[“সাকিবই বাংলাদেশের একমাত্র খেলোয়াড় যাকে কমপ্লিট একজন খেলোয়াড় মনে হয়। আর এই মনে হওয়া থেকেই আশঙ্কার শুরু। এদেশের ক্রিকেটারদের হঠাৎ ঝলকানি,আর অচিরেই নিভে যাওয়ার দৃষ্টান্ত এত বেশি যে আশঙ্কাকে অমূলকও বলা যাচ্ছেনা”…………….. ৮ বছর আগে সামহোয়ারইন ব্লগে সাকিবকে নিয়ে একটা ছোট্ট পোস্ট লিখেছিলাম, শুরুর লাইনগুলো সেখান থেকেই ধার নেয়া।
বিগত ৮ বছরে সাকিবকে ঘিরে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে কয়েক লক্ষ লেখার জন্ম-মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু ২০০৯ এর পরে আশ্চর্যজনকভাবে হলেও আমি সাকিবকে নিয়ে কিছুই লিখিনি। ক্রিকেটসংক্রান্ত অনেক লেখাতেই সাকিবের প্রসঙ্গ চলে এসেছে, কিন্তু শুধুমাত্র সাকিবকে নিয়ে লেখাই হয়নি। মনে হলো, এবার লেখা উচিত। লক্ষ লেখার ভিড়ে হারিয়ে গেলেও লেখা উচিত, কেউ শেয়ার করলে লেখা উচিত, কেউ এড়িয়ে গেলেও লেখা উচিত। ‘ঔচিত্যবোধ’ এর প্রাবল্য একপ্রকার বাধ্য করছে ‘সাকিব পর্যালোচনা’কে একটি কাঠামোমুক্ত রূপে নিয়ে আসতে। চেষ্টা করে দেখা যাক]
সাকিব- পূর্বকথা:
২০০৭ বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুইয়ে সফরে (সম্ভবত ২০০৬ এ) সাকিবের অভিষেক হলেও বয়সভিত্তিক দলে খেলাসূত্রে তার নামটা পত্রিকায় আসতো মাঝেমধ্যেই। তার চাইতে সেসময় সোহরাওয়ার্দি শুভ নামটা বেশি পরিচিত হলেও জাতীয় দলে শুভর আগে অভিষেক হয় তার, এবং পরবর্তীতে শুভ আসলেও বয়সভিত্তিক দলের পারফরম্যান্সের ধারেকাছেও পৌঁছুতে পারেনি। শুরুতে বোলিং জানা ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে খেলতে হয়, কারণ রফিক আর রাজ্জাক থাকায় বাঁহাতি স্পিনের সার্ভিস খুব বেশি প্রয়োজন পড়েনি। টেস্ট শুরু করে ব্যাটিং জানা বোলার হিসেবে; প্রথম ২-১টা টেস্টে বোধহয় ৭-৮ নম্বরে ব্যাটিং করেছিলো।
সাকিব- অনন্যতা:
কয়েকটা ম্যাচ দেখার পরেই যে বিষয়টা বোঝা যায় সেটা হলো, সাকিবের ধারাবাহিকতা এযাবতকালে বাংলাদেশের হয়ে খেলা যে কোনো ক্রিকেটারের চাইতে বহুগুণ বেশি। ইতিপূর্বে মেহরাব হোসেন অপি, আলশাহরিয়ার রোকন, আশরাফুল, শাহরিয়ার নাফিস, অলক কাপালি, নাফিস ইকবাল, নাজিমউদ্দিন, আফতাব আহমেদ- বহুজনকে নিয়ে আশা করা হয়েছে, কিন্তু কয়েকটা ম্যাচ ভালো খেলেই তারা নিষ্প্রভ হয়ে গেছেন। কনসিসটেন্সি আর বাংলাদেশী ক্রিকেটার যেন পৃথিবীর দুই বিপরীত গোলার্ধে বসবাস করতো।
আরেকটা বড় ব্যাপার হলো, যাদের নাম উল্লেখ করলাম তারা প্রত্যেকেই ছিলো ব্যাটসম্যান; সাকিব ব্যাটিং-বোলিং দুটোতেই অবদান রাখতে সক্ষম। এর আগে কোনো অলরাউন্ডারকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ জমেনি। নাঈমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাহমুদ সুজন, মুশফিক বাবু- এদের অলরাউন্ডার হিসেবে চালিয়ে দেয়ার জোর চেষ্টা চালানো হলেও তারা নিজেরাও জানতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মানদণ্ডে তারা কতটা পিছিয়ে আছে প্রতিভায়।
এবার একটু ভিন্ন স্টাইলে লিখি।
ব্যাটসম্যান সাকিব (ওয়ানডে):
• সাকিবের ব্যাটিংয়ের প্রধান শক্তি সিঙ্গেলস বের করার ক্ষমতা। সে যখন ব্যাট করে মাঠকে অনেক বড় মনে হয়, ওভারে কোনো বাউন্ডারি না এলেও কীভাবে যেন রান আসতেই থাকে। রানিং বিটুইন দ্য উইকেটেও সে দুর্দান্ত।
• ক্যারিয়ারের শুরু থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত সে স্কুপ শটটা বেশ ভালো খেলতো। কিন্তু ক্রমাগত আউট হয়ে যাওয়ায় সর্বশেষ ৩-৪ বছরে এই শট তাকে খেলতে দেখা যায় না সচরাচর। একসময় ফ্ল্যাশ আর আপার কাটও বেশ ভালো খেলতো; কোনো অজানা কারণে সেসব শট খেলা থেকেও বিরত রাখছে নিজেকে।
• এখন সাকিবের স্কোরিং জোন মূলত ড্রাইভ আর ক্রস ব্যাটেড শট। যেসব শর্ট বলে আগে আপার কাট করার চেষ্টা করতো সেগুলো এখন ডিপ স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে খেলার চেষ্টা করে, যার বেশিরভাগই টপ এজড হয়ে নো ম্যানস ল্যান্ডে পড়ে। তামীম বা মুশফিকের মতো সে প্রোপার ব্যাটসম্যান নয়, তাদের মতো ট্রেডমার্ক শটও তার নেই। তবু বুদ্ধি খাটিয়ে নিজস্ব স্টাইলে সে রান করে নেয়; দিনশেষে স্কোরই ম্যাটারস, স্টাইল বা অন্য কিছু নয়।
ব্যাটসম্যান সাকিব (টেস্ট):
• সাকিবের ডিফেন্সিভ টেকনিক মোটেই আস্থাজনক নয়। এটাকিং ফিল্ডিংয়ের সুযোগ নিয়ে যদি কিছু রান করে বোলারকে কৌশল বদলাতে বাধ্য করা যায়, সেটা তো একধরনের সাইকোলজিকাল এডভান্টেজ। থার্ডম্যান করিডর তার প্রধান স্কোরিং জোন; সেটা আটকে দিলে রান বের করতে কষ্ট হয়। একারণে ওয়ানডের তুলনায় টেস্টে সে অনেক বেশি শেকি থাকে। তবু এই সীমাবদ্ধতা নিয়েই সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, কখনো কখনো সুযোগ তৈরির জন্য ঝুঁকি নেয়। রান করাই শেষ পর্যন্ত আসল কথা, কীভাবে এলো ব্যাপার না; এটাই তার টেস্ট ব্যাটিংয়ের সারকথা।
• সাকিবই বোধহয় বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার যে জাতীয় দলের খেলার বাইরে পুরো সময় টি২০ খেলে সরাসরি টেস্ট খেলে। বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচের সাথে পরিচয় হয় তার টেস্ট খেলার মধ্য দিয়ে। এই অনভ্যস্ততাকে সে ট্রেড অফ করে ‘গ্যাম্বলিং’ থিওরি দিয়ে। সেটা কেমন? একজন ব্যাটসম্যান সব ম্যাচে কি রান পায়, অনেক ম্যাচেই ফ্লপ করে। কিন্তু একটা স্টাইল ধরে রাখলে প্রত্যেক ম্যাচেই কিছু রান করা যেতে পারে, কোনো কোনো ম্যাচে অনেক রান করা যাবে, এবং কয়েকটা ম্যাচে খুবই বাজে হবে। রান করা এবং উইকেট পাওয়া দুটোই ভাগ্যের ব্যাপার। সুতরাং সেই ভাগ্যকে নিয়ে গ্যাম্বলিং করলেই তো হয়। সেটার রূপায়ণ হলো, এগ্রেসিভ ব্যাটিং করা, ম্যাচের পরিস্থিতি যা-ই হোক। যদি কাজে লাগে প্রচুর রান হবে, কাজে না লাগলে সবচেয়ে খারাপ পরিণতি কী? আউট হওয়া। সেটা তো সব ব্যাটসম্যানই হবে। যেহেতু ডিফেন্স জোরালো নয়, এবং বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচও খেলা হয় না, এমন ব্যাটসম্যান রান করার জন্য এগ্রেসিভ না খেললে ৪০ বলও তো টিকতে পারবে না। এই সিম্পল এপ্রোচটা ধরতে না পেরে ক্রিকেট সমর্থক থেকে শুরু করে কর্তাব্যক্তিরা পর্যন্ত তার দোষ দেয়।
বোলার সাকিব:
স্পিনার বলা হলেও সাকিবের বলে টার্ন, বাউন্স কোনোটাই খুব বেশি নেই। তার প্রধান অস্ত্র একুইরেসি; এমন একটা স্পটে সে বল ফেলে যেটা খেলতে ব্যাটসম্যানের সমস্যা হয়; আর পেস এর ভ্যারিয়েশন, যে কারণে তার উইকেটগুলোর বেশিরভাগই মিসটাইমিংয়ে ক্যাচসূত্রে পাওয়া। একসময় তার আর্মার ডেলিভারিটাও খুব ভয়ঙ্কর ছিলো, সর্বশেষ কয়েক বছরে এটার ব্যবহার কমে গেছে। টি২০ আর টেস্টের বোলিংয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকলেও তাকে ক্রমাগত এই চর্চার মধ্য দিয়েই যেতে হয়।
অধিনায়ক সাকিব:
সাকিবের অধিনায়কত্বটা হুট করেই পাওয়া, চলে যাওয়াটাও সেভাবেই। মাশরাফি ম্যাচ চলাকালে ইনজুরিতে পড়ায় মাঠের মধ্যেই তাকে দায়িত্ব নিতে হয়, এরপরে কয়েকটা সিরিজ অধিনায়কত্ব করে মাশরাফির অনুপস্থিতিতে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। পূর্ণকালীন দায়িত্ব পাওয়ার পর বিশ্বকাপসহ কয়েকটা সিরিজে অধিনায়কত্ব করেছে।
অধিনায়ক সাকিব অনেক বেশি এটাকিং, এবং ইনোভেটিভ। ফিল্ড প্লেসমেন্টেও চমৎকারিত্ব দেখা যায়। বোলার পরিবর্তন, বিশেষ করে পার্ট টাইমারদের হ্যান্ডল করার দক্ষতা সত্যিই প্রশংসাতীত। মাহমুদুল্লাহ, নাঈম ইসলামদের মতো পার্ট টাইমারদের ব্যবহারে তার মুন্সিয়ানা বহুবার দেখেছি। তার সময়ে আমরা বেশকিছু ক্লোজ ম্যাচ খেলেছিলাম, যেগুলো শুরুতে মনে হয়েছিল বিপক্ষ দল সহজেই জিতে যাবে। এসব মোমেন্টাম শিফটের মধ্য দিয়েই অধিনায়কত্ব চেনা যায়। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত যতজন অধিনায়কত্ব করেছে, শুধুমাত্র অনফিল্ড পারফরম্যান্স বিবেচনাতে আমি তাকে বেস্ট বলতে চাই। তবে অধিনায়কত্ব যেহেতু অন ফিল্ডের বাইরে অফ ফিল্ডেও সমান দরকারী, সেক্ষেত্রে মাশরাফি আর হাবিবুল বাশার তাকে পিছনে ফেলে দেবে।
তবে যে প্রক্রিয়ায় তাকে অধিনায়কত্ব থেকে অপসারণ করা হয়েছে, এরকম আনপ্রফেশনাল এবং অসৌজন্যসূচক আচরণের দৃষ্টান্ত নিকট ভবিষ্যতে একটাই: মাহমুদুল্লাহকে শততম টেস্টের বেস্ট ইলেভেন থেকে বাদ দেয়া। আমাদের সবকিছুতে দ্রুতি প্রলেপ পড়ে যায় বলে এটাও ভুলে গেছি সাকিবের মতো একজন ক্রিকেটারকে এভাবে অপসারণ করাটা কতটা শিষ্টাচারবহির্ভূত ছিলো।
পয়েন্ট আকারে অনেকটা পথ লিখে ফেলেছি। এবার ফ্ল্যাট লিখি।
আমি ক্রিকেট ইতিহাসের মাত্র একজন খেলোয়াড়ের নাম জানতে চাই যাকে সাকিবের মতো ব্যাটিং-বোলিং দু’বিভাগেইে একদম সমান এফোর্ট দিতে হয়েছে এবং দুই ক্ষেত্রেই তার প্রতি একইরকম প্রত্যাশা ছিলো। গ্যারি সোবার্স, রিচার্ড হ্যাডলি, ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, ইমরান খান, জ্যাক ক্যালিস, ক্রিস কেয়ার্নস, এন্ড্রু ফ্লিন্টফ, বেন স্টোকস, যতগুলো নাম মনে এলো বললাম। তাদের কথা পুরোপুরি মাথায় রেখেই প্রশ্নটা আবার করছি। একজন খেলোয়াড়ের নাম জানতে চাই। ডব্লিউ জি গ্রেসও সম্ভবত বোলিংয়ে প্রচুর উইকেট পেত, তবু তাকে ঘিরে যত গল্প শোনা যায় সবই ব্যাটিংকেন্দ্রিক। আমি তাই সাকিবের মতো ভূমিকা পালন করতে হয়েছে এমন একজনকেও পাইনি। পরিসংখ্যান বলে ক্যালিস বিশাল অলরাউন্ডার; কিন্তু একবার চোখ বন্ধ করে ক্যালিসের কথা ভাবুন, দেখবেন প্রতিবারই ব্যাটসম্যান ক্যালিস আপনার মাথায় আসছে। সাউথ আফ্রিকার বোলার বললে ডোনাল্ড, পোলক, এনটিনি, স্টেইন, মরকেল এরাই আসছে বারবার। বোথামের নাম মনে করুন; কখনো বোলার, কখনো ব্যাটিং পরিচয় মাথায় আসবে, কিন্তু টিমের ১ জন মাত্র বোলার, ১জন মাত্র ব্যাটসম্যানের কথা ভাবতে বলুন, কোথাও বোথাম নেই। এখানেই সাকিবের সাথে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যদের পার্থক্য। বাংলাদেশের খেলা, বোলিং করবে সাকিব, ব্যাটিং করবে সাকিব; তার আলাদা কোনো পরিচয় আপনি বের করতে পারবেন না। এই ইমপ্যাক্টকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। আমাদের ব্যাটিংয়ে তামীম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ আছে; সৌম্য, সাব্বির, মোসাদ্দেকরা তৈরি হচ্ছে, তবু কার ব্যাটিং সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখেন? সাকিবের। বোলিংয়ে মাশরাফি আছে, মুস্তাফিজ আছে, তাসকিন, রুবেল আছে, তবু সেই সাকিবই ভরসা। এরকম এক্সাক্টলি সমান ইমপ্যাক্ট রাখা খেলোয়াড় কে আছে? প্লিজ নাম বলুন।
এই লাইন পড়ে. অনেকে বলতে পারেন সাকিব কি তাহলে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়? কোনোভাবেই নয়। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তালিকা করলে সেখানে নেই, বোলারদের মধ্যেও না; সুতরাং খেলোয়াড়ি মেরিট বিবেচনা করলে সাকিব বহু দূরে থাকবে। তবে আমি ব্যক্তিভাবে ‘সর্বকাল’ ধারণার সাথেই একমত নই। একটা জেনারেশনের সাথে আরেক জেনারেশনের যোজন যোজন ব্যবধান; তাদের মধ্যে তুলনা করার কমন গ্রাউন্ডই তো নেই। তবু পপুলার ডিবেট হিসেবে ‘সর্বকাল’ ঢুকে পড়েছে, এবং সর্বক্ষেত্রেই এটা চলছে।
ক্রিকেট ইতিহাস সাকিবকে মূল্যায়ন করবে উঠতি দলের একজন বিশাল তারকা হিসেবে বড়জোড়, কারণ ইতিহাস লেখে ক্ষমতাশালীরা, কিন্তু একদম নিরপেক্ষ কোনো ক্রিকেট বিশ্লেষক যদি টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো নিয়ে গবেষণা করে, ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ে কাজ করে, সেখানে সাকিবের সাথে একই কাতারে রাখার মতো ক্রিকেটার পেতে তাকে সত্যিই হিমশিম খেতে হবে।
সাকিবকে নিয়ে এদেশের মানুষ এতো সমালোচনা করে কেন? আরেকপক্ষ ঢালাওভাবে তাকে সমর্থন করে কেন? দুটোর কারণ অভিন্ন, শুধু প্রকাশভঙ্গিটা ভিন্ন। সমালোচকেরা মনে করে, সাকিব হচ্ছে তামিল সিনেমার নায়ক, যে হাতের ধাক্কায় বিল্ডিং কাঁপিয়ে দেবে। কিন্তু সাকিব তো সীমাবদ্ধতা সম্পন্ন একজন ক্রিকেটার। সে জানে কোহলির মতো ব্যাটিং সে করতে পারবে না, মুরালির মতো স্পিন করাতে পারবে না; সে ব্যাটিং-বোলিং দুক্ষেত্রেই কন্ট্রিবিউট করতে পারবে। এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারে না বলে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়, সেটা রূপ নেয় ক্ষোভে।
সাকিবের সমালোচনাকে ২টি অধ্যায়ে বিভক্ত করা যায়: অধিনায়কত্বকালীন, এবং ২০১৪ পরবর্তী। অধিনায়কত্বকালে তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, সে দলের মধ্যে গ্রুপিং করে। বিকেএসপি থেকে আসা ক্রিকেটার আর তামীম-মুশফিকদের সাথে নিয়ে সে একটা কোরাম তৈরি করেছে, যার প্রশ্রয়দাতা তৎকালীন কোচ জেমি সিডন্স। রকিবুল, জুনায়েদ সিদ্দিক, নাঈম ইসলাম, ইমরুল কায়েস প্রমুখ ক্রিকেটারদের সুযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে আশরাফুলকে হটাও নীতি বেশি কাজ করেছে, মাশরাফিকে টিমে না চাওয়ার ক্ষেত্রে সাকিবের হাত আছে- এরকম বহু লেখা আমরা পড়েছি। এসবের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা সময় অপচয়। যে কোনো গোত্র বা গোষ্ঠীতে পলিটিক্স খুব সাধারণ প্রবণতা, ৩ জন বাঙালি একসাথে থাকলে সেখানে পলিটিক্স হবেই; সাকিবও হয়তো তেমন কিছু করেছিলো। যখন যে ক্ষমতায় থাকে সে-ই চায় তার আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে, কেউ পজিটিভ এপ্রোচে চেষ্টা করে, কেউ স্বৈরতান্ত্রিক এপ্রোচে, কিন্তু টার্গেট একই। ক্ষমতার উত্তাপকে উপেক্ষা করা আসলেই দুরূহ। সাকিব যদি সত্যিই গ্রুপিং করে থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু গ্রুপিংকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যাদের মেরুদণ্ড থাকার কথা, তাদের ভূমিকা কতটুকু আন্তরিক, সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু মেলে না।
সাকিবের জনপ্রিয়তায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে ২০১১ বিশ্বকাপ চলাকালে সাবেক ক্রিকেটারদের ক্রিকেটীয় যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে। বিশ্বকাপে ৫৮ রানে অলআউট হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু খেলায় তো এমনটা হতেই পারে। সেটা মেনে নেয়ার মতো স্পোর্টিং মানসিকতা আমাদের সাবেক ক্রিকেটারদের নেই, সমর্থকদের কথা বাদই দিলাম। তারা শুধু জয় দেখতে চায়, জয়ের জন্য প্রার্থনা করে। কিন্তু সাবেক ক্রিকেটাররাও আমজনতার কাতারে চলে গেলে তাদের খেলাধুলার মূল্য কোথায়! সেক্ষেত্রে , সাবেক খেলোয়াড়- সাকিব দুপক্ষই অন্যায় করেছে, কিন্তু সাকিবকে একাই সকল সমালোচনা সইতে হয়েছে, কারণ সে তারকা।
সাকিব আবার সমালোচিত হয় ২০১২ তে বিয়ে করার পর। তার স্ত্রী কেন আমেরিকান, এরকম কুযুক্তি নিয়েও কথা কম চালাচালি হয়নি। এর বাইরে যেসব সমালোচনা সবই অযাচিত। যেমন, ক্যামেরার সামনে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করার কারণে শাস্তি পাওয়া, হাথুরুসিংহে কোচ হয়ে আসার পর ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগে খেলা নিয়ে ঝামেলাসূত্রে নিষেধাজ্ঞা, এগুলো সবই ঘটেছে।
২০১৪ এর পর থেকে সাকিবের সমালোচনায় ভিন্ন কিছু ডাইমেনশন যুক্ত হয়েছে। যেমন, সাকিব নাকি টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না।
সাকিবকে আমরা চিনি ক্রিকেটার হিসেবে। সে কি আমার ভাই, নাকি বন্ধু? যদি হয়ও, তাতেই কি? আপনি তার সাথে ছবি তুলতে চাইবেন, সে রাগ করলেই দোষ। আপনি-আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ জিজ্ঞেসও করে না ভাই কেমন আছেন, অথচ সাকিবকে দেখলে শত শত মানুষ তাকিয়ে থাকে। কাজেই আপনি কীভাবে বুঝবেন তার মনে কী প্রতিক্রিয়া ঘটছে। সে হয়তো ৫ জনের সাথে খুশিমনে ছবি তুলেছে, কিন্তু সংখ্যাটা যদি ৫০০ হয়ে যায়; তার কি বিরক্ত লাগতে পারে না? আপনি বুঝতেই পারেন না, সে আর আপনি টোটালি আলাদা শ্রেণীতে বিলং করেন এটা বোঝেন না? রাস্তায় বের হলে যদি দেখেন প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি যাবে, সব গাড়ি বন্ধ, মানুষের চলাচল বন্ধ; সমস্ত জনজীবন স্তব্ধ। দেশের প্রধানমন্ত্রী ম্যাচ শেষে নিজে সাকিবকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানান; এইবার বুঝেছেন পার্থক্যটা কোন্ লেভেলে? অথচ, আপনি তার ব্যাপারে গোস্বা করে আছেন, তাকে গালি না দিলে আপনার ভালো লাগে না। সাকিবের ছবি ব্যবহার করে মোটর বাইক বিক্রি করছেন, আইসক্রিম বিক্রি করছেন, কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছেন, বিনিময়ে সাকিবের কাছে কী আশা করেছিলেন? সে আপনার পণ্যের বিজ্ঞাপন নামমাত্র মূল্যে করে দিবে। কিংবা, সাকিবের একটা সাক্ষাৎকার লক্ষ লক্ষ মানুষ পড়বে, আপনার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে একটা মাইলফলক যুক্ত হচ্ছে; আপনি কী আশা করেছিলেন, আপনি বলামাত্র সে আপনাকে বাসায় এসে ইন্টারভিউয়ের জন্য ইনভাইট করবে? আপনি/ আপনারা নিজেরা সাকিবের মুখাপেক্ষী হচ্ছেন চরম স্বার্থ চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে, অথচ সাকিব স্রেফ নিজের ভ্যালুটা বুঝতে চাইলেই তখন তার পারসোনালিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? প্রশ্ন করতে পারেন, সাকিব এতোগুলো বিদেশী টি২০ লীগে কেন খেলে, একমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফ্রিল্যান্সার ক্রিকেটার ছাড়া আর কেউই এভাবে ফেরিওয়ালার মতো খেলে বেড়ায় না। ১টা, সর্বোচ্চ ২টা লীগ খেলে বাকি সময় ফার্স্ট ক্লাস খেলা উচিত; এটা নিয়ে কথা বলুন, তা না বলে লিখছেন টাকার লোভে সাকিব খ্যাপ খেলে। আপনি নিজে ৩ হাজার টাকার লোভ সংবরণ করতে পারেন না, ৩ কোটি টাকা পেলে কী করতেন সেই খেয়াল আছে? কয়েক বছর আগেও টেন্ডুলকারকে অনুসরণ করতো হাজার হাজার ক্যামেরা, কোটি কোটি দর্শক। আজ কোথায় টেন্ডুলকার?
সাকিবের পরিণতিও তো তা-ই হবে। ক্রিকেট ছেড়ে দিলে সাকিবকে নিয়ে কারো কি কোনো মাথা ব্যথা থাকবে? ভিভ রিচার্ডস কোন পানশালায় গিয়ে বেহুঁশ হয়ে আছে, জানে কেউ? স্টারডম ব্যাপারটা চিরকালই সাময়িক। বিশেষ করে এন্টারটেইনমেন্ট সেক্টরে এটা আরও ধ্রুবসত্য। এই আছে এই নাই। সাকিব যদি পরের কোনো ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে ৩ টা সিরিজ মিস করে, কারো মাথায়ই থাকবে না সাকিব কী করছে, কোথায় আছে! ২০ বছর বয়সে আমরা কী করি? ভার্সিটিতে ভর্তি হই, বড়জোড় টিউশনি করি। সেখানে ২০ বছর বয়সে একটা কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছে; এবং ১০ বছর ধরে পরিসর কেবলই বেড়েছে; এই জীবনের সাথে আপনি একটা গড়পড়তা জীবন মেলাতে চান কোন্ যুক্তিতে? এতোটাই নির্বোধ আপনি!
একবার ভেবেছেন, একজন মানুষ ৩০-৩৫ বছর বয়সে চাকরিতে স্টেবল হয়, আর একজন ক্রিকেটার সেই বয়সে অবসরে যায়। বাকি জীবন সে কী করবে ভেবেছেন কখনো? বলতে পারেন, ওরা যে পরিমাণ টাকা উপার্জন করে, একজন চাকরিজীবী সারাজীবনেও তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারবে না। একটা সহজ সূত্র বলি, যার যত আয়, তার ব্যয়ও সেভাবে। যেমন, একটা ম্যাচ খেলে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়ে ১ লাখ টাকা প্রাইজমানি পেলো; বিলিভ মি, সেটা পার্টি, খাওয়াদাওয়া আর শপিংয়েই চলে যাবে। এই টাকাগুলোর কোনো হিসাব থাকে না আসলে। শেয়ারবাজার, বাজি ধরা, বা ডেসটিনিসূত্রে অনেকেই প্রচুর টাকা উপার্জন করেছেন, কিন্তু জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাদের সঞ্চয়ের ভাণ্ডার ফাঁকা। কারণ ম্যাচিউরিটির একটা ব্যাপার আছে, দীর্ঘসূত্রীতার একটা ইনফ্লুয়েন্স আছে। ২০ বছরের একজন তরুণ ২ লাখ টাকা পেলে সে যেভাবে খরচ করবে, ৪০ বছরের একজন কি সেভাবে করবে? কিংবা সারামাস খাটুনির পর ৫০ হাজার টাকা পেলে সেটার প্রতি যে দরদ, ১দিনের ১টা ম্যাচ খেলে ৫ লাখ টাকা পাওয়া গেলে দুটোর প্রতি দরদ কি এক হবে? কখনোই না। আপনি তো বয়স বাড়ছে, আর টাকা জমাচ্ছেন, কিন্তু ক্রিকেটার কী করছে? ৪০ বছর বয়সে আপনি চাকরিতে অনেক ভালো পজিশনে চলে গেছেন, আপনার সাথের ক্রিকেটারটি তো আরও ৫ বছর আগেই খেলা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। তার খবর জানেন? মোহাম্মদ রফিকের খেলা দেখার জন্য একসময় কত আগ্রহী ছিলেন, সেই রফিক এখন কী করছে জানেন নাকি? সাকিবও তো একদিন রফিক, আকরাম হয়ে যাবে। তখন সে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করছে, নাকি আমেরিকায় স্থায়ী হয়ে গেলো, তা ভেবে একটি মুহূর্ত্ও খরচ করবেন কি? তাহলে সাকিব যদি খেলার বাইরে নিজের জীবন সাজানোর জন্য সাময়িক স্টারডম ভ্যালুর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায়, তাতে আপনার খারাপ লাগার হেতু কী? নিজের অক্ষমতার জন্য আরেকজনের সাফল্যকে ঈর্ষা করেন? লজ্জা নেই আপনার? ছিঃ
একটা অনলাইনে পোর্টালে একবার নিউজ এলো, সাকিবের সম্পদের পরিমাণ ২৭৫ কোটি টাকা। এটা দেখার পরই বোধহয় পরশ্রীকাতর বাঙালি নড়েচড়ে বসে। আমি আর সাকিব একদম সমবয়সী; সে যখন ক্যারিয়ার শুরু করে আমি তখন বুয়েটে পড়ি; ফলে তার বেড়ে উঠাটা একদম নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নিতে পেরেছি। আমি যতদিনে উপার্জনক্ষম হয়েছি, ততদিনে সে কোটিপতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি এই সমস্যাটায় আক্রান্ত হয়েছে বোধকরি। ৩০ বছর বয়স হয় নাই অথচ ৩০০ কোটি টাকার মালিক; ঠিক আছে তো মতিগতি? অথচ একবারও মাথায় আসে না, ৩০০ না হয়ে টাকাটা যদি ৩০০০ কোটিও হয়, সেখানে কাউকে ঠকানো একটা পয়সাও নেই, কঠিন রোদের নিচে পরিশ্রম করে গড়া নিজের ব্যক্তিইমেজের বিনিময়ে অর্জিত প্রতিটি টাকা। ১ কোটি টাকার মধ্যেই যেখানে ৭০ লাখ থাকে মানুষকে ঠকানো টাকা, সেখানে এরকম সৎ উপার্জনের দিকেও আমাদের বাঁকা দৃষ্টি চলে যায়!
সাকিবের ইমপ্যাক্ট কোথায়? এই যে, আমরা খেয়ে না খেয়ে পোস্ট লিখছি, আমাদের মতো লাখ লাখ মানুষকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া, এটার মূল্য কত? বাংলাদেশে আসলে ক্রিকেট ছাড়া বিনোদনের সত্যিই কি কিছু আছে? আর ক্রিকেট মানেই সাকিব….. ৮ বছর আগে লেখা সেই শিরোনামটাই তাই আবারো প্রযোজ্য হয়- ‘সাকিব প্লিজ হারিয়ে যেও না’