গত ডিসেম্বরে একজন স্টোরিটেলারের সাথে আলাপ হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পরিণত হন আমার অন্যতম পছন্দের মানুষে৷ মাত্র ৪৫ বয়সেই তিনি একজন বিশুদ্ধ একাকী মানুষ, গত ৬ বছর ধরে এই ঢাকা শহরে তার জন্য অপেক্ষায় নেই কেউ। মা-বাবা-স্বামী পরলোকগত, দুই বোন থাকেন বিদেশে, একমাত্র পুত্রটিও ‘ও লেভেল’ দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে আমেরিকায়।
স্টোরিটেলার হিসেবে তিনি সফল, এবং বিত্তশালী৷ কিন্তু গল্পপ্রসঙ্গে প্রায়ই বলেন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হলে কেউ সাথে থাকার নেই, ঈদের দিন বাসায় রান্না হয় না, এমনকি মৃত্যুর পরে কে কবর দিবে তাও জানেন না। ছেলে খবর পেয়ে আসতে আসতে লাশ পঁচে দুর্গন্ধ বের হবে।
কাউকে পছন্দ হলে দত্তক নেয়াটা দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এতদিন পর্যন্ত সব দত্তকই মুখে মুখে। কিন্তু
আমি ব্যাপারটাকে যত ক্যাজুয়াল দৃষ্টিতে দেখি, দত্তক নেয়ার নিশ্চয়ই আইনগত নিয়মকানুন আছে।
স্টোরিটেলারের জীবনযাপন আমাকে এতটাই স্পর্শ করে সিদ্ধান্ত নিই তাকে অভিভাবক হিসেবে দত্তক নিব, এবং সেটা সিরিয়াসলি। হতে পারে বড় বোন, দাদী-নানী, খালা-ফুপু সহ যে কোনো গুরুজনস্থানীয় সম্বন্ধ৷ বড় বোন সম্পর্কটাই পছন্দ হয়।
ভাবনামতো বেশ কয়েকজন পরিচিত আইনজীবীর সাথে কথাও বলি অভিভাবক হিসেবে কাউকে দত্তক নেয়ার উপায় কী।
তাদের রেসপন্সে মুষড়ে পড়ি। দত্তক নেয়া যায় শুধুমাত্র শিশু সন্তান, এবং সেক্ষেত্রেও আইন অনেক কঠোর। এর বাইরে সকল ক্ষেত্রে দত্তক অনুপযোগী, অভিভাবক-বড় বোন এগুলোর প্রশ্নই তো আসে না।
তাদের একজন উলটো বলে বসে- ‘তুমি যদি তাকে অভিভাবক ভাবো বা সে তোমার পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয় সেটাই তো যথেষ্ট। কাগজপত্র দিয়ে দত্তক নিয়ে কী হবে’!
গুগলে দত্তক আইন নিয়ে পড়াশোনা করলাম, তার কথারই প্রতিধ্বনি।
প্রশ্ন জাগলো, পরিবার কি শুধু নাবালক শিশুরই প্রয়োজন? স্টোরিটেলার বুবুর মতো মানুষের সংখ্যা আগামীর পৃথিবীতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে; সেইসব বিশুদ্ধ একাকী মানুষের জীবনের সমীকরণে কি পরিবারের প্রয়োজন নেই; তাহলে আইনে সেই সুযোগ কোথায়?
উল্লিখিত সেই স্টোরিটেলারকে আমি অভিভাবক হিসেবে দত্তক নিতে চেয়েছিলাম স্রেফ দুটো কারণে : তার অসুস্থতায় হাসপাতালের ফরমালিটি পালন করতে গিয়ে যেন লিগাল প্রসিডিউরে আটকে না পড়ি, এবং আমার আগে যদি তার মৃত্যু হয় লাশ যেন হিমাগারে পড়ে না থাকে, নিজ উদ্যোগে দাফন করতে পারি।
প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে লাইফস্টাইল সংক্রান্ত ধারণা, পারিবারিক আইনেও আরো বেশি মানবিকতার সংযোগ না ঘটলে মানুষে মানুষে সম্পর্কগুলো নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলবে। আমি স্টোরিটেলার বুবুকে দাফন করতে গিয়ে যেন না শুনি কোন অধিকারে আপনি এটা করলেন, কার পারমিশন নিয়েছেন।
দত্তক বিষয়ক এত দীর্ঘ গল্পটা বললাম বাংলাদেশ জাতীয় দলের ব্যাটসম্যান লিটন দাসের প্রতি আমার অনুভূতির একটি ডাইমেনশন ব্যাখ্যা করতে।
কংক্রিট রিয়েলিটি ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে মানুষের কথা-কর্ম বা আচরণকে ব্যাখ্যা করতে গেলে বেশিরভাগ সময়ই সারফেস লেভেলের কিছু উপলব্ধির বাইরে কিছুই বোঝা যায় না, কারণ মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়ার চাইতে হেয়ালিপূর্ণ ম্যাটার পৃথিবীতে ২য় টি হয় না।
মানুষকে বুঝতে হয় সুররিয়ালিস্ট ফ্রেমওয়ার্কে। আদতে মানুষ এক সুররিয়ালিস্ট প্রাণী।
লিটন দাস বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবচাইতে ইনফর্ম ব্যাটসম্যান। তার ব্যাটিংশৈলীর কারণে দিন দিন তার ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে, বিদেশী ধারাভাষ্যকার, ক্রিকেট বিশ্লেষকরাও তাকে হাইরেট করে। বড় কোনো ইনজুরিতে ক্রিকেট খেলা বন্ধ না হলে আগামী বছর থেকে ২০২৭-২৮ পর্যন্ত লিটন দাসই যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টারবয় হতে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত।
এবং সঙ্গত কারণেই এসময়ে তার ভক্ত এবং নিন্দুক উভয়ই এক্সপোনেন্টশিয়ালি বাড়বে৷ তারপর ২০৩০ বা ৩১ এ বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোথাও আর নেই লিটন দাস, যেমন থাকবে না ২০২৪ থেকে এখনকার তারকারা। তারপর অখন্ড সাধারণ জীবন, অথচ বয়স তখনো ৪০ এর নিচে, জীবনের অর্ধেকটাই বাকি।
যদি সুস্থ্য থাকি আমি সেই সময়ের সাধারণ লিটন দাসকে ছোট ভাই অথবা পুত্র হিসেবে দত্তক নিব। পোস্টারবয় লিটনকে নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, কারণ তারকাদের জীবনচক্রের একটা স্টেরিওটাইপ টেম্পলেট থাকে, সেখানেই সবাইকে ফিট করে নেয়া যায়, কেবল নামগুলো থাকে আলাদা।
লিটনের সাথে আমার সংযোগের যে গল্প এটা খুবই ইউনিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১৭ তে স্থানীয় কিছু কোচ আর কয়েকজন টিমমেটের বাইরে কতজন তাকে মূল্যায়ন করত? সংখ্যাটা ৪১ এর কম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বরং সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের স্বীকার হওয়া, আন্ডার পারফরম্যান্সের কারণে অবিরাম ট্রল সহ্য করা নিশ্চয়ই বিশাল মানসিক যাতনার কারণ হত।
তখন থেকে এই তরুণকে পর্যবেক্ষণে রাখি, ক্রিকেটিয় সম্বল বলতে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে ৭ নম্বরে নেমে ৭০ রানের এক ইনিংস! কিন্তু সেই ব্যাটিংয়ে এমন কিছু পাই যা কোনোদিন কোনো ব্যাটসম্যানের খেলায় পাইনি।
আমার জীবনে টেন্ডুলকার এবং সাঈদ আনোয়ারের বিস্তর প্রভাব, বিশেষত টেন্ডুলকার। আমি হয়ত ক্রিকেটের প্রতি আকর্ষণই বোধ করতাম না যদি শৈশবে টেন্ডুলকারের ব্যাটিং আর ওয়াকার ইউনুস-শেন ওয়ার্নের বোলিংয়ে না মজতাম।
সালাহউদ্দিন শুভ্র নামের এক লেখক-সাংবাদিক কয়েক মাস পূর্বে ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছিলেন ক্রিকেট মূলত প্রতিভাহীনদের খেলা। তার স্ট্যাটাসের পরই বুঝেছিলাম পড়ুয়া প্রকৃতির অধিকাংশ মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়া শ্যালো হওয়ার কারণ কী হতে পারে৷ আমি ক্রিকেটকে যদি একটি টিম স্পোর্টস এর সিম্বল ধরি, চিন্তার চাঞ্চল্যের জন্য প্রতিটি মানুষের কোনো না কোনো টিম স্পোর্টস এ আগ্রহ থাকা উচিত৷ নইলে সাধারণ মানুষের জীবনে রাজনীতি এবং রাজনীতিহীনতার ধারাপাত সম্বন্ধে প্রাগম্যাটিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি কঠিন হবে। ক্রিকেট আমার জন্য চিন্তার সেই অক্সিজেন হয়েছিল নাবালক বয়সে, এবং তার বৃহদাংশের ক্রেডিট জমা হবে টেন্ডুলকারের একাউন্টেই।
টেন্ডুলকার চলে যাওয়ার পরে সেরকম কোনো ক্যারেক্টার পাচ্ছিলাম না যে আমাকে ক্রিকেটে নিবিষ্ট রাখতে পারে। শূন্যতা আর শূন্যতা।
ভেবেছিলাম বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানকে দিয়ে তা পূরণ করব। কিন্তু ব্যক্তি সাকিব আমার মধ্যে যতখানি কৌতূহল জাগায় ব্যাটসম্যান বা বোলার সাকিবের মধ্যে পাচ্ছি না সেটা৷ সাকিবকে নিয়ে প্রচুর কনটেন্ট লিখলাম ঠিকই, আমাদের মধ্যে আত্মিক যোগাযোগটা অনুভব করলাম না। ভিরাট কোহলিকেও খেয়াল করতে থাকি এর মধ্যে, তার মতো মেন্টালি টাফ ব্যাটসম্যান আমি কোনোদিন দেখিনি, কিন্তু প্রতিনিয়ত লোকজন তাকে যেভাবে টেন্ডুলকারের সাথে তুলনায় মেতে উঠেছিল, তার আর আমার মধ্যে বারবার চলে আসতে থাকে টেন্ডুলকার।
ফলে কোহলির স্বকীয় অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সে হয়ে থাকছিল সাব-টেন্ডুলকার।
অবশেষে ২০১৭ এর ওই ৭০ রান আমাকে চূড়ান্তভাবে eternal peace এর সন্ধান দেয়৷ আমি পাই এক ক্যারেক্টার, যার কারণে ক্রিকেটে প্রাণ পাই পুনরায়।
আমি কখনোই মনে করি না ব্যাটসম্যানশিপের প্রশ্নে লিটন দাস টেন্ডুলকারের পরে ৯৭ জনের মধ্যেও থাকার যোগ্য। ভারত, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া লীগেও লিটনের চাইতে অধিক স্কিলসেটের ব্যাটসম্যান পাওয়া যাবে অহরহ।
কিন্তু ব্যাট, ব্যাটসম্যান এবং বলের সংযোগে যে কম্পোজিশনটা তৈরি হয়, সেই কনটেক্সট থেকে দেখলে লিটনের সাথে তুলনাযোগ্য এমনকি টেন্ডুলকারও নয়। ফেসবুকে এধরনের লাইন লেখা বিপজ্জনক, ভুল ইন্টারপ্রেটেশনের ঝুঁকি থেকে যায়। তবু যেটা সত্য বলে মানি সেটা ফেসবুকেও সত্য, নেপচুন-প্লুটো গ্রহেও সত্য।
তবে আমার বিশাল সার্কেলে ক্রিকেট যারা দেখত প্রত্যেকে ছিল লিটনের প্রতি নাখোশ। তাদের কাছে সে লেগসাইড নির্ভর প্লেয়ার, ঘরোয়া লীগ লিজেন্ড, আরেকজন তুষার ইমরান। লণ্ঠন দাস, লটকনা দাস, লটরফটর দাস– আরো কত নামে তাকে ডাকে সবাই। আর মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর ব্যাচেলর ফিল্মসূত্রে ‘লিটনের ফ্ল্যাট’ ফ্রেজিংটা তো ইতোমধ্যেই অশালীনতার এক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশের খেলা থাকলে লিটন দাস আউট হওয়ামাত্র ৮-১০ জনের একটা গ্রুপ মেসেজ বা ফোন দিয়ে বলতো দেখেন লিটন সেঞ্চুরি করে ফেলেছে।
দমে যেতাম না।
উপরন্তু নানাধরনের বাজি ধরতাম লিটনের পারফরম্যান্স নিয়ে৷ বেশিরভাগ সময়ই হারতাম।
সাংবাদিক যাদের চিনতাম তারা দুটো কথা বলতো লিটনের ব্যাপারে-
* অতিরিক্ত ইন্ট্রোভার্ট, টিমমেটদের সাথেও কথা বলে না ঠিকমতো। মাশরাফি অত্যধিক পছন্দ করে বলে টিমে সুযোগ পায়।
*অলস প্রকৃতির। রুটিন প্র্যাক্টিসের বাইরে কোনোরকম বাড়তি এফোর্ট দেয় না। দল থেকে বাদ পড়া নিয়েও টেনশন নেই, ঘরোয়া খেলে কাটিয়ে দিবে– এমন নির্বিকার মানসিকতার। তবে সাব্বির বা নাসিরের মতো উশৃংখলও নয়। একজনের সাথেই রিলেশন, এবং বেশ সিনসিয়ার তার ব্যাপারে। বাজে নেশা নেই।
কিন্তু যে ব্যাটিংয়ের কারণে লিটনের প্রতি আগ্রহ সেটাই বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ মিলছিল না। বেশিরভাগ ইনিংসেই অল্প সময়ের মধ্যে প্যাভিলিয়নমুখী হয়। পুনরায় ব্যাটিং উপভোগের সুযোগ পাই এক টি২০ ম্যাচে, উইন্ডিজের বিপক্ষে ৩২ বলে তোলে ৬১, ম্যাচটা ছিল ভোরের দিকে।
এতটাই আনন্দিত হই, অফিসে গিয়ে দুই জুনিয়রকে লাঞ্চ করাই।
সেই যে শুরু, এরপর যখনই লিটনের ব্যাটিং বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ পেয়েছি কাউকে না কাউকে খাইয়েছি।
তার কিছুদিন পরই এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে সেই ১২১, এবং লিটনকে নিয়ে অনলাইনে দীর্ঘতম আর্টিকেল লেখা। সেটা উদযাপন করেছিলাম ১ সিএনজিওয়ালা এবং চা বিক্রেতাকে ডাব খাইয়ে। নিন্দুক গ্রুপের ৩ জন অবশ্য স্যরি লিখে মেসেজও পাঠিয়েছিল।
এরপরই কাহিনীতে নতুন মোচড়।
একজনের সাথে বাজি ধরি লিটন এখন প্রতি ৩ ইনিংস পর একটা অন্তত ৪১+ ইনিংস খেলবে। হেরে যাই যথারীতি।
কিন্তু লিটনের ব্যাটিং মিস করি না ১টি বলও৷
টেন্ডুলকারের ব্যাটিং দেখতে ঝামেলা ছিল না তেমন। ছাত্র ছিলাম, ক্লাস মিস দিলেই হয়ে যেত। লিটন যতদিনে এসেছে ততদিনে আমার ক্যারিয়ারের বয়স ৮ বছর হয়ে গেছে। অখণ্ড অবসর আর নেই। কিন্তু অফিসে থাকাকালেও নিচে চায়ের দোকানে গিয়ে দেখেছি, গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকলে মোবাইলের স্ক্রিনে দেখেছি। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ব্যক্তির ইন্টারভিউ নেয়ার সময় অপমানিতও হয়েছি, কারণ ইন্টারভিউ নেয়ার সময় তার মুখের দিকে না তাকিয়ে মোবাইলের ছোট স্ক্রিনে দেখছি লিটনের ব্যাটিং, এটা তাদের জন্য অপমানজনক মনে হয়েছে।
ফলে টেন্ডুলকারের চাইতে লিটনের খেলা দেখতে আমাকে স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে অনেক বেশি। এজন্য অপমানিত যেমন হয়েছি, কাজের কনট্রাক্ট ক্যান্সেল হওয়ায় আর্থিক লোকসানের মুখেও পড়েছি।
প্রায়ই প্রশ্ন করেছি, লিটনের ব্যাটিং দেখার জন্য এমন কেন করি।
ভেবে দেখি আমি বিনোদন বা চিন্তা চর্চার জন্য যতরকম সোর্সের দ্বারস্থ হই সবকিছুতেই অসংখ্য অপশন আছে, লিটনের ব্যাটিং একটাই। দুর্লভ এবং ইউনিক জিনিসের প্রতি আমার আসক্তি জন্মকালীন।
এভাবে চলতে চলতে ২০২০ এর জিম্বাবুয়ে সিরিজের সময় ভাবনা আসে, পরিচিত সার্কেলে প্রচুর খরচ করে ফেলেছি লিটনের পারফরম্যান্সের জন্য। এবার অন্যদের যুক্ত করি প্রকল্পে যাতে এটি একটি উৎসবে রূপ পায়। তখনই ফেসবুকে ঘোষণা দিই উপহার দেয়ার, এবং ২ বছর ধরে সেটি চলমান।
মাঝে গত বছর টি২০ বিশ্বকাপের সময় লিটনের আন্ডার পারফরম্যান্স নিয়ে বিভিন্ন ফেসবুক পেজ একযোগে ট্রলস্বরূপ তার রানের পরিমাণের উপর ডিসকাউন্ট দেয়। অর্থাৎ সে যত রান করবে তত পারসেন্ট ডিসকাউন্ট। অত্যন্ত অবমাননাকর এই উদ্যোগ নিয়ে প্রথমে ছোট স্ট্যাটাস, পরে দীর্ঘ পোস্ট লিখি। বালখিল্য চিন্তাধারার পপুলিস্ট সাংবাদিক এবং ফেসবুক সেলিব্রিটিদের কেউ কেউ আমার সমালোচনা করে, কারণ সেসব ডিসকাউন্টের বেনিফিশিয়ারি ছিল তারাও। এর মধ্যে লিটনের স্ত্রী সঞ্চিতার সাথেও পরিচয় হয়ে যায়, কিন্তু কোনোদিনই লিটনের সাথে আলাপ করা-দেখা করা বা ইন্টারভিউ নেয়ার প্রস্তাব দিইনি, দেবও না।
কারণ আমার ইথিকাল বাউন্ডারি এটা অনুমোদন করে না।
সেলিব্রিটিদের প্রতি আগ্রহ নেই৷ লিটন যখন ক্রমশ সেলিব্রিটি হয়ে উঠছে তখন তার সাথে দেখা বা কথা হওয়া আমার জন্য কোনো ভ্যালু এড করবে, নাকি লিটনের জীবনে করবে? দুপক্ষই যেখানে ভ্যালুহীনতায় ভুগছে সেখানে এই গতানুগতিক অর্থহীন দেখা-সাক্ষাত নিষ্প্রাণ এবং নির্জীবতাকেই প্রমোট করে।
আমি ভাবি উনিশ-তেইশ বা আমার ছোট ভাই যদি কর্মক্ষেত্রে সাফল্য দেখায় আমি কি আনন্দিত হব? অবশ্যই।
সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ কীভাবে ঘটে? উৎসব এবং উদযাপনের মধ্য দিয়েই৷ লিটনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অবিকল এক।
আমি আজ পর্যন্ত কোনোদিন লিটনের আন্ডারপারপফরম্যান্সকে ডিফেন্ড করিনি, দল থেকে বাদ পড়েছে সেটাকেও স্পোর্টিংলি নিয়েছি, কেউ লিটনকে ট্রল করলেও কিছুই মনে হয়নি। আমি তো লিটনের ভার্চুয়াল বডিগার্ড নই যে তাকে সুরক্ষিত রাখা আমার দায়িত্ব।
আমি তখনই ভয়ংকর রিএক্ট করি যদি কেউ আমাকে লিটনের ফ্যান বা ভক্ত হিসেবে উপস্থাপন করে। আমি নিজে একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। হাজার বা লাখের কাতারে না হলেও দুই-তিনশো অনুরাগী আমার লেখারও আছে, তাদের বহু বিচিত্র মাতামাতির অভিজ্ঞতায় প্রতিনিয়তই হই ঋদ্ধ; নিজের ক্রিয়েশন বাদ দিয়ে আরেকজনকে নিয়ে পড়ে থাকার সময়-ধৈর্য-বয়স-রুচি-প্রফেশন কোনোটাই আমার অনুকূলে নয়। কন্যা উনিশকে ঘিরে আমার যে উন্মাদনা তাতে কি আমি তার ফ্যান বা ভক্ত বনে গেছি!
কিন্তু সোস্যাল ডায়নামিক্স কংক্রিট রিয়েলিটি ফ্রেমওয়ার্কে সবকিছুকে যেভাবে গুঁজে দিতে চায় এই গোঁজামিল প্রবণতাই সামাজিক মানুষকে শেষ পর্যন্ত রূপান্তরিত করে সজারুতে।
লিটনের অনাগত দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ব্যাড প্যাচ আসবে, বিশেষত শীঘ্রই সে টেস্ট আর টি২০ দলের অধিনায়ক মনোনীত হবে৷ তারপর পড়বে জনরোষে, একসময় পারফরম্যান্স গ্রাফও হবে নিম্নমুখী। স্রোতের মতো আসা ফ্যানরা স্রোতেই ভেসে যাবে আবার।
এই সাপ-লুডু খেলার মধ্যেই লিটনকে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাব, তারপর সে যখন এখনকার তারকা ক্রিকেটারদের মতো সিন্ডিকেটবাজি করবে সেগুলোর কঠোর সমালোচনাও করব। হয়ত খারাপ লাগবে আমার, কিন্তু আমরা যারা পরিব্রাজনের ধর্ম মেনে পথ চলি তাদের জীবনে শোকের আয়ু ২ ঘন্টা বড়জোর। সেইসব সমালোচনার স্ক্রিনশট জমিয়ে রাখবে লিটনের কতিপয় খাসভক্ত, আমি চিহ্নিত হব লিটন বিদ্বেষী রূপে, এখন যেমন তামিম বা রিয়াদ বিদ্বেষী রূপে পরিচিত।
তারপর একদিন থেমে যাবে পথচলা।
লিটনও স্থায়ীভাবে তুলে রাখবে ব্যাড-প্যাড-গ্লাভস। ততদিনে আমার সোস্যাল স্ট্যাটাস কেমন হবে জানি না, তবে সুস্থ্য থাকলে লিটনকে দত্তক নেয়ার উদ্যোগ নিব।
এবং
অকেজো এবং লুথা প্রকৃতির পারিবারিক আইন আবারো আটকে দেবে আমায়, যেমনটা দিল স্টোরিটেলার বুবুকে দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রে। আমরা যারা বসবাস করি সুররিয়ালিস্টিকতার পৃথিবীতে, আমাদের সমাজ স্বীকৃত সম্পর্ক নির্মাণের উপায়টা তবে কোথায় থাকলো!
রাষ্ট্র কি আমাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে আদৌ, নাকি আমরা সিস্টেমের উচ্ছিষ্টমাত্র?
দেখা হবে লিটন দাস, তার আগে তারকাখ্যাতির আনন্দ উপভোগ করতে থাকো।
ধর্মীয় ট্যাগটা একটা নেগেটিভ ফ্যাক্টর না হলে গত ২ বছরে যেমন খেলছো এতদিনে অন্তত ৫-৬ টা বড় এনডোর্সমেন্ট কনট্রাক্ট পেতে। যাক মন খারাপ করো না, যা আছে ওই পরিমাণ অর্থ দিয়েই বিশ্বভ্রমণ করতে পারবে অনায়াসে।
সুইপ শটটা একেবারে বাদ দিয়ো না, শটটা ইফেক্টিভ তো।
তবে আমি ক্রিকেট নিয়ে বহুজনের সাথে বহু আলাপ করেছি জীবনে, তোমার সাথে বরং ফিলোসফি নিয়েই আড্ডা হবে।