সেপ্টেম্বর এলেই ৯৬ সাল ফেরত আসে, আক্ষেপের রাগিনী শোনাতে ফিরে আসে সালমান শাহ। বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ২ জন ফ্যাশন সচেতন নায়ক ছিলো, প্রথমজন জাফর ইকবার, ২য় জন সালমান শাহ। দুজনই প্রয়াত, তবে জাফর ইকবালের ক্যারিয়ার যেখানে ১৮ বছরের, তুলনায় সালমানের ক্যারিয়ারের আয়ু সাড়ে তিন বছর মাত্র।
সালমান শাহকে নায়ক হিসেবে কোন স্তরের বলা যায়, এই মূল্যায়নের আগে একটা ভিন্ন ট্র্যাকের গল্প বলি। ধরা যাক, একজন ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডেতেই সেঞ্চুরি করলো, পরবর্তীতে আরও কয়েকটা সেঞ্চুরি করলো, কিছু ফিফটি, কয়েকটা দশের নিচে স্কোর, এরকম যখন স্ট্যাটিসটিক্স, হঠাৎ করে কোনো একটা ম্যাচে গুরুতর ইনজুরিতে পড়ে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল তার। ধরা যাক, সবমিলিয়ে ২০টি ম্যাচ খেলেছে সে, এভারেজ ৪৫। এই ব্যাটসম্যানকে ২০ বা ২৫ বছর পর কী হিসেবে মূল্যায়ন করবেন আপনি? ক্রিকেট আর সিনেমা অবশ্যই এক নয়, কিন্তু দুটোই তো ইন্ডাস্ট্রি। প্রত্যেক ইন্ডাস্ট্রির পারফরমারকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেই কিছু কমন প্যারামিটার প্রযোজ্য। তবু সালমানের সার্থকতা এখানেই যে, তিনি এই প্রযোজ্যতার বাইরেও আলাদা কিছু ফ্যাক্টরের কারণে আরও ৫০ বছর পরেও হয়তোবা প্রাসঙ্গিক থাকবেন।
শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন সিনেমায় প্রবেশের আগে মিডিয়াতে খুব বেশি পরিচিত কোনো মানুষ ছিলেন না। ৮৫ সালে হানিফ সংকেতের নির্মিত একটি মিউজিক ভিডিওতে মাদকাসক্ত যুবকের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে মিডিয়াতে আসেন, ৯০ সালের কিছু আগে আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘পাথর সময়’ নামের একটি নাটকে অগুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্রে অভিনয় করেন। সেখান থেকে ৯১ সালে কীভাবে সালমান শাহ হয়ে চলচ্চিত্রে এলেন সেই গল্পটা জানা নেই আমার। ইমন থেকে সালমান শাহ হওয়ার পেছনে সম্ভবত বলিউডের সালমান খান নামটি মোটিভেশন হিসেবে কাজ করেছিল। আমাদের দেশী পরিচালকদের বেশিরভাগই তখন হিন্দিতে প্রবলভাবে আসক্ত ছিলেন (এখন অবশ্য তামিল-তেলেগু আসক্তি চলছে)। তাঁর প্রথম সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ও তো আদতে আমির খান-জুহি চাওলার একই নামের সিনেমার সিন বাই সিন অনুকরণ। তবু এদেশের দর্শক সিনেমাটি ভীষণভাবে গ্রহণ করেছিল। এ সিনেমায় তার সহশিল্পী মৌসুমী বরং তুলনায় বেশি পরিচিত ছিলেন। চলচ্চিত্রে আসার আগে একটি বিউটি কনটেস্ট এ বিজয়ী হয়েছিলেন, বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছিলেন।

প্রথম সিনেমা দিয়েই সালমান শাহ- মৌসুমী জুটি ইতিহাস নির্মাণের প্রতিশ্রুতি তৈরি করতে পেরেছিলেন। হয়তোবা রাজ্জাক-কবরী এর পর আরেকটি অবিসংবাদিত জুটি হতে পারতেন তারা। কিন্তু নিজেদের মধ্যকার ইগোর দ্বন্দ্বে এই জুটি একত্রে সিনেমা করেছে মাত্র ৪টি। এক্ষেত্রে উত্তম কুমারের থেকে শিক্ষা নেয়ার সুযোগ ছিলো। উত্তম কুমার- সুচিত্রা সেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে কালজয়ী জুটি এটা আমরা জানি, কিন্তু এটা হয়তো অনেকেই জানি না এক পর্যায়ে সুচিত্রা সেন এতোটাই জেদী হয়ে উঠেছিলেন যে সিনেমার পোস্টারে উত্তমের নামের আগে তার নামটি দিতে প্রযোজককে চাপাচাপি করেন। আকাশচুম্বী জনপ্রিয় উত্তম কুমার নিজের ইগোকে দমন করে সুচিত্রার সেই আবদার মেনে নিয়েছিলেন। যে কারণে আজও উত্তম- সুচিত্রা মানে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’
সালমান- মৌসুমীর ইগোর দ্বন্দ্বটা কী নিয়ে তা আমার জানা নেই, তবে এটুকু বলতে পারি আরেকটু উদার হলে বাংলা সিনেমা উপকৃত হত, নিজেদের ক্যারিয়ার আরও শার্প হতো। নিজেদের ইমেজ দিয়ে স্বতন্ত্র ক্যারিয়ার গড়ার মিশনে মৌসুমী বেছে নেন ওমর সানীকে, সালমান শাহ শাবনুরকে। অথচ, তখনো পর্যন্ত ওমর সানী বা শাবনুর দুজনই ছিলেন স্ট্রাগলিং আর্টিস্ট। সালমান- মৌসুমীর দ্বন্দ্বে সবচাইতে লাভবান হয়েছেন এই দুজনই। মৌসুমীর বিপরীতে সেট হওয়ার আগে ওমর সানীর ক্যারিয়ারের সাফল্য বলতে আনোয়ারা কন্যা ‘মুক্তি’এর সাথে ‘চাঁদের আলো’ সিনেমা। তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রির ব্যস্ততম নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছোটভাই চরিত্রে ‘এই নিয়ে সংসার’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, এবং আরও কিছু খুচরো সিনেমা হয়তোবা করেছিলেন যেগুলার কোনোটিই তাকে গ্রহণযোগ্য ইমেজ দিতে পারেনি। মৌসুমীর ওপর ভর করে এমনকি তিনি সালমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হন। পরিসংখ্যান দেখলে জানা যাবে, সালমান শাহ- শাবনুর এর চাইতে মৌসুমী- ওমর সানী জুটির ব্যবসায়িকভাবে সফল সিনেমার সংখ্যা বেশি, বা ক্রিটিকরা এটাও বলবেন, ‘বিক্ষোভ’ বাদে সালমানের অধিকাংশ সিনেমাই যেখানে প্রেমকাহিনী নির্ভর, সেখানে ওমর সানী একশন, রোমান্টিক, কমেডি সব ধরনের সিনেমাতে অভিনয় করেছেন, সুতরাং নায়ক হিসেবে ওমর সানী বৈচিত্র্যময় বেশি। কিন্তু ক্রিটিকরা এটা বিবেচনায় নেয় না, মৌসুমী ফ্যাক্টর বাদে ওমর সানী কতটা বিবর্ণ। একই কথা প্রযোজ্য শাবনুরের ক্ষেত্রেও। মৌসুমীর সাথে দ্বন্দ্বের পর ইন্ডাস্ট্রিতে তখনকার জনপ্রিয় নায়িকা দিতি বা চম্পা বয়সে সালমানের সিনিয়র হওয়ায় অপশন ছিলো শাবনাজ, শাহনাজ, লিমা প্রমুখ নায়িকা। এদের মধ্যে শাবনাজ বাদে কেউই প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন না, কিন্তু শাবনাজ তখন নাঈমের সাথে জুটি গড়ার চেষ্টা করছেন, এবং এই জুটি সিনেমা নিয়ে খুব বেশি প্যাশনেট ছিলেন না বোধহয়। ‘চাঁদনী রাতে’ এর মতো চরম ফ্লপ এক সিনেমার নায়িকা হুট করে সালমানের বিপরীতে চান্স পেয়ে যাবেন, এবং প্রথম সিনেমা ‘তুমি আমার’ ১৯ কোটি টাকা ব্যবসা করবে ( এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যবসাসফল সিনেমা), এতটা আকাশ কুসুম কল্পনার সাহস শাবনুরের থাকার কথা নয়। তবু সেই কল্পনা বাস্তব হয়েছিল, যে কারণে মৌসুমীর সাথে ইন্ডাস্ট্রির ১ নম্বর নায়িকার আসন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে উঠেছিল।
সালমান এর মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা ২৭, এর মধ্যে ১৪টি সিনেমার নায়িকাই শাবনুর। ৩টি সিনেমা করেছেন শাবনাজ এর সাথে, ২টি লিমার সাথে। বাকিগুলো উঠতি ও অখ্যাত নায়িকার বিপরীতে, যদিও শাহনাজ এর সাথে করা ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমাটা আলাদাভাবে নাম করেছিল এই সিনেমার একটা গানের কারণে। ‘চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর, এই দুনিয়া ছাড়তে হবে এসেছে খবর’- শিরোনামের এই গানের দৃশ্যায়নে সালমান ছিলেন ফাঁসির আসামী, বাস্তবেও তাঁর মৃত্যু হয়েছে ফাঁসিতে ঝুলে। ফলে এই সিনেমাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৪টি সিনেমা শাবনুরের সাথে না করে যদি মৌসুমীর সাথে করতেন, নিশ্চিত করে বলা যায় সালমান-মৌসুমী জুটি ক্লাসিকের মর্যাদা আদায় করে নিতে পারতো।
একটা পয়েন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। সালমানের মৃত্যুর পর সেই শোকে ৭ জন তরুণী আত্মহত্যা করেছিল। আর কোনো সুপারস্টারের মৃত্যুতে এধরনের ঘটনা ঘটেছে কি না নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ৯৬ সালে আমার বয়স ছিলো মাত্র দশ বছর, তাই তখনকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অনেক কিছুই আমি এই সময়ে বসে বুঝতে পারবো না। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় সালমানকে এতো ওভাররেট করার পেছনে এই আত্মহত্যাগুলোর কোনো সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট আছে কিনা। সালমান সুদর্শন, সালমান ফ্যাশন সচেতন, কিন্তু নায়কোচিত যে বলিষ্ঠ দেহসৌষ্ঠব সেটা কি তার ছিলো, নাকি চকলেট হিরো হয়েই টিকে থাকতে হতো তাকে! ওই ৭টি ঝরে যাওয়া প্রাণ তাকে কি একজন সম্ভাবনাময় নায়কের স্তর পেরিয়ে অমর নায়ক এর স্তরে উন্নীত করলো! মিডিয়ায়ও সেসময় তুমুল মাতামাতি ছিলো তাঁর মৃত্যু নিয়ে, প্রায় প্রতিদিনই তাঁর মতো দেখতে কোনো না কোনো তরুণের ছবি পত্রিকায় আসতো, এবং বলা হতো, এই হতে পারে পরবর্তী সালমান। এমনকি সালমানের শেষ সিনেমা ‘বুকের ভেতর আগুন’ এ তার মুখ পুড়িয়ে দেয়ার পর কসমেটিক সার্জারি করে তার পরিবর্তে স্ক্রিনে এলো যে ফেরদৌস, তাকেও তো সালমানের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবেই চিন্তা করা হচ্ছিল। ‘প্রিয়জন’ সিনেমায় সালমানের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা রিয়াজকেও রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে চেষ্টা করা হয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে ফেরদৌসকে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ করতে হয়েছে, রিয়াজকে করতে হয়েছে ‘মনের মাঝে তুমি’, কিন্তু আজ এতোদিন পরেও এরা ছায়া হয়েই রয়ে গেছে।

সালমানকে কি সুপাস্টার বলা যায়? ঝোঁকের বশে বললে বলবো, অবশ্যই, কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলা আমার পক্ষে কঠিন। একজন সুপারস্টারের স্ট্রাগল থাকে, স্টারডম কীভাবে ডিল করে সেটা বুঝার ব্যাপার থাকে, স্টারডম ফুরিয়ে এলে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায় সেটা দেখার থাকে, সবমিলিয়ে সুপারস্টার একটা দীর্ঘ জার্নি। এদিক থেকে সুপারস্টার বলা যায় মান্নাকে। ৮৬ সালে সিনেমায় আসা মান্নার ৯৭ সাল পর্যন্ত ক্যারিয়ারে হিট সিনেমা বলতে ছিলো শুধু ‘কাশেম মালার প্রেম’। দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন চম্পা নির্ভর নায়ক। তৎকালীন স্টার ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে চম্পা ঝুঁকে পড়েন মান্নার দিকে, এই জুটি বেশ কয়েকটি সিনেমা করে, সেগুলোর সাফল্য যা সবই চম্পার কল্যাণে। টানা ১১ বছর মান্না অভিনীত বেশিরভাগ সিনেমাতেই তার রোল ছিলো সেকেন্ড হিরোর। এই দীর্ঘ স্ট্রাগল শেষে ব্রেক পাওয়া শুরু করেন গুলজার পরিচালিত ‘অনন্ত প্রেম’ সিনেমার মাধ্যমে। এরপর কাজী হায়াতের মাধ্যমে তাঁর ক্যারিয়ার ঘুরে যায়। তেজী, শান্ত কেন মাস্তান, আম্মাজান, কষ্ট এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমা করেছেন, মৃত্যুর দিনও শুটিং করেছেন, এবং ইন্ডাস্ট্রির ১ নম্বর নায়ক হিসেবে মারা গেছেন। ২২ বছরের ক্যারিয়ারে ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি কন্ট্রিবিউট করেছেন। আমি আমার পরিচিত কোনো ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ বা তরুণীর মুখে শুনিনি মান্না তার প্রিয় নায়ক, তবু বাংলা সিনেমাতে সুপারস্টার বললে মান্নাকে অস্বীকার করা যাবে না। গালিগালাজ, বাজে অভিনয়, ডিপজলের সাথে মিলে অশ্লীল সিনেমা প্রোমোট, অর্থাৎ তার স্টার থাকাকালে বাংলা সিনেমা পতনমুখীই হয়েছে কেবল, তবু কমার্শিয়াল আসপেক্ট চিন্তা করলে, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির গ্রোথ প্রশ্নে মান্নাকে উপেক্ষা করলে চলবে না, সম্ভবও নয়।
ঠিক এই জায়গাটাতে এসে হারিয়ে যাবেন সালমান। তাঁর ক্যারিয়ার মাত্র ৩ বছরের, ছবির সংখ্যা ২৭টি, যার অর্ধেকের বেশি এক নায়িকার সাথে। অভিনীত চরিত্রগুলোও একই রকম, ভালো গল্পের সিনেমাতে খুব বেশি অভিনয় করেননি (সেরকম ভালো মানের কোনো পরিচালকের হাতে পড়েননি এটা একটা আফসোস)। টানা কয়েকটা সিনেমা ফ্লপ করলে সেখান থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতেন বা আদৌ পারতেন কিনা সেটা বুঝতে পারা যায়নি, কলেজ বয় ইমেজ চলে গেলে নিজেকে কীভাবে ফিট রাখতেন তা দেখার সুযোগ পাওয়া যায়নি, ইম্যাচিউরিটি ভুলে মৌসুমীর সাথে আবারো জুটি বাঁধতেন কিনা সেটা দেখা হয়নি, শেষের দিকের সিনেমাগুলোতে দেখা গেছে তাঁর চুল পড়ে যাচ্ছে। চুল পড়ে যাওয়ার পর এই সংকট কীভাবে সামাল দিতেন সেটা জানা হয়নি, শিল্পী সমিতির নির্বাচনে কী ভূমিকা নিতেন, বা উঠতি স্টারদের দমিয়ে রাখতে কী ধরনের কৌশল করতেন, শাবনুরকে ঘিরে যে স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েছিল সেটার সমাধান বিয়েতে গড়াতো, নাকি নতুন কোনো শাবনুর চলে আসতো সেটা দেখা হয়নি। ৯৬ পরবর্তীতে কলকাতার ঋতুপর্ণা বাংলাদেশে এসে অশ্লীল সিনেমা করতে শুরু করলো যখন ( ‘রাঙা বউ’ নামে হুমায়ুন ফরিদি আর আমিন খানের সাথে একটি সিনেমা করেছিল ঋতুপর্ণা, যাকে অফিসিয়ালি বাংলাদেশের প্রথম অশ্লীল সিনেমা বলা হয়), সেই নায়িকার সাথে তিনি সিনেমা করতেন কি না এরকম অনেক কিছুই জানা যায়নি। মাত্র ৩ বছরের ক্যারিয়ারেই শুটিংয়ে দেরিতে আসা, শিডিউল ফাঁসিয়ে দেয়ার অভিযোগে এফডিসিতে তাঁকে সাসপেন্ড করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তার মানে, ইতিমধ্যে স্টারডমে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। নায়ক রাজ্জাক কয়েক বছর আগে প্রথম আলোতে মাদকবিরোধী একটা লেখা লিখেছিলেন, যেখানে তিনি প্রয়াত জাফর ইকবাল আর সোহেল চৌধুরীর সাথে তাঁকেও উল্লেখ করেছিলেন মাদকাসক্ত হিসেবে। প্রতিদ্বন্দ্বী ওমর সানী একসময় মাদকাসক্ত হয়ে সিনেমা থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে যতদিনে ফেরত আসেন. ততদিনে নায়ক থেকে ভিলেন হয়ে গেছেন, ওজন ছাড়িয়ে গেছে ১১০ কেজি। কাজেই উশৃঙ্খলতার কারণে তাঁকেও একই পরিণতি বরণ করতে হতো কিনা, তা জানার আগেই তিনি ৯৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যান। অনেকে বলেন তাঁর মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত হত্যা। আমি সেই বিতর্কে যেতে চাই না, সালমান শাহ আর নেই এটাই সত্যি কথা। কীভাবে নেই হয়ে গেল সেটা বরং সিনেমার গল্প হয়ে থাকুক। সালমান বিয়ে করেছিলেন মাত্র ২১ বছর বয়সে, তাঁর শ্বশুর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা। কিছুদিন আগে অনলাইন পোর্টালে দেখলাম, তাঁর স্ত্রী সামিরা বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী, পুনরায় বিয়ে করেছেন, ৩ সন্তানের মা। জীবন থেমে থাকে না, জীবন চলে জীবনের গতিতে। মান্না গেছে, শাকিব খান এসেছে, এরপরে আসবে অন্য কেউ, কিন্তু আরেকজন সালমান কি আর আসবেন? এই প্রশ্নটাই আর্টিস্ট হিসেবে সালমানের সার্থকতা। তিনি অবশ্যই সুপারস্টার নন, কিন্তু ব্যাকরণের বাইরেও তো কিছু নিয়ম থাকে যাকে বলে নিপাতনে সিদ্ধ।আমার কাছে, সালমান তেমনই এক নিপাতনে সিদ্ধ আর্টিস্ট, যে কেবল আক্ষেপ বাড়ায়।

ফ্যাশন সচেতন হিসেবে সালমানকে আলাদা করে বলায় অনেকে বলতে পারেন ষাটের দশকের রাজ্জাক বা রহমান কি ফ্যাশন সচেতন ছিলেন না? সময়টা বুঝতে হবে। ষাট এবং সত্তরের দশকে বাংলা সিনেমার দর্শক মার্কেটে শ্রেণী বিভাজন ছিলো না। শিক্ষিত, নিম্নবিত্ত সকলেই একইভাবে সিনেমা দেখতেন। বাংলা সিনেমায় বিভাজনটা ঢুকে পড়তে শুরু করে মধ্য আশির দশক থেকে, যখন সাপের সিনেমা, রাজা-রানী, পীর আউলিয়া টাইপ ফোকনির্ভর সিনেমাগুলো নির্মিত হতে থাকে। সালমান যে সময়টাতে চলচ্চিত্রে আসেন তখন সিনিয়র নায়ক আলমগীর ছিলেন (শাবানার সাথে তার পারিবারিক সিনেমাগুলোর মার্কেট ছিলো), ইলিয়াস কাঞ্চন রাজত্ব করছিলেন, একশনের কারণে রুবেলের দর্শক ছিলো, শাবনাজ-নাঈম জনপ্রিয়তা পাচ্ছিলেন, কিন্তু স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ইয়ুথ গ্রুপে কোনো তারকার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা ছিলো না, তরুণীদের মধ্যে ক্রেজ ছিলো না। সালমান শাহ একমাত্র নায়ক যিনি এই গোষ্ঠীর মাঝে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন; হিন্দি সিনেমার শাহরুখ-সালমান খানদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেই নিজের একটা ক্রেজ তৈরি করেছিলেন। ভিউ কার্ড জমানো তরুণ-তরুণীদের কাছে চাহিদা আদায় করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের আর কোনো নায়ক এই গোষ্ঠীর মনোজগতে এতোটা আলোড়ন জাগাতে সমর্থ হননি। এখানেই তিনি অনন্য।
সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র ২১ এই থেমে গিয়েছিলেন, সালমান থেমেছেন ২৫ এ। এই স্বল্পায়ু মানুষগুলো জানতেও পারে না, কত নিযুত আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস প্রজন্মান্তরে তারা সযতনে উপহার দিয়ে যান। আমার ১০ বছরের ভাগ্নে সালমান শাহ সম্পর্কে হয়তো কিছুই জানে না, কিন্তু আরও ১০ বছর পরে ভার্সিটিতে উঠার পর যদি বাংলা সিনেমা নিয়ে ওর আগ্রহ তৈরি হয়, হাতের কাছে থাকা স্মার্টফোন থেকে ইউটিউব এ সার্চ দিয়ে ও যদি কখনো ‘ও আমার বন্ধু গো’ গানটি দেখেই ফেলে, আমি নিশ্চিত সেদিন ও ৫মিনিট চিন্তা করবে। সালমান শাহ প্রজন্মান্তরে ৫ মিনিট সময় আদায় করে চলবেন, এটাই ভবিতব্য।