রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে নিয়ে জীবনের একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমার কোনো আগ্রহই জন্মায়নি, আমার শৈশব-কৈশোরের প্রায় পুরোটাই দখল করে ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ওই বয়সে তার পড়া লেখা বলতে কেবল বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রৌ ও একেই কি বলে সভ্যতা, এবং সেগুলো পড়ে খুব বুঝেছি এটা বলার সামান্যতম সৎসাহস নেই আমার। তবু মাইকেলের প্রতি প্রবল আগ্রহের মূল কারণ তিনি বাংলা ভাষায় সনেট শুরু করেছিলেন, অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে কাজ করেছেন এবং স্যারদের মুখে শোনা গল্পে; তিনি নাকি মুখে বলতেন এবং সেটা শুনে লেখার জন্য তার সামনে থাকতে কয়েকজন শ্রুতিলেখক। সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দ কী এ সম্পর্কে আমি এখনো স্পষ্ট নই, তবু শৈশব-কৈশোরের বেড়ে উঠার দিনগুলিতে মাইকেল মধুসূদন ছিলেন আমার চরম ফ্যাসিনেশন, কারণ একদম নতুন বা ব্যতিক্রমী কিছুর প্রতি আমার দুর্নিবার নেশা জন্মান্তরের।

তবে রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমি বোধহয় অধিকাংশ মানুষের চাইতেই মানসিকতার দিক থেকে এগিয়ে থাকবো। পৃথিবীতে অদ্যাবধি যতগুলো প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে সবচাইতে মাল্টি ডাইমেনশনাল ট্যালেন্টেড মানুষ মনে হয় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে, এরপরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনযাপনের খুব কম বিষয়ই পাওয়া যাবে যেখানে তিনি অতুলনীয় কোনো চিন্তা সৃষ্টি করেননি। ট্যালেন্ট সবসময়ই ফোকাসড এবং সুনির্দিষ্ট ফিল্ডভিত্তিক। যেমন, বিজ্ঞানী হিসেবে নিকোলাস টেসলা বিরল প্রতিভার অধিকারী হতে পারেন, কিন্তু দাবা খেলা বা গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রতিভা নেই। তাই টেসলার সাথে প্রতিভার তুলনা করতে হলে কোনো একজন বিজ্ঞানীকেই তুলনা করতে হবে; লেখক বা চিত্রকর নয়। টেসলা আর গ্যেটের মধ্যে কে বেশি প্রতিভাবান, এটা প্রশ্ন নয়, মূর্খামি। বহুমাত্রিক প্রতিভা অনেকেরই ছিলো এবং থাকবে, কিন্তু সবগুলো মাত্রাই একইরকম শার্প, এই ফিল্টার যুক্ত করলে বড় অংশই ছিটকে পড়বেন। রবীন্দ্রনাথ এই জায়গাতেই শক্তিময়তার দাবিদার, এবং ইমপ্যাক্ট প্রশ্নে বিশ্বের যে কোনো দার্শনিকের সাথেই কমপ্যাটিবিল তিনি। যদি বঙ্গে না হয়ে পাশ্চাত্যে, বিশেষত গ্রীস বা রাশিয়ায় জন্ম নিতেন, নিঃসন্দেহে তিনি আরও ইনফ্লুয়েন্সিয়াল একজন মহামনীষী হতেন।

তবু এরকম একজন মানুষের প্রতি জীবনের একটা লম্বা সময় অবধি বিকর্ষণ বোধের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, তার ভক্তকুলের আচরণ সহনীয় লাগতো না। গুরুদেব, সিদ্ধিপুরুষ জাতীয় বিবিধ সম্বোধনের ব্যাকুলতার মধ্যে আমি এক ধরনের মেকি উপাসনা প্রবৃত্তি আবিষ্কার করেছিলাম, ভক্তির চাইতে লৌকিকতাই যেখানে প্রকট। রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরক্তি মানে শিল্পসত্তার বিকাশ, এরকম এক স্টেরিওটাইপতা লক্ষ্য করে বিরক্তি জমতে থাকতো মনে। বিশেষত, রবীন্দ্রসংগীতকে তার মেজরিটি ভক্তকুল যেমন ধর্মগ্রন্থের আয়াতের মতো করে ট্রিট করেন, এটাকে শিল্পজোতদারী মনে হতো। আম্মুর বদৌলতে একদম বাচ্চা বয়স থেকেই প্রচুর রবীন্দ্র সংগীত শোনা হয়েছে; ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’ গানটা শুনে ছোটবেলায় কেঁদেছি বহুদিন। কিন্তু টেলিভিশন অনুষ্ঠান আর সংবাদপত্রসূত্রে যখন দেখি, রবীন্দ্রসংগীতে সামান্য ফিউশন করা হলেই সেটা বিকৃতির পর্যায়ে চলে যায়, বিশেষত ব্যান্ডশিল্পী মাকসুদ রবীন্দ্র সংগীতের এলবাম বের করার পর যেরকম ছিঃছি রব উঠে, সেই শৈশবের ঘটনাটা আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিলো। একজন ব্যান্ডশিল্পী হয়তো ছোটবেলায় রবীন্দ্রসংগীত শেখেনি, যে কারণে সুর-তালের যথেষ্ট বিচ্যুতি থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি তার ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ কি তাতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে? রবীন্দ্রনাথ কি এতোই সীমাবদ্ধ? কিশোর কুমারের ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ গানটা যথেষ্ট বাজে লেগেছে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসংগীতও মুগ্ধ করার মতো লাগেনি, তবু তাদের গাওয়া যদি অপরাধ না হয়, মাকসুদ গাইলেই সেটা বিকৃতি! অন্য কোনো ফোক গান নতুনভাবে গাইলে বিকৃতির প্রশ্ন উঠে না, রবীন্দ্র সংগীতের বেলায়ই কেন বিশুদ্ধতার দোহাই? শেষ পর্যন্ত এগুলোও তো নিছক গানই, একে এতো এরিস্টোক্রেসি দেয়ার কী হলো! যে শিল্পী বা সমঝদারদারদের মনে এতো অন্ধকার, তাদের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে আলোকিত হওয়ার কোনোরকম ইচ্ছাই ছিলো না। ফলে প্রায় ৫ বছর রবীন্দ্রসংগীত শোনা থেকে বিরত ছিলাম, এবং ফোক গানের প্রতি আকর্ষণ তীব্র করেছিলাম। দ্বিতীয়ত, প্রচুরসংখ্যক মানুষ যে বিষয় বা ব্যক্তিকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখায়, আমি অবচেতনভাবেই সেখোন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই (টেন্ডুলকারের ব্যাপারটা এক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম), মনে হয় নতুন কিছু খুঁজি যেটা খুব বেশি এক্সপ্লোরড হয়নি। ওইসব সমাজস্বীকৃত রবীন্দ্র ধ্বজাবাহীর প্রতি ক্ষোভে মাঝখান থেকে আমার জীবনের বিরাট ক্ষতিটা হয়ে গেছে। ২৫ বছর বয়স হওয়া অবধি আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথ বলতে শুধুই পাঠ্যবইয়ের কবিতাগুলো, এবং গীতাঞ্জলি লিখে নোবেল পেয়েছেন এই সামান্য তথ্যটুকু।

বায়োগ্রাফি, সাক্ষাৎকার, ডায়েরি আর বিদেশী ফিকশন বাদে খুব কম বাংলা ভাষাভাষি বই-ই আমি পুরোটা শেষ করার আগ্রহ বোধ করেছি। বইয়ের কনটেন্টে চিন্তার তারল্য আর বায়বীয়তায় বিরক্ত হয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলি প্রায়শই। হুমায়ূন আজাদের যতগুলো বই পড়েছি প্রতিটিই একটির চাইতে আরেকটি বেশি অপছন্দ করেছি (লাল নীল দীপাবলী, ৫৬ হাজার বর্গমাইল এই দুটো বাদে), তবু বাঙালি বিষয়ে আমার জীবনে পড়া অন্যতম সেরা প্রবন্ধ তার লেখা ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’। বাঙালির মৌলিকত্বহীনতা, অনুর্বরতার বিষয়গুলো সম্বন্ধে তার বেশিরভাগ পর্যবেক্ষণের সাথেই আমি গভীরভাবে একমত।

এই লেখায় হুমায়ূন আজাদের উল্লিখিত প্রবন্ধটি প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। একক ব্যক্তির ওপর বাংলা ভাষায় সর্বাধিক লিখিত বইয়ের বিষয়বস্তু রবীন্দ্রনাথ। কত লোকের আয়-রোজগার, চাকরির প্রমোশন, পুরস্কার প্রাপ্তির উৎস এই বিকট প্রতিভাবান মানুষটি, ভেবে নিজেকে ব্যাক্টেরিয়ার চাইতেও আণুবীক্ষণিক লাগে। যারা এইসব বই লিখেন, সামাজিক এবং সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে তারা নমস্য ব্যক্তিত্ব। তবু সাহস করে একটা কথা বলেই ফেলি; এইসব পণ্ডিতের মধ্যে ৮০% কেই আমার কাঠামোবদ্ধ আর টুকলিফাই এক্সপার্ট মনে হয়। এরা এ বই, সেই বই ঘেঁটে গতানুগতিক ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করান, অথচ সেখানে নেই কোনো তীক্ষ্ম ইনসাইটের নিদর্শন; স্রেফ চর্বিতচর্বন। একটু সময় খরচ করে সেইসব বই পড়ে নিলে ৭ বছরের বাচ্চার মন্তব্যের সাথে এদের মন্তব্যের হেরফের হবে সামান্যই। এই সমস্ত পণ্ডিতই রবীন্দ্রনাথের মানুষি দুর্বলতা, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি বিষয়ে বই লিখেন, কারণ রবীন্দ্র বন্দনায় বিভোর কমিউনিটিতে প্রতিভাবনা বা অলটারনেটিভ ডিসকোর্স তৈরি করতে পারলে সেটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ তৈরি করার সম্ভাবনাযুক্ত হয়। কিন্তু মৌলিকতাহীন স্বল্পমেধার এইসব বইপড়ুয়া পণ্ডিতের মধ্যে সেই ক্রিটিকাল এনালাইটিক এবিলিটির বিন্দুমাত্র নেই, তবু আছে ছিদ্রাণ্বেষণ, হয়তোবা এটাই আপাত প্রথাবিরোধীতা। জনৈক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই এক বই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে মূখ্য চরিত্র করে, যেটির নাম অনেকেই জানেন – কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট।

যত দুষ্প্রাপ্য, ঐতিহাসিক বই-ই হোক, আমার কাছে অবশ্যপাঠ্য বলতে কিছু নেই; জীবনে এমন কোনো বই নেই যেটা না পড়ার জন্য আফসোস বোধ করেছি। কিন্তু এমন অসংখ্য বই আছে যেগুলো পড়ার পর গভীর অনুশোচনায় ভুগেছি, মনে হয়েছে কেন পড়লাম, এই মানসিক ভগ্নতায় আমার ভাবনা যে বিঘ্নিত হলো সাময়িক, বইটা না পড়লে তো সেটা হতো না। কেন পড়লাম! এই সেলফ কনভারসেশন থেকে আমি সেইসব বইয়ের লেখকের উদ্দেশে তীব্র সমালোচনামূলক চিন্তা সৃষ্টি করি, কিন্তু সচরাচর লেখার আগ্রহ পাই না। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় কে সে সম্পর্কে ধারণা নেই, তিনিও কি পণ্ডিতগোত্রীয় কেউ কি না গুগল ঘেঁটে সেটা জানারও প্রয়োজন বোধ করিনি; আমার বিবেচনায় তিনি স্রেফ একজন চিন্তাপ্রতিবন্ধী মানুষ। তবু এতো দীর্ঘ লেখা লিখছি আসলে সম্প্রতি কাদম্বরী দেবী নামে একটি সিনেমা দেখার পর, সিনেমাটা দেখে কৈশোরের বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে। মনে হলো এই যাত্রায় কিছু লিখে ফেলি। আমার প্রতিটি লেখার পেছনেই সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে, এটা বোধহয় সেই বিরল লেখা যেখানে কারণের চাইতে প্রকরণই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

কৈশোরে স্যারদের এবং বড়দের মুখে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যতবারই গল্প শুনেছি, একটা প্রসঙ্গ আসতোই- নিজের ভাবীর সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো যার টানে তিনি বিলেত থেকেও ফেরত এসেছিলেন। যেহেতু সেই বয়সে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো আগ্রহই ছিলো না, ভাবীর সাথে নাকি শ্যালিকার সাথে প্রেম ছিলো এতে কী আসে-যায়; তাছাড়া প্রেম-শরীর এই বোধগুলো আমার অনেক দেরিতে তৈরিতে হয়েছে। ইন্টারে ওঠার আগে বুঝতেই পারিনি, মেয়েদের প্রতি ছেলেরা কেন আকৃষ্ট হয়। সেই ইন্টারে পড়ার সময়ই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটা শেষ করি। বইটা পড়ার একমাত্র কারণ ছিলো, তাতে মাইকেল মধুসূদন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিখ্যাত মানুষেরা চরিত্র হিসেবে আছেন এমন পূর্বশ্রুতি। আমি মূলত মধুসূদনের অংশটাই বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়ার ইচ্ছায় বইটা হাতে নিয়েছিলাম, কোন্ ফাঁকে বইটাই শেষ হয়ে গেল! সেই বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তার নতুন বৌঠানের বন্ধুত্বের কাব্যিক বর্ণনা ছিলো, পড়ে ভালো লেগেছিলো (পরে অবশ্য সমালোচনা গ্রন্থ পড়ে জেনেছি, সুনীল সেখানে প্রেমের সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। এছাড়া, মাইকেল মধুসূদন তার বন্ধু গৌরাঙ্গ বসাককে যেসব চিঠি লিখেছিলেন সেগুলো পড়তে ভালো লাগলেও পরে সুনীল গাঙ্গুলী নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি নাকি দুজনের মধ্যকার হোমোসেক্সুয়াল এট্রাকশনটা বুঝবার চেষ্টা করেছেন)

তো সিনেমাটা দেখার পর হঠাৎ মনে হলো, কাদম্বরী দেবী আসলে আত্মহত্যা করলো কেন। গুগলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটার সন্ধান পাই, এবং এই বইয়ের নেগেটিভ রিভিউও পড়ে ফেলি অনেকগুলো। কাদম্বরীর সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রেম- বাস্তবতা, নাকি কল্পনা- এই নামে ৩ পর্বের বিশাল আর্টিকেলেরও সন্ধান পাই, এবং বিরক্তিতে খুবই বিস্মিত হই, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন বইও লেখা সম্ভব! কিন্তু সেই ছ্যাচড়ামো আসলে কোন লেভেলের সেটা পরখ করে দেখার জন্য হলেও বইটা পড়ার আগ্রহ বোধ করি, এবং বইয়ের শীর্ষদেশে যখন লেখা দেখি ৫০ হাজার কপি পেরিয়ে…. ১ লক্ষ কপির লক্ষ্যে, তখনই ধরে নিই, এই গারবেজ পড়ে আমাকে অনুতপ্ত হতে হবে। জিদ চাপলে আমি স্বাভাবিক থাকি না, এক বসাতেই পুরো বই শেষ করি, এবং তারপর সিদ্ধান্ত নিই এই বইটা আমি ঠোঙ্গা কাগজওয়ালাকে ফ্রি দিয়ে দিবো; এমন একটা বইয়ের কাগজগুলো সিঙ্গারা-সমুচার প্যাকেট হিসেবেই উপযুক্ত মর্যাদা পেতে পারে; আমার ২০০ টাকা খরচ হয়েছে তাতে কী; এই জীবনে সবচাইতে কম গুরুত্ব দিয়েছি যাকে সেটা তো এই টাকা-ই !

ধরা যাক, কাদম্বরী দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথের অনৈতিক সম্পর্ক ছিলো; তাতে কি তার সমস্ত সৃষ্টি ম্লান হয়ে যাবে? জীবনদর্শন মিথ্যে প্রতিপন্ন হবে?

কিংবা ধরা যাক, দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা নিছকই দেবর-ভাবীসুলভ দুষ্টুমি আর বন্ধুতার। তাতেই কি রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধিপুরুষ হয়ে যাবেন? তার কি বিচ্যুতি নেই?

এই উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই পীরপূজা চলে আসছে। নির্বোধ বস্তুবাদী মানুষগুলোকে একটু ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা শুনাতে পারলেই রাতারাতি পীর হওয়া যায়। তারপর সেই পীর পরিণত হয় নিষ্কলঙ্ক এক চরিত্রে, যার কোনোরকম কোনো মানবীয় ত্রুটি থাকার কথা কল্পনারও অযোগ্য। পীররা তাহলে যাবে কোথায়!

প্রশ্ন হলো দুর্লভ মেধার মানুষদের দেহজ আকর্ষণ বা যৌনতা সংক্রান্ত বোধবিচার কি তবে পৃথক হবে, কিংবা নৈতিকতার ব্যক্তিগত স্ট্যান্ডার্ড সেট করা থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া মুশকিল। সামাজিক শ্রেণীকাঠামোর একটি ভিত্তি যদি অর্থনৈতিক সক্ষমতা হয়, অপরটি ‘মেধাস্তর’ হতেই পারে। একজন গড়পড়তা মানুষ জীবনকে, সময়কে বা সম্পর্ককে যে নিক্তিতে, যে এককে পরিমাপ করে একজন ব্যতিক্রমী মেধার মানুষের পরিমাপের ধরন-ধারণ অবশ্যই ভিন্ন হবে। একজন কোটিপতির সাথে একজন হকারের জীবনযাপন যেমন মিলবে না, একজন সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানী, লেখক, গণিতবিদ বা চিন্তকের বোধের ওজন একজন ইন্দ্রিয়পূজারী বস্তুবাদী মানুষ ধরতেই পারবে না।

অধিকাংশ ভাবুক মানুষ প্রচণ্ড খামখেয়ালি আর হেয়ালি প্রকৃতির। তাদের আচরণ অনেক বেশি রেন্ডম। তাদের প্রতিটি বাক্য, শব্দ, এক্সপ্রেসন ভীষণভাবে সাংকেতিক; সেগুলো উদঘাটন করতে প্রখর মেধাশক্তি থাকতে হয়। যেমন, আমি তোমাকে ভালোবাসি বা তোমার প্রতি মুগ্ধতা- এই বাক্যগুলো একজন ভাবুক বা ইমাজিনেটিভ মানুষ বললে সেটাকে আক্ষরিক ভাবে ধরে নেয়ার কোনো সুযোগই নেই যে আমি তোমার সঙ্গ কামনা করি, তোমার সাহচর্য চাই, তোমাকে নিয়ে জীবন পার করে দিবো; হয়তোবা এমনও হতে পারে, ‘তোমার প্রতি মুগ্ধতা’ কথার আড়ালে হেয়ালিতে আছে ‘আমি তোমাকে নির্মাণ করছি’। কিন্তু বইপোকা গবেষক কয়েকটা বইয়ে এরকম কিছু লাইন পেলেই যথাযথ রেফারেন্স দিয়ে একেবারে ঘোষণা করে দেবেন, ওই ভাবুক মানুষটি ওই মানুষটির প্রতি আসক্ত ছিলেন, কিন্তু বোঝার সামান্যতম চেষ্টাও করবেন না, হেয়ালি বা খামখেয়ালির আড়ালে কোন্ মহাসত্য অন্তর্নিহিত ছিলো। টুকলিফাইং এক্সপার্ট এই গবেষকেরা বড্ড স্ট্রাকচারড; তারা কীভাবে রেন্ডমনেস এর সৌন্দর্যকে ধারণ করবেন! যে মানুষ জীবনে খয়েরির বাইরে কোনো রঙই দেখেনি, আকাশের নীলকে তার বীভৎস লাগতেই পারে।

আরেকটা ব্যাপার হলো, ভাবুক মানুষেরা ক্ষণে ক্ষণে বিবর্তিত হয়। ১ বছর আগে যা লিখেছে, ২ বছর পরে সেটা আর মনে-প্রাণে ধারণই করে না, কিন্তু ছারপোকা কিসিমের বইপোকারা বিভিন্ন সময়ের লেখাকে এক জায়গায় জড়ো করে তার সম্বন্ধে মত দিয়ে দেন, কিন্তু এটা বোঝার চেষ্টা করে না মানুষটি নিজেই পরজীবনে সেটা আর বিশ্বাস করে না।

দুর্লভ মানুষের কি তাহলে অবাধ শারীরিক সংস্রবের অধিকার আছে; একজন বিজ্ঞানী ২০০০ টি আবিষ্কার করেছে বলেই কি সে ৫ জন মানুষের সাথে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হলে সেটা স্খলন হবে না? আমরা শুধু তার আবিষ্কারগুলো নিয়েই আবিষ্ট থাকবো? ‘কৃষ্ণ করলে লীলা, আমরা করলে বিলা’- এই যে কথাটি ভাইরাল হয়েছে, এটা তো সেই লাইসেন্স চাওয়ারই অনুযোগ। ‌ব্যালেন্স সোসাইটি টিকে থাকে মিডিওকর মানুষের বিশ্বাস আর নীতির ভিত্তিতে, যাদের বড় আবিষ্কার, উৎকৃষ্ট রচনা, জীবনদর্শনের প্রয়োজন নেই, যারা শুধু এটুকুই বোঝে, চালের দাম কত!

অন্যদিকে তারা কীর্তিমানদের দুর্বলতার ব্যাপারে বিশ্রীভাবে কৌতূহলী। বিল গেইটস কোথায় দুর্নীতি করলো, বিরাট কোহলি কোন্ নায়িকার সাথে হোটেলে রাত কাটালো, রোনালদোর যমজ বাচ্চার মা কে – এইসব গ্রস গল্পে তাদের বিস্তর আগ্রহ, কারণ ওই সমস্ত মানুষের কীর্তি ছোঁয়ার যোগ্যতা তাদের না থাকলেও আপাত কুকীর্তিতে ওই মানুষদের ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তারা এক অমলিন নৈকট্যলাভের সুখানুভূতি পায়।

মানবসমাজের ইতিহাস বহুগামীতার। পুত্র স্বামী, পিতা স্বামী, ভাই স্বামীর সেই সমাজব্যবস্থা খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। সেখান থেকে মানুষ মনোগামী হওয়ার সাধনায় রত আছে। বাহ্যিকভাবে যতোই মনোগামীতা থাকুক, মনের দিক থেকে এখনো ৯৭% মানুষই বহুগামীতাকে লালন ও ধারণ করে; শুধুমাত্র সামাজিক অনুশাসন আর ব্যক্তিগত ইমেজের প্রতি সেনসিটিভ থেকে মনোগামীতা ধরে রেখে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। বহুগামীতার অরাজকতা পৃথিবীকে বসবাস অযোগ্য করে তুলেছিলো বলেই মনোগামীতার প্রয়োজনীয়তা উদ্ভূত হয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথের মতো একজন কিংবা লতা মঙ্গেশকারের মতো একজন মানুষ আপনার আশপাশে বিচরণ করবে, অথচ আপনি তার প্রতি আকৃষ্ট হবেন না, এটা খুব কঠিন। কারণ, মানুষ আসলে শরীরের নয়, প্রতিভার প্রেমে পড়ে। শরীর সেই প্রেম প্রকাশের একটা উপলক্ষ্য মাত্র। একারণে ব্যতিক্রমী প্রতিভার মানুষদের নৈতিক স্খলনকে যথাসম্ভব আড়ালে রাখাই ভালো; সূর্য যতই আলো দিক, রাত্রির আঁধার আসবেই। আমরা দিনকে উপভোগ না করে রাত্রিতে অন্ধকার কেন সেটা নিয়ে বিচার সালিশ বসাই; প্রকৃতির বিধান তাতে কি বদলায়!

প্রথমে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী। এই পৃথিবীতে যতগুলো অশ্লীল ধারণা বৃহৎ মনুষ্যগোষ্ঠীর মধ্যে ইনজেক্ট করা হয়েছে, আমি মনে করি এটা তার শীর্ষে। সুন্দর চেহারা দিয়ে বড়জোড় সিনেমার নায়ক-নায়িকা বা মডেল হওয়া যায়, কিন্তু সেই সিনেমা ক্যারিয়ারেও দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য পেতে গুণের বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথের প্রতি এতোবছর পরেও যে লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা জন্মে, এটা কি তার চেহারার কৃপা, নাকি গান-কবিতার গুণ? বলতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ তো এক্সট্রিম উদাহরণ হয়ে গেলো, আমাদের সাধারণ মানুষের উদাহরণ দিন। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, চেহারার কারণে সাময়িক মোহ তৈরি হতে পারে, কিন্তু সম্পর্কে শ্রদ্ধা আনতে গুণ লাগবেই। অথচ এই অশ্লীল ধারণা মানুষের মধ্যে থেকে ট্যালেন্টের প্রতি রেসপেক্ট নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দেবর-ভাবী, শ্যালিকা-দুলাভাই জাতীয় সম্পর্কগুলো দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের লোকালয়ে মুখরোচক, অথচ এগুলো হওয়া উচিত সুন্দরতম সম্পর্কের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের ভিশন কী? দীর্ঘদিন ধরে যৌন অবদমিত বাঙালি সমাজে দেবর-ভাবী সম্পর্কগুলোকে ঘিরে যেরকম ফ্যান্টাসি চলে, সেটার কেন্দ্রবিন্দুতে একজন মহামনীষীকে বসিয়ে, মিষ্টির দোকানে যেমন লাইন দেয় মানুষ আর মাছি, তেমনি করে মিষ্টিবুভুক্ষু অভুক্ত পাঠককে মাছিতে রূপ দেয়া? নইলে এই বই থেকে রবীন্দ্রনাথ নামটি রথিন্দ্র দ্বারা রিপ্লেস করলে, এই বইয়ের কনটেন্ট মেরিট কতটুকু? যদি শুধু চিঠি হিসেবেই পড়ি, কী আছে সেখানে যার মধ্যে মুগ্ধ হওয়ার রসদ পাওয়া যাবে? সেসবের বোধহয় কোনো আবশ্যকতাও নেই, লেখকের ইনটেনশন রবীন্দ্রনাথ নামটিকে সেল করা, কারণ এখনো ৮৩% বাঙালি বারবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করতে গিয়ে সবার আগে বলবে, ওই ব্যাটার তো ভাবীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিলো! এরকম জনপদে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় রাই ১ লক্ষ্য কপি পেরিয়ে ১ কোটি কপির টার্গেটমিশনে নামার জন্য ওৎ পেতে আছেন বিভিন্ন চেহারায়, নানান চোরাগলিতে!

সমস্যা অন্যত্র। প্রায় প্রত্যেক কীর্তিমান মানুষের জীবনেই অন্ধকার অধ্যায় আছে। কাজী নজরুল ইসলামের নিউরোসিফিলিস রোগ হয়েছিলো এটা যেমন প্রমাণিত সত্য। এখন, কোনো এক সাগুফতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি নজরুলের অনিয়ন্ত্রিত যৌন জীবন নিয়ে এরকম কোনো বেস্টসেলার বই লিখে ফেলেন, কিংবা আইনস্টাইনের সাথে তার কাজিনের আপাত অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে বই লেখা হয়, সেটার ভার চালের দামে যাবতীয় চিন্তা নিমগ্ন করে রাখা মানুষেরা বইতে পারবে তো!

কাদম্বরী দেবী বেঁচেছিলেন মাত্র ২৫ বছর, তিনি যখন বউ হয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ৭, তার ৯। ফলে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভের পুরো সময়টাই তিনি তার পাশে ছিলেন। মানুষের চিন্তা এবং প্রতিভার যা বিকাশ তা ১৯ বছরের মধ্যেই ঠিকঠাক শেপ পেয়ে যায়, তাই রবীন্দ্রনাথের মানসগঠনে কাদম্বরী দেবীর অবদান কতখানি সেটা সেইসব মানুষ উপলব্ধি করতে পারবেন যারা জীবনে প্রচুর প্রতিভাবান মানুষ নিয়ে গবেষণা করেছেন, ক্রিয়েটিভিটি,ইমাজিনেশনের মতো জটিল মানসিক প্রবণতাগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন । বাঙালির পৃথিবীতে কাদম্বরী দেবী হয়তোবা শুধুই একটি নাম, কিন্তু একজন বিরল রবীন্দ্রনাথের আত্মোসন্ধানের জার্নিতে তিনি যে কল্পিত চিন্তামিতা হিসেবে অফুরন্ত রসদ যুগিয়েছেন, সেই দায় বৈকল্যেভোগা এইসব মানুষেরা কীভাবে পূরণ করবে! তারা তো ফুৎকার দিয়েই বলে দেবে, ছ্যা ছ্যা, ‘চিন্তামিতা’ আবার কী জিনিস, সবই বিছানায় যাওয়ার ধান্ধা! মাঝে মাঝে ভাবি, দুনিয়ার সব কাজ ভুলে কাঠমিস্ত্রি হয়ে যাবো; এতো বিছানাকাতর জাতির জন্য অবিরাম খাট-পালঙ্কের যোগান দিয়েই জীবিকার ধোঁকায় বোকা বনে গিয়ে কাটিয়ে দিবো বাকিজীবন!

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাঁটে,
আমি বাইবো না, আমি বাইবো না মোর খেয়ার তরী এই ঘাঁটে