ইদানীং ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থানকে তুলনা করা হচ্ছে শ্রীলংকার সঙ্গে। অর্জুনা রানাতুঙ্গা, আরবিন্দ ডি সিলভা, রোশান মাহানামার সাথে তরুণ জয়াসুরিয়া, মুরালিধরন, চামিন্দা ভাস, আতাপাত্তু, কালুভিথুরানা এবং আরও পরে যোগ হওয়া মাহেলা জয়াবর্ধনে, সাঙ্গাকারা, দিলশান, মালিঙ্গা- এই সাপ্লাই চেইন প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত শ্রীলংকা দলটাকে একটা সমীহ জাগানিয়া পর্যায়ে আসীন রেখেছিল। বর্তমানে তারা একটা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
শ্রীলংকার ক্রিকেট নিয়ে শব্দ নির্মাণ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, পুরো লেখাটাই আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে লিখতে চাইছি। তবু গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে শ্রীলংকান ক্রিকেট এলো, কারণ এর সঙ্গে বেশ কিছু ব্যাপার জড়িত। যেমন, ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ক্রিকেটার, রাইজিং ক্রিকেটার, পাইপলাইন, ক্রিকেট কূটনীতি, ক্রিকেট সংস্কৃতি। একটামাত্র ফেসবুক স্ট্যাটাসে এতো ব্যাপক এরিয়া কভার করা দুষ্কর, তবু চেষ্টা করছি সব এরিয়াতেই কিঞ্চিৎ দৃষ্টিপাত করবার।
মাঠের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দল যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আন্ডারডগ এবং অকেশনাল জায়ান্ট কিলার (আরও স্পেসিফিক বললে ‘মিনোস’) হয়ে ছিলো এর প্রধান কারণ, আমি বলবো, একাদশে ইফেকটিভ এবং ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ক্রিকেটারের ঘাটতি। আকরাম, বুলবুল, নান্নু, আতহার বা দুর্জয়, অপি, বিদ্যুৎ, পাইলট- প্রত্যেক জেনারেশনেই দলে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ক্রিকেটার ছিলো, কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড এ তাদের ইফেকটিভ বলাটা একটু কঠিন। মূলত তাদের রোলটা ছিলো আজেকের তামীম, সাকিবদের জন্য গ্রাউন্ড প্রিপার করা, সেই রোল প্লেয়িংয়ে তারা হান্ড্রেড পারসেন্ট সফল।
কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টাতে শুরু করে ২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকে, যার দৃশ্যমানতা আমরা লক্ষ্য করছি ২০১২ এর এশিয়া কাপ থেকে। ২০১৪ সালটা বিস্মরণযোগ্য কাটলেও যে কোনো ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়ায় আপস এন্ড ডাউনস থাকবে, এটা সেই নিয়মেরই প্রতিফলনমাত্র। তো এই ৯ বছরে আমরা একটা পুল অব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল এন্ড ইফেকটিভ প্লেয়ার পেয়েছি, যারা সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে, নিজেদের আইডেন্টিটি ক্রিয়েট করেছে।এই সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়, পাঁচ, প্রথম আলো যাদের নাম দিয়েছে পঞ্চপাণ্ডব। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তামীম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান এবং মাশরাফি মর্তুজা।
আমার লেখাটা আসলে মাত্র শুরু হলো, এতোক্ষণ যা লিখেছি তা ট্রেইলার। উল্লিখিত ৫ জন ক্রিকেটারের পারসোনালিটি প্রোফাইল এবং ক্রিকেটিং মেরিট সম্পর্কে আমার নিজস্ব মূল্যায়ন উল্লেখ করতে চাই প্রথমে।
শুরু করছি মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে দিয়ে। আমি মনে করি, মাহমুদুল্লাহ বাংলাদেশ ক্রিকেটের নেক্সট গার্ডিয়ান ফিগার হতে যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে। তিনি ইন্ট্রোভার্ট, তিনি ন্যাচারাল লিডার না, তার নেতৃত্ব সিনিয়র ক্রিকেটাররা ভালোভাবে নাও নিতে পারে- এরকম একটা শঙ্কা আমার ছিলো। কিন্তু গত বিপিএল আসরে বরিশাল বুলস এর পক্ষে তার নেতৃত্বগুণ এবং দলকে স্পিরিটেড রাখার যে নমুনা দেখা গেছে, তাতে আমি অন্তত কনভিন্সড যে আমার শংকা অমূলক ছিলো। মাহমুদ উল্লাহর এস্টাব্লিশমেন্ট প্রসেসটা খুবই ইনস্পাইরিং, যার সাথে অধিকাংশ সফল মানুষের গল্প মেলে। তিনি প্রথম যখন দলে আসেন তার রোল ছিলো ব্যাটিং জানা অফস্পিনার। টেস্টে তার ৫ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে। দুর্জয়, ফাহিম মুনতাসীর সুমিত এর পর বাংলাদেশ একজন জেনুইন অফস্পিনার পেল- তার অন্তর্ভু্ক্তির পর প্রথম আলোতে এটাই ছিলো রিপোর্টের সারবস্তু। পরবর্তীতে জাতীয় লীগে টানা তিন সেঞ্চুরি করা, টেস্টে আট নম্বরে নিয়মিত রান করতে করতে সুনীল গাভাস্কার কর্তৃক বেস্ট নাম্বার এইট ব্যাটসম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড খেতাব পাওয়া তার ক্যারিয়ারের মোমেন্টাম চেঞ্জ করতে ভূমিকা রাখে; নির্ভেজাল অফস্পিনার থেকে তিনি হয়ে উঠতে থাকেন নির্ভরযোগ্য লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান। তিনি ওয়ানডেতেও সুযোগ পান, কিন্তু নাঈম ইসলাম (ওরফে ছক্কা নাঈম) তার তুলনায় বেশি গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করে। তিনি স্লো, তাঁর ফিল্ডিং-ফিটনেস বাজে, প্রচুর বল নষ্ট করেন এসবই ছিলো দর্শকের কমন অভিযোগ। এক পর্যায়ে মুশফিকের সাথে আত্মীয়তাসূত্রে ফেসবুকে তার নাম ভাইরাল হয় ‘ভায়রা ভাই’। এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে যখন বাংলাদেশ হেরে গেল তিনি ক্রিজে ছিলেন, সে কারণে তিনি ভিলেন, এরপর এবছর ভারতের কাছে টি-টোয়েন্টিতে যখন হেরে গেলাম আমরা, সেখানেও তিনি ভিলেন। অথচ, এটা মনে নেই, ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬০ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলার পরও যে আমরা জিতলাম সেখানে তিনি ছিলেন, পরের বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডকে নক আউট করে দেয়ার যুদ্ধটা তার সেঞ্চুরি দিয়েই শুরু হয়েছিল। কিন্তু মানুষ মনে রেখেছে শফিউলকে, রুবেলের সেই দুটো আগুন ডেলিভারিকে। এজন্যই মাহমুদউল্লাহ এক ট্রাজেডি হিরোর নাম। তিনি তামীমের মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান নন, তার সীমাবদ্ধতা প্রচুর। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙ্গেছেন তিনি। এখন তিনি অবলীলায় স্লগ করতে পারেন, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র তার ব্যাটিংয়েই আছে ইনিংস বিল্ড আপ প্রসেস। তার ওয়াগন হুইলে প্রচুর সিঙ্গেলস থাকে, গ্যাপ বের করে রান নেয়ার প্রবণতা থাকে; এটাই ইন্টেলিজেন্ট ক্রিকেট। অস্ট্রেলিয়া দলে ডেমিয়েন মার্টিন নামে একজন ব্যাটসম্যান ছিলো; মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংয়ের সঙ্গে আমি সেই মার্টিনের মিল পাই। একদার লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান মাহমুদ উল্লাহ এখন দলের অন্যতম ব্যাটিং ভরসা।এই যে চেঞ্জ, এটা একদিনে হয়নি। তিলে তিলে পরিশ্রম করে এই পজিশন তাকে এচিভ করে নিতে হয়েছে। এখানেই অধিকাংশ মানুষের ইনস্পাইরেশন খুঁজে নেয়ার স্কোপ, কিন্তু দর্শকমহলে তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস কম, কারণ তার রোলটা অধিকাংশ সময়ই আড়ালে চলে যায়; নিয়তির দিক থেকে তিনি ভারতের রাহুল দ্রাবিড়ের কাছাকাছি। তবে ক্রিকেট বোদ্ধারা ঠিকই তাকে মূল্যায়ন করে, বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে যে কোনো এক্সপার্ট এনালাইসিসে তাঁর কথা থাকে। কোনো একটা পারটিকুলার ম্যাচে ৫০ বলে ৯০ টাইপ একটা ইনিংস খেললে এবং সেই ম্যাচটা যদি বাংলাদেশ বাজে অবস্থা থেকে জিতে যায় তাহলে হয়তোবা একজন আনসাং হিরো মাহমুদউল্লাহ হয়ে উঠতে পারেন আশরাফুল বা সাকিবের মতো রূপকথার নায়ক। আগামী ৫ বছরের মধ্যে এরকম একটা ম্যাচের অপেক্ষায় রইলাম।
এবার আসি তামীম ইকবাল প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে এযাবৎকালের সবচাইতে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান কে, এই প্রশ্নে আবেগী মানুষ বলবে আশরাফুল কিংবা অলক কাপালীর কথা। কিন্তু যে প্রতিভা ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে রূপ পায় না, সেই সাময়িক আলোর ঝলককে আমি গ্রেটার পরিসরে বা ইমপ্যাক্ট প্রশ্নে পিছিয়ে রাখারই পক্ষপাতী। তামীমের সাথে বাকি ব্যাটসম্যানদের এখানেই পার্থক্য। ক্যারিয়ার শেষে কোথায় থামবেন সেটা বলার চাইতে কোথায় থামতে পারতেন এই আক্ষেপটাই বরং বেশি বাড়ে তার কথা ভাবতে গেলে। তার সমসাময়িককালে ক্যারিয়ার শুরু করা বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, কিংবা তার অনেক পরে শুরু করা জো-রুটদের খেলা ম্যাচসংখ্যা দেখলেই এই আক্ষেপটা ক্ষোভে রূপ নেয়। এমনকি জিম্বাবুইয়েও বছরে বাংলাদেশের চাইতে বেশি ম্যাচ খেলে। সেখানে একটা সিরিজ খেলার পর আরেকটা সিরিজ আসতে আসতে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের গড় বয়স বেড়ে যায় অনেকটাই। ক্রিকেট বাজার প্রশ্নে ভারতের পর সবচাইতে সম্ভাবনাময় বাজার হতে পারে বাংলাদেশে, স্পন্সর, ক্রেজ কোনোকিছুর কমতি নেই, তবু ক্রিকেট প্রশাসকরা একটা ট্যুর ম্যানেজ করতে পারে না। এফটিপির অপেক্ষায় থাকতে হয়, নিজেরা টুর্নামেন্ট আয়োজন করবে সেটাও করে না; বেশিরভাগেরই মনোভাব বরং ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার এবং ব্যাংক-ব্যালান্স বাড়ানো। কিন্তু বেশি খেলা হওয়া মানে যে তাদের ব্যালান্স বাড়ারও সুযোগ তৈরি হওয়া এই সরল অংকটা বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসকরা কেন বুঝে না, নাকি বুঝেও হাঙ্গামায় যেতে চায় না, এটা একটা রহস্য। নাফিস ইকবাল যখন জাতীয় দলে খেলতেন তখন থেকেই শোনা যেত তার ছোট ভাই তার চাইতেও ভালো ব্যাটসম্যান, বড় বড় ছক্কা মারে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো সেই ম্যাচে জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে মারা ছক্কাতো অনেকদিনই তামীমের ট্রেডমার্ক হয়ে ছিলো।ক্যারিয়ারের প্রথম ৩-৪ বছর তার শট রেঞ্জ ছিলো খুবই লিমিটেড; স্পিন বল একদমই খেলতে পারতেন না, শর্ট বলে দুর্বল ছিলেন, লেগ সাইডে খেলতে পারতেন না। সেখান থেকে তামীম ইকবাল যেভাবে মোডিফাইড হয়েছেন তা অবিশ্বাস্য। তবে এখনো তার কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে দুর্বলতা দৃষ্টিকটু পর্যায়ের, সিঙ্গেলস বের করতে পারেন না সেভাবে, পাওয়ার প্লে শেষ হয়ে গেলে গ্যাপ বের করতে হাঁসফাঁস করেন, ৬০ এর ঘরে গেলেই কনসেনট্রেশন হারিয়ে ফেলেন। তবু আমি বলবো, কোয়ালিটির দিক থেকে বাংলাদেশের বাকি ব্যাটসম্যানদের তুলনায় তামীম অনেকদূর এগিয়ে। শুধু ব্যাটিং নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি যে একজন অসাধারণ বাউন্ডারি লাইন ফিল্ডার সেই প্রসঙ্গটি চাপা পড়ে যাচ্ছে। ‘তামীম ইকবাল ক্যাচেস’ এটা লিখে ইউটিউবে সার্চ দিলেই তামীমের স্টানিং সব ক্যাচের ভিডিও চলে আসবে। ২০১৩-১৪ সালটা যে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ স্ট্রাগল করলো এর অন্যতম কারণ ছিলো, এই সময়টা তামীমের ব্যাটে নিদারুণ রানখরা চলেছে। তামীম মানেই প্রতিপক্ষ বোলারদের বিপক্ষে ঔদ্ধত্য দেখানো। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত নতুন বলে পেস বোলিং খেলতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বুক কাপতো; মিরপুরের উইকেটে আকরাম খান এনটিনির বল খেলেছেন চেস্ট গার্ড পরে, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রাদেশিক দলের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ৫১ আর ৫৭ রানে অলআউট হওয়ার রেকর্ড আছে, ঘাসের উইকেটে ওপেন করার সাহস পাচ্ছিলেন না কেউ। সেই দেশের একজন ওপেনার পেস বোলার বোলিং রান আপ শুরু করে বল ডেলিভারি দেয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে স্ট্রাইক থেকে সরে যান সাইট স্ক্রিন এডজাস্ট করার কথা বলে, এই ঘটনা বহুবার দেখেছি আমরা। এটা একটা সাইকোলজিকাল লড়াই; বোলারের রিদম নষ্ট করার কৌশল, এটা নিয়ে বোলার ক্ষিপ্ত হয়েছে, বাক-বিতণ্ডা হয়েছে, কিন্তু তামীম ঘাড়ত্যাড়া মানুষের মতো বোলারের সাথে তর্ক করেছে, একটুও ছাড় দেয়নি। এই যে গাটস, এই যে এটিটুড- এটাই এগ্রেসিভ ক্রিকেট, দাদাগিরিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের সাহস দেখানো। তামীম ইকবাল এটা করে দেখিয়েছেন। তার এই এটিটুড অনেকেরই অপছন্দ, তার ঔদ্ধত্যের বহু দৃষ্টান্ত লাস্ট ৯ বছরে মিডিয়াতে এসেছে, ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু আমি বলবো, এই এটিটুডই তার এসেট; সে ব্যক্তিগত জীবনে কী এটা তার কাছের মানুষদের ব্যাপার, ক্রিকেট থেকে অবসর নিলে সেও আমাদের মতোই কোনো এক পেশাজীবীতে পরিণত হবে, পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ ফিরে তাকাবে না ১০ বছর পরে, আমরা তাকে মূল্যায়ন করি দেশের অবিসংবাদী ওপেনার হিসেবে, তার সাথে আমাদের যোগসূত্র ২২ গজ পিচ আর বাউন্ডারি ঘেরা মাঠ। ওইটুকু সীমানার মধ্যে হুংকার দেয়া মানে বাংলাদেশ আর ছোট নেই, আমাদের প্লেয়াররা এখন আর স্লেজিং শুনে মুখ লাল করে না, তারাও স্লেজিংয়ের জবাবে কড়া স্লেজিং করতে জানে। তামীমকে তাই অনুসরণ করার কিছু নাই থাকতে পারে, জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু তার এটিটুডটা অটুট থাকার দরকার আছে। তবে সবচাইতে কষ্টের বিষয়. তার মতো ক্রিকেটারকেও ‘চাচার জোরে খেলে’ টাইপ অসভ্য ও স্থূল মন্তব্য শুনতে হয় দিনের পর দিন, ‘তামীম ক্যালা পারে না’ হয়ে যায় ফেসবুকের অমোঘ বাণী। তামীমের আসলে কার কাছে কী প্রমাণের আছে এই সহজ বিষয়টা আমি এখনো বুঝি না। বাংলাদেশে এক কালে কাকের চাইতে কবি বেশি এরকম জনশ্রুতি ছিলো, এখন বোধহয় ডিমের চাইতে ক্রিকেটবোদ্ধা বেশি হয়ে গেছে।
মুশফিকুর রহিমের সাথে আমি ভিতু এবং ক্যালকুলেটিভ মধ্যবিত্ত বাঙালি চরিত্রের মিল পাই। তিনি যখন প্রথম দলে আসেন পাইলট তখনো খেলেন, ফলে একাদশে তার রোলটা ছিলো ব্যাটসম্যান হিসেবে। ইংল্যান্ড সফরের এক প্রস্তুতি ম্যাচে চমৎকার ব্যাটিং করে মিডিয়ার নজরে আসেন। এরপর ২০০৭ বিশ্বকাপে পাইলটকে সরিয়ে তাকে নেয়া হয় যখন, সবাই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। ভারতের বিপক্ষে জেতা ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করে সেই প্রতিবাদ ঠাণ্ডা করে দেন। মাঝে অফ ফর্মের কারণে ধীমান ঘোষের কাছে জায়গা হারান। আইসিএল বিস্ফোরণে ধীমান হারিয়ে গেলে তিনি পুনরায় ফেরত আসেন, ব্যাটিংয়ে প্রভূত উন্নতি করেন। কিন্তু তার কিপিং নিয়ে কখনোই সমালোচনা বন্ধ হয়নি। এই সমালোচনার দায় তার নিজেরই। আন্তর্জাতিক মানের একজন কিপারের কাছ থেকে একটা দল যতটুকু পারফরম্যান্স আশা করে সেই স্ট্যান্ডার্ড থেকে তিনি অনেকটাই পিছিয়ে। তার ডিসমিসাল স্ট্যাটিসটিক্স দিয়ে হয়তো অনেকেই বুঝাতে চাইবেন তিনি ভালো কিপার। কিন্তু ম্যাচের পর ম্যাচ কতগুলো ক্যাচ ড্রপ করেছেন, স্ট্যাম্পিং মিস করেছেন, বাই রান দিয়েছেন- সেগুলো স্ট্যাটিসটিক্স এ লেখা থাকে না। অনেক বেশি ম্যাচ খেললে রেগুলেশন ক্যাচ, রেগুলেশন স্ট্যাম্পিং এগুলো দিয়ে একজন কিপারের ডিসমিসাল সংখ্যা বাড়তেই পারে, কিন্তু টেকনিকালি তিনি কতটা স্কিলড কিপার সেটাই মূল বিবেচ্য। তাকে কিপিং ছাড়ার জন্য নির্বাচক, বোর্ড সভাপতি, ক্রীড়া সাংবাদিক- প্রায় সবাই অনুরোধ করেছে, অনেকটা জোর করেই টেস্টে লিটন দাসকে দিয়ে কিপিং করানো হয়েছে ১টা সিরিজে, তবু তিনি অনড়। তার একটাই কথা, আমি আগে কিপার, পরে ব্যাটসম্যান। এই যে গোয়ার্তুমি এর নেপথ্য কারণ সম্ভবত পজিশন হারানোর ভয়। কিপিং ছাড়লে পিওর ব্যাটসম্যান হিসেবেও যে অনায়াসে দলে টিকে থাকতে পারবেন এই কনফিডেন্স এর অভাব আছে তার। অথচ টেকনিকালি তিনি দলের বেস্ট ব্যাটসম্যান। এই কনফিডেন্সহীনতার কারণে এতোবছরেও তার সুনির্দিষ্ট ব্যাটিং পজিশন নেই। কখনো ৪, কখনো ৫, কখনোবা ৬এও ব্যাট করেছেন। টেল এন্ডারদের সাথে ব্যাট করলে বেশিরভাগ সময়ই নন-স্ট্রাইকে থাকার চেষ্টা করেন যাতে আউট না হন। এই রক্ষণাত্মক মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় তার ফিল্ড প্লেসিং এবং বোলার রোটেশনের ক্ষেত্রেও; অনেকটাই মুখস্থ ক্যাপ্টেন্সি। অথচ এই দলে প্র্যাকটিসে সবচাইতে বেশি সময় দেয়া ক্রিকেটারের নাম মুশফিক। তবু তিনি ভরসা পান না; যদি বাদ পড়ে যান! অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাঙালি এই ইনসিকিউরিটি ফিলিংয়ে ভুগে জীবন পার করে দেয়, কখন কোন্ বিপদ আসে! কনফিডেন্সহীনতা থেকে বের হতে না পারলে রাইজিং স্টাররা যে সত্যিই নির্দিষ্ট সময়ের আগে তাকে দলচ্যুত করবে একথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। বনের নয়, মনের বাঘই মানুষকে গ্রাস করে আসলে।
সাকিবের প্রসঙ্গে সবচাইতে কম কথা লিখবো। লাস্ট ৮ বছরের পেপার, ক্রিকইনফো, গুগল আর্টিকেল রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে দিয়ে রাখলাম, যার ইচ্ছা সেগুলো নিয়ে স্টাডি করে সাকিবকে নিয়ে বেশ কয়েকটা গবেষণাগ্রন্থ লিখতে পারে। তাকে নিয়ে বই একটা লেখা হয়েছে সত্যি, কিন্তু তার মাপের ক্রিকেটারের জন্য বইয়ের কনটেন্ট যতটা সমৃদ্ধ হওয়া উচিত ছিলো, আমি মনে করি সেই বইটা তার কণামাত্রও ধারণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রোসপেক্ট বুঝতে হলে সাকিব আল হাসানকে বুঝতে হবে, শুধু বুঝলেই চলবে না সেটা অন্তঃপ্রাণে স্বীকার করে নিতে হবে। ভারতের ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকার যে পর্যায়ের লিজেন্ড, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিবের ইনফ্লুয়েন্স এবং ইমপ্যাক্ট তার চাইতেও বহুলাংশে বেশি। এটা শুধু মাঠের ক্রিকেটে নয়, ক্রিকেটকে একটা সম্মানজনক পেশা এবং পটেনশিয়াল মার্কেট হিসেবে এস্টাব্লিশ করার ৯০% ক্রেডিটই তার প্রাপ্য। একটা পয়েন্টেই শুধু লিখবো, যেটা সচরাচর লেখা হয়নি। মানুষের বুদ্ধি আর ইচ্ছা থাকলে যে মেধা, ট্যালেন্ট তেমন একটা না থাকলেও চলে- এই শিক্ষাটা সাকিবের লাইফস্টোরি থেকে শেখার আছে। সাকিব যখন দলে আসেন, তার রোল ছিলো ব্যাটসম্যান যে বোলিং জানে। রফিক, রাজ্জাকের আড়ালে তিনি ছিলেন তৃতীয় বাঁহাতি স্পিনার। সেসময় ব্যাটিংয়ে স্কুপ খেলতেন, ইমপ্রোভাইজিং শট খেলতেন ঠিকই, কিন্তু কোনো ব্যাটিং কোচই তার ব্যাটিং অনুসরণ করার পরামর্শ দেবেন না কোনো ইয়ংস্টারকে, এতোটাই স্টাইললেস তার ব্যাটিং। বোলিংয়েও এমন কোনো ভ্যারিয়েশন বা ক্যারিশমা নেই, কিন্তু বছরের পর বছর তিনি ব্যাট-বল দিয়ে পারফরম করে যাচ্ছেন। এখানেই কনফিডেন্স আর বুদ্ধির ব্যাপারটা চলে আসে। তিনি নিজের লিমিটেশন জানেন, কিন্তু জাস্ট কনফিডেন্সের জোরে তিনি সেসবকে অতিক্রম করে গেছেন; বিশ্বজুড়ে টি২০ লীগ খেলে বেড়ান সেই বোলিংয়ের কারণেই। তার ব্যক্তিগত আচরণের কারণে আপনি তাকে অপছন্দ করতেও পারেন, কিন্তু মাঠের ভেতরে কখনো ঢিলেমি করতে দেখতে পাবেন না, তার ক্রিকেট প্রজ্ঞাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। ‘আমার কাছে ১ রানে হার আর ১০০ রানে হারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই’- এমন কথা যিনি বলতে পারেন আবেগী দর্শক তাকে ঘৃণা করতে পারে, কিন্তু নিছক ক্রিকেটীয় গ্রাউন্ডে এর চাইতে সত্যি কথা দ্বিতীয়টি নেই। আমাদের সৌভাগ্য সাকিব বাংলাদেশী, সাকিবের দুর্ভাগ্য তিনি বাংলাদেশী। তার ব্যাপারে আর কিছু বলার নেই।
এই লেখাটা আমি শেষ করবো মাশরাফিকে দিয়ে। ইতোপূর্বে আমি ৩-৪টা পোস্ট লিখেছি যার প্রেক্ষিতে অনেকেরই ধারণা তৈরি হয়েছে আমি বোধহয় মাশরাফি বিদ্বেষী একজন মানুষ। আমাদের এক্সিসটিং সোসাইটিতে ট্যাগিং খুবই সহজ একটা ব্যাপার। যেমন, কেউ ব্রাজিল সাপোর্ট করা মানে সে আর্জেন্টিনা বিদ্বেষী, রোনাল্ডোর ভক্ত মানে মেসি তার শত্রু; একজন মানুষ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই দলকেই সমর্থন করতে পারে, মেসি-রোনাল্ডো দুজনের খেলাতেই মুগ্ধ হতে পারে এই মডারেট দৃষ্টিভঙ্গিকে আমাদের এখানে দেখা হয় সুবিধাবাদী মানসিকতা হিসেবে। এজন্যই ট্যাগিং এতো সহজলভ্য।
মাশরাফির টপিকে যাওয়ার পূর্বে রাইজিং ক্রিকেটার এবং পাইপলাইন প্রসঙ্গে কিছু লিখতে চাই। আগামী ৪ বছর আমার নজর সবচাইতে বেশি থাকবে সাব্বির রহমানের ওপর। একজন ক্রিকেটার কমপক্ষে ১০০ ম্যাচ আর তিন বছর পারফরম না করলে সেই ক্রিকেটারকে মূল্যায়নের পক্ষে নই আমি, বা তাকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু দেখি না। সাব্বিরকে আমি দেখছি এশিয়ান গেমস এ বাংলাদেশ আফগানিস্তানকে হারিয়ে যেবার সোনা জিতলো তখন থেকে। প্রথম বিপিএল আসরেও তার ব্যাটিং ভালো লেগেছিল। ক্লিন হিটার, অথচ প্রোপার ক্রিকেটিং শট, কোনো স্লগিং নয়। গত বিশ্বকাপের আগে সে দলে আসে, ৬-৭ নম্বরে মোটামুটি ভালোই ব্যাটিং করছিলো, কিন্তু আমি চাইছিলাম তাকে ৩ এ উঠিয়ে আনা হোক, কারণ হাবিবুল বাশার যাওয়ার পর লাস্ট ৮-৯ বছরে ৩ নম্বরে কোনো কনসিসটেন্ট ব্যাটসম্যান নেই, অথচ এটাই সবচাইতে ক্রুশাল পজিশন। অবশেষে শ্রীলংকার বিপক্ষে টি২০ তে ৮০ করার পর ওয়ানডাউনে তার উঠে আসার পথটা সুগম হয়। ইনকামিং বলে দুর্বলতা আছে, এগেইনস্ট দ্য স্পিন স্লগ করে মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে আউট হন- এই দুটো ব্যাপার ছাড়া তার ব্যাটিং দেখা পুরোটাই এন্টারটেইনমেন্ট। মাঠের বাইরের উশৃঙ্খল জীবন পেয়ে না বসলে, টেপ টেনিস বল এ খ্যাপ খেলা কমালে, সেলিব্রিটি লীগের গ্ল্যামারে মাথা ঘুরিয়ে না ফেললে এই ছেলে ৪ বছর পর ওয়ানডে টিমের অধিনায়ক হবে একথা আজই লিখে দিতে পারি। তার ফিটনেস আর ফিল্ডিং পুরো অস্ট্রেলিয়া স্ট্যান্ডার্ডের, নিয়মিত রিভার্স সুইপ খেলেন, তার স্টাইল অনেকটাই গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মতো, কিন্তু আমি চাই সে পন্টিং হোক। সেই পটেনশিয়ালিটি তার আছে, কিন্তু অল্পবয়সের স্টারডম হ্যান্ডল করার জন্য যে মেন্টাল স্মার্টনেস দরকার, সেটার অভাবে তার পরিণতিও নাসিরের মতো হয় কি না এটা নিয়ে একটা প্রকাশ্য সংশয় রয়েই যাচ্ছে। নাসিরের ব্যাপারে আমি কখনোই আশাবাদী ছিলাম না, তার ব্যাটিং সেরকম পছন্দও করতাম না, কিন্তু ফিল্ডিং আর বোলিং ইফেকটিভ যথেষ্ট। এখন যারা খেলছে, তাদের মধ্যে তাসকিনকে প্রমিজিং মনে হয়। একটু ইনজুরিপ্রবণ, কিছুটা খরুচে, কিন্তু উইকেট টেকিং এবিলিটির কারণে তার মধ্যে একজন স্ট্রাইক বোলারের লক্ষণ ভালোমতোই প্রতীয়মান। মোস্তাফিজকে নিয়ে সবাই উচ্ছ্বসিত। তার যৌক্তিক কারণও আছে, কিন্তু ১ বছরের মধ্যে দুবার ইনজুরিতে পড়া তার ক্যারিয়ারের স্থায়িত্ব বিষয়ে আমাকে কিছুটা সংশয়ী করেছে। সে হয়তোবা সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। দেখা যাক।
এর বাইরে তেমন কোনো ক্রিকেটার নেই যার কথা খুব শোনা যাচ্ছে। মেহেদী মিরাজ, পিনাক ঘোষ, সাইফুদ্দিন এদের নাম অল্পস্বল্প আলোচিত হলেও আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি এখনো। মোসাদ্দেকের ফার্স্ট ক্লাস এভারেজ ঈর্ষণীয়, কিন্তু ওয়ানডেতে তার ব্যাটিং যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হয়েছে শট রেঞ্জ লিমিটেড (অবশ্য খেলছে ৭-৮ নম্বরে, ৪-৫ এ উঠে এলে তারপর বুঝা যাবে, এজন্য সময় লাগবে)। তাই শুধুমাত্র ঘরোয়া এভারেজ দেখে তার ব্যাপারে পজিটিভ হওয়ার সুযোগ কম। অপেক্ষা করতে হবে, দেখতে হবে আরও বেশ কয়েকটা সিরিজ।
এর বাইরে পাইপলাইনে উল্লেখযোগ্য ক্রিকেটার নেই। তামীম, সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ এরা প্রায় একই সময়ে ক্রিকেট ছাড়বে (যেহেতু সমবয়সী)। তাদের ব্যটনটা ধরার মতো লোক না তৈরি হলে বাংলাদেশ ক্রিকেটও শ্রীলংকার ক্রাইসিসে পড়বে। তারা তবু ২০ বছর টিকে ছিলো, আমরা সংকটে পড়বো ৮-১০ বছরের মধ্যেই। এটা মোটেই পজিটিভ লক্ষণ নয়। ক্রিকেট কর্তারা এ নিয়ে কিছু কি ভাবছেন? আপনাদের পাইপলাইন রেডি তো?
শেষপ্রান্তে চলে এসেছি, এবার মাশরাফি সমাচার। মাশরাফি সম্পর্কে আমি আমার ক্রিকেট বিষয়ক বই ‘বেনিফিট অব ডাউট’ এ সুস্পষ্টভাবে লিখেছি। তবু এখানে লিখতে হচ্ছে, কারণ মাশরাফির পারসোনালিটি টাইপ। ৮ বছর পরে মাশরাফি ওয়ানডেতে ৪ উইকেট পেয়েছেন, ম্যান অফ দ্য ম্যাচও হয়েছেন প্রায় ৭-৮ বছর পরই। কাজেই শুধু ক্রিকেটিয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এক্সিলেন্ট পারফরম্যান্স করেছেন এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। ২০০১ এ যে এগ্রেসিভ স্ট্রাইক বোলার মাশরাফির অভিষেক হয়েছিল ইনজুরির কারণে সেই আগ্রাসন আমরা ভালোমতো দেখার সুযোগই পাইনি, ২০০৭ পর্যন্ত তবু কিছুটা টেনে গেছেন, এরপরই তিনি স্ট্রাইক বোলারের জায়গা থেকে সরে গেছেন। তার রোল হয়েছে ইফেকটিভ বোলারের, ২০১২ সালের পরে অনেকটা স্টক বোলারের। ম্যাচের খুব টানটান উত্তেজনা, উইকেট লাগবে, তখন বোলিং দিতে হচ্ছে রুবেল, তাসকিন অথবা আলআমিনকে। কিংবা ৬ বলে ১০ রান দরকার, ডট দিতে হবে, তখন বল করছেন সাকিব কিংবা অন্য কেউ। মাশরাফি বোলিং করছেন, উইকেটও পাচ্ছেন মাঝেমধ্যেই, কিন্তু মাশরাফি বলতে ২০০৭ পর্যন্ত যে বোলারটিকে বুঝতাম আমরা, এই মাশরাফি তেমনটি নন। অবশ্য, ক্যারিয়ারে সবারই রোল চেঞ্জ হয়, সায়াহ্নে এসে প্রায় সব ফাস্ট বোলারই এরকম ইফেকটিভ হওয়ার চেষ্টা করে। শন পোলক, চামিন্দা ভাস, ওয়াসিম আকরাম তাদের শেষের দিকে যেরকম রোলপ্লে করেছেন ২০০৮ এর ইনজুরি থেকে ফেরার পরও মাশরাফির রোলটা অনুরূপ হয়ে গেছে। তাই ক্রিকেটার মাশরাফিকে আমি এক বাক্যে আক্ষেপের গল্প হিসেবেই চালিয়ে দেবো, যিনি কী হয়েছেন তার চাইতে কী হতে পারতেন এটা নিয়েই বিচার-বিশ্লেষণ চলবে বেশি।
আমি বরং ফিলোসফার মাশরাফি, মানুষ মাশরাফির বিশাল ফ্যান। তার মতো ক্রিকেট insight আমি সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বেই খুব বেশি পাইনি। মার্টিন ক্রো, রিচি বেনো, টনি গ্রেগ এর ক্রিকেট ক্রিটিক এর অনুরাগী ছিলাম আমি। মাশরাফির ক্রিকেট পাঠ, জীবনের সাথে সেই ক্রিকেটকে সংমিশ্রিত করার গুণ তাদের চাইতেও শার্প মনে হয় আমার কাছে। আমি ক্রিকেট ফলো করি ১৯৯৬ সাল থেকে, কিন্তু এই ২০ বছরে তার মতো এমন স্মার্টলি মিডিয়া হ্যান্ডল করতে দেখেছি কেবলমাত্র মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। আমাদের দেশের মন্ত্রী যেখানে হিন্দিতে ইন্টারভিউ দেয় সেখানে তিনি হিন্দিতে প্রশ্ন করলে স্ট্রেইট বলে দেন ‘ইংলিশ প্লিজ’ এবং ইংরেজিতে প্রশ্ন না করা পর্যন্ত কোনো উত্তর দেন না; এই যে ডিটারমিনেশন একে স্যালুট না করে উপায় নেই। তিনি যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন, তাসকীন হয়তো তখন স্কুলেও যাওয়া শুরু করেনি, সেই অসমবয়সী খেলোয়াড়ের সাথেও বুক মিলিয়ে স্পেশাল সেলিব্রেশন করেন; এগুলো খুবই সিম্বলিক এবং তার মনের প্রসারতাকে ইন্ডিকেট করে। তার ইন্টারভিউগুলো পড়া মানে ফিলোসফির বই গড়গড় করে শেষ করে ফেলা। ‘আমরা তো নাটক-সিনেমাওয়ালাদের মতোই পারফরম করছি, টাকা পাচ্ছি। আমাদের মধ্যে কিসের দেশপ্রেম’ কিংবা ‘৩ কোটি লোকও ক্রিকেট দেখে কিনা সন্দেহ। এটা কীভাবে ষোল কোটির আবেগ হয়’ কিংবা ‘ক্রিকেটের পেছনে এতো বিপুল এনার্জি নষ্ট না করে সময়টা আরও গ্রেটার কাজে ব্যয় করুক, দেশ এগিয়ে যাবে’- এরকম অজস্র সিম্পল কিন্তু গভীর মিনিংফুল কথা তিনি অবলীলায় বলে ফেলেন। এই মানুষটিকে আপনি কীভাবে অশ্রদ্ধা করবেন। আমি ১৭ বছর ধরে প্রায় ২০০০ জন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, কিন্তু ২০১৪ সাল থেকেই আমি স্বপ্ন দেখছি একদিন মাশরাফির একটা ইন্টারভিউ নেব। আরেকজন মানুষ হলেন ডক্টর ইউনুস (তার ব্যাপারে এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই)। মাশরাফি দেখিয়েছেন কীভাবে ইনজুরিতে পড়েও মনের জোরে খেলা চালিয়ে যাওয়া যায়, তার দেখাদেখি অসংখ্য তরুণ এখন ফাস্ট বোলার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এতোবার ইনজুরিতে পড়া সত্ত্বেও এখনো ফিল্ডিংয়ের সময় নির্বিকারচিত্তে ডাইভ দেন। এই অদম্য উদ্যম একে অস্বীকার করি কোন্ উপায়ে! আমার ধারণা ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলেই তিনি অবসর নেবেন। সে হিসেবে আর খুব বেশি সময় হাতে নেই। তাকে নিয়ে লেখা বইসূত্রে জানতে পেরেছি, খেলা ছাড়লে রাজনীতিতে নামার ইচ্ছা আছে। সেক্ষেত্রে দুর্জয় বা আরিফ খান জয়ের মতো তিনিও হয়তোবা মন্ত্রী-এমপি কিছু একটা হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু আমি মনে করি রাজনীতির চাইতে ক্রিকেটে তার মেধা বেশি প্রয়োজন। ক্রিকেট ছাড়লেও ম্যানেজার বা মেন্টর হিসেবে তাকে যদি দলের সাথে রাখা হয় বা তিনি যদি ক্রিকেট মেন্টরিংকে একটা বিজনেস বা প্রফেশন হিসেবে নেন, সেখানেও তিনি বিশাল কন্ট্রিবিউট করতে পারবেন। ম্যানেজার হিসেবে জাতীয় দলের সাথে থাকলে পরবর্তী অধিনায়ক বা সিনিয়র খেলোয়াড়রা ইগোর দ্বন্দ্বে ভুগতে পারেন এরকম একটা শংকা আছে বইকি, কিন্তু খালেদ মাহমুদের মতো মানুষ যদি ম্যানেজার হতে পারেন, সেখানে মাশরাফি তো নিজেই এক বিশাল মহীরূহ। মাঠের মাশরাফিকে আমি খুব বেশি স্মরণে রাখবো না, কিন্তু মাশরাফি যদি হয় একটা কনসেপ্ট, একটা আইডিওলজি সেই মাশরাফিকে আমি আমার টোটাল ক্রিকেট জার্নিতেই টপলিস্ট এ রাখবো। মাশরাফি শ্যুড বি মাশরাফি ফরএভার।