এই লেখাটি কোচিং বিষয়ে, কিন্তু এই লেখাটিতে কোচিং নেই। একাডেমিক পড়োশানার ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন থেকেও আমি যেহেতু একাডেমিক পড়াশোনার প্রচলিত প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করেছি, পরিণত বয়সে এসে একাডেমিক পড়াশোনাকে সিস্টেম লস আখ্যা দিয়ে লেখালিখি চালানোটা ক্লীবতার লক্ষণ হয়ে যাবে। একটা ব্যালেন্সড সোসাইটিতে একাডেমিক পড়াশোনা লাগে। বুয়েটে পড়া শেষে চাকরি-বাকরিতে না ঢুকে মানব গবেষণাতেই সময় পার করে দিচ্ছি, পরিচিত মানুষ বলে প্রতিভার চোটে পাগল হয়ে গেছে। এর মধ্যে একধরনের প্রচ্ছন্ন প্রশংসা থাকে। কিন্তু আমি যদি ক্লাস নাইনের পরই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখন যা করছি তা-ই করতাম, এই পরিচিত মানুষগুলোই দিনে ৫ বেলা কথার মেশিনগানে আমাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে বলতো- ‘ তোমার যা যোগ্যতা, তুমি এইসব বাল-ছাল ছাড়া করতাই বা কী! রামছাগলের গতি তো কাঁঠালপাতাই’! একই মানুষ, একই কাজ; কেবল একাডেমিক পড়াশোনা ইস্যুতে মন্তব্যটা মহাদেশ ঘুরে যায়। ব্যতিক্রম দিয়ে সোসাইটি চলে না, সোসাইটির জন্য লাগে নর্মস, ম্যানার, প্রসেস, মেথড, সিস্টেম। একাডেমিক পড়াশোনাকে নিরুৎসাহিত করা তথাকথিত উত্তরাধুনিকতা। খাপছাড়া যে হবে সে তার নিজের নিয়মেই হয়ে যাবে, তার জন্য প্রসেস ডিজাইনের প্রয়োজন পড়ে না, কিন্তু সোসাইটি চলে এভারেজ মানুষ দিয়ে। আদর্শ এভারেজ বানানোর যতগুলো টুলস আছে, একাডেমিক পড়াশোনার সাথে তুলনাযোগ্য নয় কোনোটিই।

একাডেমিক পড়াশোনার সাথে কোচিংয়ের যোগসূত্র কী এ নিয়ে ভনিতার প্রয়োজন দেখি না। শিক্ষা আইনের একটা খসড়া প্রস্তাব দেখেছিলাম, সেখানে কোচিংকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে অনেকটা এভাবে- সরকার স্বীকৃত যে কোনো মূল ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দেয়ার মাধ্যম। সংজ্ঞাটা হুবুহু এরকম নয় হয়তো, তবে মূল ভাবটা অবিকল এটাই। অর্থাৎ স্কুল-কলেজের বাইরে কোথাও পড়া বা পড়ানো এবং পড়ুয়ার কাছ থেকে টাকা নেয়াটা কোচিং। প্রাইভেট পড়া বা বাসায় শিক্ষক রেখে পড়াও কোচিং। সর্বশেষ কয়েক বছরে বাংলাদেশে অনলাইন লারনিং বা টিচিং প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, আগামীতে করবে আরো। টেন মিনিট স্কুল, অন্যরকম পাঠশালা- দুটো প্লাটফরমই অনলাইন লারনিংয়ের ক্ষেত্রে পরিচিত। অনলাইনে তারা শেখায়, এজন্য শিক্ষার্থীকে কোনো টাকা দিতে হয় না, কিন্তু এই সেট আপ চালিয়ে নিতে আয়োজকদের নিশ্চয়ই স্পন্সরদের কাছ থেকে সহায়তা নিতে হয়। একদিক থেকে এটাও আর্থিক লেনদেন, যেখানে ভোক্তা নিজে না দিলেও অনুদান বা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে উদ্যোগ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু অন্যরকম পাঠশালা বা টেন মিনিট স্কুলকে বোধহয় কেউই কোচিং বলে না। কিন্তু এথিকাল গ্রাউন্ড এবং সংজ্ঞা বিবেচনায় নিলে, এ দুটো প্লাটফরমেরও কোচিং হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত ছিলো। আমি যদি এখন একটা শ্রুতিমধুর শব্দ ‘প্যারালেল স্কুল’ বা ‘শ্যাডো স্কুল’ ব্যবহার করি এবং বলি উল্লিখিত অনলাইন প্লাটফরম দুটি আদতে প্যারালেল স্কুল, কম-বেশি সকলেই একমত হবেন, এবং বলবেন এটা তো প্যারালেল স্কুলই, এ নিয়ে এত কথা কিসের! অনলাইন লারনিং যদি প্যারালেল স্কুলিং হয়, অফলাইনে একই কাজ করলে তাকে কি প্যারালেল স্কুল বলা যাবে? লজিকালি চিন্তা করলে বলা উচিত, কিন্তু বলার সুযোগ কম। কারণ অনলাইন স্কুলিং আর মূলধারা স্কুলিংয়ের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য প্রচুর, পক্ষান্তরে অফলাইনে এই পার্থক্যটা একেবারেই নেই। উভয়ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীকে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়, এবং প্রায়োরিটি ঠিক করে নিতে হয়। মূলধারার স্কুল নাকি অফলাইন স্কুল, কোথায় সময় দেবো, এবং কোথায় সময় দিলে আমার বেটার আউটপুট আসবে। আমি সঠিক জানি না প্যারালেল স্কুলিং কনসেপ্ট বাংলাদেশে আসলেই এক্সিস্ট করে কিনা, কিংবা ফিজিবল কিনা। আমাদের জাতিগত ভিশনহীনতা, রেডিমেড গেইন, শর্টকাট, সাধনাহীনতা আর অবক্ষয়ের যে দৈন্যচিত্র, এই দুর্ভেদ্য ব্যূহ ভেদ করে মহাভারতের অভিমন্যু সপ্রাণে ফিরে আসতে পারবে কিনা এ এক দুশ্চিন্তা বটে!

কথা বলছি শিক্ষা বিষয়ে, বারবার কোচিং প্রসঙ্গ আসে কেন? কারণ কোচিং আর একাডেমিক শিক্ষা চালে-ডালে মিশে খিচুড়ি হয়ে গেছে, ফলত চাল আর ডালের আলাদা অস্তিত্ব খুঁজে বের করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ ৩০-৪০ বছরে কোচিং রীতিমতো কালচারের অংশ হয়ে পড়েছে। শব্দগত ইন্টারপ্রেটেশনের কারণে সময়টা ৩০-৪০ বছর বলছি, প্রাইভেট বা গৃহশিক্ষতাকে কোচিংয়ের আওতায় আনলে এই ঐতিহ্যের বয়স ১০০ পেরিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলা নিয়ে পড়তে গেলেও দেখা যায় তাদের ভাই-বোনদের গৃহশিক্ষক ছিলো। তখন হয়তোবা বিত্তবানরাই গৃহশিক্ষক রাখতো সাধারণত, কালক্রমে গৃহশিক্ষক হয়ে পড়েছে সংস্কৃতির অংশ। যাদের সঙ্গতি কম তারা শিক্ষককে বাসায় না ডেকে নিজেরা ব্যাচ করে শিক্ষকের বাসায় পড়ছে। কেন পড়ছে জিজ্ঞেস করলে গুছিয়ে উত্তর দিতে পারবে খুব কম জনই। ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত প্রাইভেট পড়েছি আমি। কেন? কারণ স্যারের সহায়তা ছাড়া ম্যাথ, ইংরেজি শেখা যায় এই বিশ্বাসটাই ছিলো না আমার মধ্যে। বড় আপা, ছোট আপারও প্রাইভেট টিউটর ছিলো, সিনিয়র ব্যাচে যারা ভালো ছাত্র ছিলো প্রত্যেকেই প্রাইভেট পড়তো। ফলে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিলো এমন, প্রাইভেট আর স্কুল একে অপরের কমপ্লিমেন্টারি হয়ে উঠেছিলো। স্কুলে তবে যেতাম কেন? প্রাইভেট স্যারের কাছে পড়ে তো সিক্স থেকে সেভেনে উঠা যাবে না, রোল নম্বর পাওয়া যাবে না। স্যাররা ক্লাসে এসে পড়া ধরতো, পড়া না পারলে দাঁড় করিয়ে রাখতো, ২-৩ টা ম্যাথের সমস্যা সমাধান করে দিয়ে বলতো বাকিগুলো নিজে করে নিয়ো। কিন্তু একটা চ্যাপ্টারে সমস্যা থাকতো অনেক, কোনটা পরীক্ষায় আসবে কে জানে! জ্যামিতির এক্সট্রা কোনোদিনই ক্লাসে করানো হতো না, কিন্তু পরীক্ষায় তো এক্সট্রা আসবে; সেটা করে দেবে কে! প্রাইভেট স্যারও একের পর এক অংক করে দিতো, আমরা খাতায় তুলে নিতাম, বারবার প্র্যাকটিস করে মনে রাখতাম; ১ মাস প্র্যাকটিস না করলেই ভুলে যেতাম। আমাদের স্কুলের কয়েক সিনিয়র ভাই নটরডেমে ভর্তি হয়েছিলো, তাদের মুখে শুনেছি নটরডেম কলেজে ক্লাসেই সব পড়ানো হয়, কোনো প্রাইভেট পড়ার দরকার হয় না। কলেজের নবীন বরণেও প্রিন্সিপাল বেঞ্জামিন কস্তা তার ভাষণে বলেন- নটরডেমের ছাত্রদের কোনো প্রাইভেট পড়তে হয় না; ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম ক্লাস ছিলো ফিজিক্স, নেন সুশান্ত স্যার। তারও ভাষ্য ছিলো- নটরডেমে প্রাইভেট পড়তে হয় না। আমি পুরোপুরি কনভিন্সড হই প্রাইভেট পড়তে হয় না। কিন্তু ৫০ মিনিটে যতটুকু পড়ায় কুইজ পরীক্ষায় আসে অন্য প্রশ্ন, সেগুলোর সমাধান করবে কে! গাইড বই কিনি। ৬ মাস পর দেখি, অল্প কয়েকজন বাদে প্রায় প্রত্যেকেই প্রাইভেট পড়ে। রানা স্যার, ফেরদৌসী ম্যাডাম, আরও কত কে!

আমার এই জার্নিটা একটা চমৎকার কেস স্টাডি হতে পারে। ৪০ এর নিচে বয়স এমন শিক্ষিত মানুষের মধ্যে একটা জরিপ চালিয়ে দেখা যেতে পারে, আমার ধারণা মোট জনসমষ্টির ৩% পাওয়াও দুষ্কর হবে যারা কখনোই প্রাইভেট পড়েনি। আর বর্তমানে যে চিত্র তাতে ২০ বছরের কম এমন মানুষের মধ্যে ১% পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়ে ঘোরতর সংশয়ী আমি।

কোচিং বা প্রাইভেট আসলে কেন পড়ে? পরীক্ষা পাশ এবং ভালো ফলাফলের জন্য। সবাই তো ভালো ফলাফল করে না, বাকিরা পড়ে কেন? ভালো ফলাফল করতে না পারলেও ইচ্ছা তো সবারই কাজ করে। কোচিং না করলে কী হবে? পরীক্ষায় ফেল করবে। সংখ্যাগিরষ্ঠ শিক্ষার্থীই যদি নিজে নিজে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করতে না পারে সেই সমস্যা দিয়ে আসলে লাভ কী! শিক্ষক নিজে গাইড দেখে সমাধান করে দিচ্ছে, সে প্রশ্নও সেট করছে গাইড দেখে, আবার খাতাও মূল্যায়ন করছে শিক্ষকই। মূল্যায়নটা তাহলে হচ্ছে কার; শিক্ষকের, নাকি ছাত্রের? কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হতে দেখেছিলাম, ক্লাস ফোর বা ফাইভের এক ছেলে খাতায় লিখেছে- আওয়াজ শোনা গেলে তাকে শব্দ বলে। একে দেখা হচ্ছে মেধাহীনতা হিসেবে, হাসাহাসির পাত্র বানিয়ে দেয়া হয়েছে ছেলেটাকে। অথচ ওইটুকু একটা ছেলে কমনসেন্স খাটিয়ে কী চমৎকার এক ব্যাখ্যা তৈরি করেছে এই ব্যাপারটা বোঝারই চেষ্টা করা হলো না। নিজস্ব সেন্স খাটানোর সুযোগ নেই যেখানে, বড়দের লিখে দেয়া সংজ্ঞা মুখস্থ করাই যদি মেধা হয়, তারা তো প্রাইভেট পড়বেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনা বিষয়ে অদ্ভুত সুন্দর এক লাইন আছে- ‘ মুখস্থ করিয়া পাশ করাই তো চৌর্যবৃত্তি।! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সে-ই বা কম কী করিল’? মুখস্থনির্ভর শিক্ষা নিয়ে বহু কথা চালাচালির পর সৃজনশীল নামে শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলো, কিন্তু গতবছর প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখলাম দেশের ৫২% সরকারি স্কুলের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নই তৈরি করতে পারে না। গ্রেডিংয়ের আমরা ছিলাম ৩য় ব্যাচ, আমাদের সময় সারাদেশে জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলো ১৩৯২ জন, তার আগের ২ বছর সংখ্যাটা ছিলো খুবই কম, যে কারণে পত্র-পত্রিকা সহ বহু জায়গায় আমাদের বছরের ফলাফল নিয়ে হতাশামিশ্রিত উপহাস করা হয়েছে; এতো ছেলে এ প্লাস পাইলে তার আর দাম থাকে কী; এর চাইতে তো ডিভিশন সিস্টেমই ভালো ছিলো! আমাদের পরের বছর থেকেই সংখ্যাটা হুহু করে বাড়তে থাকে, এবং মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সংখ্যাটা ১ লাখ পেরিয়ে যায়। মাত্র কয়েক বছরে দেশের মধ্যে মেধার এমন কী ভয়াবহ পর্যায়ের জোয়ার নেমে এলো যে এমন বিপুল পরিমাণ জিপিএ ফাইভ পেয়ে গেলো! ছাত্রকালে শুনতাম পরীক্ষার খাতায় প্রেমপত্র লিখেছে, স্যারকে অনুরোধ করেছে তাকে যেন পাশ করিয়ে দেয় নইলে বিয়ে হবে না বা বাবা ত্যাজ্যপুত্র করে দিবে। সেইসব কর্মকাণ্ড ঠেকাতে নীতিমালা জারি করা হয়েছে, এরকম করলে খাতিল বাতিল হয়ে যাবে। এখনকার সময়ে খাতায় ওসব লিখলেও নম্বর পেয়ে যাবে, কারণ আমার পরিচিত ৩ জন শিক্ষক আমাকে বলেছেন- প্রধান পরীক্ষক কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, কোনোভাবেই ফেল করানো যাবে না, নইলে পরের বছর আর খাতা পাবেন না। পাশের হার বেশি দেখিয়ে, লক্ষাধিক জিপিএ ফাইভ অর্জন করে আমাদের ঠিক কোন্ মহতী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে, জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়ার নেই কেউ। সম্প্রতি অদ্ভুত এক নিয়ম হয়েছে শুনলাম। গ্রেডিংয়ের সাথে সাথে নাকি প্রাপ্ত নম্বরও দিয়ে দেয়া হচ্ছে। গ্রেডিং মানে একটা বেঞ্চমার্ক। ধরা যাক, নিউজিল্যান্ডের মাঠ আকারে ছোট, সেখানে মিসহিটও ছক্কা হয়ে যায়। আবার অস্ট্রেলিয়ার মাঠগুলো বিশাল বড়ো; ছক্কা মারা অনেক কঠিন। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের মাঠের ছক্কা অন্য মাঠে ক্যাচ হয়ে যাবে এই বিবেচনায় কি সেগুলো ছক্কা হিসেবে বাতিল হয়ে যাবে, কিংবা বাউন্ডারির দড়িতে লাগলে ছক্কা, আর বল হারিয়ে ফেললে কি বারো রান যোগ হবে? এটাই তো বেঞ্চমার্কের সৌন্দর্য। আপনি দয়ার মহাসাগর হয়ে লক্ষাধিক জিপিএ ফাইভের জন্ম দেবেন, আবার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য নম্বর প্রকাশ করে দেবেন, তাহলে তো আগের সেই ডিভিশন সিস্টেমই ভালো ছিলো। ২০ জন স্ট্যান্ড করতো; টিভিতে আর পত্রিকায় তাদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হতো; তারা খুব গুছিয়ে বলতো- আমি দৈনিক মাত্র ৪-৫ ঘন্টা পড়েছি, আমার কোনো প্রাইভেট টিউটর ছিলো না’! কিংবা সেমিস্টার সিস্টেমে ক্রেডিট আওয়ার থাকে যেমন, তেমনি বিষয়ের ক্ষেত্রেও ওয়েটেড এভারেজ নেয়া উচিত। ফিজিক্সে ৯৭ আর সামাজিক বিজ্ঞানে ৬৭, এমন ছাত্রকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? ওয়েটেড এভারেজ সিস্টেম থাকলে ঠিকই এই সমস্যা সমাধান করা যেত।

একাডেমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে কাগজে-কলমে বোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা হলেও আদতে শিক্ষার উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরি করা, এবং আমাদের ব্যবহারিক জীবনেও শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য সার্টিফিকেট অর্জন, যা দিয়ে ভালো চাকরি পাওয়া যাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে শিক্ষা হয়ে আছে বাস্তবতাবিবর্জিত এবং ইন্ডাস্ট্রির সাথে সম্পর্কহীন এক সিলেবাসের অনুসরণ। কর্মীই যদি প্রয়োজন, তাকে স্কুল পর্যায় থেকেই লিডারশিপ, টিমম্যানশিপ, এক্সেল, প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি কনটেন্ট এবং টুলস শেখানো হয় না? তাতে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পূর্বে একটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রশিক্ষণ হয়ে যেতো। জ্ঞানার্জন তো একটা ভেক কথা, গুগলের যুগে জ্ঞানী হওয়ার জন্য কি একাডেমিক সিলেবাসের অপেক্ষায় বসে থাকে কেউ? একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় ৯-১০ টা বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়? কেন এতগুলো বিষয় থাকবে? সর্বো৩-৪ টা বিষয়ে পরীক্ষা হতে পারে, এর বাইরে অপশনাল থাকবে অনেকগুলো সাবজেক্ট; সেখান থেকে যে যেটা নিতে চায় নিক, না নিলে ওই ৩-৪টাই; এতেই তো বোঝা যাবে কে কর্মী হবে আর কে গবেষক বা পলিসি মেকার হবে ভবিষ্যতে। একই দরে বালি আর হীরা মাপলে বালিকে অতিমূল্যায়ন আর হীরাকে চরম অবমূল্যায়ন করা হয়। একটা ব্যালেন্সড সোসাইটির জন্য কতজন গবেষক বা পলিসি মেকার লাগে আসলে? কর্মীই তো রাশি রাশি। সুতরাং সিস্টেমটা সেভাবেই ডিজাইন করা হোক। বিসিএস বাছাইয়ের প্রাথমিক ফিল্টারিং যেমন প্রচুর তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা, অনুরূপভাবে সুষম মানুষ বানাতে গিয়ে একগাদা বিষয় পড়িয়ে আদতে যে মানুষ অমানুষ কোনোটাই বানাতে পারছি না, এতো বছরের ডাটা দেখেও কি তা বোঝা যাচ্ছে না? বিষয় সংখ্যা যখন কমে যাবে, তখন আরো ফোকাসড হয়ে এভারেজ নিয়ে কাজ করা যাবে। পরীক্ষা পাশই যদি মূল হয়, উৎসবমুখর পরিবেশে প্রশ্ন ফাঁস হলেই বা কী! পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পছন্দসই কলেজে ভর্তি হোক, প্রয়োজনে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হোক। ভার্সিটির ক্ষেত্রেও যে যেখানে পারে আবেদন করুক। এখন ইন্টারনেট চলে এসেছে; ৩টা সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর লিখে ইমেইল করুক ভার্সিটির ইমেইলে তার ভিত্তিতেই তো শর্টলিস্ট করা যায়। তারা পরীক্ষা দিক, এবং সবই কনসেপচুয়াল প্রশ্ন করলে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে নাকি নিজের জ্ঞানে পরীক্ষা দিয়েছে তাতে কী আসে যায়!
একটা সমাজ যখন অবক্ষয়ের একটা নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করে ফেলে তখন এক সামাজিক রুচি বিকৃতি দেখা দেয়। আমরা অবক্ষয় স্তর পেরিয়ে বর্তমানে এক বিভীষিকাময় রুচি বিকৃতির সময়ে বসবাস করছি। কয়েকদিন আগে রোয়ার বাংলায় এক আর্টিকেল পড়লাম, মানুষের মাংস বিক্রি হয় এমন হোটেলও নাকি আছে। আমাদের জীবন ডুবে গেছে অপরিমেয় ভোগবিলাস আর অফুরন্ত ক্ষমতার লোভে। স্ট্যাটাস, সম্মান সবকিছুর একমাত্র পরিমাপক হয়ে উঠেছে অর্থ। গড় মানসচেতনায় ঢুকে পড়েছে বিত্তশালী হওয়া মানেই সফলতা। ফলে সুকোমল বৃত্তির বিকাশ বন্ধ হয়ে গেছে। দূরদর্শীতা বোধটা এখন কেবল অভিধানে ঘোরাফেরা করে, বাস্তবে তার দেখা নেই। ভিশন শব্দটাই শোনেনি বেশিরভাগ কিশোর-তরুণ; এদের যারা শেখাবে সেই শিক্ষকদের ব্যাকগ্রাউন্ড কী? গ্রাজুয়েশন শেষ করতে করতে আমরা ন্যূনতম ৪৩ জন শিক্ষকের সংস্পর্শে আসি গড়ে; এই দীর্ঘ শিক্ষাজীবন শেষে ৩ জন শিক্ষকও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, যার প্রতি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জাগে। কেন জাগে না? কারণ শিক্ষক নিজেই তো আদর্শচ্যুত। প্রাইেভট না পড়লে নম্বর কম দেয়া, প্রশ্ন করলে তিরস্কার করা এগুলো বাদ দিলাম, জীবন মানে কেবল অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান নয়, জীবন আরো অনেক বড়, এইটুকু দর্শনের সাথে পরিচিত করে কতজন শিক্ষক? কতজন শিক্ষক বছরে ৩ টা বই পড়েন? স্কুল বা কলেজে বাউন্ডারির বাইরে বেরুলেই যদি শিক্ষক হাজারো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায়, তাকে আলাদা করা যায় না, সেই শিক্ষকের প্রতি সম্মান আসবে; সম্মান কি ট্যানারিতে শুকানো গরুর চামড়া? শ্রদ্ধা নেই, বিশ্বাস নেই, প্রশ্ন নেই, কেবল চাই বিত্ত, ক্ষমতা আর অন্তহীন নার্সিসিজম; বিকৃতি হবে না তো কী হবে?

সনদনির্ভর চাকরি পাওয়ার কারখানাই যদি একাডেমিক পড়াশোনা হয় তবে এই কারখানায় গলদ আছে ভয়াবহ পর্যায়ের। অনেকেই অভিমান করতে পারেন শিক্ষাকে এভাবে ন্যক্কারজনক বলা ঠিক নয়। তাহলে জবাব চাই, পালি, সংস্কৃত, উর্দু প্রভৃতি সাবজেক্টে পড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগে কেন, আর মার্কেটিং, জার্নালিজম, ফার্মেসি, ফাইন্যান্স প্রভৃতি সাবজেক্টে পড়ার জন্য বাড়তি উচ্ছ্বাস কেন কাজ করে? কিংবা ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারে পড়া শিক্ষার্থী কেন ভার্সিটি লাইব্রেরিতে বসে বিসিএস গাইড পড়বে? সত্যি মেনে নিলে কি জাত থাকে না? ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, লক্ষ লক্ষ ডিপ্লোমা তাদের ভবিষ্যৎ কী, এবং এ নিয়ে তাদের বড় অংশই চরম বিষাদগ্রস্ততায় ভুগে কেন? যখন আমি জব ইন্টারভিউ নিই, ৯০% গ্রাজুয়েট ইংরেজিতে কলিগ বানানটা ভুল করে কেন? ভুল করাটা অস্বাভাবিক বা দোষের নয়, কিন্তু ভুল স্বীকার না করাটা অপরাধ। পত্রপত্রিকায় আপনি লিখে দিচ্ছেন সারা দেশে বেকারে ভরা, অন্যদিকে চাকরিদাতারা হাহুতাশ করছে চাকরিতে নেয়ার মতো উপযুক্ত লোক পাচ্ছি না। আপনার মধ্যে স্কিল আছে এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত, এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড যেটাই হোক, তবু চাকরি পাচ্ছেন না এমন মানুষ কতজন আছে? প্রোএক্টিভনেস, সেলফ-ডিপেন্ডেন্স প্রভৃতি বোধ আমাদের এই জনপদে অচেনা। পৃথিবীতে মানুষ হয় ৩ ধরনের- থিংকিং বেইজড, একশন বেইজড, ব্যালান্সড। কিন্তু সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ৪র্থ একটা ধরন অস্তিত্বশীল, সেটা হলো আরামবেইসড, এবং এই সংখ্যাটাই সবচাইতে বেশি। আরামবেইসড মানে স্পৃহাশূন্য মানুষ; কোনকিছুতেই তাদের মন বসে না, কিছুই ভালো লাগে না; কেউ তার মুখে তুলে খাইয়ে দিলে সবচাইতে ভালো হয়। এতো বিপুল আরামবেইসড মানুষ কীভাবে তৈরি হলো? ওই যে মেন্টাল ডিপেন্ডিন্সি। আমাদের একাডেমিক জীবন প্রায় ১৭-১৮ বছরের, সেশন জট থাকলে সেটার ব্যাপ্তি আরো বেশি। এই দীর্ঘ সময় ধরে মেন্টালি ডিপেন্ডেন্ট থাকতে থাকতে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে শিখি না, ঝুঁকি নিতে জানি না, আমরা কেবল অপেক্ষায় থাকি স্যার এসে সমাধান করে দেবে। অমেরুদণ্ডী এই জীবনাচরণ তো একদিনে গড়ে উঠেনি। জার্মান- বাংলাদেশ টেকনিক্যাল ইনস্টিউটে গিয়েছিলাম একবার, সেখানে এক ভদ্রলোক মন্তব্য করেছিলেন- ‘বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে বিভিন্ন টপ পজিশনে যেসব বিদেশী ম্যানেজার কাজ করে, তারা সবমিলিয়ে যে পরিমাণ বেতন এদেশ থেকে নিয়ে যায়, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের বাইরে থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠায় দুয়ের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি না। মানে যা আসছে তা আবার চলেও যাচ্ছে। এবং এমন না যে বিদেশী ম্যানেজাররা জোর করে টাকা নিয়ে যাচ্ছে, তারা সেই লেভেলের স্কিলড বলেই কোম্পানীগুলো তাদের এতো বেতন দেয়’।

আগামীতে ভার্সিটিগুলোতে হয়তোবা ৫% ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি কোটা’ চালু করতে হবে। এক্সট্রা অর্ডিনারিকে ডিফাইন করতে বেশ কিছু প্যারামিটার সেট করা হবে; তখন যদি কিছু ক্যাপাবল মানুষ গ্রো করে। প্রচলিত ব্যবস্থা না পারছে ব্যালেন্সড মানুষ বানাতে, না পারছে দক্ষ কর্মী সরবরাহ করতে। এই শিক্ষার তবে ভবিষ্যৎ কী? আমাদের সমাজ ব্রেক ফেল করা গাড়ি হয়ে লাগামহীন ছুটে চলেছে, গন্তব্য জানা নেই, তবে দুর্ঘটনা সুনিশ্চিত!

বাংলাদেশে শিক্ষাবিদ হিসেবে যারা স্বীকৃত এবং সম্মানিত বেশিরভাগকেই আদর্শিকভাবে হিপোক্রেট এবং জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মনে হয়। যে কোনো সমস্যার সমাধান তাদের রেডি থাকে, যে সমাধান একজন ১৫ বছরের কিশোরের দেয়া সমাধানের চাইতে আলাদা কিছু নয় মোটেই। কী করতে হবে এটা প্রায় সকলেই জানে, এটা বলার মধ্যে কৃতিত্ব কী; কীভাবে করতে হবে সেটাই বড় বিবেচ্য, এবং এটা বলতে হলে রিয়েল লাইফ রিসার্স থাকতে হয়। বদ্ধরুমে কফিতে চুমুক দিয়ে এই করো, সেই করো বলে মানুষের কাছে হাসির পাত্রই হতে হয়; চিন্তাশীলতার প্রমাণ মেলে না। কারোরই পড়তে ভালো লাগে না, জোর করে পড়ে। কেন ভালো লাগে না, এ নিয়ে চরম পর্যায়ের কোনো গবেষণা আছে কি? ভাসা ভাসা অনেক কিছুই তো বলা যায়, জরিপ চালিয়ে বায়বীয় কিছু পয়েন্ট পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো কতটুকু ভ্যালিড? চাকরিতে প্রমোশন পাওয়া যখন হয়ে যায় পিএইচডির উদ্দেশ্য, সেইসব পিএইচডি থেকে আমরা কী-ই বা আশা করতে পারি। ফলে অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষাও একটি ইনোভেশনবন্ধ্যা খাত হয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করছে মাত্র। কিন্তু শিক্ষা যেহেতু সরাসরি একজন মানুষের ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের সাথে জড়িত, এখানে বন্ধ্যাত্ব পুরো রাষ্ট্রকাঠামোকে অনুর্বর করে দেয়। প্রশ্নফাঁস যখন একটি উৎসব, মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে কখন ফেসবুকে আসবে প্রশ্নফাঁসের আগাম ঘোষণা এবং তারা জোরে হাততালি দেবে, রুচিবিকৃতির সেই সময়ে আপনি অভিধান থেকে ‘সুষম’, ‘নৈতিকতা’ প্রভৃতি শব্দগুলো বাদ দেয়াকেই যথার্থ গণ্য করে টিভিতে তামিল সিনেমা দেখায় মনোনিবেশ করবেন। বালিতে মুখ গুজে রাখলেই কি ঝড়ের প্রকোপ থেকে রক্ষা পায় উটপাখি!
আমরা স্কুলে পড়াকালে নাইন-টেন ২ বছরে ল্যাবে ঢুকেছি মোটে ৫ দিন, অথচ মানিকগঞ্জ জেলার সবচাইতে নামকরা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। গ্রামের দিকের স্কুলগুলোতে হয়তোবা ল্যাবের তালাই খোলা হয় না কোনোদিন। তবুও বগুড়া, ময়মনসিংহ বা রাজশাহী থেকে ঢাকা ভার্সিটি বা বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে এটা সংবাদ হয়, কিন্তু সর্বশেষ কয়েক বছরের ডাটা নিয়ে তুলনা করে দেখুন, ঢাকার বাইরে থেকে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলে সুযোগ পাওয়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ১০-১৫ বছর আগেও হয়তোবা কিছুটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিলো, এখন পুরোপুরি ঢাকার নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ঢাকা যে পুরোপুরিই বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র্বব্যবস্থা হয়ে উঠেছে, এটা কি খেয়াল করেছি আমরা? ঢাকা মানেই বাংলাদেশ? বর্তমান বাংলাদেশ যারা বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষে পরিচালনা করছেন, তাদের বেশিরভাগই কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকেই পড়াশোনাসূত্রে ঢাকায় এসেছিলেন। ন্যাচারাল ট্যালেন্ট কি তবে ফুরিয়ে গেছে? কিন্তু পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি সবকিছুতে ঢাকার সাথে বাকি শহরগুলোর পার্থক্যটা বৈষম্যের পর্যায়ে চলে গেছে। বৈষম্য আরো বাড়বে, কমার লক্ষণ দেখি না দৃষ্টিসীমায়।

কোচিং করায় কারা, কেন করায়? মূলত শিক্ষক, কলেজ বা ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র, পড়াশোনা শেষে চাকরি না পাওয়া শিক্ষিত তরুণ- তরুণী। এর বাইরে খুব ছোট্ট একটা গোষ্ঠী থাকতে পারে যারা শিক্ষা বিষয়ে প্রচণ্ড প্যাশনেট, শিক্ষা ক্ষেত্রে কাজ করতে চায়, সে লক্ষ্যে কোচিং চালায়, কিছু উপার্জনও করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেষোক্ত গোষ্ঠীটি বিরল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ধরে নিয়ে তাদের ব্যতিক্রম হিসেবে ধরে রাখি। শিক্ষা আইনের ২য় বা ৩য় খসড়ায় একটা শব্দ দেখি ‘ছায়া শিক্ষা’, যার মাধ্যমে কোচিংকে বৈধতা দেয়ার একটা চেষ্টা ছিলো। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোচিং শব্দটা একটা ট্যাবু। কেন ট্যাবু তার উৎস বুঝতে একটা উদ্ধৃতি দিতে চাই। ৬ বছর বয়স থেকে কারো কোনো উদ্ধৃতি পছন্দ হলে মনে রাখার চেষ্টা করি। এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস রোধে সরকার যখন কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়, কোচিংয়ে কাজ করা একজনের সাথে কথা বলার সময় সে উদ্ধৃতিটা দিয়েছিলো। উদ্ধৃতিটা বলি- ‘ঢাকা শহরে প্রতিরাতে ২০০০ মহিষ ঢুকে, সকাল বেলা আমরা সেগুলারে গরুর মাংস হিসেবে কিনি। তেমনি এমপি, সচিব, প্রফেসর, সাংবাদিক, পুলিশ, শিক্ষিবিদ, বিসিএস ক্যাডার সবার ছেলে-মেয়ে কোচিং করে, নিজেগো পরিচয় দিয়া এক্সট্রা ডিসকাউন্টও নেয়, কিন্তু টিভি ক্যামেরায় বলার সময়, টকশো, পেপার নাইলে ফেসবুকে লেখার সময় বলবো- কোচিং খুব খারাপ, কোচিং অবশ্যই নিষিদ্ধ করা উচিত। মহিষেরও তবু আইডেন্টিটি আছে; আমাগো সেইটাও নাই’। কোচিংয়ের কারণে টিচাররা মনোযোগ দিয়ে পড়ায় না, কোচিংয়ের কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে আসে না, কোচিং প্রশ্ন ফাঁস করে; আরো বহু অভিযোগ। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সময় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ২-১টা কোচিংয়ের পরিচালককে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই ছবিও এসেছে পত্রিকায়; সুতরাং প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ অমূলক নয়। কিন্তু বিচ্যুতি, স্খলন যে কোনো সেক্টরেই ঘটে, তাতে সমগ্র সেক্টরকে দোষী বলাটা যৌক্তিক নয়। ঘুষ খাওয়ার দায়ে সরকারী কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছে এই সংখ্যা বেশি, নাকি কোচিং পরিচালক গ্রেফতার হওয়ার সংখ্যা? অবশ্যই প্রথম দল; তার মানে কি সরকারি কর্মকর্তা মানেই ঘুষখোর, এমন স্টেরিওটাইপে পৌঁছাবে কোনো সচেতন বোধসম্পন্ন মানুষ? একটা স্কুলে একবার ভর্তি হলে সেখান থেকেই এসএসসি পাশ করে সাধারণত, অনিবার্য কারণ ছাড়া স্কুল বদলের ঘটনা দেখা যায় না সচরাচর। কিন্তু প্রাইভেট টিউটর টানা ২ সপ্তাহ অনুপস্থিত থাকলে বা কোচিং সিলেবাস শেষ করে না দিলে টিউটরও বাদ, কোচিংও ছাত্র হারাবে। ফলে এই সেক্টরে প্রতি মুহূর্তেই নিজেকে প্রমাণ করে টিকে থাকতে হয়। সার্ভিস বাজে, তুমিও নাই। মানসিক পরাধীনতা যে পর্যায়ে চলে গেছে তাতে কোচিং ইতিমধ্যেই আমাদের কালচারের অংশ হয়ে গেছে; এটা অবশ্যই গ্লানির এবং বেদনাদায়ক। কিন্তু আইন করে কি কালচার বদলে ফেলা সম্ভব? কোচিং বন্ধ হয়ে গেলো, তাতে কি অভিভাবকরা বাড়িতে শিক্ষক রাখা বাদ দিয়ে দেবে; পুলিশের পক্ষে কি সম্ভব বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদারকি করা গৃহশিক্ষক আছে কিনা? এজন্য কত লক্ষ পুলিশ লাগবে এবং কতদিন ধরে তারা এই কাজ করবে? কোচিং সেক্টর নিষিদ্ধ করলে পাড়া-মহল্লায় গজিয়ে উঠা কোচিং কি আদৌ বন্ধ করা সম্ভব হবে? সাইনবোর্ডওয়ালা বড় কোচিংগুলো হয়তোবা বন্ধ হবে, কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া পাড়া-মহল্লার ওইসব কোচিংকে ঘিরে তখন নতুন সিন্ডিকেট গড়ে উঠবে। স্থানীয় পাতি নেতা, পুলিশ, সাংবাদিক বিভিন্নভাবে টাকা আদায় করবে, কোচিংও চলবে। কতজন অভিভাবক মনে করে, কোচিং নিষিদ্ধ হলে তারা বাড়িতে শিক্ষক রাখবে না? কিংবা শিক্ষকদের বেতন ঠিক কত লক্ষ টাকা করা হলে তারা আর প্রাইভেট পড়াবে না? দুটোর একটারও যদি সন্তোষজনক উত্তর না দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে নিশ্চিত বুঝতে হবে সমস্যাটা কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনির নয়; সমস্যাটা কারণের মধ্যে নিহিত। বুয়েটে আমরা রেসনিক হ্যালিডের যে বই পড়তাম, কিংবা ম্যাথমেটিক্সে ডিফারেন্টশিয়াল ইকুয়েশনের বই পড়তাম, কোনোটাতেই উত্তর দেয়া থাকতো না; ফলে আমাদের নিশ্চিত হওয়ার জন্য কনসেপ্ট খুব ভালো বুঝতে হতো। উদাহরণের সমস্যার সাথে অনুশীলনীর সমস্যা খুব বেশি মিলতো না, যে কারণে থিওরিগুলো ভালো না বুঝলে একটারও সমাধান করা সম্ভব হতো না। জীবনে যত গণিত সমাধান করি, সমাজ-ভূগোল পড়ি, ব্যবহারিক জীবনে কিছুই তো কাজে লাগে না। তবু ওগুলো পড়ানো হয় আমাদের মধ্যে বোধ জাগ্রত করতে। সেক্ষেত্রে স্যারের সমাধান করে দেয়া ম্যাথ বা সাজেশনে কি বোধ তৈরি হবে? তার চাইতে কে কীভাবে চেষ্টা করেছে সেটাই বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত না? যদি তা-ই হয়, তখন তো আর প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজনই নেই। যেহেতু ডিমান্ড নেই, বিজনেস এমনিতেই বন্ধ। তা না করে উল্টোপাল্টা যতই উদ্যোগ নেয়া হোক, টার্গেট পূরণ হবে না। কোচিং থাকা না থাকা আসলে একই কথা। থাকলেও ক্ষতি নেই, না থাকলেও লাভ নেই। আপনার পেটে ব্যথা করছে, ২৩ বছর হাত-পা মালিশ করলেও পেট ব্যথা সারবে না, যতক্ষণ না পেট ব্যথার কারণ আবিষ্কার করে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হচ্ছে। শিক্ষা সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে বরাবর প্রাইভেট টিউটরিং বা কোচিং নিষিদ্ধ করতে চাওয়াটা এক ধরনের দায় এড়ানোর প্রবণতা বা নিজেদের অক্ষমতাকে আড়াল করতে বলির পাঠা বানানো। কোচিং তো বন্ধ আছে; প্রশ্ন ফাঁস কি রোধ করা গেছে? যাদের এখনো পর্যন্ত ধরা হয়েছে, তাদের মধ্যে শিক্ষক বা কোচিং ব্যবসায়ী কতজন? শিক্ষা একটি প্রকাণ্ড গ্যালাক্সি; প্রাইভেট টিউটরিং বা কোচিং সেখানে ছোট্ট একটা উপগ্রহের চাইতে বেশি কিছু নয় মোটেই। এটা এতোই তুচ্ছ যে একে আমলে নেয়ারই কিছু দেখি না। পরীক্ষা সিস্টেম নিয়ে গভীর গবেষণা করা হোক, দরকার পড়লে ছোট্ ছোট্ স্যাম্পল সাইজ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে ফলাফল দেখা হোক, তারপর বড় স্কেল অপারেশনে যাওয়া হোক। কিন্তু এটা নিশ্চিত পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন এই দুই ধারণায় বড় পরিবর্তন না আনলে ৫ লক্ষ হাতি-ঘোড়া মেরেও যুদ্ধ জয় হবে না।

কোচিং কি মূলধারার স্কুলের জন্য হুমকিস্বরূপ? এই প্রশ্নটাই চরমমাত্রার নিবুদ্ধিতার। সিক্স এ সাইড ক্রিকেটে হাত তালি কিছু মানুষ দিতেই পারে, তাই বলে এটা কি টেস্ট ক্রিকেটের জন্য হুমকি? নিজেদের যোগ্যতার ব্যাপারে এতো হীনম্মন্যতায় ভোগা লোকজন কীভাবে ফিউচার এসেট তৈরি করবে! ছায়া শিক্ষা বা শ্যাডো এডুকেশন বিষয়ে গুগলে সার্চ দিতে গিয়ে অবাক হলাম। ম্যাথেউ ইশেলস নামের এক স্কলার দীর্ঘদিন ধরে ছায়াশিক্ষা বিষয়ে এক গবেষণা চালাচ্ছেন। তিনি জানাচ্ছেন, সারাবিশ্বে ছায়াশিক্ষার মার্কেট ২০১৮ সাল নাগাদ ১০২.৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে, যা এপলের মার্কেট সাইজের ছয় ভাগের এক ভাগ প্রায়। ইত্তেফাকের এক রিপোর্টে পড়েছিলাম বাংলাদেশে কোচিংয়ের মার্কেট নাকি ৩২ হাজার কোটি টাকার। এতো বিপুল টাকা কীভাবে আসে? হয়তোবা একারণে কোচিং ব্যবসায় আগ্রহী মানুষের সংখ্যাও বেশি। ১ টা পারফিউমের দাম যদি ৫০০ টাকা হয়, ১ লাখ টাকার পারফিউম বিক্রি করতে কতগুলো পারফিউম বিক্রি করতে হবে। সকল খরচ বাদ দিয়ে প্রফিট কত টাকা থাকে? অন্যদিকে একজন ছাত্র মানে ১০০০০ টাকার প্রোডাক্ট হলে মাত্র ১০ জন ছাত্র হলেই ১ লাখ টাকা হয়ে যায়; সকল খরচ বাদ দিয়ে যা প্রফিট থাকবে তার মার্জিন বেশিরভাগ ফিজিকাল প্রোডাক্ট বিজনেসের চাইতেই বেশি হবে হয়তো। তবে ফাস্ট মুভিং বিজনেস সেক্টর তো কোচিং একা নয়; ক্লিনিকবা ট্রেডিং ব্যবসাও কাছাকাছিই হবে হয়তো। এই ক্যালকুলেশন থেকে অনেকেই হয়তোবা কোচিংয়ে চলে আসে, কিন্তু কোয়ালিটির সার্বক্ষণিক চ্যালেঞ্জ পূরণ করে টিকে থাকে কতজন? বরং ভার্সিটিউ পড়ুয়া কিছু তরুণ-তরুণী হাত খরচ চালানোর জন্য কোচিংয়ে ক্লাস নেয়, তাদের জড়তা কাটে; এটার একটা ছোট্ট ইমপ্যাক্ট আছে। এতে স্কুল- কলেজের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস কীভাবে তৈরি হতে পারে? ছায়া শিক্ষা কনসেপ্ট তো গ্লোবালি একসেপ্টেড একটা জিনিস। ১৯৮৪ তে দক্ষিণ কোরিয়ায় ছায়া শিক্ষা বাতিল করেও পরবর্তীতে চালু করতে বাধ্য হয়েছে। ছায়া শিক্ষা বিষয়ে মার্ক ব্যারি নামে ইউনেস্কোর প্রাক্তন এসিসটেন্ট ডিরেক্টর জেনারেল বিশাল কলেবরের এক বই-ই লিখে ফেলেছে দেখলাম, পড়া হয়নি অবশ্য। আমি পড়িনি, কারণ একাডেমিক শিক্ষা বিষয়ে আমার তেমন কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু আই মানে কী জানে না, ইউ মানে কী তাও জানে না, অথচ আই লাভ ইউ মানে ঠিকই জানে- এই ধরনের প্রোডাকশন দেখলে খারাপ লাগে। শিক্ষা খাতে তাই চিন্তাশীল ও মননশীল মানুষের যুক্ত হওয়া উচিত। ছায়া শিক্ষা- মায়াশিক্ষা বুঝি না, কিন্তু প্যারালেল স্কুল মুভমেন্ট দেশে জোরেশোরে যুক্ত হওয়া উচিত। অন্য পেশার মানুষ, অথচ শিক্ষা নিয়ে প্যাশনেট এমন মানুষ সেখানে কন্ট্রিবিউট করবে। বইয়ের ম্যাথ সেখানে সমাধান করা নিষেধ, কিন্তু সেই সংক্রান্ত থিওরি নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। তাতে কিছু ব্যালেন্সড মানুষ যদি পাওয়া যায়! এতো বড় উদ্যোগ চালিয়ে নিতে টাকা লাগবে। ছাত্র শিখছে, আগ্রহী মানুষ শেখাচ্ছে; উইন- উইন সিচুয়েশনে এক্সচেঞ্জ তো থাকতেই হবে, নইলে চ্যারিটি দিয়ে টেকা যায় কতদিন!

দেশ, কিংবা বিদেশ; কন্ট্রিবিউট করার জন্য সীমানা কোনো বিষয় নয়। প্যারালেল স্কুলিং সংস্কৃতি গড়ে উঠুক; তখন ভুইফোঁড় কোচিং, প্রাইভেট শিক্ষকতা এমনিতেই গ্ল্যামার হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শ্বাসরোধ করার চাইতে ডিমান্ড রোধ করা ভালো। কারণ শ্বাসরোধে একজন শেষ হয়, ডিমান্ড শূন্য করে দিলে পুরো সিস্টেম শেষ হয়ে যায়। স্মার্ট থিংকিংয়ের মানুষ খুচরো জিনিস দিয়ে ডিল করে না, মহাকারণ নিয়ে ডিল করে বলেই তারা স্মার্ট। জোড়াতালি আর দোষারোপ দিয়ে শূন্যতা আড়াল করা যায় না, অযোগ্যতা ধরা পড়বেই।

বি স্মার্ট, স্টে স্মার্ট……..