এস এম সুলতান সম্বন্ধে জানার জন্য বই-পত্রের অভাব নেই, বা তার ব্যাপারে যেসব জনশ্রুতি- যেমন নারীদের মতো শাড়ি পরিধান করতেন, অত্যধিক গাঁজায় আসক্ত ছিলেন, বাড়িতে চিড়িয়াখানা বানিয়ে বিভিন্ন পশুপাখি পালতেন, তিনি মাটি-মানুষের ছবি আঁকতেন; তার ছবির কৃষকেরা পেশীবহুল, নারীরা সুডৌল-সুঠাম দেহের অধিকারী, পাবলো পিকাসো-সাভাদোর দালি প্রমুখ বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পীর সাথে তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে— প্রভৃতি কথামালাও অতি প্রাথমিক পর্যায়ের সুলতানপাঠ।

সুতরাং সেইসব আলোচনার পুনরুক্তির প্রয়োজন দেখি না।

জেমসের গাওয়া বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ’ গানের একটি লাইন প্রণিধানযোগ্য- ‘তুমি জয়নুল আবেদীন, এসএম সুলতানের রঙতুলির আঁচড়/ শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরীর নতুন দেখা সেই ভোর’।— এই লাইনের মাধ্যমে এসএম সুলতানের প্রতি প্রথম ইমপ্র্রেসন তৈরি হয়েছিলো আমার। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে জয়নুল আবেদীনের জীবনি অন্তর্ভুক্ত থাকায়, বিশেষত নামের পূর্বে শিল্পাচার্য বিশেষণ থাকায় ধরে নিয়েছিলাম জয়নুল আবেদীনই বাংলাদেশে চিত্রকলার শেষ কথা। একদিন পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় ছোট্ট এক কলামে চোখ পড়েছিলো ‘শিল্পী এসএম সুলতানের মৃত্যুবার্ষিকী’ সংবাদটি। বিশেষ ভাবান্তর ঘটেনি শিশুমনে। জেমসের গানে জয়নুলের পাশে তার নাম দেখে ধারণা জন্মে তিনিও তাহলে বড় কোনো শিল্পী হবেন, ব্যস এটুকুই।

তবে বিশাল দৈর্ঘ্যের চুল দেখে প্রশ্ন জেগেছিলো মনে। দ্য ভিঞ্চি, নিউটনের জীবনি পড়াসূত্রে বড়ো দৈর্ঘ্যের চুলে অনভ্যস্ততা না থাকলেও বাংলাদেশে বড়ো চুল মানে ব্যান্ডশিল্পী অথবা বাউল- এরকম একটা পারসেপশন তৈরি হয়েছিল নিজের মধ্যে। জয়নুল বাদে আর কোনো দেশী চিত্রকরের নাম না জানায় তাদের চুলের ব্যাপারে তথ্য ছিলো না।

বুয়েটে কুমু নামে এক সহপাঠীকে পাই যে নড়াইলের মানুষ। একদিন কথা প্রসঙ্গে সে বলে- ‘ছোটবেলায় সুলতান দাদুর বাড়িতে গিয়ে ছবি আঁকা শিখতাম মাঝেমধ্যে।উনি বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন’। ভাবি সে বোধহয় সুলতানের নাতনী, সে জানায় সুলতান তার রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় নয়।

২০১২ তে লেখক শাহাদুজ্জামানের দীর্ঘ এক ইন্টারভিউ নেয়ার সুযোগ পাই। কথাপ্রসঙ্গে জানান, তার জীবনে দেখা ইন্টারেস্টিং মানুষের মধ্যে এসএম সুলতান অন্যতম, তার মতো কেউ নয়, তিনি ইউনিক স্যাম্পল। আফসোস হয়, মানুষটা জীবিত থাকলে নড়াইলে গিয়ে একটা ইন্টারভিউ নিয়ে আসতে পারতাম। যেহেতু চিত্রকলা একেবারেই বুঝি না, শিল্পী হিসেবে তিনি কত বড় সে মূল্যায়নে যাওয়ার প্রয়োজনই বোধ করিনি, তবে
— ১৯৫১ সালে নিউইয়র্কে, ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন৷
—প্যারিসের জাদুঘরে তার আঁকা তিনটি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে
—‘সুলতানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না’ কথাটা নোবেলজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের।গেল শতাব্দীর আশির দশকে গ্রাস একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। সুলতানের জন্ম শহর নড়াইলেও গিয়েছিলেন। তিনি কথাটা তুলেছিলেন শিল্পকলা একাডেমি ও জাদুঘরে সুলতানের ছবি না দেখে
—কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৮২ সালে তাকে এশিয়ার ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করে।
—সুলতানের বাল্যবয়সের চরিত্র-গঠন সম্পর্কে আহমদ ছফা লিখেছেন: “কোনো কোনো মানুষ জন্মায়, জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না। অথচ যাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এরকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বভাবিক আকুতি। …শেখ মুহাম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের বরে অভিশপ্তও”।
—নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো এবং বোস্টনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়।এরপর লন্ডনেও তিনি প্রদর্শনী করেছিলেন। ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে তিনি নড়াইলে ফিরে আসেন।

প্রভৃতি তথ্যগুলো তাকে একজন বিশেষ মানুষ মনে করতে বাধ্য করে। ১৯৫৩ তে তার বয়স মাত্র ৩০, অথচ এরই মধ্যে তিনি বিশ্বে পরিচিতি পেয়ে গেছেন।

সময়টা কখন? ১৯৪৭ এ দেশভাগ হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান-পশ্চিম পাকিস্তান ইস্যুতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হচ্ছে ক্রমাগত, সেই সময়ের মধ্যে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন এবং মাত্র ত্রিশেই দেশে ফেরত এসেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত আমার ‘হিউম্যান ল্যাব: মৌন মানুষ মানসে’ বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপের কয়েকটি লাইন:
“প্রথম ত্রিশ বছর হওয়া উচিত পর্যবেক্ষণ আর পরিভ্রমণের। একত্রিশতম জন্মদিনে প্রত্যেক বোধসম্পন্ন মানুষের জীবনের লক্ষ্য রচনা লিখে যাচাই করা উচিত কোথায় সে আছে, কোথায় সে যেতে পারে”

অথচ সুলতান ত্রিশের মধ্যেই তার জীবনের কক্ষপথ নির্ধারণ করে এরপরে চলে গেলেন অবসরে। নইলে যে মানুষ নিউইয়র্ক, লন্ডনে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তিনি ঢাকারও বহুদূরে নড়াইলে চলে যাবেন কেন? এটা তো এক ধরনের স্বেচ্ছানির্বাসন।– এই লাইনটা লিখবার পরই নিজেকে বেকুব আর বুদ্ধিহীন মনে হচ্ছে। সুলতান আসলে কী চেয়েছিলেন তা বোঝার চেষ্টা না করেই নিজের/নিজেদের বানানো এক কাঠামোতে তাকে ঠেঁসে ফিট করার হাস্যকর চেষ্টা চালাচ্ছি। তবে যে শাহাদুজ্জামান বলেছিলেন, তিনি কারো মতো নন- একথা কি নিছকই হালকা চালে বলা কথা!

***
তারপর থেকেই যেখানে যখন সুলতান সম্বন্ধে কোনো আলোচনা পাই শোনার চেষ্টা করি, এবং তার জীবনকে ব্যাখ্যা করতে চাই। বিশ্বজুড়েই বায়োগ্রাফিকাল লেখাগুলোতে একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করি। ব্যক্তিটি কত সালে জন্মগ্রহণ করলেন, পরিবারের সদস্য. তার কর্মজীবন, বিতর্ক, পুরস্কার-স্বীকৃতি— এরকম এক কাঠামোর তথ্যপঞ্জিকায় ঠাঁসা থাকে লেখাগুলো। ব্যক্তিটি কেন এমন হলো, বা তার চিন্তাধারার পেছনে জ্বালানী কিংবা উৎস হিসেবে কাজ করেছে সেই সকল ক্রিটিকাল এনালাইসিস একেবারেই থাকে না। লেখাগুলো হয় পত্রিকার প্রতিবেদনের মতো।

কেন এই বোরিং ফরম্যাট চিন্তা করে উত্তর পাই, ডিমান্ড নেই। যখন গ্রুপ ইন্টারভিউ করি ২০-২৫ জন মানুষের যারা একে অপরের অপরিচিত, প্রতিবার একটা সাধারণ এক্সপেরিমেন্ট করি। অপরিচিত ব্যক্তিকে যে কোনো ৩টি প্রশ্ন করতে হবে। এভাবে ৬০০-৭০০ মানুষের উপর পরীক্ষা চালিয়ে যে ৩টি প্রশ্ন সবচাইতে পাওয়া যায়- ১. আপনার বাড়ি কোথায়? ২. আপনার পড়াশোনা কোথায় ৩. আপনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?- প্রশ্নগুলো পর্যালোচনা করলেই বুঝতে পারবো, মানুষ আদতে তথ্য জানতে চায়, তত্ত্ব নয়।

পৃথিবী তাই ক্রিটিকাল এনালাইসিসের জন্য চরম অনুর্বর এক বসবাসের জগত। ‘কী’, ‘কীভাবে’ এর বিপুল চাহিদার কাছে ‘কেন’, ‘কিনা’ এর রক্তশূন্যতা দশা।

ফলে সুলতান সংক্রান্ত হাইপোথিসিস দাঁড় করানোর মতো কোনো ক্রিটিকাল এনালোজিপূর্ণ রিসোর্স পাওয়া যায়নি। তবু তিনি যেহেতু আমার আগ্রহের মানুষ, বিভিন্ন সময়ে পড়া তথ্যভিত্তিক লেখাগুলো থেকে তার প্রকৃতি এবং মনতুলির আঁচড় সংক্রান্ত কোনো তত্ত্ব প্রস্তুত করা যায় কিনা চেষ্টা করে দেখি।

***
গত বছরের শেষের দিকে বুক ক্যাফেশপ দীপনপুরে সুলতানের জীবনি পড়তে থাকি। একটি তথ্যে মন আটকে যায়। শৈশবে, সম্ভবত ৬-৭ বছর বয়সে. সুলতান তার বৈমাত্রেয় শিশু বোন ক্ষুধার জ্বালায় কান্না করলে তার মুখে খাবার হিসেবে জ্বলন্ত কাঠ গুঁজে দেন, শিশুটি তৎক্ষণাৎ মারা যায়। তার ভাবনা ছিলো- মানুষ যদি ভাত বা দুধ খেতে পারে জ্বলন্ত কাঠ খেলে সমস্যা কী। ৬-৭ বছর মোটেই কম নয়, অন্তত আগুন-পানি চেনার জন্য যথেষ্ট পরিপক্ব বয়স। তখন এভাবে চিন্তা করা মানে জন্মগতভাবেই তার চিন্তাপ্রক্রিয়ায় বাস্তব এবং বৈষয়িকতার বাইরে ভিন্ন এক জগত তৈরি হয়ে ছিলো।

১৯৭৬ এর আগ পর্যন্ত সুলতানের সম্বন্ধে বাংলার মানুষ খুব বেশি কিছু জানতে পারেনি। তার মানে, বহু দেশে পরিচিত পেয়েও নিজ দেশে নিভৃতি ভেঙ্গে জনসম্মুখে আসতে আসতে বয়স ৫৩ হয়ে গিয়েছে। একজন মানুষ ৫০ পেরুনোর পর তার জীবনে নতুন করে আর কী-ই বা থাকে। এবং তার আবির্ভাবের বেলাতেও চিরন্তন ছোটলোকি বাঙালি মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়,পরশ্রীকাতরতা চুইয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে। আহমদ ছফার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যায়-
“আমার সঙ্গে আকস্মিকভাবে সুলতানের পরিচয় হয়। কী করে কোন পরিস্থিতিতে সুলতানের সঙ্গে আমার পরিচয় হল, সে বিষয়ে এখানে বিশেষ বলার অবকাশ নেই। শুধু এটুকু বলতে চাই, উনিশশো ছিয়াত্তর সালে শিল্পকলা একাডেমীতে সুলতানের আঁকা প্রায় পাঁচশো ছবির একটা প্রদর্শনী হয়। এই প্রদর্শনীতেই প্রথম আমি সুলতানের আঁকা ছবি দেখি এবং অভিভূত হয়ে যাই। পত্রপত্রিকায় সুলতানের বেশভুষা, বৈচিত্র্যময় জীবন, এবং গঞ্জিকাপ্রীতি এসব নিয়ে এন্তার গল্প কাহিনী প্রচারিত হলেও চিত্রশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা সুলতানের আঁকা ছবির উৎকর্ষ বা অপকর্ষ সম্বন্ধে কোনো কথা বলতে কেউ রাজি ছিলেন না। নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে একটা ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হয় যে ইংরেজিতে যাকে কনস্পিরেসি অভ সাইলেন্স বলা হয়, সুলতানকে ঘিরেও একটা নীরব ষড়যন্ত্র আর্ট এস্টাবলিশমেন্টের লোকেরা করে যাচ্ছিলেন। নীরব উপেক্ষার মাধ্যমে সুলতানের শিল্পকর্মকে সর্বসাধারণের সচেতন মনোযোগ থেকে আড়াল করে রাখাই ছিল এঁদের অভিপ্ৰায়।
আমি যখন বুঝতে পারলাম, শহরবাসী আর্ট এস্টাবলিশমেন্টের লোকেরা সুলতানের শিল্পকর্মের ব্যাপক পরিচিতি এবং মূল্যায়নের পথে একটা অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, তারপর আমি আমার কর্তব্য স্থির করলাম। যে-করেই হোক, সুলতানকে অবশ্যই জনসমক্ষে প্রকাশমান করে তুলতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল আমি নিজে কিন্তু চিত্রশিল্পী নই। চিত্রশিল্পের ব্যাপারে আমার মতামতের কোনো মূল্য নেই। তাই আমি চাইছিলাম, সমানে মান্যতা অর্জন করেছেন এমন কোনো ব্যক্তি যদি সুলতানকে তুলে ধরতে এগিয়ে আসেন। আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। অনেকের কাছেই গেলাম। কেউ-কেউ আগ্রহ প্রদর্শন করলেন, কেউ-কেউ শীতলতা। যাহোক, রাজ্জাক স্যারের কাছে গিয়ে সুলতানের ছবি সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা বললাম। দেখলাম, চিড়ে ভেজার কোনো সম্ভাবনা নেই। স্যার তখনও শিল্পী বলতে বোঝেন, ওই একমাত্র জয়নুল আবেদীন। চিত্রকলার অনেক লোকের সঙ্গে স্যারের ওঠা বসা, যাওয়া-আসা আছে, কিন্তু প্ৰাণের ভেতর থেকে জয়নুল আবেদীন ছাড়া অন্য কাউকে স্বীকৃতি দিতে চান না”।

সুলতানকেন্দ্রিক ইতরপনার আরো প্রমাণ মেলে প্রিয় ডট কম এ প্রকাশিত নাসির আলী মামুনের সাক্ষাৎকারে। চুম্বক অংশ তুলে দিচ্ছি- “বাংলাদেশের ইতিহাসে এস এম সুলতান দূরূহ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কিংবদন্তিতূল্য একজন চিত্রশিল্পী। যিনি জীবিত অবস্থায় বহুবার তাঁর বন্ধুর বেশে, চিত্রশিল্পী বেশে, সাংবাদিকের ছদ্মবেশে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, নানা ষড়যন্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে করা হয়েছে। তিনি যাতে ছবি আঁকতে না পারেন, উনি যাতে ঢাকায় এসে কোথাও থাকতে না পারেন, উনি যাতে কোথাও প্রদর্শনী করতে না পারেন, চারুকলার বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের চত্বরে যেন উনি প্রবেশ করতে না পারেন- এই রকম বন্দোবস্ত করছিলেন আমাদের দেশের অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পীরা”।

মুদ্রার অন্য পিঠ নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নাসির আলী মামুনের বক্তব্যকেই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে: “তিনি ভীষণ ডুয়েল চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। একই সাথে তিনি একবার মানবিক, আবার মুহূর্তেই তিনি প্রচণ্ড নিষ্ঠুর।এ জন্য আহমদ ছফা এবং আমরা বলতাম – এস এম সুলতানকে ৭২ ঘণ্টার বেশি সহ্য করা যায় না। ৭২ ঘণ্টার বেশি তাঁর সাথে থাকাই যায় না। আমি অবশ্য এক সাথে আট-নয়দিন থেকেছি, কিন্তু মনে হয়েছে হয় সুলতান ভাই আমাকে খুন করবে, না হয় আমি তাঁকে খুন করবো- এই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো”
আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটি যারা পড়েছেন সেখানেও সুলতান সম্বন্ধে ইন্টারেস্টিং এক তথ্য পেয়েছেন নিশ্চয়ই। যারা পড়েননি তাদের জন্য সারমর্ম লিখে দিচ্ছি- “সুলতানের ৩০০ চিত্রকর্ম সোনারগায়ে এক বাড়িতে ছিল। সুলতানের অনুরোধে সেগুলো আনার ব্যবস্থা করে দেন আব্দুর রাজ্জাক। একটা সরকারি ট্রাকের ব্যবস্থা করে সাথে আহমদ ছফাকে দিয়ে দেন। কারণ সুলতান ছিলেন গাঁজাখোর। গাঁজার প্রতি তার যে অশেষ ভক্তি এবং ভালোবাসা।
আর সে কারণেই ছফা সাথে যান যাতে সহীহ সালামতে ৩০০ চিত্রকর্ম ঢাকায় ফেরত আসে এবং ট্রাকটা বিকেল ৫টার মধ্যে ইডেন জমা দেয়া যায়। সব ছবি সাবধানে উঠানো হল। কাজ শেষ হওয়ার খানিক আগে সোনারগায়ে সেই বাড়ির সামনে সুলতানের এক বাউলে সাথে দেখা হয়ে গেল। দুজনে মিলে গাজা খেতে বসলেন। গাজা খাওয়ার মধ্যে বাউল গান ধরলেন। স্বাভাবিকভাবে সুলতান বাকি সব কিছু ভুলে গেলেন।
আহমদ ছফা সুলতানকে ডাকতে আসলেন। সুলতান বিরক্ত হলেন। তিনি হিন্দিতে জবাব দিলেন, ‘আমি সুলতান, আমি কারো কথায় চলিনা’। সাথে থাকা বাউলও তাল দিলেন। বললেন, ‘অবশ্যই আপনি সুলতান। আপনি কারো কথায় কেন চলবেন?’
আহমদ ছফা আরও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলেন। তারপর ট্রাকে উঠে ড্রাইভারকে গিয়ে বললেন, গাড়ি স্টার্ট দেন, আমাদের ৫টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। ট্রাক চলা শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সুলতানের ডাক শুনে পিছন দিকে তাকালেন ছফা। দেখলেন জোব্বা পড়া সুলতান ট্রাকের পেছনে পেছনে দৌড়ে আসছেন আর বলছেন, ‘ছফা ভাই আমাকে রেখে যাবেন না”!
***
লেখার এই পর্যায়ে আমরা একটি প্রতিবেদনের অংশবিশেষ দেখবো।
“যে মানুষ নিজের কথা কখনো ভাবেনি, শুধুই ভেবেছে অন্যের উপকারের কথা, সে মানুষটিই অসীম এক জগতের রহস্যময় সত্তা। একবার এক বানর উঁচু গাছে উঠে তাল সামলাতে না পেরে মগডাল থেকে পড়ে যায়। এতে বানরটির এক পা ভেঙে যায়। সুলতান নিজে সেই বানরটি নিজ বাড়িতে এনে পায়ে ব্যান্ডেজ করে চিকিৎসা করতে থাকেন। এক সময় বানরটি সুস্থ হয়ে যায়। তবে সে সুলতানকে ছেড়ে অন্য কোথাও কখনো চলে যায়নি। সুলতানের ছিল প্রচ- এক অজগর সাপ। ফোঁষ ফোঁষ করত সারাক্ষণ তার পাশে। কুকুর আর অজগর একই সাথে কাটাত সময়। অজগর কুকুরকে পেঁচিয়ে তার গায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলত আবার কুকুরটি অনেক সময় সাপের গা চেটে দিত। বিচিত্র মায়ার বন্ধনে সকল অবলা পশু-পাখিই যেন ধরা পড়েছিল। সবাই কেমন নির্মহ এবং ত্যাগী হয়েছিল।
ছোট ছোট খরগোশ তার আঙ্গিনাকে ধবল-শুভ্র করে রাখত। ভল্লুক, হনুমানও ছিল সুলতানের সঙ্গী। অনেকগুলো বেজীও দেখা যেত তার বাড়িতে।
শাড়ি, চুড়ি এসব পরে ঘুরে বেড়াতেন।
অমাবস্যা ও পূর্ণিমার রাতে তিনি রাধা সেজে নৃত্য করতেন। জানা যায়, গভীর রাতে তার কাছে বহু ধরনের সাপ আসত”।
এই প্রতিবেদনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাসির আলী মামুনের বক্তব্যও।“ তার জীবনদর্শন অনেক গভীর ছিল। অনেক সময় সেগুলো ধর্মের বিরুদ্ধে এবং মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে চলে যেত। যেমন উনি মনে করতেন মানুষ মূলত নিষ্ঠুর এবং অসভ্য। শুধু শিক্ষায় কিছু কিছু মানুষকে সভ্য করে তুলেছে। তাছাড়া বেসিক্যালি মানুষ অসভ্য এবং ভীষণ স্বার্থপর। তিনি বলতেন জীবজন্তুর কোনো স্বার্থ নেই। বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর সাথে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বসবাস করে গেছেন। পশুপাখি নাকি তার সাথে কথা বলতো এবং তিনিও ওদের সাথে কথা বলতেন”।

একই নাসির আলী মামুনই একই সাক্ষাৎকারে অবতারণা করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণের- “ব্যক্তি জীবনে তিনি উদাসীন ছিলেন কিন্তু শিল্পী এস এম সুলতান মোটেও উদাসীন ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শিল্প ঘনিষ্ঠ মানুষ। মাটির ও মানুষের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি যখন ছবি আঁকতেন, তার মতো এত অর্গানাইজ লোক বোধহয় আর একটাও থাকতো না। সে রকম মানসিক এবং বাহ্যিক পরিবেশ তিনি গড়ে নিতেন। তার অসংখ্য ছবি আঁকার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম এবং সেগুলো আমি দেখেছি। মানুষ মনে করে তিনি অনেক উল্টাপাল্টা জীবন যাপন করতেন, হঠাৎ হঠাৎ হয়তো কাজ করতেন। আসলে কিন্তু সে রকম না, তিনি অনেক গভীর চিন্তার মানুষ ছিলেন। কৃষি সভ্যতার প্রতি তার আলাদা টান ছিল, এর সাথে যুক্ত মমত্ববোধ অতুলনীয়”।

***
সুলতানকে নিয়ে আরো অজস্র লেখা লিখিত হয়েছে, সবগুলোর বক্তব্য কম-বেশি একইরকম।সুলতান বোহেমিয়ান প্রকৃতির, আনপ্রেডিক্টেবল এবং তার ফিল্ডের মানুষেরা তাকে দমিয়ে রাখার জন্য সবরকম নীচতার পরিচয় দিয়েছে। যে কোনো প্রথাবিরোধী ব্যক্তিত্বের জন্যই কথাগুলো অত্যন্ত ক্লিশে। স্রেফ এসব দিয়ে সুলতান মানস বুঝতে চাওয়াটা ঠিক হবে না।

সুলতান বোহেমিয়ান কেন হলেন? ছয়-সাত বছরে বৈমাত্রেয় বোনের মৃত্যুর সেই ঘটনাটা থেকেই বোঝা যায় তার মস্তিষ্কের ক্রিয়াপ্রণালী জাগতিক মানুষের চাইতে আলাদা। কৈশোরে শিক্ষকের মেয়ের সাথে প্রণয় হয়েছিল, শিক্ষক সেটা মেনে নেয়নি। কলকাতা আর্ট কলেজে ফার্স্ট হয়েও গ্রাজুয়েশন শেষ করার কোনো আগ্রহই বোধ করেননি, বেরিয়ে পড়েছেন। এগুলো সবই পূর্ব ত্রিশ এর ঘটনা, যে মানুষের জীবনকাল ৭১ বছর, তার জন্য ৩০ কি আসলেই অনেক বয়স?

তিনি নড়াইলেই জীবনের বড়ো অংশ কাটিয়েছেন। তাহলে বোহেমিয়ান ব্যাখ্যা দেয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু? বরং তাকে বলা যায় সূফীজম ঘরানার। ঈশ্বর সম্পর্কে আপনার কী ভাবনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি সহজেই বলেন, “কোনো ভাবনা নেই। আমি যখন ঐ পাতার রঙ দেখি, আকাশ দেখি তখন ভাবি, যদি কেউ থেকে থাকে সে খুব বড় মাপের একজন আর্টিস্ট।”

নিজের জবানীতে উল্লেখ করেছেন শুরুর দিকে তিনি মাইকেল এঞ্জেলো এবং দ্য ভিঞ্চির দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার জীবনযাপনের ধরনে দ্য ভিঞ্চির বিষয়টা আরো প্রকট লাগে। তিনি শাড়ি কেন পড়তেন? কলকাতার ঋতুপর্ণ ঘোষের বদৌলতে ইউনিফাইড পোশাক ধারণার সাথে আমরা পরিচিত। জীবনের শেষের দিকে ঋতুপর্ণ যে পোশাক পরতেন সেটা নারী বা পুরুষের সংমিশ্রণে বিশেষায়িত ছিল। সুলতান কি মনে-প্রাণে নারী ছিলেন? দ্য ভিঞ্চি সমকামী ছিলেন, এটা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সত্য। বাল্যপ্রেমের কাহিনী বাদ দিলে সুলতানের বাকি জীবনে নারীসঙ্গ কেমন ছিল সে সংক্রান্ত কোনো উপসংহারসূচক অভিমতে পৌঁছানো যায় না। তবে কি তিনি উভকামী প্রকৃতির ছিলেন? আজীবন অকৃতদার থাকার ক্ষেত্রে তার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন কোনো নিয়ামক হয়ে উঠেছিলো কিনা সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ কবি নজরুলকেও বোহেমিয়ানপনার অনন্য উদাহরণ ধরা যেতে পারে; বোহেমিয়ান হওয়ার সাথে নারী সংসর্গের সংঘাত নেই একেবারেই। তাছাড়া জীবনের বৃহত্তম অংশ যিনি এক মফস্বল শহরে কাটিয়েছেন তাকে বোহেমিয়ান বলাটাও অতিশয়োক্তি। তারেক মাসুদ নির্মিত ‘আদমসুরত’ দেখার সুযোগ হয়নি, সেখানে এ সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য না থাকারই কথা, কারণ আমাদের দেশের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ডকুমেন্টারিগুলোতে ব্যক্তিকে পূজনীয় হিসেবেই মহার্ঘ্য প্রদান করা হয়, তাকে প্রশ্ন করার অবকাশই রাখা হয় না।

প্যারালেল ইউনিভার্স জনপ্রিয় সাইন্স ফিকশন। কিন্তু সুলতান বা দ্য ভিঞ্চি ধরনের মানুষদের পর্যবেক্ষণ করলে প্যারালেল ইউনিভার্সকে অনিবার্য বাস্তব মনে হয়। তিনি জগতের কোনো নিগূঢ় মহাসত্যকে ধারণ করে সেটাকে গোপন রাখতে চেয়েছেন, ঔদাসীন্য বা আপাত অপ্রকৃতিস্থতা এক বিভ্রান্তি তৈরির কৌশল মাত্র। শিল্প-সাহিত্যের সাথে যুক্ত অনেকেরই গাঁজার নেশা থাকে, কারো কারো নেশা সুলতানের চাইতেও তীব্র। তবু গাঁজার কারণে তাদের জীবনযাপন অপ্রকৃতিস্থতায় ঠাঁসা তা কি মনে হয়েছে কখনো? সুলতানের অপ্রকৃতিস্থতাকে ‘গাঁজার প্রভাব’ বলাটা নিজেদের অজ্ঞানতারই বহিঃপ্রকাশ। এমনও হতে পারে, আপনি তাকে অপ্রকৃতিস্থ ভেবে তাকে একভাবে দেখেছেন, তিনি মনে মনে হেসে বলেছেন- কেমন বোকা মানুষ।

সুলতানের ছবিতে সিম্বলিজম, জ্যামিতি আর ম্যাথমেটিক্স থাকার সম্ভাবনাকে খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। কেবল পেশীবহূল কৃষক (যা তার ভাষায় সিম্বল অব এনার্জি)- এটাই তার চিত্রকলার সিগনেচার টোন নয় এটা অনেকটাই নিশ্চিত করে বলা যায়।সুলতানের ছবি যা পাওয়া যায় তার চাইতে অনেক বেশি হারিয়ে গেছে, নিতান্ত ক্যাজুয়ালভাবে যত্রতত্র ছবি একেছেন কোনো সংগ্রহের চিন্তা না করেই।সেই ছবিগুলোতে কী ছিলো? সুলতান কি লেখালিখি করতেন? এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া গেলে তার চিন্তামানস আর প্রগাঢ়ভাবে অনুধাবন করা যেত।

আলবেয়ার ক্যামুর আউটসাইডার উপন্যাসটি যারা পড়েছেন তারা জানেন একজন মানুষ মায়ের কফিনের পাশে বসেও কীরকম নির্বিকার ভঙ্গিতে চুরুট টানতে পারে, কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই খুন করতে পারে কিংবা মৃত্যুদণ্ড পেয়েও আহামরি বিচলিত হয় না। জীবন সম্বন্ধে এক গভীর নিরাসক্তি তাদের ভিন্ন কোনো ডাইমেনশন, ভিন্ন কোনো জগতের সাথে সংযুক্ত করে দেয় যেন। নইলে সুলতান শেষ জীবনে কেন বলবেন- ‘আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে’।

সুলতানকে যদি কাল্ট চর্চার ক্যারেক্টার হিসেবে দেখি সেক্ষেত্রে তার আপাত অর্থহীন এবং নিরুদ্যম জীবনযাপনের অনেক কিছুরই বিকল্প ইন্টারপ্রেটেশন পাওয়া যাবে হয়তো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাল্ট চর্চা করে তিনি আদৌ কিছু চেয়েছিলেন। গুপ্ত সংগঠন বিষয়ে যেসব মিথ শোনা যায় তার কোনোকিছুর সাথেই সুলতানকে মেলানো যাবে না, এলাকার মানুষের কাছে তিনি গোসাই প্রকৃতির ছিলেন, মানুষকে সম্মোহিত করতে পারতেন, অথচ পছন্দ করতেন বিচ্ছিন্নতা। ফলে সংঘবদ্ধ কার্যক্রম তার লাইফস্টাইলের সাথে বেমানান।

কিন্তু তার সামগ্রীক কার্যক্রম থেকে অনুসিদ্ধান্তে আসা যায়, জগত নিয়ে তার ব্যক্তিগত কোনো এজেন্ডা তৈরি হয়েছিলো ত্রিশ পেরুনোর পরে। সেই ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়নে তিনি কতটুকু সফল হলেন সেটাই বরং তাকে আরো রহস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।

সুলতান হতে শুধু সাহস যথেষ্ট নয়, জগতকে প্রচণ্ড ঔদ্ধত্যে অস্বীকার করে বিচ্ছিন্ন উল্কাখণ্ডের ন্যায় বসবাস করবার উন্নাসীকতাও অপরিহার্য শর্ত। শেষপর্যন্ত দলবদ্ধ হওয়াই নিয়তি বলে আমরা ব্র্যাকেটবন্দী ইনসাইডার হয়ে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার এক সিলিন্ডার আকৃতির শরীর নিয়ে সময়যানে চলাচল করি। সুলতান আউটসাইডার হয়ে কেবলই পর্যবেক্ষণ করেন, স্বপ্নাদিষ্ট কল্পিত পৃথিবীর সাথে কানেক্টেড হতে উদ্ভট রিচুয়াল পালন করেন। তাতে কার কতটুকু প্রাপ্তিযোগ হলো জানি না, তবে আমার চিন্তাজগতে আলোড়ন তৈরি হয়েছে, হয়েই চলেছে। সুলতান আপনার জগতে আসবো সহসাই। আপনি গাঁজা আর আমি চা নিয়ে এক নক্ষত্রপূর্ণ সময়ের স্বাদ আস্বাদন করতে করতে স্মৃতি নির্মাণ করবো।