আমার বিজনেস ইন্টারপ্রেটেশন হলো যে কোনো নৈতিক এবং স্ট্র্যাটেজিক উপায়ে মানুষ ম্যানেজ করা এবং ইনপুট-আউটপুট অনুপাত প্রফিটেবল রাখা। নৈতিক শব্দটা বড়ো কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে ভিন্নার্থ বহন করে, এই শব্দটা উহ্য রাখলে যেখানে যুক্ত হবে ডিপ্লোম্যাটিক। প্রায় প্রতিবছর বহু মানুষ বিবিধ আইডিয়া নিয়ে বিজনেস শুরু করে, বেশিরভাগই ঝরে পড়ে, কিছু কিছু কষ্টেশিষ্টে টিকে থাকে, কিছু সিস্টেমবাজি শিখে নেয়; এই তো বিজনেসের ধারপাত।

সিস্টেমবাজির অংশটুকু ব্রাকেটের মধ্যে রেখে বিজনেস স্ট্যাবিলিটি বিষয়ে নিজস্ব উপলব্ধিগুলো শেয়ার করতে চাই।

বিজনেসের ফিজিবিলিটি নির্ভর করে গুরুতর তিনটি নিয়ামকের উপর। প্রথমত, কান্ট্রি কালচার। এটাই নির্ধারণ করে সেখানকার মানুষের লাইফস্টাইল, বিলিফ সিস্টেম এবং ইন্টারেকশন। দ্বিতীয়ত, কাস্টমাইজড স্ট্যাটিসটিক্স। অনেকে মার্কেট স্টাডি বা সার্ভেকে স্ট্যাটিসটিক্স বলে ভুল করেন। জনমত জরিপ অত্যন্ত ফাঁকিবাজিপূর্ণ একটি টুলস। রিসার্চগুলোতে অনেক সময়ই একটি প্রশ্নের সেট থাকে, মানুষের কাছ থেকে সেগুলোর উত্তর সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসা হয়। মানুষ উত্তর দেয় রেন্ডমলি; প্রথমত সে আরেকজনের প্রয়োজনকে খুব সিরিয়াসলি আমলে নেয় না, ২য়ত সে খুব কম ক্ষেত্রেই কেন এবং কারণ দ্বারা চালিত হয়।

আপনি যা জানতে চান সরাসরি সেই প্রশ্ন করে কখনোই কাঙ্ক্ষিত উত্তরটি পাবেন না। অন্তত ৫-৭টি প্রশ্ন করে সেগুলোর উত্তর বিশ্লেষণ করে একটি প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে হবে। এই প্যাটার্ন বা টেন্ডেন্সি থেকেই আপনি কোনো কিছু সম্বন্ধে ধারণা পেতে পারেন বা অনুমান করতে পারেন। এই প্যাটার্ন আবিষ্কার করার প্রক্রিয়াতেই নানারকম পরিসংখ্যান আপনার সামনে আসবে; আপনার জন্য কোনটা প্রয়োজন সেটা বোঝার ম্যাচিউরিটি অবশ্য পূরণীয় শর্ত।

একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ধরা যাক, আপনার কোম্পানীর প্রোডাক্ট ৩টি-ক,জ,ধ; আপনার বাৎসরিক রেভিনিউতে প্রোডাক্টগুলোর কন্ট্রিবিউশন- ক: ৬৭%, জ:১৯%, ধ:১৪%; উল্লেখ্য প্রোডাক্ট ক এর পেছনে মার্কেটিং ইনভেস্টমেন্ট জ আর ধ এর তুলনায় অনেক কম! এই স্কোরকার্ড দেখে আপনি অভিভূত হতেই পারেন; যে প্রোডাক্টের মার্কেটিংয়ে সবচাইতে কম খরচ করছেন সেখান থেকেই রেভিনিউ আসছে সর্বোচ্চ হারে। কিন্তু মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই আপনার বিজনেস বন্ধ হয়ে যাবে, এই অনুমান মাথায়ই আসবে না। একবার ভাবুন, যে প্রোডাক্টগুলোর পেছনে বেশি খরচ করছেন সেগুলো তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না, তার মানে আপনার সেলস এবং মার্কেটিং দুই ডিপার্টমেন্টই অযোগ্য। অন্যদিকে, একটিমাত্র প্রোডাক্ট থেকে তিন-চতুর্থাংশ রেভিনিউ আসছে, এই পারসেন্টেজ আর খুব বেশি বাড়ার সম্ভাবনা নেই, কোনো কারণে প্রোডাক্টটা পড়তির দিকে গেলে মুহূর্তের মধ্যে বিজনেস সংকটের মুখে পড়বে।

তাহলে, বিষয়টা কী দাঁড়ালো? একই ডাটা সম্পূর্ণ ভুল অর্থ বহন করতে পারে যদি আপনি বুঝতে অসমর্থ হন, আপনার জন্য প্রযোজ্য কোনটা।

তৃতীয়ত, ‘১১-৮৯ নিয়ম’। আমরা বহুবছর আগে থেকেই পড়ে আসছি পৃথিবী চলে ৮০-২০ রুলস এ। কিন্তু আমার ইন্টারপ্রেটেশন হলো, পৃথিবী চালায় ১১:৮৯ এর বিভাজনে। এই অনুপাত পরিবার, মহল্লা, সমাজ, জেলা, রাষ্ট্র, বিশ্ব সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পৃথিবীর ১১% মানুষ যেমন ৮৯% মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো নির্ভর করে সেখানকার নির্ধারিত ১১% মানুষের সামষ্টিক চরিত্রের উপর। আপনি যখন বিজনেস শুরু করবেন, সেই ১১% এর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য না বুঝলে আপনি দিনমজুর স্টাইলের ব্যবসায়ী হতে পারবেন বড়োজোর।

ই-কমার্স বিষয়ক লেখালিখিতে এই ৩ নিয়ামকের অবতারণা কেন ঘটাচ্ছি, প্রশ্ন জাগতেই পারে। বর্তমান বাংলাদেশে জনপ্রিয়তম ট্রেন্ড ই-কমার্স। গুগলসূত্রে জানলাম অনলাইনে বেচা-কেনা করে এমন ফেসবুক আছে ৮০০০, প্রতিবছর ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয় ১০ বিলিয়ন টাকা। এই সংখ্যা দেখে আরো বহু মানুষ হয়তোবা ই-কমার্সে নেমে পড়তে উদ্বুদ্ধ হবে, আগামী বছর নাগাদ সংখ্যায় বিরাট পরিবর্তন আসবে নিশ্চিত। কিন্তু এই চিত্র কি আশাব্যঞ্জক? কোনো অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছুতে চাই না, কিছু পর্যবেক্ষণ শেয়ার করি বরং।

কান্ট্রি কালচার শব্দটা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। আমাদের কালচারের অন্যতম উপকরণ ভাইরালিটি। এক কালে প্রফিটেবেল বিজনেস ছিলো জমির দালালী। ৫ হাজার টাকা ডিসিমালে জমি কিনে ৩ বছর ফেলে রেখে সেই জমি বিক্রি করেছে ২ লাখ টাকা ডিসিমালে; ঘটনা কমন পড়েছে তো? যে কারণে মানুষ খেয়ে না খেয়ে জমি কিনতো তখন। রিয়েল এস্টেট বিজনেসের প্রভাবে মানুষ দেখলো জমি কিনে সেখানে বাড়ি করায় অনেক ঝামেলা; তার চাইতে রেডিমেড ফ্ল্যাট কিনে বাকি টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা যায়, কিংবা এফডিআর করা যায়। এককালে বন্ধুরা কয়েকজন মিলে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট খুলতো, কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর ডিলারশিপ নিতো। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের নামে ট্রেডিং বিজনেসও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো, এখনো তা মিইয়ে যায়নি পুরোপুরি।

ছাত্র থাকাকালে কয়েক বন্ধু মিলে কোচিং সেন্টার খোলা বিজনেসেরও চল ছিলো এক দশক আগেও। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পর ফ্রিল্যান্সিংয়ের হার বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। আউটসোর্সিং ঘরানার ফ্রিল্যান্সিং কোম্পানীগুলোর নাম হয়ে গেলো সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানী। স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রসারের কারণে প্রোডাকশন হাউজ, ইভেনন্ট ম্যানেজমেন্ট ঘরানার বিজনেসও ডালপালা মেলতে শুরু করে।

কিন্তু এগুলোর কোনোটিই ঠিক কান্ট্রি কালচার বোঝানোর সিম্বলিক হতে পারে না। আমরা বরং চোখ রাখতে পারি সমবায় সমিতির দিকে। ২৩ জন একত্রিত হয়ে প্রতি মাসে ১৩০০ টাকা দিবে; তারপর কোনো একদিন সেই সমিতির টাকা গায়েব করে দিয়ে লোকজন হাওয়া। আমরা যুবক বা ডোলেন্সার ধরনের বিজনেসকেও বিবেচনায় রাখতে পারি। আরো তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিলে আমরা খুঁজে পাবো শেয়ার বাজার। গরু-বাছুর বিক্রি করেও লোকজন শেয়ার বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ডেস্টিনির ডান হাত-বাম হাত, ভ্যানওয়ালাদের স্যুট-টাই পরিহিত চেহারাগুলো এখনো অমলিন।

প্রতিটি প্রবণতার মূলেই আমরা পাই ভাইরালিটি। কিছু একটা শুরু হয়, তারপর ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ২০১২ তে এশিয়াকাপের ফাইনালে উঠার আগে বাংলাদেশের ক্রিকেট খুব মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করতো এই সংখ্যা নগণ্য হবে, ২০১৮ তে এসে ক্রিকেট হয়ে গেছে দেশপ্রেমের সমার্থক। ইন্ডিয়ান আইডলের দেখাদেখি চালু হলো ক্লোজআপ ওয়ান। এরপর রিয়েলিটি শো এর ছড়াছড়ি। আমরা যদিওবা বহুদিন পূর্বেই নিজেদের হুজুগে বাঙালি হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি, কিংবা কান নিয়ে গেছে চিলে শুনে চিলের পিছনে দৌড়ানোর দৃষ্টান্ত পাই সাহিত্য, তবু হুজুগের চাইতে ভাইরালিটিকেই মূখ্য প্রকরণ বলবো।

পেপার-পত্রিকায় প্রতিনিয়ত দেখি বেকার সমস্যা, লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন। অথচ সর্বাধিক বিক্রিত বিলাসী পণ্যের তালিকায় স্মার্ট ফোনের নাম চলে আসে; মফঃস্বলেও গড়ে উঠছে রেস্তোরা, বিয়ের অনুষ্ঠানকে বিভক্ত করা হচ্ছে কয়েক পর্বে, ঢাকার বাইরের বিত্তশালীরাও গাড়ি কিনছে, চাকরিতে ঘুষ দেয়ার সময় কিংবা বিদেশে যাওয়ার দালাল খরচ মেটাতে গিয়েও ১০-১৫ লাখ টাকা কীভাবে যেন ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে। তার মানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাদে অন্যদের হাতে টাকা আছে।

এই টাকার উৎস কী?

আমরা সেভেন-এইটের সামাজিক বিজ্ঞান বইতে পড়েছিলাম পূর্বপুরুষ বিত্তশালী থাকলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সম্পদ বণ্টিত হতে হতে কীভাবে ২য় বা ৩য় প্রজন্মে এসে নিঃশেষিত হয়। এখনো টাকার অন্যতম উৎস জমি আর স্বর্ণালংকার। বেকার তরুণদের জন্য চালু আছে বাবার হোটেল নামক নিঃশর্ত আশ্রয়স্থল। এই বাবাদের পেশা যা-ই হোক, পৈতৃকসূত্রে পাওয়া সম্পদ দিয়ে পুত্র-কন্যাদের ভরণপোষণ চালাতে সমর্থ হচ্ছেন। কিন্তু তাদের পুত্র-কন্যারা নিজেরা যখন অভিভাবক হবে তারা কি আদৌ ‘বাপের হোটেল’ চালু রাখতে পারবে? মাত্র ১৩ বছর পরেই এই প্রশ্নের ভয়াবহতায় পড়তে হবে আমাদের, সেই চিন্তা কি করেছি, কিংবা করলেও এটা প্রতিরোধে করণীয় কী? জানি না।

২০১০ থেকে যে দশকের সূচনা তার অন্যতম হাইপ ই-কমার্স। স্মার্টফোনের বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এবং মোবাইলে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় ই-কমার্সকে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ভবিষ্যৎ বলা যায়। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল শব্দের মধ্যেই ই-কমার্স ধারণা বেশ জোরেশোরে বর্তমান।

এখনকার ভার্সিটি পাশ তরুণ কিংবা শিক্ষিত গৃহবধূ অন্য কোনো বিজনেসে আগ্রহী না হয়ে অনলাইনে প্রোডাক্ট বিক্রির দিকে ঝুঁকছে। তাদের দেখাদেখি অনলাইন বিক্রেতার সংখ্যা কিলবিল করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনলাইনে আম কিংবা ইলিশ মাছ বিক্রির দৃষ্টান্তও রেখেছে তারা। একটা শ্রেণি আছে যাদের আত্মীয়-স্বজন দেশের বাইরে থাকে, সেসূত্রে প্রোডাক্ট আনে, তারপর বিক্রি করে। প্রফিট কেমন হয় সেই হিসাব তাদের মুখে মুখে। কিন্তু লাভের গুড় যে পিঁপড়া আর হাতি ভাগাভাগি করে খায় সেই হিসাব কোথায় তাদের!

বাংলাদেশের ই-কমার্স আদতে তাই এফ-কমার্স। অর্থাৎ, অফিসের কোনো প্রয়োজন নেই, বাসার মধ্যেই একটা রুমে প্রোডাক্ট জমা রাখুন, তারপর ফেসবুকে পেজ খুলে নির্বিচারে প্রচারণা চালিয়ে প্রোডাক্ট বিক্রি করুন। প্রসাধনী সামগ্রী, ফ্যাশন আইটেম, গ্যাজেট, শাড়ি- কী লাগবে! এফ কমার্সের বদৌলতে কুরিয়ার সার্ভিস সেক্টরটা সতেজ হয়েছে। পেমেন্ট অপশন হিসেবে রকেট/বিকাশ, কিংবা ক্যাশ অন ডেলিভারি। এসব প্রোডাক্টের শুরুর দিকের ক্রেতা ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি; তারপর সময়ের পরিক্রমায় ক্রেতার চেইন বিস্তৃত হয় কিংবা থমকে যায়। অনেকে চাকরির পাশাপাশি পার্ট টাইম অপশন হিসেবেও এফ-কমার্স বেছে নিয়েছে।

কেউ একেবারে ২৩ হাজার টাকার প্রোডাক্ট কিনে আনে, প্রতি প্রোডাক্টে ২০০-৩০০ টাকা প্রফিট ধরে হয়তোবা ২৯০০০ টাকা বিক্রি করে ধরে নেয় ৬০০০ টাকা প্রফিট। কিন্তু সাংক কস্ট, হিডেন কস্ট ফ্যাক্টর বিবেচনায় না নেয়ায় তারা বুঝতেই পারে না ৬০০০ টাকা প্রফিটের পরিবর্তে আদতে ১১০০০ টাকা লোকসান হয়েছে।

ভাইরালিটি বুঝতে হলে ২০০১ এ আসিফের ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ এবং ২০১৭-১৮তে ‘অপরাধী’ গান দুটিও বিবেচনায় রাখা উচিত। এই গান দুটি ভাইরাল হলো কেন? ভিক্টিমাইজেশনের গ্লোরিফিকেশন বহু গানেই হয়েছে, তবু এ দুটির মতো ভাইরাল হলো না কোনো গান। এর সঙ্গে যোগ করুন বিকাশে টাকা পাঠানো সংক্রান্ত অভিনব প্রতারণার সকল কেস স্টাডি। ডটগুলো পাশাপাশি বসালে যে প্যাটার্নটা পাবো তাতে দেখা যাবে, বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ আমাদের জনপদে অসম্ভব কল্পনা। আমরা চিরকাল জোড়াতালি আর গোঁজামিল দিয়ে চলা জনগোষ্ঠী, ফলে আমরা সিস্টেম তৈরি করি চোর বাড়ানোর উদ্দেশ্যে, চোর কমাতে নয়।

আরেকটা ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটির বেশি; ফেইক আইডি ৩১% বাদ দিলেও ইউনিক ইজার ৩ কোটির কাছাকাছি থাকবে। এদের বড়ো অংশেরই ইমেইল আইডি খোলা শুধুমাত্র ফেসবুক চালানোর উদ্দেশ্যে; এরা জীবনে কখনো ইমেইল লিখেনি। এর সপক্ষে একটা চমৎকার প্রমাণ হতে পারে আমার নামহীন বইয়ের বিপণন পদ্ধতি। বইটির কোনো ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল ছিলো না, কেনার আগে আমাকে ইমেইল করতে হতো। যারা ইমেইল করেছে প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে, কিংবা কোনো পেশাজীবী। অর্থাৎ তারা সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা স্যাম্পল বলা যেতে পারে। মেইল পেয়েছি ৪৫৭+, এদের মধ্যে কমপক্ষে ২৯% আছে যারা মেইল লিখেছে কোনো সাবজেক্ট নেই, বক্তব্য নেই, এমনকি জীবনে প্রথমবারের মতো ইমেইল লিখছে। কেউ কেউ আরো সরেস। তারা আমাকে ফেসবুকে ইনবক্স করেছে, কেননা কীভাবে ইমেইল করতে হয় জানা নেই তাদের!

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরিরত মানুষের সাথে কথা বলতে যান, দেখবেন তারা টেকনোলজি বলতে বুঝে শুধু ফেসবুক। ঢাকার বাইরের অবস্থা আরো শোচনীয়। অথচ, দেশের বিভিন্ন স্তরের পারচেজিং ডিসিসনে এরাই সক্রিয়তম মানুষ। ডিজিটাল শব্দটার প্রয়োগও তাই শেষ পর্যন্ত ফেসবুক পর্যন্তই। অনলাইন লারনিং, অনলাইন পেমেন্ট, অনলাইন রেজিস্ট্রেশন প্রভৃতি অপশনগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে তরুণদের মধ্যে যাদের বড়ো অংশই উপার্জনক্ষম নয়; তারা খরচ করছে যেগুলো তাদের উপার্জনের অর্থ নয়।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের পটেনশিয়ালিটিও আদতে ফেসবুকনির্ভর এফ-কমার্সের সমান। কিন্তু যখন আপনি একটা অফিসিয়াল সেট আপ নিবেন, এবং সেই অনুসারে অপারেশন চালাবেন দিনের পর দিন, আপনার জন্য অন্য কোনো বিজনেস না থাকে, আপনি কীভাবে টিকবেন সে এক সুবিস্তৃত আলোচনা। সেদিকেই এগুতে চাই বলে এফ কমার্স বাদ দিচ্ছি। এরা ই-কমার্স বিজনেসের বিচ্ছিন্ন স্যাম্পলের বেশি কিছু নয়। এরা না পারবে ব্রান্ডিং করতে, না পারবে পারচেজিং বিহেভিয়ার নিয়ে কাজ করতে, না কান্ট্রি কালচার পরিবর্তনে প্রভাব রাখতে। প্রত্যেক মার্কেটপ্লেসেই দিনমজুর ধরনের কিছু ফ্রিল্যান্সার থাকে; এদের না থাকে অতীত, না ভবিষ্যৎ; বর্তমানেই বিলীন হয় এরা। এফ-কমার্সের অবস্থানও ফ্রিল্যান্সারেরই সমতুল্য।

উপরন্তু এফ-কমার্স সমগ্র মার্কেট ইকোসিস্টেম নষ্ট করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। কোয়ালিটি সার্ভিস প্রদানের জন্য যে আর্থিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও সঙ্গতি থাকা উচিত তা না পেরে তারা গ্রাহকের মনে আরো অসন্তুষ্টি বাড়ায়। তবু টিকে থাকবে এরাই, মূল ধারার বিজনেস হিসেবে যারা ই-কমার্সে যুক্ত হবে তাদের পরিণতি দুটো: প্রথমত এদের প্রধান টার্গেট হবে সিলিকন ভ্যালির বিভিন্ন ইনভেস্টরকে আকৃষ্ট করে বড়ো অংকের ইনভেস্টমেন্ট তোলা, দ্বিতীয়ত তাদের অন্য বিজনেসের ব্ল্যাক মানিকে সাদাকরণ প্রকল্প হিসেবে ই-কমার্স চালিয়ে যাওয়া।

তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২য় অপশনটা তুলনামূলক অপ্রচলিত হবে সম্ভবত। প্রায় প্রত্যেক ই-কমার্সের একমাত্র টার্গেট অন্য কোনো বিদেশী কোম্পানীর সাথে মার্জ হয়ে যাওয়া, কিংবা কোম্পানী ভ্যালুয়েশন করে বিদেশী ইনভেস্টমেন্ট তোলা।

বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্সের সংখ্যা তো কম নয়। কোনো একটাও কি প্রফিটেবল, কিংবা আগামী ১৩ বছরেও প্রফিটে পৌঁছুতে পারবে? হয়তোবা প্রফিটে পৌঁছানোর প্রয়োজনও নেই। এমাজন, আলিবাবা, ফ্লিপকার্টের সাথে যদি কোনোভাবে যুক্ত হতে পারে তাহলেই তো বর্তে যায়। ভিশনই যদি ২ নম্বরী হয়, তাদের কার্যক্রমও সেরকমই হবে।

ই-কমার্সের সবচাইতে লোভনীয় শ্লোগান হলো সময় বাঁচান। ঢাকার জনজীবনে এটা ক্ষেত্রবিশেষে ইফেক্টিভ হলেও ঢাকার বাইরের মানুষের জন্য সময় বাঁচান শ্লোগান খুব আহামরি আকর্ষণীয় কিছু নয়। এখানকার মানুষের হাতে প্রচুর সময়; তারা ৭ দোকান ঘুরে তবে একটা জিনিস কিনবে। সেটা যদি নাও হয়, দরদাম করা আমাদের কান্ট্রি কালচারের খুবই শক্তিশালী অনুষঙ্গ। আমরা ফিক্সড প্রাইসের দোকানে গিয়েও দরদাম করি। সেখানে একটা প্রোডাক্ট কোনোরকম দরদাম ছাড়া না কিনলে প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই নিজেদের প্রতারিত মনে করবেন সিংহভাগ ক্রেতা।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি অনলাইন থেকে একটা জার্সি কিনবেন ১১০০ টাকা দিয়ে, সেই একই জার্সি হয়তো গুলিস্তান থেকে কিনে আনবেন ২৩০ টাকায়। তখন বলবেন অনলাইনে ডাকাতি করে। অথচ এটা মাথায় রাখবেন না, ফুটপাতের দোকানে ডুপ্লিকেট প্রোডাক্ট দিয়েছে, সেখানে হকারের একমাত্র খরচ চাঁদাবাজকে দেয়া চাঁদা। কিন্তু কোনো একটি ই-কমার্স থেকে কিনতে গেলে সে আপনাকে মূল ব্রান্ডের পোশাকটি দিবে, সেই প্রাইসের সাথে তার অফিসের খরচ, ইমপ্লোয়ি বেতন এগুলো যুক্ত করতে হয়; ফলে ফুটপাত থেকে কেনা জার্সিও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একই দামে দেয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু ক্রেতার বয়েই গেছে এসব নিয়ে ভাবতে। বাংলাদেশের মতো প্রাইস সেনসিটিভ মার্কেট সারাবিশ্বে ২য়টি নেই। এখানে বিক্রিযজ্ঞ চলে পুরোপুরি পুশসেলিং স্ট্র্যাটেজির উপর নির্ভরশীল থেকে। আপনি ডিসকাউন্ট দিবেন বিক্রি বাড়বে, ডিসকাউন্ট বন্ধ বিক্রিও কমে যাবে। এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ই-কমার্সগুলো। আপনি দেখবেন, ই-কমার্সগুলো বছরজুড়ে বিভিন্ন অফার দিতেই থাকে। তাদের লক্ষ্য যতো বেশিসংখ্যক ইউজার বা কাস্টমার সংগ্রহ, এরপর রিপারচেজ বাড়ানো। রিপারচেজ বা রিটেনশন বাড়ুক না বাড়ুক, কাস্টমার সংগ্রহে ভাঁটা পড়বে না। কারণ আমার সংগ্রহে ১৯ লাখ ইউনিক কাস্টমার আছে এটা ডাটা বিজনেসের জন্যও বড়ো অপশন। একই ডাটা আরো ৫-৭ কোম্পানীর কাছে বিক্রির সুযোগ থাকবে তখন। যদিও এটা নীতিগতভাবে অবৈধ, তবু প্রচুর ডাটা হয়ে গেলে সেই ডাটা ম্যানিপুলেটেড হবে না সেই নিশ্চয়তা কে দিয়েছে, বিশেষত এমন অফুরন্ত সুযোগ যখন রয়েছে!

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো আদতে মধ্যস্বত্বভোগী কিংবা বলা যায় অনলাইন ডিস্ট্রিবিউটর। ধরা যাক, ম্যানুফ্যাকচারার একটি প্রোডাক্ট তৈরি করে ১৩০০ টাকায়, সেটার মার্কেট প্রাইস ২৯০০ টাকা, হোলসেলার প্রাইস হিসেবে ই-কমার্স তার কাছে ২৩০০ টাকায় কিনলো; মাঝখানে যে ৬০০ টাকা এটা দিয়েই তার অফিস খরচ, মার্কেটিং, এমপ্লোয়ি স্যালারি কভার করতে হবে। যখন সে ডিসকাউন্ট অফার দেয় তখন হয়তোবা ম্যানুফ্যাকচারারও তাকে ডিসকাউন্ট দেয়। ফিজিকাল ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটররাও এই মডেলেই ব্যবসা করে। কিন্তু পার্থক্য হলো, অনলাইনে তো খুব বেশি মানুষ কেনে না, সশরীরে বহু মানুষ কেনে, সেখানে দরদামের সুযোগ থাকে বিধায় প্রফিটের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য রাখা সম্ভব হয়। ই-কমার্সের বিক্রি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দরদাম করার অপশন চালু রাখতে হবে নিশ্চিত।

কিন্তু একটা প্রোডাক্ট না দেখে তো দরদাম করা যায় না। এক্ষেত্রে হয়তোবা প্রতি প্রোডাক্টের সাথে ভিডিও অপশন চালু করতে হবে, কিংবা ইমো-ভাইবার চালু করে প্রোডাক্ট ডিসপ্লে করতে হবে।

শুনতে খুব সরল, কিন্তু এটার প্রায়োগিক জটিলতা চিন্তা করেছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রোডাক্ট স্টক করা থাকে না; একজন ক্রেতা একই সময়ে শার্ট এবং নারিকেল তেল অর্ডার করতে পারেন। সঙ্গে থাকতে পারে মুরগী আর জুতা। এক অর্ডারে এতগুলো আইটেম থাকলে সেটা উপরোক্ত প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে ম্যানেজ করতে গেলে কাস্টমার সার্ভিসে কতজন মানুষ নিয়োগ দিতে হবে, সাপ্লাই চেইনে কতজনের কাজ করতে হবে, এবং কতবড়ো মজুদঘর লাগবে কল্পনা করা যায়? সমগ্র প্রক্রিয়াটা অব্যাহত রাখতে যে পরিমাণ আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন তার যোগান নিশ্চিত হবে কীভাবে? বাংলাদেশে ই-কমার্স তাই অনেকটাই সাদা হাতি পোষার মতো।

ই-কমার্স যে সাদা হাতি এটা হয়তোবা উদ্যোক্তারাও বোঝে, কিংবা শুরু করার ৭ মাসের মধ্যেই বুঝতে পারে, কিন্তু সেটা স্বীকার করবে না। ই-কমার্স কোম্পানীগুলোর সেলস ডাটা নিয়ে যদি রিসার্চ করা যায় আমার ধারণা ৫৯% আসবে ঢাকার গ্রাহক, বাকি সবগুলো জেলা মিলিয়ে ৪১%! ইন্টারনেট তো পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামেও, টেন মিনিট স্কুলের সাবস্ক্রাইবার দেখলে অনুমান করা যায় ব্যাপারটা। তবু বাকি জেলাগুলোতে অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে অরুচি কেন? রুচি বদল হতে লাগবে আরো ১৯ বছর। ততদিন পর্যন্ত বিজনেস বেঁচে থাকবে কীভাবে?

শুধুমাত্র ঢাকাই যদি মার্কেটপ্লেস হয়, তাতে সমস্যা কী। কোনো সমস্যা নেই, আপনি একটা ফেসবুক পেজ দিয়ে বিজনেস চালান। কিন্তু আপনি একটা ২৯০০ স্কয়ারফিটের অফিস নেবেন, ৪৭+ কর্মী নিয়োগ দিবেন, এই বিপুল খরচ কভার করে ব্রেক ইভেন পার হতে যে পরিমাণ বিক্রি হওয়া প্রয়োজন কেবলমাত্র ঢাকার মার্কেট তার জন্য যথেষ্ট নয়। যদি যথেষ্ট হতো, ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলো ব্যতীত অন্য কোথাও কোনো কোম্পানীর ডিলারশিপ থাকতো না।

তবু ই-কমার্স চলতে থাকবে, যেহেতু এটাই গ্লোবাল ট্রেন্ড। ভবিষ্যতে কখনো বাংলাদেশের জায়ান্ট কোনো কোম্পানী যদি ই-কমার্স খাতে বিশাল অংকের ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে নামে, তারা হয়তোবা প্রথমেই খরচ করবে পারচেজিং বিহেভিয়ার বদলানোর পেছনে। মানুষের আচরণ যেহেতু প্রায় পুরোটাই ফ্যাব্রিকেটেড এবং নিয়ন্ত্রিত, হয়তোবা সেই মিশনে তারা সফলও হবে। আর এখনকার ই-কমার্সগুলো বিগ ব্রাদার গেম এর বলবয় হয়ে উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে নিভু নিভু হয়ে টিকে থাকবে। অন্যরা ক্রমাগত বিদেশী ইনভেস্টমেন্ট যোগাড়ের ধান্ধায় দিনমান পার করবে।

কিন্তু বিদেশীদের কি টাকার মূল্য নেই, তারা কি বোঝে না বাংলাদেশের কান্ট্রি কালচারে ই-কমার্স একটি পেয়ারার আমসত্ব? অবশ্যই বোঝে, আমরা সাদা চোখে যা দেখি বা ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করি তার চাইতেও ভালোমতো বোঝে। তবু ইনভেস্ট কেন করে? ঘুড়ি ওড়ানোর পদ্ধতি দেখে থাকলে এই প্রশ্ন করার কথা নয়।

কিন্তু আমাদের এখানকার ভিশনলেস মানুষের এতোকিছু নিয়ে ভাববার সময় নেই। তারা বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং প্রোগ্রাম করবে, বিজনেস কেইস কম্পিটিশনে বিচারক হবে, সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার নিবে, লবিং করে কাজ বাগাবে, টেবিলের নিচ দিয়ে গেমপ্ল্যান করবে, তাদের এক জীবন কেটে যাবে বর্ণনাতীত গ্ল্যামার আর আভিজাত্যে। এর পরে কী হবে তা ভেবে সময় নষ্টের আবশ্যকতা তাদের নেই। তাদের মননে একটাই লাইন লেখা- here lies the legacy which was never born at all!

আমাদের করণীয় কী? ওই যে, ২-৩জন পার্টনার যোগাড় করে বিজনেস প্রোফাইল বানানো, তারপর বিভিন্ন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া, দুপুরে ভুনা খিচুরি আর বিকালে কোল্ড কফি খাওয়া। এক জীবনে আর কী চাই!
ভাই কোথায় আছেন? এই তো অনলাইনে প্রোডাক্ট সেল করি!
সংসার চলে কীভাবে? কিছু সেভিংস আছে, আর বিজনেস থেকে আসে টুকটাক।
আপনার বিজনেসের গোল কী? পেপারে দেখেন ই-কমার্সের কেমন রমরমা অবস্থা, গুগলেও দেখবেন ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি কেমন বুম করছে, এবং আগামীতে করবে। জাস্ট আ ম্যাটার অব থ্রি এয়ারস!

কিন্তু ৮-৯ বছর তো হয়ে গেলো; কোনো একটা ই-কমার্সও তো দাঁড়ালো না! এখনো কি ৩ বছর হয়নি? আরে ভাই এতো প্রশ্ন করেন ক্যান, কাজ-কাম নাই; কথা শুইনা মনে হয় বিরাট তালেবর, আসলে তো বিজনেসের বালডাও বোঝেন না!