চঞ্চল চৌধুরির কি মার্কেট ডাউন হয়ে গেছে, নাকি ফেসভ্যালু বেচে যত বেশি টাকা উপার্জন করা যায় সেই নীতি বেছেছে, নইলে এরকম অন্তঃসারশূন্য স্ক্রিপ্টে তার কাজ করার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। চঞ্চলের পরিবর্তে যদি লিড রোলে তুলনামূলক অজনপ্রিয় কাউকে কাস্টিং করা হতো এটা কি কিনতো কোনো ওটিটি প্লাটফরম!—- ‘তাকদীর’ দেখার পরে আমার প্রাথমিক জিজ্ঞাসা ছিল এমনই।
বাংলাদেশি ভিজুয়াল কনটেন্টগুলো কেন মনে রেখাপাত করা অথবা নিখাদ বিনোদন দেয়া উভয় শর্ত পূরণেই ব্যর্থ হয় তার পারফেক্ট কেইস স্টাডি হতে পারে তাকদীর। ৩টি মৌলিক শর্ত পূরণ হলে ভিজুয়াল কনটেন্ট কমার্শিয়ালি অথবা ক্রিটিকালি সফলতা পায়
১. ক্যারেক্টারাইজেশন। স্টোরিলাইনের প্রটাগনিস্ট আর এন্টাগনিস্ট এর জন্য কতটা স্পেস বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেই স্পেস ব্যবহারের স্কোপ কেমন। যত বেশি এঙ্গেল থেকে তাদের ফোকাস করা হবে স্পেস এবং স্কোপ তত বৃদ্ধি পাবে।
২. স্ক্রিন টাইম ডিস্ট্রিবিউশন। প্রটাগনিস্ট-এন্টাগনিস্ট এর বাইরেও সাপোর্টিং এবং ফিলার ক্যারেক্টার থাকে প্রচুর। সেই ক্যারেক্টারগুলো কোন অনুপাতে স্ক্রিন টাইম পেল এটাও অতীব গুরুতর নিয়ামক। স্ক্রিন টাইম বন্টনে বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে কার্পণ্য করলে স্টোরিলাইনের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে।
৩. এনগেজিং অথবা কনফিউজিং স্টোরিলাইন এবং উইটি অথবা ইমোশনাল সংলাপ। বোনাস হিসেবে যুক্ত হতে পারে গান।
তাকদীর ৩টি শর্ত পূরণেই শোচনীয়রূপে ব্যর্থ, তবু একে ঘিরে আলোচনার কারণ একটাই- চঞ্চল চৌধুরির ফেসভ্যালু। সমকালীন বাংলা এন্টারটেইনমেন্ট অঙ্গনে সে ইতোমধ্যেই একজন কাল্ট ফিগার।
কনটেন্ট হিসেবে তাকদীর তালতুবাহীন হলেও চঞ্চল চৌধুরীর সাথে কোরিলেশন খুঁজতে গিয়ে মনে হলো ‘তাকদীর’ শব্দটার যদি প্র্যাক্টিকাল উদাহরণ চাওয়া হয় সেখানে চঞ্চল চৌধুরীর চাইতে উৎকৃষ্ট স্যাম্পল কে হতে পারে?
চঞ্চল চৌধুরী প্রথম লাইমলাইট পান কীভাবে?
গ্রামীণ ফোনের বিজ্ঞাপনে মডেলিংয়ের পাশাপাশি হেমন্ত মুখার্জীর ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ গানটি গাওয়ার মাধ্যমে, অথচ তিনি কোনো স্বীকৃত বা প্রতিষ্ঠিত গায়ক নন, অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন স্ট্রাগলিং
মুক্তির আগেই মানুষের মুখে মুখে সিনেমার গান ছড়িয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত খুব বেশি নয়, বিশেষত ইন্টারনেট পরবর্তী যুগে কোনোকিছুর প্রতি দীর্ঘমেয়াদী আকর্ষণ থাকাই অস্বাভাবিক ঘটনা। এর ব্যত্যয় ঘটিয়েছিল মনপুরা সিনেমাটি। একরৈখিক বিয়োগান্তক স্টোরিলাইন সত্ত্বেও মনপুরা মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হয়েছিল গানের দাপটেই। গিয়াসউদ্দিন সেলিম আরো সিনেমা নির্মাণ করেছেন, সেখানেও গান ছিল, কিন্তু মনপুরার এক পঞ্চমাংশ আলোড়নও কি তুলেছে সেগুলো? সেলিম কেন চঞ্চলকেই কাস্টিং করেছিলেন?
জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন নির্মাতা অমিতাভ রেজা চলচ্চিত্র পরিচালক হলেন আয়নাবাজির মাধ্যমে। সেখানেও লিড রোল চঞ্চল।
হুমায়ূন আহমেদ এর জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলি সিনেমায় স্থান পেলেন। সেখানেও চঞ্চল।
‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ গানটি ভাইরাল হলো। গায়ক চঞ্চল চৌধুরি।
এবং সাম্প্রতিক হাইপ ‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ গানসূত্রে হাওয়া সিনেমাটিকে ঘিরে যে তুমুল আগ্রহ, চঞ্চল আছে সেখানেও।
এতজন পৃথক পরিচালক যারা মার্কেটে গুণি হিসেবে জনশ্রুত তারা চঞ্চলকে লিড রোল এ পছন্দ করলে সেটাকে নিছক তাকদীর বললে তার যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করা হয়। আবার মার্কেটে চাহিদা থাকাও অনেক সময় পরিচালকের পছন্দকে প্রভাবিত করে।
কিন্তু কোনো প্রজেক্ট যখন শোরগোল তুলতে সমর্থ হয় সেখানে সবকিছুর সাথে তাকদীরও একটা অনুঘটক বটে। সেজন্য চঞ্চলের হয়তবা ভাগ্যের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করে কম-বেশি, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই এতটাও তীব্র নয় যে জন্য স্রেফ তাকদীর নামের কারণেই একটা আগাপাশতলাহীন স্টোরিলাইনে ঢুকে পড়তে হবে।
তাহলে ব্যাপারটা কী ঘটলো আসলে?
জানি না।
ওয়েবসিরিজগুলো যেভাবে আগায় তাতে লক্ষ্য থাকে সিক্যুয়েল তৈরির। তাকদীর এর সিক্যুয়েল নিয়ে আগ্রহ বোধের কারণ দেখি না, তবে প্রিক্যুয়েল হতেই পারে। মানে যে সেট আপ এ আমরা পেলাম সিরিজটাকে, সে অব্দি পৌঁছানোর ব্যাকস্টোরি কেমন ছিল, সেটা বরং অধিক এনগেজিং হবে।
আপনি কারো উপর চরম প্রতিশোধ নিতে চান? ফেসবুকে তার নামে একটা ফেক একাউন্ট খুলে সেখান থেকে ইসলাম ধর্ম বা নবীর উদ্দেশে করে ২-৩টা ঋণাত্মক বাক্য লিখুন। তারপর রটিয়ে দিন ধর্ম আর মহানবীর অবমাননা করা হয়েছে; পৃথিবী থেকে তার নাম-নিশানা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে। প্রচলিত ন্যারেটিভ হলো এসব উস্কানির পেছনে বহুমুখী রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক এজেন্ডা থাকে৷ তাকদীর এর স্টোরিলাইন সেই ন্যারেটিভের আভাস দিয়েই মিইয়ে গেল। এরপর স্ক্রিনজুড়ে শুধু লাশবাহী গাড়ি। একটা গাড়ি দেখার জন্য কতক্ষণই বা ব্যাকুলতা ধরে রাখা সম্ভব!
চঞ্চল এর ক্যারেক্টারাইজেশনে ন্যূনতম স্কোপ রাখা হয়নি। ফোনে কথা বলা, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগা আর ক্ষুব্ধ হওয়ার বাইরে তার জন্য আদৌ কি কোনো রসদ ছিল? প্রটাগনিস্টই যদি এমন অপুষ্টির শিকার হয়, স্টোরিলাইনের অপমৃত্যু ঘটে গেছে সেখানেই।
সানজিদা প্রীতিকে বারবার পরিচয় করানো হয়েছে হাইপ্রোফাইল সাংবাদিক হিসেবে, অথচ তার চলন-বলন এবং কার্যক্রম এন্ট্রি লেভেল এক্সিকিউটিভের চাইতে ব্যতিক্রমী কিছু করা হয়েছে কি? গল্পের প্রয়োজনে তার খুন হওয়াটা আবশ্যক ছিল, কিন্তু খুনের কার্যকারণ এতটা আনাড়ি ধরনের হলে ক্যারেক্টারের প্রতি জাস্টিস হয় কি?
স্ক্রিনে পার্থ বড়ুয়াকে দেখে মনে হচ্ছিল সোলস ব্যান্ডের সদস্যদের উপর ডকুমেন্টারি নির্মিত হচ্ছে। পার্থ সেই উদ্দেশ্যে শট দিচ্ছেন। অভিনয় যে বিশেষ ধরনের স্কিল, এবং সবার জন্য নয়, পার্থকে দেখে বোঝা গেছে শৌখিনতা আর স্কিলের মধ্যে তফাতটা কত যোজন। ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক’–এই সংলাপ একজন নির্দয় প্রকৃতির হিটম্যানের মুখে শুনলে শিরদাড়া ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার কথা, এটাই অভিনেতার সার্থকতা। অথচ পার্থ বড়ুয়া যতবার সংলাপটি ডেলিভার করেছে মনে হচ্ছিল লাজুক মেয়ে জামাই শ্বশুরের সাথে কথা বলছে।
এই যদি হয় এন্টাগনিস্ট, সেটা স্কুলবালকের হ্যান্ডি ক্যামে শ্যুট করা শর্টফিল্মের চাইতে আলাদা আর কী হবে!
অপর এন্টাগনিস্ট ইন্তেখাব দিনারের নামে এলাকায় বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খায়, সেসব শুধু শুনেই গেলাম, দেখবার সুযোগ জুটলো না। অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সমু চৌধুরি আর প্রধান এন্টাগনিস্ট দিনার—- দুয়ের স্ক্রিন টাইম আর ক্যারেক্টারাইজেশনে হেরফের অতি সামান্য।
তবে তাকদীর নামের সার্থকতা আসতে পারে মন্টু চরিত্রে রূপদানকারী সোহেল মন্ডল এর জন্য৷ পার্শ্ব চরিত্র হয়েও মূখ্য চরিত্রদের তুলনায় অনেক বেশি ভাইব্রেন্ট৷ এতে যেটা হবে সোহেল মন্ডল পরবর্তীতে কিছু প্রজেক্ট পাবে, যেখানে চরিত্র হিসেবে তার জুটবে প্রমোশন৷ তাকেই বলা যেতে পারে তাকদীর এর একমাত্র বেনিফিশারি।
বাংলাদেশী কনটেন্টগুলোর ক্যারেক্টারাইজেশন এমন নাজুক কেন?
আমার হাইপোথিসিস হলো, স্ক্রিপ্ট রাইটারদের সম্মানি নিতান্তই অসম্মানজনক। একটা স্ক্রিপ্ট লিখবার পরে সেটাকে ফারনিশ এবং ফাইন টিউন করতে যে পরিমাণ শ্রম, সাধনা এবং সময়ের খরচ হয় বিপরীতে রিটার্ন প্রফিটেবল নয়। বরং একটা ন্যারেটিভ প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে: ফিল্ম চলে নায়ক-নায়িকার নামে। কিন্তু স্টোরিলাইন যদি হয় এমেচার প্রকৃতির, সংলাপে না থাকে এক্স-ফ্যাক্টর, কেবল চেহারা দেখিয়ে ভুলিয়ে রাখা সম্ভব দর্শককে; তারা কি ফিডার খায়?
ভিজুয়াল কনটেন্টের প্রোডাকশন কোয়ালিটি উন্নত করতে বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে। হয়ত বাড়বে আরো। এতে লুক এন্ড ফিল এ পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক। ফিল্ম আর্টের চাইতে কমার্স বেশি। কাঁচামাল বাজে হলে প্যাকেজিং, প্রমোশন যা-ই করা হোক, প্রোডাক্ট মুখ থুবড়ে পড়বেই। ফিল্মে যারা অর্থলগ্নি করে তাদের না বুঝিয়ে উপায় নেই যে স্ক্রিপ্টিংয়ের জন্য আলাদা বাজেট রাখলে প্রফিট বৃদ্ধির সম্ভাবনাও বাড়বে। নইলে যেটা হবে, কয়েক বছরের মধ্যেই ওয়েব সিরিজ বা ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম মেকারদের কাজগুলোও হবে ভিন্ন চেহারার ‘শান্ত কেন মাস্তান’ বা ‘কাল্লু মামা’ তথা এফডিসির পরিত্যক্ত ভাগাড়!