সোস্যাল ডায়নামিক্স বোঝার ক্ষেত্রে যতরকম চিত্তাকর্ষক কেস স্টাডি হওয়া সম্ভব তার সংক্ষিপ্ত তালিকাতে কোচিং সেন্টার ফ্যাক্টকে রাখা উচিত। প্রাইভেট টিউশনি আর কোচিংকে এক করে ফেললে হবে না; একজন শিক্ষক যদি ব্যাচে ১৫ বা ২০ জনকে পড়ান বা একজন ভার্সিটি গ্রাজুয়েট বা শিক্ষার্থী যদি ব্যাচ করে ২০-৩০ জনকেও পড়ায় সেটাকে কোচিং সেন্টার বলা যাবে না। যখন সে একটি ট্রেড লাইসেন্স নিবে এবং পড়ানোর জন্য রুম ভাড়া করবে, স্বল্প পরিসরে সে এক কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করলো।স্বীকৃত স্কুলের বাইরে পাঠদান করিয়ে অর্থ নেয়াকেই কোচিং বলা হয়, তবে পার্থক্য হলো কোচিং এক ইনডিভিজুয়াল প্রক্রিয়া, কিন্তু কোচিং সেন্টার মানে সেই প্রক্রিয়ার ইনস্টিটিউশনালাইজেশন এবং কমার্শিয়ালাইজেশন; এটা একটা স্বতন্ত্র বিজনেস সেক্টর।
১.
কোচিং এবং কোচিং সেন্টারের মধ্যবর্তী বিভাজন রেখা আবিষ্কারের কারণ সেই সোস্যাল ডায়নামিক্স বুঝতে চাওয়া। বাংলাদেশের ৫থেকে৫৯ বছর বয়সী অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে যদি জরিপ চালানো হয় এদের মধ্যে ৯৭%ই জীবনের কোনো না কোনো বয়সে প্রাইভেট পড়েছেন, তার মানে তারা কোচিং প্রক্রিয়ার ভোক্তা, যাদের বয়স ৪১ এর নিচে তাদের বৃহত্তম অংশ কোচিং সেন্টার থেকেও সেবা নিয়েছেন, তবু যদি জরিপ চালানো হয় কোচিং সেন্টার সমর্থন করেন কিনা, ২০১৯ এর জানুয়ারির পূর্বে ৮৯% নেগেটিভ উত্তর দিতো, জানুয়ারির পরে হয়তোবা সেটা কিছুটা কমে ৭৯% এ ঠেকেছে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোজগতে কোচিং সেন্টার অচ্ছুত হিসেবেই ইমেজ ধারণ করেছে।
আরেকটু বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে তাকালে সমাজে কোচিং সেন্টারকে আমরা আবিষ্কার করবো এক ট্যাবু হিসেবে। সিংহভাগ মানুষ যেখানে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে একটি সেক্টর থেকে সেবা গ্রহণ করছে, তারাই আবার এর প্রতি বিমুখ।আমরা এবার ট্যাবুমুখী নির্মোহ অভিযাত্রার উদ্যোগ নিতে চাই।
বাংলাদেশের কোচিং সেন্টারকে শ্রেণিকরণ করলে ৩টি প্রকার পাওয়া যায়- একাডেমিক, এডমিশন এবং স্কিলভিত্তিক। শেষোক্ত শ্রেণিটিকে আলোচনার বাইরে রাখতে হচ্ছে কারণ এটি আমাদের পর্যবেক্ষণে ইন্টারেস্টিং কোনো ইনপুট দিবে না।কেউ আইএলটিএস বা জিআরআ-টোফেল কোচিংয়ে ভর্তি হলো, ফটোশপ-ইলাস্ট্রেটর বা ওয়েব ডিজাইন কোর্স করলো কিংবা বিসিএস এ চান্স পাওয়ার আশায় কোনো কোচিংয়ে ভর্তি হলো প্রভৃতি চিত্রগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এগুলোর মাধ্যমে তারা খুব দ্রুতই জীবিকার সাথে যুক্ত হতে চায়।
পক্ষান্তরে ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা কোনো এক কোচিং সেন্টারে বাংলা-ইংরেজি-গণিত পড়লো, জিপিএ ফাইভ পাওয়ার জন্য কেউ এসএসসি বা এইচএসসি মডেল টেস্ট দিলো, কিংবা নামকরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার আশায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কোথাও ভর্তি হলো, এরা কেউই জীবিকাপোযোগী মানুষ হয়ে উঠেনি, লং টার্ম ইনভেস্টমেন্টের প্রাথমিক পাঠ বলা যেতে পারে। এই গোষ্ঠীটিই একাডেমিক এবং এডমিশন কোচিংয়ের টার্গেট মার্কেট।
২.
আমার পর্যবেক্ষণ মতে, কোচিং সেন্টারের ট্যাবু হয়ে উঠার ক্ষেত্রে প্রধান জ্বালানী স্কুলের সাথে আইডেন্টিটি কনফ্লিক্টে জড়িয়ে পড়া। হাসপাতাল আর ক্লিনিকের মধ্যে পার্থক্য কী এটা হয়তো অনেকেরই অজানা, জানা খুব জরুরীও নয়, কারণ অসুস্থ্ হলে কেউ ক্লিনিক থেকে সেবা পেলে তার আর হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু যে শিক্ষার্থী কোচিং করে তাকে স্কুলেও যোগদান করতে হয়, ফলে তার সময় দুদিকেই খরচ হয়ে যায়। সে স্কুলে যায় সার্টিফেকট পেতে, কোচিংয়ে যায় সার্টিফিকেটকে ঝকঝকে-তকতকে করতে।
স্কুলের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সচরাচর যে অভিযোগ শুনি, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে অসাম্য; ৫০ বা ৬০ জন ছাত্রের বিপরীতে শিক্ষক ১ জন, সবার প্রতি সমান মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। কোচিংয়ের চিত্র কি এর চাইতে আলাদা আদৌ? এক রুমের ক্লাসে সেখানেও গড়ে ৪০-৫০জন শিক্ষার্থী থাকে, শিক্ষকও একজন; তবু কোচিং কেন লোভনীয়? কারণ সেখানে পরীক্ষায় যেসব প্রশ্ন আসতে পারে তার সমাধান করে দেয়া হয় এবং বিভিন্ন শর্টকাট টেকনিক শেখানো হয়। এবং এমন উদাহরণও পর্যাপ্ত দেয়া সম্ভব, কোচিং সেন্টারে পড়া সত্ত্বেও সেখানকার শর্টকাট টেকনিকগুলো ভালোমতো বুঝতে বাসায় আলাদা শিক্ষক রাখা হয়েছে।
সবকিছুর একটাই লক্ষ্য- প্রতিযোগিতার বাজারে নিজের জন্য একটি আসন নিশ্চিত করা। যার যতটুকু সাধ্য সে সেটাও ছাড়িয়ে ফেলে শিক্ষাব্যয় যোগাতে। আমরা ব্যয় শব্দটাকে এতোবেশি সংকীর্ণ অর্থে চিন্তা করি যে বিনোদন আর বিলাসিতায় খরচ করলে সেই ব্যয় গায়ে লাগে না, কিন্তু শিক্ষা আর চিকিৎসা খাতে খরচের সময় তখন ব্যয়ের দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ নামে।
মৌলিক চাহিদাকে মৌলিক অধিকার মনে করার মৌলিক ভুল করার কারণেই সম্ভবত এই গোলযোগ।
কোচিং সেন্টার থেকে মানুষের প্রত্যাশা ওই শর্টকাট টেকনিক শেখা আর তরতাজা সমাধান পাওয়া। প্রত্যাশাটাই গলদপূর্ণ; যদিও বিবেকবোধ তাদের প্রবল নয়, তবু অন্তর্গত ব্যক্তিসত্তায় রক্তক্ষরণ হয়, যে কারণে ব্যাপারটার প্রতি কিছুটা লুকোচুরি কাজ করে,কিংবা দালালকে দিয়ে প্রয়োজন উদ্ধার করতে টাকা দিলেও দালালের প্রতি যেরকম অর্থনৈতিক জোর কাজ করে (টাকা দিবো কাজ করবেন, আমার কথা শুনতে আপনি বাধ্য, আপনি তো একটা ছ্যাচড়া মিঞা), কোচিং সেন্টারের সাথে সম্পর্কটাও সেরকম অর্থনৈতিক নিক্তিতে উঠানামা করে। আইডিয়াল স্কুলের ছাত্রকে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি নিজেদের ছাত্র দাবি করবে না, প্রয়োজনও নেই, কিন্তু শিমুল নামের কোনো ছেলে যদি এসএসসিতে গোল্ডেন ফাইভ পায় তাকে আম, জাম,কাঁঠাল, জামরুল নামে যতগুলো কোচিং সেন্টার আছে প্রত্যেকেই নিজেদের দাবি করতে পারে বা করে এবং হাস্যোজ্জ্বল ছবি শোভা পায় প্রত্যেকের প্রসপেক্টাসে।সমগ্র বিষয়টাই যেহেতু অত্যন্ত নাজুক নৈতিক ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে থাকে, কোচিং সেন্টারের পক্ষে কনফিডেন্টলি কারো আপত্তিকে ডিফেন্ড করা সম্ভব হয় না।
৩.
স্কুল কি কোচিং সেন্টারকে প্রতিপক্ষ মনে করে; এর থাকা না থাকায় স্কুলের কি আসে-যায়, সার্টিফিকেট দেয়ার সাইনবোর্ড হওয়া ব্যতীত স্কুলের ভূমিকা কী? আমার অভিমত অনুসারে স্কুলের প্রধান এক্সিলেন্সের জায়গা আদতে সামাজিকীকরণের সুযোগ দেয়া, যেখানে একই বয়সের অথচ ভিন্ন মানসিকতা ও চিন্তাধারার মানুষেরা পরস্পরের সংস্পর্শে এসে ব্যক্তিত্ব গঠনের সুযোগ পায়। সোসাইটির ডিমান্ড পূরণে স্কুল যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছে। সোসাইটির ডিমান্ডটা কী? প্রত্যেকে ১০০ তে ৯৭,৯৮ করে নম্বর পাবে, বইয়ের সমস্ত অধ্যায় ক্লাসেই পড়িয়ে দেয়া হবে, যেগুলো পরীক্ষায় আসবে সেগুলো সনাক্ত করে বারবার প্র্যাক্টিস করানো এবং শর্টকাট টেকনিক শেখানো হবে।
বুঝলাম সোসাইটির ডিমান্ড পূরণ হলো না, কোচিং সেন্টার তা পূরণে এগিয়ে এলো (যদিও তারাও ডিমান্ড পূরণে অসফল, আদতে এই প্রলয়ঙ্করী ডিমান্ড কখনোই পূরণ হবার নয়) এজন্য কি স্কুলের সাথে কোচিং সেন্টারের বৈরিতা হতে পারে? তার আগে বোঝা উচিত স্কুলের পক্ষে সোসাইটির ডিমান্ড পূরণের দায় স্কুলের আছে কিনা বা তার পক্ষে সম্ভব কিনা। সোসাইটির আল্টিমেট গন্তব্য সফল এবং জনপ্রিয় মানুষ উৎপাদন করা। সফল মানুষ কারা? যার প্রভূত অর্থ-বিত্ত এবং ক্ষমতা রয়েছে। পেশা যা-ই হোক, উপায় যেমনই হোক- সফলতার শর্ত পূরণ হলেই যথেষ্ট। যদি না হয় জনপ্রিয়তা অর্জন করে এওয়ার্ড পেতে হবে। জনপ্রিয় কীভাবে হওয়া যাবে? রিয়েলিটি শো-তে নাচ-গান বা সুন্দরী প্রতিযোগীতায় যেতে হবে, জাতীয় দলের ক্রিকেটার কিংবা নাটক বা সিনেমার নায়ক-নায়িকা হতে হবে, কোনোটাই না পারলে ইউটিউবার হতে হবে।
জাগতিক নিয়মেই এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই ডিমান্ড পূরণ করতে পারবে না, কিন্তু তাদের গল্প করার উপকরণ লাগবে। সেটার জন্য হলেও ভালো নম্বর পাওয়া চাই। স্কুল কী করছে? রোল-কল করতেই ১০-১৫ মিনিট সময় খরচ করে ফেলছে, নানা উপলক্ষ্যে বন্ধ তো থাকছেই। ফলে পরীক্ষার আয়োজন করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে গাইড বই দেখে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা ব্যতীত স্কুলের বিশেষ করণীয়ও কিছু নেই, তারা সোসাইটির ডিমান্ডের কাছে সমর্পণ করেছে নিজেদের। মানসিকভাবে তারাও কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভরশীল। কারণ বিবিধ ছুটিহেতু স্কুলের সিলেবাস শেষ না হলেও কোচিং সেন্টারগুলো সিলেবাস শেষ করতে বাধ্য, নইলে অভিভাবকরা তাদের টুঁটি চেপে ধরবে এবং প্রতারক আখ্যা দেবে।ফলে আমরা পড়াই না পড়াই কোচিং সেন্টারগুলো ঠিকই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে- জাতীয় প্রবোধ নিয়ে তারা খুশি থাকেন।
তাছাড়া গ্ল্যামার প্রশ্নেও কোচিং সেন্টারের সাথে স্কুলের পেরে উঠা কঠিন। কোচিং সেন্টারকে যেহেতু কৌশলে ছাত্র ধরতে হয় এবং ছাত্র-অভিভাবক দুই পক্ষের মনোরঞ্জন করতে হয়, পড়ানোর ধরনেও সেখানে নানা চটকদারিতা রাখা জরুরী হয়ে পড়ে। শিক্ষকরা মাস গেলে মাইনে পাবে, কিন্তু কোচিং সেন্টারে যারা পড়ায় তারা মূলত ভার্সিটির শিক্ষার্থী, তাদের ক্লাসপ্রতি পেমেন্ট হয়, স্টুডেন্ট যদি মজা না পায় তাহলে হয়তো ক্লাসই পাবে না সে/তারা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো সোসাইটির এরকম আত্মঘাতি ডিমান্ড তৈরি হলো কীভাবে? এটা একজন-দুজন মানুষ বা দুই-একটা ঘটনা থেকে হয় না, দীর্ঘদিনের পূঞ্জীভূত অবদন সমণ্বিত হয়ে বর্তমানের পরিস্থিতিতে এসে উপনীত হয়েছে।
৪.
আরেকটা খুবই ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ সামনে আনতে চাই। প্রায় প্রতিটি বিজনেস সেক্টরই নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাবানরা। কিন্তু কোচিং সেন্টার ইন্ডাস্ট্রিতে এটা এক বিরল ব্যতিক্রম। ক্ষমতাশালীরা প্রাইভেট কলেজ বা ইউনিভার্সিটি-মেডিকেল চালায় বরং; বাধাটা সম্ভবত ইমেজের।
ধরা যাক ভার্সিটি বা মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং এডমিশন কোচিং। এই প্রোগ্রামে ভর্তি হয় কখন?সেকেন্ড ইয়ারে টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়নি বা হয়েছে, ইন্টার পরীক্ষা শুরু হতেও কয়েক মাস বাকি, অথচ কোচিং সেন্টারগুলো তখন ডিসকাউন্ট অফার দিয়ে রাখবে, সেটা লুফে নিবে শিক্ষার্থীরা, পরীক্ষা শেষ করে যে ভর্তি হতে আসবে শুনবে ভর্তি শেষ, তবু বিশেষ ব্যবস্থায় ভর্তি করা যাব, কিন্তু প্রাইস নিয়ে কোনো নেগোশিয়েট করা যাবে না।
কোচিং সেন্টারগুলোকে তাই ৩টি বড়ো চ্যানেলে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী,পুলিশ এবং সাংবাদিক। বিপুল পরিমাণ লিকুইড মানির সমাগম ঘটছে মাত্র কয়েক মাসে, সে তুলনায় তাদের খরচ কিন্তু আহামরি পর্যায়ের নয়। গার্মেন্টস সেক্টরের মতো কোচিং সেন্টারেও কর্মীদের বেতন-ভাতা নগণ্য, যেহেতু ভালো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ এখানে ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা করে না। লেকচার শিট একই, প্রশ্নপত্র একই, ফলে একটা ব্রাঞ্চ খোলা মানেই বিশাল অঙ্কের টাকা। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিজনেস চলে, একে বলা যায় সিজন, বাকি মাসগুলোতে রুমের ভাড়া দিতে হয়। যেহেতু ইমপ্লোয়িদের বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক, বছরজুড়ে টানতে হয় না তাদের খরচ। যোগ-বিয়োগ করে প্রফিট মার্জিন থাকে বিরাট পরিমাণে।
এক্ষেত্রে আরেকটা গুরুতর ফ্যাক্টর আছে। পরীক্ষা দেয়ার সময়ই অনেকে বুঝতে পারে ভার্সিটি বা মেডিকেলের জন্য নির্ধারিত পয়েন্ট তার আসবে না, ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর নিশ্চিত হয়ে যায় অনেকটা। ফলে যত ষ্টুডেন্ট ভর্তি হয় তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কোচিংয়ে আর কন্টিনিউ করে না, কেউ ভর্তি বাতিল করে, কেউ নিজ থেকেই অব্যাহতি নেয়। কিন্তু ভর্তির পুরো টাকা তো দেয়া হয়ে গেছে, সবার পক্ষে টাকা ফেরত পাওয়া সম্ভব হয় না। প্রফিট মার্জিন অক্ষত থাকার ক্ষেত্রে এর সরাসরি ভূমিকা আছে, অবশ্য নেতা-কর্মীদের চাপে একটা ছোট্ট অংশকে নির্ধারিত ফি এর বহু কমে ভর্তি করতে বাধ্য হতে হয়, কিন্তু সেই সংখ্যাটা সর্বমোট স্টুডেন্টের ৫%ও নয়।
বাংলাদেশে কোচিং সেন্টারের ইতিহাস ৪০ বছরের আশপাশে, অথচ এতোবছরেও তাদের কোনো এসিসিয়েশন ছিলো না। হকারদেরও এসিসিয়েশন থাকে, তাদের ছিলো না কেন? কারণ এই সেক্টরে পেশাগত বিরোধ সর্বোচ্চ পরিমাণে বিরাজ করে। আম কোচিং বিজ্ঞাপন দিবে ২০১৫ তে আম কেয়ার থেকে ১০০০ জন স্টুডেন্ট ভার্সিটিতে সুযোগ পেয়েছে বা ২০০০ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে, জাম কোচিং বিজ্ঞাপন দিবে ভার্সিটি বা মেডিকেলে চান্স পাওয়া প্রথম ১০০ জনের মধ্যে ৯৭ জনই জাম কেয়ারের, এবং আম-জাম-কাঁঠাল কেয়ারের প্রতিনিধিদের মধ্যে কে কার আগে ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড এর বাসায় মিষ্টি আর ফুলের তোড়া নিয়ে উপস্থিত হবে তার অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। শহরজুড়ে ব্যানার টাঙায় ২ ধরনের গ্রুপ- প্রথমত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা, দ্বিতীয়ত কোচিং সেন্টারের মার্কেটিং।
কোচিং সেন্টারের মার্কেটিংয়ে আরেকটা আনএথিকাল চর্চা দেখা যায়। নামী স্কুল-কলেজের প্রথম দিককার স্টুডেন্টদের টার্গেট করে ফ্রি বা কম বেতনে পড়ায়, তারপর তাদের রেফারেন্স দিয়ে (নটরডেমের ফার্স্ট, ভিকারুননিসার ফার্স্ট আমার এখানে) অন্যান্য স্টুডেন্ট আর অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করে। সেই সাথে শিক্ষক লিস্টে থাকবে আগের বছর ঢাকা ভার্সিটি বা বুয়েট-মেডিকেলে ফার্স্ট হওয়া শিক্ষার্থীদের নাম। তারা ১-২টা ডামি ক্লাস নিবে, বাকি সময়ে তাদের আর খোঁজই মিলবে না।
কোচিং সেন্টারে মার্কেটিংয়ের সমগ্র ভিত্তিটাই যেহেতু নৈতিকতার মানদণ্ডে বহু যোজন পিছিয়ে, তারা বুক ফুলিয়ে চলতে গেলে কোথাও বাধাগ্রস্ত হয়, এবং মানুষ সেটার সুযোগ নেয়।
এতো বছর ধরে যে সেক্টরটি মার্কেটে সক্রিয় তারা কোনো এসোসিয়েশনের অধীনে আসতে পারেনি। ২০১৮তে যখন শিক্ষা আইন পাশ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো, সিটি কর্পোরেশন থেকে একযোগে বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টারের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হলো, তারপরই হঠাৎ শ্যাডো এডুকেশন এসোসিয়েশনের আবির্ভাব। কিন্তু কতিপয় ব্যতিক্রম বাদে এই এসোসিয়েশনের বেশিরভাগ সদস্য সঠিকভাবে বলতেই পারবে না শ্যাডো এডুকেশন জিনিসটা কী, এবং বাংলাদেশে যেখানে কয়েক হাজার কোচিং সেন্টার সেখানে এই এসোসিয়েশনের সদস্যসংখ্যা ৫০০ এরও কম (কিছুদিন আগে একাত্তর টেলিভিশনের এক টক শো তে সংখ্যাটা জানা যায়)। ফ্রিল্যান্সারদের কোচিং সেন্টার চালানো যেহেতু বৈধতা পেয়ে গেছে, ধরে নেয়া যায় শ্যাডো এডুকেশন এসোসিয়েশন নিজ গরজেই শ্যাডো হয়ে গিয়ে আবারো যে যার সাথে পেশাগত বিরোধের নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।
যে কোনো কিছু ট্যাবু হওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ইতিহাস জড়িত থাকে। কোচিং সেন্টার ট্যাবু হয়েছে নিজেদের শর্টকাটপ্রিয়তা, নীতিহীনতা, নেগেটিভ মার্কেটিং আর নিজেদের মধ্যে রেষারেষির ফলাফলস্বরূপ।
তবে আমার ধারণা অন্য সবকিছুর মতো কোচিং সেন্টারের ট্যাবু হওয়ার কারণও প্রবলভাবে অর্থনৈতিক। ৪০ হাজার টাকা দামের একটা ফ্রিজ বিক্রি করলেও সেখানে ম্যানুফ্যাকচারারের প্রফিট থাকে সামান্য, পক্ষান্তরে ২০ হাজার টাকা দিয়ে একজন স্টুডেন্ট ভর্তি হলেও যদি মাত্র ৫০ জন স্টুডেন্টও ভর্তি হয় তবু ১০ লাখ টাকা চলে আসে, যেখানে প্রফিট মার্জিন যথেষ্ট বড়ো। ১ কোটি টাকা ইনকাম হয়ে যায় দেখতে দেখতেই। কিন্তু চাকরি করে একজন মানুষ কত টাকা উপার্জন করে বছরে, কিংবা অন্য বিজনেস করে ১ কোটি টাকা উপার্জন করতে কী পরিমাণ এফোর্ট দিতে হবে ভাবলেই গা শিউরে উঠবে অনেকেরই।মানুষ হিসাবটা করে মুখে মুখেই, এবং তারপর হিংসাণ্বিত হয়ে পড়ে। ‘সারা জীবন ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়ে চাকরি বা বিজনেস করছি, আর সৈকত চাকরি না পেয়ে কোচিং দিয়ে কোটিপতি হয়ে গেলো, কী করলাম শালার জীবনে’- এটা গোষ্ঠীগত হতাশা আর আক্ষেপের প্রতিস্বর হয়ে উঠে।
কোচিং সেন্টারকে আমলে নেয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যার ম্যাজিক কাজ করে থাকতে পারে। এক শিক্ষাবর্ষে ইউসিসিতে যত স্টুডেন্ট ভর্তি হয় অনেক ইউনিভার্সিটিতেও এতো স্টুডেন্ট হয় না। প্রত্যেকের ডাটা সংরক্ষিত থাকে। কোচিংগুলোর কাছে ডাটা আছে, অর্থ আছে, স্টুডেন্ট আছে; তারা যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। ফলে তাদের ট্যাবু বানিয়ে রাখাটাকে একধরনের রাজনৈতিক এজেন্ডাও বলা যেতে পারে।
৫.
তবে কি কোচিং সেন্টার নিষিদ্ধ হওয়া উচিত? একদমই নয়। হরলিক্স এর বিজ্ঞাপনেই আছে উত্তর- হরলিক্স বানায় টলার, স্ট্রঙ্গার, স্মার্টার। প্রতিটির মধ্যেই দেখিয়ে দেযা ভাব, অন্যের চাইতে নিজেকে উপরে উঠানোর চাহিদা-চেষ্টা। কেউ ভ্যালুয়েবল মানুষ হতে চায় না। সমগ্র পৃথিবী যা চাইছে কোচিং সেন্টার নিজেদের সামর্থ্যের মধ্য থেকে তার যোগান দিয়ে যাচ্ছে। নিখাঁদ মধ্যবিত্ত বলতে কোনো শ্রেণির অস্তিত্ব আর নেই সম্ভবত। এটা বিভাজিত হয়ে উচ্চ-মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত দুটো উপস্তরের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন-মধ্যবিত্তে অবস্থান করছে। তাদের সবার লক্ষ্য উচ্চ-মধ্যবিত্ত হবে; হোক না, তাতে বাধা দেয়ার কী হলো!
তবে কোচিং সেন্টারের ভর্তি ফি এর ক্ষেত্রে লিমিট আরোপ করা যেতে পারে। ২০০০০ টাকাকে যদি ১০ বা ১২ হাজারে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় তখন খেলা জমবে আরো বেশি। প্রফিট ঠিক রাখতে সার্ভিস কোয়ালিটি আরো খারাপ করে দেবে কোচিংগুলো, এক কোচিংয়ের বদলে ৩-৪টা কোচিংয়ে ভর্তি হবে শিক্ষার্থীরা। উন্মত্ততা তার চরম শিখরে পৌঁছুবে। মানুষের মধ্যে রক্তের নেশা চেপে বসেছে, মানুষের চেহারায় কিলবিল করে হাঙর, তাদের রক্তলোলুপতার জন্য হলেও আরো বেশি এনার্কি তৈরি করা যেতে পারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কোচিং ইন্ডাস্ট্রির খুব উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না। মাত্র দুই দশক আগেও ভিসিপি, ভিসিআর এর জমজমাট ব্যবসা ছিলো, তারপর এলো সিডি-ডিভিডি প্লেয়ার; আজ কোথায় সেগুলো? নিকট ভবিষ্যতে টেলিভিশনও জায়গা হারাবে ইউটিউবের কাছে। এটাই জগতের নিয়ম, বিজনেস সেক্টর প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয।
মানুষের হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের সুলভতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনলাইন লারনিংয়ে আরো বেশি জোর দেয়া চলতেই থাকবে,অফলাইনে শিক্ষাগ্রহণকে দেখা হবে ক্ষ্যাত মানুষের কার্যক্রম হিসেবে। অনলাইন স্কুল খুলে ছাত্রদের বলা হবে তোমাদের সমস্যা পাঠাও সমাধান করে দিচ্ছি, অনলাইনে নেয়া হবে মডেল টেস্ট। সমস্তটাই ফ্রি সার্ভিস, কিন্তু সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা দিয়ে টাকা আসবে গুগল থেকে। কোচিং সেন্টারের দরকার কী থাকবে আদৌ?
কোচিং সেন্টারের ব্যবসায়ীরা কী করবে তখন? সিজনাল ব্যবসা হলেও কোচিং থেকে আসা লিকুইড মানির পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। এই টাকা ব্যাংকে রেখে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম গঠন করে বিভিন্ন উদ্যোক্তার বিজনেসে ইনভেস্ট করে সেখান থেকে লভ্যাংশ নিবে।
লক্ষণ সেদিকেই আগাচ্ছে। গত দশকেও ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কোচিং সেন্টার খুলতো। এখন কী করে তারা? ফেসবুকে পেজ খুলে অনলাইনে প্রোডাক্ট বিক্রি করে, টেকনোলজি সংক্রান্ত স্টার্ট আপ দেয় কিংবা নিজেরা ইউটিউবার হয়ে যায়। কোচিং সেন্টার খুললেও খুলবে অনলাইন স্কুল হিসেবে। ফলে বিজনেসের সমগ্র পরিমণ্ডলেই খুব সন্তর্পণে এক প্যারাডাইম শিফটিং চলছে; স্বীকার করি বা না করি সময়ের তাতে ভাবান্তর ঘটবে সামান্যই;সে এক চিরন্তন হিস্টিরিয়াগ্রস্ততার মধ্য দিয়ে প্রলাপ বকতে বকতে কেবলই এগিয়ে চলবে আর গন্তব্যে এলে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দিয়ে বলবে- বিদায় হ, নতুন কাস্টমার আসতেছে!