্রায় ২০-২৫ দিন বইটি পড়েই ছিলো অপঠিত অবস্থায়, এর মধ্যে পরিচিত এক সুহৃদ বাসায় এসে,পড়ার জন্য, ৫-৬টি বই নিয়ে যায়; অন্যমনস্ক ছিলাম, এর মধ্যেই লক্ষ্য করি তার চাহিদাপত্রে চৌকাঠ বইটিও স্থান পেয়েছে। নিবৃত্ত করি তাকে। গতকাল কালবৈশাখীর প্রতাপে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিলো। আইপিএস এর আলোকে সদ্ব্যবহার করতে চৌকাঠ বেছে নিই।
যে কোনো বই পড়ার সময় প্রত্যাশা থাকে খুবই সরল- লেখকের চিন্তাপ্রক্রিয়া এবং চিন্তাকৌশলে পরাস্ত হবো অথবা তাকে চ্যালেঞ্জ জানাবো। যদি প্রক্রিয়া আর কৌশল রিফ্লেক্টিভ এবং রিপ্রোডাক্টিভ লাগে সেই বইয়ের পেছনে সময় খরচ করে ছত্রভঙ্গ অনুভূতি হয়।
কিন্তু বিস্ময়কর হলেও, চৌকাঠ নিয়ে আমি কোনো প্রত্যাশাই রাখিনি, বরং রিফ্লেক্টিভ এবং রিপ্রোডাক্টিভ এর ব্যাপারটি অনুমিত ছিলোই। কী পড়বো এর চাইতে কী পড়বো না, সেই ভাবনাটি বরাবরই প্রাধান্য পায়। চৌকাঠ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলবো। সময় খরচ করে প্রাপ্তি জুটবে না জেনেও নির্বিচারে সময়কে অনুদান হিসেবে দেয়া।
চৌকাঠের লেখক, ধরা যাক, রেবেকা খাতুন, তবে কি এই বই শেষ করা হতো? অবশ্যই নয়। কিছুদূর পড়লেই বোঝা যায়, ২০১৮ সালে প্রকাশিত হলেও বইয়ের লেখক বসবাস করছেন ৯০ এর দশকে, এবং চরিত্রগুলো যেন হুমায়ূন আহমেদের বিটিভি যুগের নাটকের স্মৃতি বহন করছে।
বিপত্মীক প্রৌঢ়, বাড়িতে আশ্রিত পরিবার, নিম্নবিত্ত সংসারে ভাই-বোনের খুনসুটি, অসৎ মানুষের মধ্যেও সুন্দর মন, মেধাবী ছাত্রের হঠাৎ হিমু হয়ে যাওয়া, বহু প্রকাশকের কাছে ধরনা দিয়ে ব্যর্থ হওয়া এবং শেষমেষ প্রকাশক পেয়ে যাওয়া; সেই বই বিক্রিও হওয়া, এবং শেষবেলায় এসে কাহিনীধারার বিপরীতে ক্লাইম্যান্স নিয়ে আসা- এই সবকিছুর সাথে আমরা অতি পরিচিত ২০-২৫ বছর আগে থেকেই।
এমনকি অন্তিম দৃশ্যে রহমত যখন ছুরি নিয়ে আসে এবং নোমান চৌধুরী মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত থাকে, তখনো আমরা নিশ্চিন্তে পড়ে যেতে পারি এই বিশ্বাসে রহমত যা- ই করুক ছুরি দিয়ে নোমান চৌধুরীকে মারবে না। এটাও হুমায়ূন আহমেদের নাটক থেকেই আমাদের গা- সওয়া হয়ে গেছে।
বইতে টেকনিকাল কিছু ভুল ছিলো বাংলা সিনেমা পর্যায়ের। বুয়েটের কোনো ছাত্র থার্ড ইয়ার পর্যন্ত সিজিপিএ ফোর রেখে ফোর্থ ইয়ারে এসে লেখক হওয়ার বাসনায় পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিবে, ক্যাম্পাস থেকে গায়েব হয়ে যাবে এটা খুবই অবিশ্বাস্য। নিজে বুয়েটিয়ান বলেই হয়তোবা ব্যাপারটাকে আরো গাঁজাখুরি লেগেছে। তবু হতেও তো পারে ধরে নিয়ে একে বেনিফিট অব ডাউট দিলাম, কিন্তু ৫ মাস ক্লাস মিস? বুয়েটে কি ৫ মাস ক্লাস হওয়ার সুযোগ থাকে? সেমিস্টার থাকে ১৩ অথবা ১৪ সপ্তাহের, এটা দিয়ে কি ৫ মাস পূরণ হয়? তাছাড়া ক্লাস টেস্ট, সেশনাল এগুলো কোথায় যাবে? এগুলোর একটাই জবাব হতে পারে- লেখক সেমিস্টারের বদলে ইয়ার সিস্টেম ধরে নিয়েছেন। এবং সিজিপিএ ফোর পাওয়া ছেলে অর্থাভাবে দুটো টিউশনি করছে এটার উপস্থাপন দেখে মনে হতে বাধ্য, লেখক কোচিং সেন্টারে এবং টিউশনির বাজারে বুয়েট ছাত্রদের ডিমান্ড-সাপ্লাই সম্বন্ধে অবগত নন মোটেই। এগুলোকেও নিছক গল্পের কারণে বেনিফিট অব ডাউট দেয়া যায়।
কিন্তু রহমতের বয়স নিয়ে একটা ঘাপলা আছে। সে অয়নের চাইতে বয়সে বড়ো। অয়নকে যদি ২৩+ ধরি, তার বয়স ৩৫+ হওয়ার কথা। অন্যদিকে সুমনা চৌধুরী মারা গেছেন ৫২ বছর বয়সে, নোমান চৌধুরীর সাথে তার যখন বিয়ে হয় তিনি ইতিমধ্যে মাস্টার্স শেষ করেছেন। তার মানে অবলীলায় বয়স ২৬-২৭। বিয়ের পরে তারা গ্রামে বেড়াতে গিয়ে এক চোর ধরেন, সেই চোরের স্ত্রী তখন গর্ভবতী, সেই সন্তানই রহমত।
অন্যদিকে রহমত বিয়ে করে ১৬ বছর বয়সে, দেড় বছর পরে তার সন্তানের জন্ম হয়, তার মানে ১৮ এর আশপাশেই সে সন্তানের পিতা। কিন্তু বইয়ের ঘটনাপ্রবাহে তার বয়স ১৮ এর অনেক বেশি।
বইতে লিনিয়া চরিত্রটি যখনই এসেছে পাঠক হাই তুলে ঘুমুতে গেছে এই ভাবনায়, এর সাথেই অয়নের কিছু একটা হবে, যতোই শ্রেণিব্যবধান থাকুক।।
বইয়ের শুরুতে দেয়া বইয়ের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। ক্লিশের উপরেই যার সমস্ত পটভূমি চর্চিত সেখানে শুরুর এই ঘোষণা কেবলই কি নাটুকেপনা, নাকি দেয়ার জন্য দেয়া তা সুস্পষ্ট হলো না। যেমন দুর্বোধ্য রয়ে গেলো, এই বই ৪র্থ বার মুদ্রিত হয়েছে সেই পরিসংখ্যানের ভিত্তি। তবে বেশিরভাগ পাঠকই নিছক গুলতেকিন খানের প্রতি কৌতূহলবশতই বইটি সংগ্রহ করেছেন?
আমি বরং প্রশ্নটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিই। গুলতেকিন খান যদি হুমায়ূন আহমেদের সন্তানের মা না হতেন তবে কি এরকম প্রেডিক্টেবল এবং একরৈখিক প্লটের উপন্যাসের জন্য কোনো প্রকাশক পেতেন? তীব্র আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলতে পারি, উত্তরটা ‘না’। কিংবা কতজন পাঠক তার বইটি সংগ্রহ করতেন যদি তার সাথে হুমায়ূন আহমেদ নামটি জড়িত না থাকতো? সংগ্রামী কত মানুষই তো লেখার চেষ্টা করেন, আমরা পড়ি ক’জনেরটা!
বিখ্যাত মানুষের সাথে জড়িয়ে পড়ার দুর্ভোগ এবং বিড়ম্বনা দুর্যোগের মতোই হয়ে যায় অনেক সময়। যে কারণে বাপ্পারাজ যখন নায়ক হয় তাকে নিয়ে আমরা বলতে শুনি রাজ্জাকের ছেলে না হলে ওকে এফডিসিতেই ঢুকতে দিতো না, কিংবা দিলদারের মতো কমেডিয়ান হতে হতো, কিংবা এতো বিখ্যাত এক নায়কের ছেলে, অথচ নিজে কী এমন করলো! রাজ্জাকের ছায়ায় ব্যক্তি বা নায়ক বাপ্পারাজের স্বতন্ত্র আইডেন্টিটি তৈরি হতে পারলো না জীবনভর, কারণে-অকারণে রাজ্জাক আসবেই। অভিষেক বচ্চন, রোহান গাভাস্কার এরাও সেই দলে। অন্যদিকে কলকাতার প্রসেনজিতকেও টানা যায়। খ্যাতিমান হওয়ার পরও লোকে বলে বাবা বিশ্বজিত নায়ক ছিলো, নায়ক হওয়াটা ছেলের নিয়তিই ছিলো!
আলাদা অস্তিত্বের জন্য বিখ্যাতদের পরিজনেরা কেবল হাপিত্যেশ করবে, কিন্তু মহীরূহের ছায়া থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না।
গুলতেকিন খান না লিখলে চৌকাঠ বইটির রিভিউ কি লিখতাম? হ্যাঁ হওয়ার সম্ভাবনা নায়িকা পপির নিজের ডাবিং নিজেই করার সম্ভাবনার বর্গমূলের সমানুপাতিক!