খুবই অদ্ভুত ধরণের একটা বাংলা বই পড়ে শেষ করেছি কয়েকদিন আগে। বইটার কোনো নাম নেই, ইচ্ছে করেই রাখেন নি লেখক। কোনো নির্ধারিত দামও নেই! পাওয়া যাবে না কোনো দোকানে- লেখককে himalay777@gmail.com এ ইমেইল পাঠাতে হবে কেন বই পড়তে চান, সেই মর্মে- তাহলেই লেখক বই পাঠিয়ে দেবেন। দাম না দিতে চাইলে নেই, দিতে চাইলে লক্ষ টাকাও দিতে পারেন। বিচিত্র এই বইয়ের লেখক মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়, ব্যতিক্রমী মননের মানুষ। খুব মোটাদাগে বললে বইটাকে লেখকের আত্মজীবনী বলা যেতে পারে, কিন্তু তাতে বইটার বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা সম্পর্কে তিলমাত্রও ধারণা করা যাবে না। খুব নির্মোহভাবে এই বইটার পাঠ-প্রতিক্রিয়া লেখা আমার জন্য অসম্ভব, কারণ এখানে আমার নিজের সম্পর্কে অনেককিছু রয়েছে – ব্যক্তি ‘চমক হাসান’ এবং লেখকের কল্পিত ‘চমক হাসান’ এর জীবন নিয়ে অনেকগুলো পর্যবেক্ষণের কথা এসেছে। বহুবার ঘুরেফিরে এসেছে আমার কথা, আমার পরিবারের মানুষদের কথা। সেগুলো পড়তে গিয়ে কখনো আনন্দ পেয়েছি, কখনও সামান্য বিব্রতবোধ করেছি।
বইটা পড়বার আগেই লেখক সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা উচিৎ। ওর যেসব পরিচয় শুনে সাধারণ মানুষ চমৎকৃত হয় সেগুলোই আগে বলি। হিমালয় বুয়েটে আমার একব্যাচ ছোট- বস্তু ও ধাতুকৌশলে পাঠ শেষ করেছে সেখানে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ঘর পাইয়ের মান জানার রেকর্ডটা ওর (২৩৩৮ ঘর)। স্কুল থেকেই জীবন্ত কম্পিউটার বলে ওকে চেনে মানুষ- মুখে মুখে বিরাট বিরাট গুণ, ঘনমূল, পঞ্চমমূল বের করে ফেলতে পারে। বিশ্লেষণমূলক লেখালিখিতে মারাত্মক রকম দক্ষ। তার ক্রিকেট বিশ্লেষণ অসাধারণ, সাকিব আল হাসান নিয়ে তার একটি লেখা মুগ্ধ করেছে লক্ষাধিক মানুষকে। এখন পর্যন্ত সে চারটে বই লিখেছে, একটা অনুবাদ, দুটো মৌলিক গল্পের, একটা ক্রিকেট বিষয়ক। পুঁথি, রম্যগল্প, গীতিকবিতা লেখাতেও দারুণ নৈপুণ্য রয়েছে তার। নয় বছর ধরে ক্রিয়েটিভ কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের নামকরা বিজনেস গ্রুপ ‘অন্যরকম গ্রুপে’- উদ্ভাস, রকমারি ডট কম, পাই ল্যাবস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান যেই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তিজীবনে হিমালয় বিবাহিত, দুটো ফুটফুটে যমজ কন্যা উনিশ তেইশের বাবা। এ পর্যন্ত জেনে তাকে একজন প্রতিভাবান সফল মানুষ বলা যেতে পারে।
কিন্তু এটুকু জানলে কেউ ধারণাও করতে পারবে না- কী শীতল, রহস্যময়, জটিল, বিচিত্র একটা জগতে লেখকের বসবাস! ওর মাথার ভেতরে অনেকগুলো কল্পচরিত্র অনবরত কথা বলতে থাকে, তাকে সংসার ছেড়ে মহাপুরুষ হবার লোভ দেখায়, মহাকারণের দিকে ছুটতে তার জীবনকে প্রভাবিত করে। এদের ভেতরেও বিরোধ, বিপণ্নতা। কেউ তাকে প্রেমে পড়তে প্ররোচিত করে, কেউ চিরকৌমার্যের বার্তা শোনায়। এদের প্রভাবে সে নয় বছরের চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিত পথে পা বাড়ায়, যে অনিশ্চয়তার অংশ হয় তার স্ত্রী, ন’মাস বয়সী দুই যমজ কন্যাশিশু। এই অদ্ভুত বইটাতে হিমালয় তার শৈশব থেকে শুরু করে এই মুহূর্ত পর্যন্ত সবকিছুই অবলীলায় বলে গেছে।
এমনসব কল্পচরিত্র অনেক পাঠকের কাছে কল্পনা মনে হবে, কিন্তু আমি জানি, হিমালয়ের কাছে এটা বাস্তবতার চেয়েও বাস্তব। এই সমান্তরাল বাস্তবতার মধ্যে ডুবে থেকে লেখক তার নিজ বস্তুজীবনের অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। আমার মনে হয় প্রচণ্ড শক্তিশালী কোনো মানুষ সারাজীবন তার শক্তিকে কাজে লাগাতে না পারার আকুতি নিয়ে মারা যাওয়ার আগমুহূর্তে যে প্রচণ্ড হতাশায় আচ্ছন্ন হয়, হিমালয় প্রতিমুহূর্তে সেই অসহায়ত্বের কুয়োর ভেতর বসবাস করে। সে বোঝে এই অচলায়তন ভাঙার ক্ষমতা তার আছে, সে জানে কী করে এই অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি মিলবে। তবু তার মুক্তি মেলে না এবং তখন সে কুয়োটাকেই আকাশ ঘোষণা করে। যদিও বাইরের আকাশের বিশালত্ব সে জানে, সেই বিশালত্বকে সে অবলীলায় অস্বীকার করতে পারে। সে কূপমণ্ডুকতাকে সবল যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে, কুয়োটাকে গভীর থেকে গভীরে খনন করে, কুয়োর দেয়ালে আঁকে মহান শিল্পকর্ম। আমরা গণমানুষ সেটাকে কুয়োই দেখি, ফলে তার যুক্তিগুলোকে বুঝতে ব্যর্থ হই এবং সরল বিচারে আমাদের কছে মনে হয় এই বই লেখা অব্দি তার জীবন কষ্টের গন্ডিতেই বন্দী।
লেখক যেসব চরিত্রের ভিতর বাস করে, যাদেরকে ও বলে একেকটা অবসেসন- তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের খুব চেনা- আছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যার সাথে লেখকের তুই তোকারি আর গালিগালাজের সম্পর্ক (!), আছেন টেন্ডুলকার, রামানুজন, পিথাগোরাস। আবার আছে লেখকের চেনা জীবনের মানুষেরা – মাহমুদুল হাসান সোহাগ, চমক হাসান, ওমর বহ্নি, ফারহানা ব্রতী, আরমান হোসেন। হিমালয় তার পরিচিত সবাইকেই চেনে সংখ্যা দিয়ে, এদের প্রত্যেকে তার কাছে একেকটা সংখ্যাসত্তা! এই বইয়ে কিছু মানুষের নাম সে উহ্য রেখেছে সংখ্যার আড়ালে। সংখ্যাটাই তাদের মূল পরিচয়- সম্ভবত এই চিন্তা থেকে। তেমন কিছু চরিত্র হলো ৩১৭৯, ১১৫৭, 41 । কল্পজগতে ৩১৭৯ আর ১১৫৭ এর সাথে লেখকের কথোপকথন দিয়ে পুরো বইটা সাজানো।
এবার বইয়ের ভালো দিক মন্দ দিকগুলো নিয়ে বলি। প্রিয় পাঠক, আমি জানিয়ে রাখি এই পাঠ-প্রতিক্রিয়া অসম্পূর্ণ। এই বইটার বেশ খারাপ কিছু দিক আছে- ভয়ঙ্কর আত্মরতি, বিজ্ঞান-বিভ্রান্তি, একরোখা একতরফা যুক্তি উপস্থাপন, মানানহীন অশ্লীল শব্দচয়ন, বাংলা-ইংরেজির দৃষ্টিকটু মিশ্রণ, অসংলগ্ন অধ্যায় বিভাজন, নিজের ভান্তধারণা পাঠকের উপর আরোপের চেষ্টা – এগুলো নিয়েও আমি বিস্তারিত বলতে চাই, প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্বে সেটা আমি বলব। তবে বইটা নানান কারণে অনেক প্রশংসার দাবি রাখে। আর আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে অর্ধপূর্ণ পেয়ালার পূর্ণ অংশের দিকে তাকাতেই ভালোবাসি। এই প্রথম পর্বে আমি বইয়ের ভালো দিকগুলো নিয়েই বলব।
১) মৌলিকতা- কোনো ভনিতা ছাড়াই আমি স্বীকার করে নিচ্ছি গত বহু বছরে এটা আমার পড়া সবচেয়ে মৌলিক বাংলা বই। আমি মৌলিক বলতে বুঝি সেই বই, যেই বই অন্য অনেক বইয়ের ধারণা ঘেঁটেঘুঁটে লেখা নয়। সেই বই যার বিষয়বস্তু ঐ বই ছাড়া আর কোথাও জানা যাবে না। আমাদের চারপাশের অধিকাংশ বই কেন জানি মনে হয় ‘সংকলন’ জাতীয় বই। যেমন ধরা যাক আমাদের গণিতের পাঠ্যবই। ওখানে লেখক নিজে থেকে তেমন কিছুই লেখেন নি, সেগুলো বিদেশী বই থেকে ধার করে লেখা বা পুরনো বইয়ের অনুবাদমাত্র। আমার নিজের লেখা গণিতবইগুলোও একই কাতারে থাকবে। সেগুলোতে যদিও উপস্থাপন আমার নিজের মতো, কিন্তু কেউ ইন্টারনেটে কদিন ঘাঁটলে সবই জেনে নিতে পারবে। সেই তুলনায় হিমালয়ের এই বইয়ে যেসব ধারণা নিয়ে ও বলেছে, সেগুলোর অনেককিছু একান্তই ওর। এটা দারুণ। ও নিজ পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনেককিছুর সংজ্ঞা দিয়েছে। নিজের দর্শনের কথা বলেছে।
ব্যক্তিগতভাবে হিমালয়ের জীবনের সবচেয়ে বড়ো অর্জন যেটা আমার কাছে লাগে, সেটা হলো সাড়ে তিন হাজার মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া। সমাজের প্রথিতযশা মানুষ থেকে শুরু করে নাম না জানা রিকশাওয়ালা, চা-বিক্রেতা সবার ইটারভিউ নিয়েছে ও। এবং আমার ধারণা প্রতিটা ইন্টারভিউই সে নিয়েছে প্রায় সমান মনোযোগে, বহু যত্নে। এত মানুষের ইন্টারভিউ নেয়ার ফলে মানুষ সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণলব্ধ ধারণা সে অর্জন করেছে- চেষ্টা করেছে তার কিছু কিছু বইটিতে বলার। এই অংশটা যে আরও গভীরভাবে আসা উচিৎ ছিল, সেটা সে বইতেই স্বীকার করে নিয়েছে ১১৫৭ এর বয়ানে। সেটা নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে বলব।
২) নির্জলা সত্যকথন- হিমালয় তার ৩১ বছরের জীবনের বহু ঘটনা বর্ণনা করেছে এই বইতে। কিছুই রাখঢাক করে নি। নিজ পিতার সাথে বৈরিতার কথা বলেছে অনায়াসে, বিবাহিত জীবনেও অবসেসনে আটকে থাকার কথা স্বীকার করেছে অসঙ্কোচে। শৈশবের সংগ্রাম এবং সেখানে চেনা মানুষের ভূমিকা অকপটে লিখে গেছে ও। যতখানি যাচাই করা যায় এবং আট বছরে ওকে যতটা চিনি, সেগুলোর প্রেক্ষিতে নিরাপদে বলতে পারি, নিজ জ্ঞানে কোথাও অসততার আশ্রয় নেয় নি সে। যা পড়বেন সবই সত্যি ঘটনা। কিছু কিছু সত্য রীতিমতো অস্বস্তিকর। অন্যরকম গ্রুপের ভেতরের বহু কথা কখনও স্পষ্টভাবে কখনও সাংকেতিকভাবে প্রকাশ করেছে সে, যেটা ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য কষ্টের ছিল। উদ্ভাস, পাই ল্যাবস আর এর মানুষগুলোর সঙ্গে আত্মার টান এখনও অনুভব করি- সম্ভবত একারণেই কষ্ট পেয়েছি। আত্মজৈবনিক বইয়ে সত্যের পাশাপাশি অনেকেই ‘অধিসত্য’ বয়ান করেন, মানে কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে বলেন আর কী- সেটার কোনো নমুনা এখানে পাই নি। নিজেকে নিয়ে উচ্চাশা বা আত্ম-অহমিকার কথা যা আছে, সেটা সত্যকে অতিরঞ্জন করে নয়।
৩) আগের বইগুলোর তুলনায় লেখার গতি- অধিকাংশ জায়গাতেই বইয়ের লেখার ঢং সুখপাঠ্য, টানা পড়ে যাওয়া যায়। হিমালয়ের আগের বইগুলোর ভাষা বহু যত্নে চিন্তা করে বোনা- ফলে প্রতিটা লাইনে থেমে থেমে ভাবতে হতো। টানা পড়ে যাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। তার তুলনায় এই বইটার গদ্য খুবই প্রবাহমান। ৩১ বছরকে ৬১৯ পৃষ্ঠায় ধরতে গেলে যেটুকু গতি দরকার সেটা বইটাতে আছে। বিরাট বই কিন্তু আমি নেশার মতো পড়ে গেছি। আপনারও তাই হবে কিনা বলতে পারছি না। যেহেতু আমার নিজের কথা বারবার এসেছে- আমার কৌতূহল বেশি থাকা স্বাভাবিক।
৪) জীবনদর্শন: এই বইয়ে কিছু অসাধারণ জীবনদর্শন এবং সেগুলো নিয়ে দুর্দান্ত কিছু উদ্ধৃতি আছে। হিমালয় যদি কখনও অনেক বিখ্যাত হয়ে যায়, এগুলো কে বাণী চিরন্তনী নামে ব্যবহার করা যাবে।
নিজের বইয়ে গালির ব্যবহার নিয়ে সে লিখছে ‘১ মণ দুধে ১ ফোঁটা চুন দিলে দুধ নষ্ট হয়ে যায়- এর চাইতে কুৎসিত স্ল্যাং আর কী হতে পারে! একটা রিফাইন মেশিন বানিয়ে নিলেই তো হয়, যেটা দিয়ে চুনের দোষটুকু রিফাইন করে ১ মণ দুধকে কাজে লাগানো যায়’ মূল বক্তব্যের সঙ্গে সহমত- একটা ছোট্ট ভুলের জন্য একটা বিরাট কর্মযজ্ঞকে বাতিল করে দিতে হবে, এটা ঠিক চিন্তা না।
‘অবাক হওয়া, মুগ্ধ হওয়া কৌতূহলী শিশুর সবচাইতে বড়ো ব্লেজিং, বয়স ২১ পেরুনোর পরও মুগ্ধ বা অবাক হওয়া সীমাবদ্ধ মানুষের লক্ষণ’। মোটেই একমত না, তবে বাণী হিসেবে ভালো।
‘যে কোনো ব্যতিক্রমী দর্শনের মানুষের প্রধানতম শত্রু পরিবার, পরিজন আর তার প্রতিবেশ। এই নির্মম পিছুটানের চতুর্মুখী চাপে দর্শনের আকাশ স্থায়ী সূর্যগ্রহণে অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যায়’ – দামী কথা!
‘শরীর হলো বস্তুসঙ্গমের অবৈধ সন্তান, এর মধ্যে নিমগ্ন হওয়া মানে বস্তু সম্ভোগে সম্মোহিত হওয়া’। একমত নই। ভালো কথা তবে ও এটা বলেছে বাউল দর্শন নিয়ে, স্বভাবতই মানতে পারি নি।
‘রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে বা চেখভ নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ পাঠক ছিলেন না; তারা উন্নত ছিলেন বৌধিক সক্ষমতায়’।
এগুলো উদাহরণ মাত্র। এগুলো লেখকের নিজের মতামত, তাঁর সাথে আমি একমত না পোষণ করতে পারি, তবে এই ভাবনাগুলোর দাম আছে। এখনকার সাহিত্যে এই বোধগুলোর খুব অভাব বোধ করি।
৪) বাক্যচয়ন: ৩১৭৯ এর সঙ্গে তার প্রেমলীলার বর্ণনায় কিছু বাক্য ছবির মতো সুন্দর
‘আমি বাতাসকে চিমটি কাটলাম, বাতাস শিরশির করে উঠলো। ’
সে হাতের মুঠোয় রোদ ধরে আমার মাথায় মেলে ধরলো…
‘হতেম যদি তিল, তোমার চোখের মেঘের ছায়ায় পেতেম সুখের মিল’
তবে সেখানে একটা আয়রনি আছে- হিমালয় নিজেই বলেছে তাঁর বারবার একই জিনিস বলা পছন্দ না। কিন্তু প্রেমবর্ণনাগুলোতে মুহুর্মুহু পরাবাস্তব কাব্যিকতা আছে, সেটা সাহিত্য অনুরাগীদের জন্য একেবারে মন্দ না। আর পাঠক বিরক্তিবোধ করলে ঐটুকু না পড়ে এগিয়ে যেতে পারেন, বিষয়বস্তু জানতে কষ্ট হবে না।
৫) স্বকীয় চিন্তাধারা:
এই অংশটা মৌলিকতার ভেতরেই হয়তো বলা যেত। কিন্তু আলাদা করে বলছি ব্যবসা নিয়ে তার নিজের সুন্দর ভাবনাগুলোর কথা। প্রচলিত কর্মকাঠামো ভেঙ্গে নিজের মতো পদ তৈরি করা, নিজের মতো করে প্রশিক্ষণ ডিজাইন করা, কিংবা প্রতিষ্ঠানে নিজের মতো দেয়া নামগুলো ‘চাঁদের হাট ছুটি, পিঁপড়া টিম’ এগুলো সম্বন্ধে পড়তে দারুণ লেগেছে। আলাদা করে বলতে হবে ‘Process Diagram for a PRODUCT এর কথা। এটা আমি শুরুতে নির্বিচারে বাদ দিয়ে গেছি,কারণ না পড়লেও গল্পে অসুবিধা হয় না। পরে আলাদা করে পড়ে ভালো লেগেছে। আমাদের কোম্পানিতে এই জাতীয় অনেক ডকুমেন্ট এখন পড়তে হয়। সেগুলোর তুলনায় আমি এটাকে এগিয়েই রাখব।
৬) রসবোধ: মজার কিছু ঘটনা সে মজা নিয়েই বর্ণনা করেছে। কিছু জায়গায় নিজেই নিজের রসবোধের প্রশংসা করেছে, সেই জায়গাগুলোতে রসটা পাওয়া যায় নি লেখকের আত্মম্ভরিতার কারণে। ঐ অংশটুকু ছেঁকে ফেলে দিলে অনেক মজার উপাদান পাওয়া যাবে। হিমালয়ের নিজের বিয়ের আসরে উপস্থিত কাজীর ঘটনা শুনে কষ্টেও হেসেছি খানিকটা, ওর সাথে ঈশ্বরও কম রসিকতা করেন নি। ক্রাউন এনার্জি ড্রিঙ্ক খেয়ে মদ্যপানের চেষ্টার বয়ানটাও দারুণ ছিল- ‘বাসার সবার মধ্যে ক্রাউনের ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টিতে সমর্থ হই; পারিবারিকভাবে মদ্যপান, কেউ সন্দেহ করবে না। আমি অর্ধেক গ্লাস খাই, কিন্তু গন্ধেই নাড়িভুড়ি গুলিয়ে আসতে থাকে…’ কিংবা ‘জীবনে যত মানুষ দেখেছো, প্রত্যেককে ধরে ধরে এখানে নিয়ে আসবে নাকি? তাহলে একে কল্পজগত বলার দরকার কী; বাড়িতে গরু জবাই দিয়ে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়ালেই তো হয়’। অন্যরকম গ্রুপের কার্যকলাপ নিয়ে ‘ব্যর্থতা অভিযান’ নামে যে ননসেন্স হিউমার ছড়া লিখেছে বইয়ে সেটার খোঁচার তীব্রতা বুঝবে শুধু সংশ্লিষ্টরা, তবে সাধারণ পাঠকের জন্য এটা বেশ মজার। যেমন নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা নিয়ে হিমালয় নিচের (কিঞ্চিৎ অশ্লীল) লাইনদুটো লিখেছে, কিন্তু ঘটনা না জানলেও পড়ে হেসেছি।
‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, প্রহরী বেঘোরে ঘুমায়
জিপারে আটকে লিঙ্গ নিহত, পৌরুষ গেছে কোমায়’।
মধুসূদনের সঙ্গে তার কল্প-আলাপে কিছু জায়গায় স্ল্যাঙয়ের ব্যবহার সুন্দর, এই চরিত্রটা বইয়ের ‘কমিক রিলিফ’। বইয়ের শেষ লাইনেও অশ্লীল গালি এবং রসবিচারে সেটার প্রয়োগ নিখুঁত। ৬) বিদায়ী অধ্যায়: বইটার শুরুর অংশ খুবই আকর্ষণীয় যখন লেখক নিজের বেড়ে ওঠার গল্প বলে। এরপর অনেক অনেক বিষয় এসেছে বইয়ে। অনেকদূর যাবার পর মনে হয়- একটা বিরাট বইয়ের শেষে একটা সুন্দর অধ্যায় থাকলে ভালো লাগবে। এই বইটার শেষ অধ্যায় ভালো লেগেছে। অনেকটা মনে হয়েছে লেখক সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে কল্পনা জগতে। লেখক জানে অন্তত কারা কারা বইটা পড়বেন, তাদের কাউকেই বাদ দেন নি। মাঝে কিছু অংশ বিরক্তিকর যেটা অন্য অধ্যায়ে থাকলেও হতো। নিজের কোম্পানির লোক নেয়ার বিজ্ঞাপন, A তে Attraction, B তে body, C তে Courage – এমন বহু চিন্তা করে বানানো কিন্তু পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন আদর্শলিপি। সেগুলোর বিশদ বিবরণ পর্ব ২ এর জন্যই তোলা থাকুক। সেটুকু বাদ দিলে বিদায় নেয়ার ধরণটা খুব সুন্দর। শেষে লেখকের প্রিয় চরিত্রগুলোর একটি, 41 কে এনে একটা শূন্যতার আবহ তৈরি করে শেষ করেছে। লেখক হিমালয়কে বরাবরই পছন্দ করি, সেটুকু সে হতাশ করে নি।
প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ করব কিছু ব্যাপার বলে। বইটা যে পড়বে এটা হবে তার আয়নার মতো- পাঠক হিমালয়ের ফেসবুক পোস্টে গিয়ে এই বইয়ের সবগুলো রিভিউয়ের দিকে তাকাবেন, প্রত্যেকে নিজের জায়গা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। গল্পকার হাসান মাহবুব বলেছেন লেখার গুণ বা সাহিত্যমান নিয়ে, জনপ্রিয় লেখক এবং প্রেরণামূলক ভিডিওনির্মাতা ঝঙ্কার মাহবুব ভাই বলেছেন ‘নির্মম বাস্তবতার সামনে অসহায় সম্পর্ক, শৈশবের চ্যালেঞ্জগুলো, অল্প বয়সের মেচিউর কাজগুলো কিভাবে করেছে লেখক’, এই দিকগুলো নিয়ে। চিরকাল বৈষয়িক হতে না পারা নিয়ে সংশয়ে থাকা আমার প্রিয় বাবা ওকে লিখেছেন কবে লেখকের আরেকটু বৈষয়িক বুদ্ধি হবে- সেই কথা। আমি রিভিউগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেছি যারা রিভিউ লিখছে তাঁরা নিজের জীবনের ছোট্ট একটা অংশ দেখছে সেখানে। এটা আমার নজর এড়ায় নি। এবং আমি আবিষ্কার করেছি আমার রিভিউতেও আমি প্রায় একই কাজ করেছি। এই ব্যাপারটাকেও আমি আমার রিভিউতে বইয়ের ভালো দিক হিসাবেই লিখে যাচ্ছি। নিজেকে জানতে চাওয়া পাঠক বইটি পড়তে পারেন।
হিমালয় লেখক হিসাবে যথেষ্ট শক্তিমান- আমার পরিচিত যাদের ভেতর মহাকাব্য কিংবা হাই ফ্যান্টাসি লেখার মতো মেধা আছে বলে মনে হয়, হিমালয় তাদের মধ্যে অন্যতম। চাইলে যে মানুষটা মহাকাব্য লিখতে পারে, সে তাঁর নিজের দেয়াল ভাঙতে পারছে না, সেটা দেখা সুহৃদ হিসেবে কষ্টকর। বইয়ের শেষে সে বলেছে বইটাকে চাইলে অনেকভাবে দেখা যায়- প্রেমকথন, মানুষ মূল্যায়ন, আত্মপ্রচারণা, আত্মকথা ইত্যাদি। আরেকভাবে দেখা যায় মাইকেল মধুসূদনের প্রতি ট্রিবিউট হিসেবে। আমি খানিকটা সেভাবেই দেখি, তবে শুধু মধুসূদন নয়, আমি দেখছি তার স্মৃতি জগতের সবগুলোর সত্তার প্রতি ট্রিবিউট হিসাবে। তাঁর পরিচিত সমস্ত মানুষকে সে স্মরণ করেছে ততটুকু গুরুত্বে, নিজের জীবনে যাদেরকে যতটুকু গুরুত্ব দেয়। কাউকে বর্জন করেছে তীব্র আঘাতে, কাউকে জড়িয়েছে কল্পজগতের সমস্ত স্বাধীনতা নিয়ে। যার প্রতি মিশ্র অনুভূতি, তার ক্ষেত্রেও দুই প্রান্তই দেখেছে নির্বিবাদে। আমাকে নিয়ে করা সব ভবিষ্যদবাণী, আমার মেধা নিয়ে তার মন্তব্য -এসব আমার পছন্দ না হতে পারে, কিন্তু যে মমতা এবং গুরুত্ব নিয়ে সে আমার চরিত্র বুনেছে সেটাকে অস্বীকার করবার উপায় আমার নেই। ধন্যবাদ হিমালয়- তোমার বইটাকে আমি উপহার হিসেবেই গ্রহণ করছি। এর কাগজের দাম পরিশোধ করেছি তারযোগে, আর হয়তো কখনও বিষয়বস্তুর মূল্য পরিশোধ করব কোনো ফিরতি উপহারে।
পাঠক- এটুকু শুনে থেমে যাবেন না, দ্বিতীয় পর্বে এই বইয়ের চরম দুর্বলতাগুলো নিয়েও বলা হবে, রাখঢাক করব না! আমা কে নিয়ে বলা কথাগুলোর জবাবও হয়তো দেব। আবারও জানিয়ে দিয়ে যাই বই পেতে আগ্রহীরা হিমালয়কে ইমেইল করতে পারেন himalay777@gmail.com এ। আর কৌতূহল না থাকলে এ বইয়ের ধারেকাছে না গেলেও চলবে।